বাংলাদেশে যেকোনো শিক্ষার্থীকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন না করার আদেশ সম্বলিত হাইকোর্টের নির্দেশনা আছে যা না মানলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রয়েছে। শতকরা ৪০ ভাগ বিদ্যালয়েই কোনো না কোনো শিক্ষার্থী শারীরিক বা মানসিকভাবে নির্যাতিত হয়। এই বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের এ আদেশ শিক্ষা মন্ত্রণালয় বাংলাদেশের ৬৪ হাজার বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের কক্ষে টানিয়ে রাখার জন্য পরিপত্র জারি করে। আদেশটি শিক্ষকরা ঠিকমত মানছেন কিনা তা তদারকের ব্যবস্থাও আছে।
তারপরেও মাঝেমাঝেই মিডিয়াতে শিক্ষার্থী নির্যাতন ও এর ভয়ংকর, বীভৎস ছবি ও খবর দেখা যায়। এসব খবরে যেকোনো বিবেকবান মানুষের খারাপ লাগার কথা। সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও এ বর্বরতা বন্ধ হচ্ছে না। বাংলাদেশের প্রায় সব বিদ্যালয় ও মাদ্রাসায়, বিশেষ করে হাফেজিয়া মাদ্রাসাগুলোতে রোজ কোনো না কোনো কোমলমতি শিক্ষার্থীর উপর কিছু নিষ্ঠুর শিক্ষক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করেই চলেছেন। এতে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মনের অনুভূতি কেমন হয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এসব নির্যাতন যে পরিমাণে ঘটে, তার খুব সামান্যই মিডিয়াতে আসে। আর এসব অপরাধী শিক্ষকদের শাস্তি হওয়ার ঘটনা তো আরও বিরল।
শিক্ষার্থীদের উপর যেকোনো কঠোর শারীরিক শাস্তি (যেমন, মারা, কান ধরে ওঠাবসা করানো, বেঞ্চের উপর দাঁড় করানো, শ্রেণিকক্ষে দীর্ঘ সময় দাঁড় করিয়ে রাখা, শিক্ষকের টেবিলের পাশে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখা, একপায়ে দাঁড় করানো, হাঁটুর উপর দাঁড় করানো ইত্যাদি) ও মানসিক শাস্তি (যেমন,গালি দেয়া, শ্রেণিকক্ষের বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখা, ভয় দেখানো, অপমানসূচক কোনো নাম বা শব্দ ব্যবহার করা ইত্যাদি) শিক্ষার্থীদের মনে দীর্ঘস্থায়ী কষ্টের জন্ম দেয় যার ফলে শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ভীতি, পড়াভীতি, ফেল করা, ঝরে পড়া, এমনকি স্বাভাবিক মানসিক বিকাশ চরমভাবে ব্যাহত হয়। তাই মনোবিজ্ঞানীরা এসব শাস্তিদান থেকে শিক্ষকদের বিরত থাকতে বলেন। এখন এগুলো শাস্তিযোগ্য অপরাধও। তবু এ অপরাধ থেমে নেই। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দু’এক জনের মধ্যেও শিক্ষার্থীদের গায়ে হাত তোলার প্রবণতা দেখেছি।
মনোবিজ্ঞানীরা এসব শাস্তিদান থেকে শিক্ষকদের বিরত থাকতে বলেন। এখন এগুলো শাস্তিযোগ্য অপরাধও। তবু এ অপরাধ থেমে নেই। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দু’এক জনের মধ্যেও শিক্ষার্থীদের গায়ে হাত তোলার প্রবণতা দেখেছি।
প্রথমে জানার চেষ্টা করি, কেন শিক্ষকরা কোমলমতি শিক্ষার্থী নির্যাতন করেন?
– এসব শিক্ষক নিজেদের ব্যক্তিগত হতাশা, রাগ বা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে শিক্ষার্থীদের নির্যাতন করেন;
– এসব শিক্ষকের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো নয়। তাঁরা নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে জানেন না। ফলে অতিরিক্ত রাগের কারণে শিশুদের মারেন;
– তাঁরা শিশুদের ওপর শারীরিক ও মানসিক শাস্তির ক্ষতিকারক দিক সম্পর্কে অজ্ঞ;
– তাঁরা জানেন না শিশুদের কোন কোন শাস্তি দেয়া যায়, কোনগুলো দেয়া যায় না;
– শিক্ষার্থীদের শারীরিক বা মানসিক শাস্তি দেওয়ার অপরাধে কোনো শিক্ষকের শাস্তি হয় না;
– কীভাবে পড়ালে শিক্ষার্থীরা ভালো শেখে, মনোযোগ বাড়ে, কেন শিক্ষার্থীরা অমনোযোগী হয়, দুষ্টামি করে এসব বিষয় সম্পর্কিত শিশু মনোবিজ্ঞানের জ্ঞানের অভাব থাকে তাঁদের। যার কারণে তাঁরা শিক্ষার্থীদের মারেন বা গালি দেন;
– বেশিরভাগ শিক্ষক পড়াতে আসেন অন্য চাকরি না পেয়ে। অর্থাৎ শিক্ষকতা পেশাকে ভালোবেসে আসেন না। ফলে এ পেশার প্রতি তাঁদের শ্রদ্ধা ও দায়বদ্ধতা থাকে না;
– আগেকার যুগে শিক্ষার্থীদের মেরেই পড়ানো হতো। সেই সনাতন মানসিকতা এখনও অনেক শিক্ষক ছাড়তে পারেননি;
– অনেক শিক্ষক মনে করেন, শিক্ষার্থীরা তাঁকে যতো ভয় পাবে, তিনি ততো ভালো শিক্ষক। তাই তাঁরা ভয় পাওয়ানোর জন্য শিক্ষার্থীদের মারেন বা গালি দেন;
– আর্থিক অস্বচ্ছলতা ও লোভের কারণে অনেক শিক্ষক ক্লাসে না পড়িয়ে কোচিং-এ পড়াতে বেশি আগ্রহী। ফলে শিক্ষার্থীরা পড়া পারে না, না পারলে শিক্ষক মারেন বা বকেন। এসব কোচিং ব্যবসায়ী শিক্ষককে শিক্ষার্থীরা শ্রদ্ধা করে না। তাই তাদের কথাও শোনে না। ফলে শ্রেণি নিয়ন্ত্রণ করতে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের নির্যাতন করেন;
– অভিভাবক ও বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যথেষ্ট সচেতন নয়। ফলে এসব অপরাধের তেমন প্রতিক্রিয়া হয় না। শিক্ষার্থীরাও সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারে না শিক্ষক ফেল করিয়ে দেবে বা কম নম্বর দেবে সেই ভয়ে;
– আমাদের দেশে শিক্ষার্থীদের দ্বারা শিক্ষক মূল্যায়নের সুযোগ নেই বললেই চলে। অনেক বিদ্যালয়ে অভিযোগ বাক্সও থাকে না। ফলে কোন শিক্ষক ক্লাসে কেমন আচরণ করেন, তা জানা যায় না। তাই শিক্ষকদের জবাবদিহিতাও থাকে না।
– সরকারি বিদ্যালয়ে কিছুটা নজরদারি থাকে। কিন্তু বেসরকারি বিদ্যালয়ে নজরদারি কম থাকার কারণে সেখানে এসব শিক্ষকদের নির্যাতন বেশি হওয়ার কথা;
– শিক্ষকরা বোঝেন না, শিক্ষার্থীরা না পড়লে, মানুষ না হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি শিক্ষার্থীর ও তার বাবা-মার। তাই তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে একান্তই না পারলে না শাস্তি দিয়ে বা গালি না দিয়ে তাদের বাবা-মার কাছে অভিযোগ করা যেতে পারে;
– শিক্ষার্থীদের বয়স একটি বড় ফ্যাক্টর। এরা শিশু বলেই পড়া ফাঁকি দেবে, দুষ্টামি করবে, মারামারি করবে, বাড়ির কাজ করবে না আর আপনি শিক্ষক বলেই তাদের বয়সের কারণে অভিজ্ঞতা বা জ্ঞানের.ঘাটতি আছে, সেটি মেনে নিয়ে তাদেরকে সেভাবে শেখাবেন। মহাপাপী বা অপরাধীর মতো শাস্তি দেবেন না। বেশিরভাগ শিক্ষক এটি বোঝেন না।
এতিমখানা ও হাফেজিয়া মাদ্রাসাগুলোতে পড়তে আসে দরিদ্র, অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, ধর্মপ্রাণ মানুষের সন্তানেরা যারা সন্তানকে ইসলাম শিক্ষা, তথা কোরানে হাফেজ বানানোর জন্য আগ্রহী। এসব মাদ্রাসা ও এতিমখানায় দরিদ্র পরিবারের শিশুদের উপর যৌন নির্যাতনের ঘটনাও কম ঘটে না। মাদ্রাসাগুলোতে নজরদারি কম। ওখানকার শিক্ষকগণ আধুনিক সময়ের শিক্ষাদান পদ্ধতি থেকে অনেক দূরে। তাঁরা আধুনিক মনোবিজ্ঞানসম্মত শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক শিক্ষাদান পদ্ধতি সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ। না মেরেও যে শিক্ষা দেয়া যায়, তা তাঁদের অনেকে জানেনই না।
আমাদের দেশে শিক্ষার্থীদের দ্বারা শিক্ষক মূল্যায়নের সুযোগ নেই বললেই চলে। অনেক বিদ্যালয়ে অভিযোগ বাক্সও থাকে না। ফলে কোন শিক্ষক ক্লাসে কেমন আচরণ করেন, তা জানা যায় না। তাই শিক্ষকদের জবাবদিহিতাও থাকে না।
শিক্ষার্থী নির্যাতন: শাস্তি প্রদান ছাড়াই শ্রেণিকক্ষ নিয়ন্ত্রণের কার্যকর কৌশলসমূহ
শিক্ষকের ত্রুটিপূর্ণ আচরণ, পড়ানোর বা বোঝানোর অক্ষমতা, শাস্তির ভয়, শিক্ষার্থীর কম বুদ্ধি, শারীরিক বা মানসিক রোগ, পারিবারিক কলহ বা সমস্যা এসব কারণেও শিক্ষার্থীরা পাঠে অমনোযোগী হয়। তাই শিক্ষকদের উচিত—
– পাঠদান আকর্ষণীয় ও অর্থপূর্ণ করা যাতে শিক্ষার্থীরা পাঠে আনন্দ পায়;
– ভয়-ভীতিহীন আনন্দঘন পরিবেশে পড়ানো যেখানে শিক্ষক হবেন সাহায্যকারী, বন্ধু ও পরামর্শদানকারী;
– দলীয় কাজ দিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক তৈরি করা যাতে কোনো শিক্ষার্থীই পিছিয়ে না পড়ে;
– উৎসাহব্যঞ্জক কাজ দিয়ে শিক্ষার্থীদের ব্যস্ত রাখা, যাতে তারা দুষ্টুমি করার সুযোগ না পায়;
– উপকরণ ব্যবহার করে হাতে-কলমে শেখানো। তাহলে শিশুরা সহজে শেখে, কোনো পড়াকেই কঠিন মনে করে না;
– অপরাধী শিক্ষার্থীর ভালো গুণের প্রশংসা করা। তাহলে সে ধীরে ধীরে অপরাধ থেকে সরে আসবে;
– শিক্ষার্থীদের চোখে চোখ রেখে পড়ানো, বোর্ডে লেখার সময়ও খেয়াল করা যে, কোনো শিক্ষার্থী অমনোযোগী বা দুষ্টামি করছে কিনা;
– শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের কাছে গিয়ে বা চারপাশে ঘুরে ঘুরে পড়ানো যাতে কোনো শিক্ষার্থী অসুবিধা বোধ করছে কিনা তা জানা যায়;
– শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন করার সুযোগ দিতে হবে যাতে শিক্ষার্থী তার অপারগতা ও অসুবিধার কথা নির্ভয়ে বলতে পারে;
– বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের প্রতি বেশি মনোযোগ দিতে হবে;
– সাবধানবাণী উচ্চারণ ও পুনঃপুনঃ সাবধানবাণী উচ্চারণ করা যাতে শিক্ষার্থীরা সতর্ক হয়, দুষ্টুমি না করে;
– উপদেশ-নির্দেশনা দানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীকে পাঠে আগ্রহী করা;
– কীভাবে অন্তর্নিহিত প্রেষণা সৃষ্টি করে শিক্ষার্থীদের পাঠে মনোযোগী করা যায় ও খারাপ আচরণ থেকে দূরে রাখা যায় তা শেখাতে হবে ইত্যাদি।
রোজ প্রার্থনা করি, বাংলাদেশে শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনা আর একটিও না ঘটুক। শিক্ষকের মার খেয়ে আহত শিশুগুলোকে দেখে নিজেকে প্রশ্ন করি, “এই শিশুটি যদি আমার হতো, তাহলে আমার কেমন লাগতো?” যেসব শিক্ষক শিক্ষার্থীদের ওপর এমন নির্যাতন করেন, তাঁদের কি সন্তান নেই?
লেখক পরিচিতি
ড. আকতার বানু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।