বাড়ি শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষিকার দৈনন্দিন জীবন: কিছু বাস্তবতা

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষিকার দৈনন্দিন জীবন
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষিকার দৈনন্দিন জীবন

সুয্যি মামা জাগার আগে উঠি আমি জেগে/ হয়নি সকাল, ঘুমোও এখন, কেউ বলে না রেগে (কিঞ্চিত সম্পাদিত)কবি হয়ত শরিফা (ছদ্মনাম, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক) ম্যাডামকে দেখেই উপরের লাইনগুলো লিখেছিলেন। শরিফা ম্যাডামের দিন শুরু হয় সূর্য উঠার আগেই প্রাতঃরাশ শেষে ঘর ঝাড়ু দেওয়ার মাধ্যমে। ঘর ঝাড়ু দেওয়া শেষে উঠোনটাও ঝাড়ু দিতে হয়। তবে উঠোনটা প্রতিদিন ঝাড়ু না দিলেও চলে। ঘর ঝাড়ু দেওয়া শেষ হলে রান্না ঘরে ঢুকতে হয়। সকালের নাস্তা, সাথে দুপুরের খাবার সব একবারেই করতে হয়।

রান্না করতে করতে পরিবারের বাকি সদস্যরা একে একে উঠে পড়ে। তাদেরকে নানাভাবে সহায়তা করতে হয়, যেমন ছেলেমেয়েদের ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে দেওয়া, তাদের ফ্রেশ হতে সাহায্য করা, স্বামীর অফিসের পোশাক কী হবে সেটি বেছে বের করে রাখা ইত্যাদি।

মাঝে মাঝে মনে হয় ঘড়ির কাটাকে থামিয়ে রাখতে পারলে মন্দ হতো না। কাজের ফাঁকে ফাঁকে শরিফা ম্যাডামকে ঘড়ির দিকেও নজর দিতে হয়। টিক টিক করে ওটাতে সময় শুধু বাড়তেই থাকে। বাড়ি থেকে বিদ্যালয়ে যেতে প্রায় আধা ঘন্টা লাগে, তাই সাড়ে আটটায় বের হতে হয়। এত সকালে বের হতে গিয়ে কখনও কখনও সকালের নাস্তা ভালো করে খাওয়া হয় না। তখন দুপুরের খাবারের সাথে নিয়ে আসতে হয়। শরিফা ম্যাডামের ছেলে বড় হয়ে গেছে, ছোট বেলায় ওকেও সাথে নিয়ে আসতে হতো। তখন আরও সমস্যা হতো। নিজের খাওয়ার সাথে সাথে বাবুর খাবারও সাথে নিয়ে আসতে হতো। এক-দুই সেট জামা কাপড়ও সাথে রাখতে হতো। এ যেন এক সংসার সাথে নিয়ে আসা।

প্রথম পিরিয়ডে প্রথম শ্রেণির বাংলা, দ্বিতীয় পিরিয়ডে দ্বিতীয় শ্রেণির গণিত, তৃতীয় পিরিয়ডে আবার প্রথম শ্রেণির ইংরেজি পড়াতে পড়াতে এনার্জিই শেষ হয়ে যায়। বারোটা বাজলে সমাবেশ।

আগের বিদ্যালয়ে শিফট ছিল দুইটি, তাই দু’বার সমাবেশ করতে হতো—সকাল ৯ টায় একবার, আর বারোটায় একবার। এক শিফট থাকায় এ বিদ্যালয়ে সেটি করতে হচ্ছে না।

বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকসহ চারজন শিক্ষক তাঁরা। তাই সবাইকেই কোনো না কোনো ক্লাসে থাকতে হয়, তবে ইদানিং পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস সমাবেশের পর শুরু করার কথা। এটি হলে একজন শিক্ষক সকালে এক পিরিয়ড করে বিরতি পাবেন। তবে পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস সকাল থেকে না রাখলে ওদের পাঠের শিখনফল অর্জন হবে না। যেহেতু ওদের ওপর বিদ্যালয়ের সুনাম নির্ভর করে, তাই এটি বাদ গেলে কিছুটা সমস্যা হতে পারে।

চারজন বিদ্যালয়ে থাকলে যদি পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী না থাকে তাহলে কিছুটা অবসর হয়ত পাওয়া যাবে; তখন বিদ্যালয়ের কিছু কাজ থাকে সেগুলো করতে হয়। আবার কোনো শিক্ষক ছুটিতে গেলে তার ক্লাসগুলোও করাতে হয়।

সমাবেশের পর তৃতীয় শ্রেণি থেকে শুরু করে পঞ্চম শ্রেণির কোনো না কোনো ক্লাসে থাকতে হয়। প্রধান শিক্ষককে যেহেতু আরও অনেক দায়িত্ব পালন করতে হয়, তাই তার জন্য দ্বিতীয় অংশে এক-দুইটা ক্লাস দেওয়া হয়েছে। অনেক সময় সেটিও নিতে তাঁর হিমশিম খেতে হয়। তখন বদলি শিক্ষক হিসেবে সেগুলোও নিতে হয় শরিফা ম্যাডাম বা অন্য কাউকে।

টিফিনে মাত্র ৩০ মিনিট সময় পাওয়া যায়। এর মাঝেই খাওয়া আর নামাজ পড়তে হয়। কোনোমতে নাকেমুখে খাবার দিয়ে টিফিনের অর্ধেক ব্যয় করে বাকি অর্ধেক সময়ে নামাজ পড়তে হয়। কষ্ট হয়, কিন্তু কিছুই করার নেই।

ক্লাস শেষ হয় বিকেল ৪.১৫ মিনিটে। টিফিনের আগে ৫০ মিনিট টিফিনের পর ৪৫ মিনিট করে ক্লাস নিতে হয়। ক্লাস শেষে সহকর্মীদের সাথে কিছু কথোপকথন, গোছগাছ করা, সব ঠিকঠাক মতো রেখে বাড়ির দিকে রওয়া দিতে দিতে সাড়ে চারটার বেশি বেজে যায়।

এরপর বাড়ি আসতে আসতে বিকেল প্রায় সাড়ে পাঁচটা। বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হয়ে আবার সংসারের কাজে অংশ নিতে হয়। বিদ্যালয়ে থাকার সময় সন্তানের ঠিকমতো যত্ন নেওয়া যায় না, সেটি এ সময়ে কিছুটা পুষিয়ে নিতে হয়। এ প্রসঙ্গে এক প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়া শিক্ষক জাহানারা আপার কথা মনে পড়ে শরিফা ম্যাডামের। জাহানারা আপা বলেছিলেন যে, বিদ্যালয় থেকে এসে তিনি বিছানায় ব্যাগ রাখার সময়টুকুও পান না। কোনোমতে ব্যাগটি বিছানায় ছুড়ে ফেলেই সরাসরি যেতে হয় রান্না ঘরে। তাঁর হাতের চা ছাড়া শাশুড়ির চা খাওয়াই হয় না। বাড়ির সবাই অপেক্ষা করে কখন ছেলের বউ আসবে, কখন চা বানাবে।

সবার জন্য বিকেলের নাস্তা, রাতের খাবারের জোগাড় করতে হয়। সবাইকে খাইয়ে নিজেও খেয়ে সব গুছিয়ে আসতে আসতে রাত প্রায় এগারোটা বেজে যায়। এ সময়ে আর ইচ্ছে করে না পাঠ পরিকল্পনা কিংবা উপকরণ তৈরি করতে। শরিফা ম্যাডাম ভাবেন শিক্ষক হলেও আমরা মানুষ, যন্ত্র না। তাই সারাদিন এভাবে খেটে ইচ্ছে করে না পাঠ পরিকল্পনা কিংবা উপকরণ তৈরির। তখন ঘুমিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিই বা করার থাকে! এভাবে আবার শুরু হয় আরেকটি দিনের।

প্রতিদিন প্রায় একই রুটিন পালন করতে হয় শরিফা ম্যাডামকে। ছুটির দিনগুলো একটু ব্যতিক্রম। সারা সপ্তাহের বাকি কাজ ঘর গোছানো, কাপড় পরিষ্কার, সামাজিক কোনো অনুষ্ঠানে অংশ নিতেনিতে কখন যে ছুটির দিনটা শেষ হয়ে যায় তার ঠিক নেই। ইদানিং আবার জাতীয় দিবসগুলোর ছুটিতেও কাটাতে হয় বিদ্যালয়ে। বিদ্যালয়ে সব ছেলেমেয়েকে নিজের ছেলেমেয়ে ভাবতে ভাবতে কখন যে নিজের ছেলেমেয়েরা নিজের কাছ থেকে হারিয়ে যায় তা বোঝাও যায় না। এই তো, এই নববর্ষে বিদ্যালয়ে অনুষ্ঠান করতে করতে নিজের পরিবারকে সময় দেওয়া হলো না শরিফা ম্যাডামের।

কখনও কখনও শুক্রবারে থাকে সাব-ক্লাস্টার ট্রেনিং। সেটি না করেও উপায় নেই। তাছাড়া মাস্টার ট্রেইনারদের থাকে সাবজেক্ট-বেইজড ট্রেনিং। সেটিও অনেক সময় কোনো না কোনো বন্ধের দিনে হয়। তাই তখন বন্ধটাও ঠিক মতো পাওয়া যায় না।

বাংলাদেশের প্রায় অধিকাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষককে এ রুটিনে জীবনযাপন করতে হয়। একজন বিবাহিত নারী শিক্ষকের সংসার ও বিদ্যালয় দুইদিকই সামলাতে হয়। তাই বিদ্যালয়ের সময় ছাড়া বাকি সময় তাঁকে সংসারের কাজ দেখাশোনা করতে হয়। আমরা যারা প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে কাজ করি, তারা অনেক সময়ই শিক্ষকদের পাঠ পরিকল্পনা করতে বলি, পাঠের প্রস্তুতি নিতে বলি। কিন্তু একজন শিক্ষককে যদি প্রতিদিন প্রায় ৬টি ক্লাস নিতে হয় আর বিদ্যালয়ে তিনি যদি কোনো অবসর সময় না পান, তাহলে কীভাবে তিনি সেগুলো তৈরি করবেন? তাঁকে প্রতিদিন ৬টি পৃথক পাঠ পরিকল্পনা করতে হবলে এবং প্রতিটির জন্য যদি ১০ মিনিট করে সময় লাগে, তাহলে তাঁকে এর জন্য প্রায় এক ঘণ্টা সময় দিতে হবে। সেই সময়টা তিনি কখন দিবে? সংসারের সময় থেকে ধার নিয়ে?

এবার আসি পাঠপ্রস্তুতির বিষয়ে। একটি আদর্শ পাঠ দিতে চাইলে তার জন্য প্রস্তুতির প্রয়োজন। একজন শিক্ষকের যেমন স্কুলে কোনো অবসর নেই, বাড়িতেও তাঁর সে সময়টা বের করা অনেক কঠিন যে সময়ে তিনি তাঁর পরবর্তী দিনের পাঠের প্রস্তুতি নেবেন। তাই হয়ত অধিকাংশ শিক্ষককে কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই ক্লাস নিতে হয়।

তাই প্রশিক্ষণে আমরা যতোই পাঠ পরিকল্পনা, পাঠ প্রস্তুতির কথা বলে থাকি না কেন, বাস্তবে তা প্রয়োগ করা তাদের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। অনেক শিক্ষক ব্যক্তিগতভাবে জানিয়েছেন, তাদের ইচ্ছে থাকলেও সময়ের অভাবে প্রতিদিন পাঠ পরিকল্পনা তৈরি করা, পাঠের প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব হয় না।

অন্য আরেকজন শিক্ষক এ বিষয়ে জানান যে, “একজন শিক্ষকের মস্তিষ্কই তো পাঠ পরিকল্পনা। একজন শিক্ষকই জানেন তার শ্রেণিতে কীভাবে পাঠ দিলে, কোন পদ্ধতি অবলম্বন করলে শিক্ষার্থীরা শিখতে পারবে”।

শিক্ষকরা মনে করেন যে, বিদ্যালয়গুলোতে যদি পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয় এবং শুধু নিয়োগ না, বিদ্যালয়ে তাঁদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয় (অনেক শিক্ষককেই বিভিন্ন সময়ে প্রশিক্ষণ, বিভিন্ন ছুটির কারণে বিদ্যালয়ের বাইরে থাকতে হয়। সে সময়টাতে যদি বদলি শিক্ষকের ব্যবস্থা করা হয়), তাহলে এ সমস্যার সমাধান হতে পারে।

কোন মন্তব্য নেই

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Exit mobile version