বাড়িশিক্ষক ও শিক্ষাশিক্ষক, শিক্ষকতা এবং আলো

সানজিদা আয়েশা শিফা লিখেছেন শিক্ষক ও শিক্ষকতা নিয়ে

শিক্ষকতা আমার রক্তপ্রবাহে। এজন্য কি না আমি জানি না, সচেতনভাবে ও সজ্ঞানে আমি সম্ভবত সবচেয়ে বেশি শিক্ষকই হতে চেয়েছি। শিক্ষকতা পেশায় যাওয়া বা শিক্ষক আমার হওয়া হয়নি। একে আপনি আমার অযোগ্যতা, দুর্ভাগ্য, সৌভাগ্য, ব্যর্থতা যা ইচ্ছে বলতে পারেন। আমার আপত্তি নেই।

তবে আজ হৃদয় খুড়ে সে-বেদনা জাগাবো না। আজ বরং জীবনে যে কিছুটা সময়ের জন্য আমি শিক্ষক হতে পেরেছিলাম সেই কিছুদিনের কথা বলি।

আমরা যারা শিক্ষা বিষয়ে পড়াশোনা করি, তাদের একটি ইন্টার্নশিপ বা শিক্ষকতা করতে হয় ছয় মাসের। আমার ইন্টার্নশিপ ছিলো অগ্রণী বালিকা বিদ্যালয়ে।

কোনো এক অজানা কারণে প্রিন্সিপ্যাল স্যার আমায় খুব পছন্দ করতেন। আমার শিডিউল ক্লাসের বাইরে যে শিক্ষকই অনুপস্থিত থাকতেন, স্যার বলতেন সানজিদা তুমি যাও, ক্লাশ নাও। আর আমি খুশিমনে ক্লাসে চলে যেতাম। যে শিক্ষকই ছুটি চাইতে আসতেন, প্রিন্সিপ্যাল স্যারকে বলতেন, আমার ক্লাশটি সিফা নিবে। এভাবে অবস্থা এমন দাড়ালো যে, আমায় একটানা সাতটি ক্লাশও নিতে হতো!

কেউ কেউ বলতো, ‘তুমি কী বোকা! তোমায় উনারা খাটিয়ে নিচ্ছেন, তুমি বুঝতে পারছো না!’ আমি মৃদু হাসতাম। জীবনের বহু জায়গায় আমি বহুবার খেটেছি, ঠকেছি কিন্তু ঠেকে যাইনি। শিক্ষকতা দ্বারা নিজেকে বিলিয়ে দেয়া এক বিস্ময়কর আনন্দেরই নাম।

তারা জানতো না, আমি যখন ক্লাসে শিক্ষার্থীদের সামনে দাঁড়াতাম, আমার মনে হতো, আমি একটি সূর্য, আমায় অনেক আলো ছড়াতে হবে। আমার মনে হতো, আমি একটি সুর, আমায় সুমধুর মূর্ছনায় ছড়িয়ে যেতে হবে শেষ প্রান্ত পর্যন্ত। মনে হতো, আমি একজন চাষী আর সামনের শিক্ষার্থীরা নরম মাটি। আমায় বুনে দিতে হবে মনে জিজ্ঞাসার বীজ। আমার মনে হতো, আমি পৃথিবীর সম্রাট। সামনে সব আমার রাজন্যবর্গ আর আমাদেরকে পৃথিবীটাকে বদলে দিতে হবে। শিক্ষকতা এক আনন্দ!

আমার মনে হতো, আমি যেন আমি নই, আমি যেন কোনো দেবদূত আর আমার কথাগুলো যেন যাদুর কাঠি!

এভাবে ক্লাশ নেয়ার কিছুদিন পরে দেখলাম, আমি বিদ্যালয়ের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যেতে পারছি না। আমায় ঘিরে ধরছে ছোট ছোট শিক্ষার্থীরা প্রজাপতির মতো। আমায় ঘিরে ধরছে তারা চিনির দানাকে ঘিরে ধরা পিঁপড়ের মতো। আহা! সে যেন এক স্বর্গীয় আনন্দ! সে যেন এক অনন্য অনুভব! যে এই অমৃতের স্বাদ পায়নি সে কী করে তা জানবে!

শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে পেয়েছিলাম বহুমূল্য নিঃস্বার্থ ভালোবাসামিশ্রিত সম্মান, শিক্ষকতা হিসেবে যা ভয়-করা-সম্মানের থেকে  থেকে অনেক অনেক দামী।

শিক্ষকতা ছেড়ে আসার বহুদিন পরও আমি নিয়মিত শিক্ষার্থীদের ফোন পেতাম, যারা তাদের জীবনের নানা ঘটনা, অভিজ্ঞতা আমার সাথে বিনিময় করতো। একবার এক কিশোরী শিক্ষার্থী আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়ে আমায় মেসেজ পাঠিয়েছিলো। তারপর দীর্ঘ কাউন্সেলিং শুরু করলাম, কিছুদিন পরে দেখলাম জীবনের প্রতি তার আস্থা ফিরে এসেছে। জীবনকে সে ভালোবাসতে শুরু করেছে। তার সমস্যা সমাধান করতে গিয়ে জীবন নিয়ে আমিও যেন অনেক কিছু শিখলাম। এজন্যই বুঝি জাপানি একটা প্রবাদে বলা হয় ‘শেখাতে গেলেই শেখা হয়’।

সেখান থেকে বুঝেছিলাম শিক্ষকতার অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য কোথায়। অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রেই যখন কর্মের অর্থ বিরক্তি, ভয় বা চাপ, তখন শিক্ষকতা মানে ‘আনন্দ’। আর আনন্দের স্পর্শেই জীবন সুন্দর হয়ে ওঠে। অনেককেই বলতে শুনি, আমি শিক্ষক হয়েছি কারণ আমি পড়িয়ে আনন্দ পাই। 

মানুষের জীবনের সবচেয়ে রঙিন, সবচেয়ে ছটফটে, সবচেয়ে উর্বর সময়টিতে মানুষ জ্ঞানার্জনে রত থাকে। আর সেই সময়টায় তার পাশে থেকে আলো-আঁধারের পার্থক্য বুঝতে শেখানো, সত্য, ন্যায়, প্রজ্ঞা আর সহিষ্ণুতার পথ দেখান শিক্ষকরা। তাঁদের ধ্যানধারণা চিন্তার গাঁথুনিতেই শিক্ষার্থীর ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে।

রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, মনুষ্যত্বের শিক্ষাটাই চরম শিক্ষা আর সমস্তই তার অধীন। শিক্ষকই ধীরে ধীরে ‘প্রাণী’ থেকে ‘মানুষ’ হয়ে উঠতে সাহায্য করেন। এর বিনিময়ে উপরি তো মেলেই না, অধিকাংশ ক্ষেত্রে ন্যায্য পাওনাটাই মেলে না। তবুও অন্যের জীবনকে গড়ে দেয়ার নিমিত্তে শিক্ষকরা ভালোবেসে এই পেশাকে ধরে রাখেন। এ-প্রসঙ্গে বিখ্যাত চীনা দার্শনিক কনফুসিয়াসের একটি কথা উল্লেখ করা যায়, “এটি সব থেকে ভালো হবে যে অন্ধকারকে অভিশাপ না দিয়ে ছোট্ট একটি দ্বীপ জ্বালান”। চারদিকে ঘিরে আসা সামাজিক অন্ধকারের মাঝেও প্রকৃত শিক্ষকরা দ্বীপ জ্বালিয়েই যান। শিক্ষকতার সেই দ্বীপের আলোয় শিক্ষার্থীরা যেমন নিজেদের স্বপ্ন প্রজ্জ্বলন করে, আবার তেমনি অহংকারী না হয়ে উঠার জন্য নিজের সীমাবদ্ধতাটুকুও দেখতে পায়।

শাসন করার যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তেমন কোনো কঠিন ক্ষমতাদণ্ড না পেয়েও তারা জীবন বোনার চরকা চালিয়ে যান। তাই কেউ কেউ বলেন শিক্ষকতা মানে অঙ্গীকার।

আমরা যেসব শিক্ষকদের পছন্দ করি, ভালোবাসি, তাঁদের চিন্তা আর প্রকাশের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠে আমাদের জীবনদর্শন। এজন্য শিক্ষককে ও শিক্ষকতাকে জীবনচাষী বললে মনে হয় এতটুকু অত্যুক্তি হবে না।  

একজন বড় চেয়ারওয়ালা কেউ চেয়ার সরে গেলে স্যার থেকে ভাই হয়ে যান; কিন্তু একজন শিক্ষক যে পর্যায়েরই হোন না কেন, মৃত্যুর পরও ‘স্যার’ রয়ে যান। শিক্ষক শব্দের অর্থ অনেক কিছুই হতে পারে, কিন্তু আমাকে অর্থ করতে দিলে আমি বলবো— শিক্ষক মানে ‘সম্মান’, শিক্ষক মানে ‘আলো’।

কোনো এক অজানা লেখকের সংজ্ঞায় পড়েছিলাম, “Teaching is that profession which creates all other profession”.

শিক্ষকরা হলেন সেই চাষী, যারা রোপণ করেন আনন্দবীজ। শিক্ষকতা বীজ থেকে জন্মায় আগ্রহ, জিজ্ঞাসা, প্রেম দয়া। আর সেই বীজ থেকে মহীরূহ হওয়া পর্যন্ত প্রতি ধাপেই নিয়োজিত থাকেন শিক্ষকরা। এভাবেই চালিত হয় জাতি, আর এজন্যই শিক্ষকতা বা জ্ঞানবিতরণ সবচেয়ে মহৎকর্ম। আর শিক্ষককে সবচেয়ে সম্মান করা জাতিই হয়ে উঠে সবচেয়ে সভ্য, উন্নত, হৃদয়বান।

সকল ভালো কর্মের উদ্দ্যেশ্যই মহৎ, তবে মনে হয় শিক্ষকতা পেশার চেয়ে মহত্তম বা সুন্দর আর কিছু হতে পারে না। আমি হয়তো শিক্ষক হইনি, কিন্তু আপনারা যারা শিক্ষক, আপনারা সবাই সেই সৌভাগ্যবান। এমন করে আলো ছড়িয়ে দিন, দিন-শেষে আলোই সত্য আর আপনারা সুন্দরতম।

লেখক পরিচিতি

সম্পাদক বাংলাদেশের শিক্ষা

এই লেখাটি সম্পাদক কর্তৃক প্রকাশিত। মূল লেখার পরিচিত লেখার নিচে দেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন

মতামত

বিজ্ঞান চেতনা: প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কোন বিজ্ঞান শিখছে শিশুরা?

নাহিদ নলেজ বিজ্ঞান চেতনা নিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা কী- এ সম্পর্কে বিস্তর কথাবার্তা আমাদের সবার জানা। সেই প্রাথমিক শিক্ষাটুকুই যদি গলদপূর্ণ হয়, তাহলে আর কী কথা...

দেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আপনি কি সন্তুষ্ট?

মোঃ তৌফিক ইমাম চৌধুরী লিখেছেন বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে বর্তমানে শিক্ষাব্যবস্থা আছে তা নিয়ে কি আপনি পুরোপুরি সন্তুষ্ট? প্রাথমিক কিংবা নিম্নমাধ্যমিক শ্রেণীতে একজনকে অনেকগুলো বিষয়ে পড়তে...
নতুন লেখার খবর পান ইমেইলে
বাংলাদেশের শিক্ষা প্রসঙ্গে নতুন লেখা প্রকাশিত হলে সেই খবর পৌঁছে যাবে আপনার ইমেইলে।

এই বিভাগের আরও লেখা

প্রাথমিকে প্যানেল শিক্ষক নিয়োগ: উত্তীর্ণদের কী হবে?

প্রাথমিক শিক্ষার ভিত্তি দুর্বল হলে শিক্ষার পরবর্তী ধাপগুলো শক্তভাবে দাঁড়াতে পারে না। তার প্রমাণ...

শহীদ ড. শামসুজ্জোহা : আত্মত্যাগের অনন্য দৃষ্টান্ত

বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, ঘুরেফিরে এই সংকটের দায় বিশ্ববিদ্যালয়ের...

প্রফেসর মোহাম্মদ নাসের : নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই

ড. রহমতউল্লাহ ইমন লিখেছেন মোহাম্মদ নাসের সম্পর্কে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর মোহাম্মদ নাসের আর আমার যাত্রা...

সুলতানা সারওয়াত আরা জামান: বাংলাদেশে ‘বিশেষ শিক্ষা’র পথিকৃৎ

বর্তমান পৃথিবী নিকট ভবিষ্যতে যে কয়টি বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে যাচ্ছে, তার মধ্যে...

অষ্টম পে-স্কেল এবং শিক্ষকের মর্যাদা সমাচার

সৈয়দ আবদুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী লিখেছেন অষ্টম পে-স্কেল ও শিক্ষকের মর্যাদা সম্পর্কে মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবকে...

উচ্চশিক্ষার মান: শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক

শিক্ষাজীবনে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বর্তমান সময়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক নিয়ে এক ধরনের...

শিক্ষা ও গবেষণায় বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়: পর্ব ১

এই মুহূর্তে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের হিসেব মতে, দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১০৩। এর ভেতর...

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা ও গবেষণা: পর্ব ৫

ভালো শিক্ষক ছাড়া ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অবাস্তব এবং অসম্ভব। এই কথাটা আমরা বুঝিনা কেনো? "প্রতিভার ঔদ্ধত্যই...