বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, ঘুরেফিরে এই সংকটের দায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ওপরই বর্তায়। বলা হয়ে থাকে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা শিক্ষা ও গবেষণামূলক কাজ থেকে রাজনীতি নিয়েই বেশি ব্যস্ত। আবার এও বলা হয়ে থাকে বর্তমানে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীবান্ধব নয়। শিক্ষার্থীদের কল্যাণের চেয়ে নিজেদের পদপদবীর বিষয়টিই বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। অতি সাম্প্রতিককালে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চিত্র লক্ষ্য করলে হয়তো সে কথাই প্রমাণিত হবে।
কিন্তু আমাদের অতীত ইতিহাস সম্পূর্ণ বিপরীত; যে ইতিহাস একজন শিক্ষকের আত্মত্যাগের ইতিহাস। এই ইতিহাস শিক্ষার্থীদের জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে দেয়ার ইতিহাস। বলছিলাম একজন ড. শামসুজ্জোহার কথা। যিনি রীতিমতো ঘোষণা দিয়েই নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছিলেন নিজের শিক্ষার্থীদের জন্য! যাঁর দৃঢ়চেতা মনোভাব, মহান ত্যাগের ফলে দেশের স্বাধীনতার পথ বেগবান হয়েছিলো। সৃষ্টি করেছিলেন আত্মত্যাগের অনন্য দৃষ্টান্ত।
ড. শামসুজ্জোহা : জন্ম ও শিক্ষাজীবন
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই প্রক্টরের জন্ম ১৯৩৪ সালে। ওপার বাংলার বাঁকুড়া জেলায়। বেড়ে ওঠা ও প্রাথমিক শিক্ষা সেখানেই। তিনি বাঁকুরা জেলা স্কুল থেকে ১৯৪৮ সালে ম্যাট্রিক এবং ১৯৫০ সালে বাঁকুরা ক্রিশ্চিয়ান কলেজ থেকে আইএসসি পাস করেন।
দেশভাগের বছর তিনেক পর দাঙ্গার কারণে পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন সপরিবারে। এখান থেকেই শুরু হয় জোহার উচ্চশিক্ষাজীবন। ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন শাস্ত্রে। এখান থেকেই ১৯৫৩ সালে স্নাতক এবং ১৯৫৪ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। বিদেশে উচ্চশিক্ষা নেয়ারও সুযোগ পেয়েছিলেন শামসুজ্জোহা। ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত তিনি লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজে অধ্যয়ন করেন। সেখান থেকে পুনরায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেয়ার পর একই কলেজ থেকে তিনি পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন তিনি।
এই ইতিহাস শিক্ষার্থীদের জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে দেয়ার ইতিহাস। বলছিলাম একজন ড. শামসুজ্জোহার কথা। যিনি রীতিমতো ঘোষণা দিয়েই নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছিলেন নিজের শিক্ষার্থীদের জন্য!
কর্মজীবন
বর্ণাঢ্য কর্মজীবন ছিলো শামসুজ্জোহার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের বছরখানেকের মধ্যে ১৯৫৫ সালের শেষের দিকে শামসুজ্জোহা পাকিস্তান অর্ডিন্যান্স কারখানায় সহযোগী কারখানা পরিচালক যোগ দেন। একই বছরের ডিসেম্বরে তিনি যুক্তরাজ্যের সাউথ ওয়েলসে রয়্যাল অর্ডিনেন্স কারখানায় বিষ্ফোরক দ্রব্যের ওপর প্রশিক্ষণলাভের জন্য যোগদান করেন। সেখান থেকে ফিরে ১৯৫৯ সালে পশ্চিম পাকিস্তানে ওয়াহ ক্যান্টনমেন্টে সহকারি পরিচালক পদে যোগদান করেন।
১৯৬১ সালে জোহা দেশে ফিরে আসেন। দেশে ফিরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ডেভেলপমেন্ট অফিসার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন এবং একই বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের লেকচারার পদে যোগদান করেন। এসময়ই তিনি আবার লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজে পাড়ি জমান পিএইচডি ও ডিআইসি ডিগ্রি অর্জনের জন্য। এসময় তিনি কিছুদিন বেরেট স্ট্রিট ওয়েস্ট লন্ডন কমার্স কলেজে শিক্ষকতা করেন।
১৯৬৪ সালে সেখান থেকে ফিরে পুনরায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা শুরু করেন। ১৯৬৬ সালে তাঁকে রিডার পদে উন্নীত করা হয়। ১৯৬৫ সালে তিনি শাহ মখদুম হলের আবাসিক শিক্ষক এবং ১৯৬৬ সালে প্রাধ্যক্ষ পদে নিযুক্ত হন। ১৯৬৮ সালের ১ মে থেকে মৃত্যুকাল পর্যন্ত তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের দায়িত্ব পালন করেন।
ড. শামসুজ্জোহা: একজন দৃঢ়চেতার আত্মত্যাগ
ছাত্রজীবন থেকেই জোহা ছিলেন দৃঢ়চেতা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে ছিলেন ভাষা আন্দোলনের সক্রিয় আন্দোলনকারী। তাঁর এই দৃঢ়চেতা মনোভাব ছিলো পরবর্তী জীবনেও। দৃঢ়চেতা ছিলেন বলেই শিক্ষার্থীদের জীবন বাঁচাতে নিজের বুক পেতে দিতে একবারও কুন্ঠাবোধ করেননি ড. শামসুজ্জোহা।
ড. জোহার আত্মত্যাগ সম্পর্কে জানতে হলে ফিরে যেতে হবে ১৯৬৮ সালের শেষের দিকে। ঠিক এই সময়টাতে তৎকালীন আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে প্রবল আকার ধারণ করতে থাকে। আন্দোলনের এক পর্যায়ে জানুয়ারির ২০ তারিখ পাকিস্তানী সামরিক জান্তার হাতে নিহত হন ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামান। ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে পাহারার দায়িত্বে নিয়োজিত পাকিস্তানী সৈনিকের হাতে থাকা রাইফেলের গুলিতে নিহত হন তথাকথিত ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার’ অভিযুক্ত সার্জেন্ট জহুরুল হক।
এই দুই হত্যাকাণ্ডের ফলে গণআন্দোলন আরো ভয়ংকর রূপ নিতে শুরু করে। ক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে যায় সারাদেশে। এরই ধারাবাহিকতায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ১৭ ফেব্রুয়ারি শিক্ষার্থীদের এই কর্মসূচিতে হামলায় পুলিশবাহিনী। স্বৈরশাসক আইয়ুবের পুলিশ বাহিনীর নৃশংস হামলায় বহু শিক্ষার্থী আহত হয়।
এমন বর্বোরচিত হামলা ড. শামসুজ্জোহার অন্তরে কতোটা রক্তক্ষরণ ঘটিয়েছিলো তা বুঝা যায় ওইদিন সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের এক অনুষ্ঠানে দেয়া বক্তব্যের মাধ্যমে। শিক্ষার্থীদের রক্তে রঞ্জিত নিজের শার্ট দেখিয়ে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে তিনি বলেছিলেন, “আহত ছাত্রদের পবিত্র রক্তের স্পর্শে আমি উজ্জীবিত। এরপর আর যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে গুলি হয়, সেই গুলি কোনো ছাত্রের গায়ে লাগার আগে আমার বুকে বিঁধবে।”
১৮ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় প্রশাসন ওইদিন পরিকল্পিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়-সংলগ্ন নাটোর-রাজশাহী মহাসড়কে ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা যখন এক হয় তাদের রুখে দেয়ার সাধ্য কার! বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা সহপাঠীদের ওপর হামলার প্রতিবাদ ও স্বৈরাচার আইয়ুব খানের পতনের দাবিতে সামরিক বাঁধা উপেক্ষা করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।
পরিস্থিতি জটিল বুঝে ড. শামসুজ্জোহা অকুস্থলে ছুটে যান এবং উত্তেজিত শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা করেন। তিনি সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন এবং তাঁর শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি না চালানোর অনুরোধ করেন। শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে ফিরে যাবে— ড. জোহা এমন আশ্বাস দিচ্ছিলেন সামরিক কর্মকর্তাদের। কিন্তু ড. শামসুজ্জোহার আশ্বাসকে কোনো কর্ণপাতই করলো না আইয়ুবের সামরিক বাহিনী। বিনা উসকানিতে এগারোটার দিকে হুট করেই কাছ থেকে প্রথমে গুলি ও পরে বেয়নেট দিয়ে খুচিয়ে রক্তাক্ত করলো ড. শামসুজ্জোহার দেহটাকে। তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
এই খবর ঢাকায় পৌঁছামাত্র ঢাকার রাজপথ আন্দোলনকারীরা প্রকম্পিত করে তোলে। আন্দোলন পায় নতুন মাত্রা । যার ফলে পাকিস্তান সরকার বাধ্য হয়েছিল নিঃশর্তভাবে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে।
ড. জোহার যত স্মৃতি
শহীদ ড. জোহার আত্মত্যাগকে স্মরণীয় করে রাখতে জাতীয়ভাবে তেমন কোনো উদ্যেগ লক্ষ্য করা না গেলেও তাঁর স্মৃতি সংরক্ষণে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে কিছু বিক্ষিপ্ত কাজ লক্ষ্য করা যায়। ড. জোহার গুলিবিদ্ধ হওয়ার স্থানটিকে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে রেখে সেখানে একটি স্মৃতিফলক করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ভবনের সামনে তাঁকে সমাহিত করা হয়। মৃত্যুর পরপরই তৎকালীন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তার নামানুসারে নবনির্মিত আবাসিক হলের নামকরণ করা হয় শহীদ শামসুজ্জোহা হল। এই হলেরই মূল ফটকের পাশে একটি স্মৃতি স্মারক ‘স্ফুলিঙ্গ’ নির্মাণ করা হয়।
তাঁর মৃত্যুর অর্ধশত বছর পেরিয়ে গেলেও তার মহান আত্মত্যাগ পায়নি জাতীয় স্বীকৃতি। তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা তাঁর মৃত্যুর দিবস হিসেবে পালনের দাবি জানিয়ে আসলেও সেটির বাস্তবায়ন হয়নি আজও। জোহাকে বলা হয়ে থাকে দেশের প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী— এরও নেই কোনো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি।
ড. জোহা ও কিছু আক্ষেপ
শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষকের এমন আত্মত্যাগ বাংলাদেশ তো বটেই পৃথিবীর ইতিহাসেই বিরল। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় হলেও এটিই সত্যি যে শহীদ ড. জোহার এই মহান আত্মত্যাগকে এখন পর্যন্ত উপযুক্ত মূল্যায়ন করা হয়নি। ড. শামসুজ্জোহার মতো মানুষদের আত্মত্যাগের ফলেই এদেশের স্বাধীনতার পথ বেগবান হয়েছিল।
কিন্তু তাঁর মৃত্যুর অর্ধশত বছর পেরিয়ে গেলেও তার মহান আত্মত্যাগ পায়নি জাতীয় স্বীকৃতি। তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা তাঁর মৃত্যুর দিবস হিসেবে পালনের দাবি জানিয়ে আসলেও সেটির বাস্তবায়ন হয়নি আজও। জোহাকে বলা হয়ে থাকে দেশের প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী— এরও নেই কোনো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি।
এসকল আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির বাইরে সবচেয়ে বড় আক্ষেপের জায়গাটি হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অধিকাংশই তাঁর মতো আদর্শ ধারণ করেন না।
লেখক পরিচিতি
ফুয়াদ পাবলো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী।