আলোচ্য বিষয়সমূহ
সম্ভবত আমরা অধিকাংশই বুঝতেই পারি না, এটি আমাদের কতো বড় সৌভাগ্য যে আমরা শিক্ষক হতে পেরেছি। কেউ বিলিওনিয়ার হওয়ার জন্য শিক্ষক হয় না। শিক্ষক হওয়ার সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো আমরা জ্ঞানের মূল প্রবাহে থাকতে পারি। একজন মানুষের জীবনে এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে?
শিক্ষক ও প্রশাসক
প্রশাসক হওয়ার যদি এতোই ইচ্ছে থাকে, তবে বিসিএস দিয়ে ওই পথে যাওয়া উচিত ছিলো। তিনিই সত্যিকারের শিক্ষক, যাকে প্রশাসনিক দায়িত্ব এমনকি ভিসি বানাতে চাইলেও গবেষণার ক্ষতি কিংবা শিক্ষকতার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হওয়ার কথা চিন্তা করে অপারগতা প্রকাশ করবেন। আমরা কি সেরকম শিক্ষক দেখি?
কথিত আছে, বিশেষ বিশেষ পদে যেতে অনেক শিক্ষক ছাত্রনেতাদের কাছে দেনদরবার করতেও কার্পণ্য করেন না। সেরকম শিক্ষক ভিসি হয়ে কী করবেন তা নিশ্চয়ই সকলে অনুমান করতে পারছেন, কারণ আপনারা সবাই অনেক কিছুই ঘটতে দেখেছেন।
অটো-প্রমোশন
আমরা অনেকেই অটো-প্রমোশনের কথা শুনেছি। যেমন, তৃতীয় শ্রেণিতে না পড়ে চতুর্থ কিংবা সপ্তম শ্রেণিতে না পড়ে অষ্টম শ্রেণিতে উঠে গেছে। এই অটো-প্রমোশন পশ্চিমা দেশ বিশেষ করে আমেরিকায় আরও বেশি শোনা যায়। তো, এরকম অটো-প্রমোশন পেয়ে যারা বিএস, এমএস, পিএইচডি করে, তাদের চাকুরির ক্ষেত্রে যদি বলি, আপনাকে তো চাকুরি দেওয়া যাবে না কারণ আপনার পিএসসি বা জেএসসি ডিগ্রি নেই। আমি জানি না পিএসসি চালুর পর এখন এরকম পঞ্চম শ্রেণিতে না পড়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠতে পারবে কিনা।
আসলে কারো উচ্চতর ডিগ্রি যেমন পিএইচডি হয়ে গেলে তার মাস্টার্স ডিগ্রি আছে কিনা সেটি দেখে তার যোগ্যতা বিচার করা ঠিক নয়। …নিয়ম হলো চালুনি। এটি যেমন অনাকাঙ্ক্ষিত বস্তুকে বাদ দেওয়ার কাজে ব্যবহৃত হয়, তেমনি নিয়ম তৈরি করা হয় খারাপকে বাদ দেওয়ার জন্য। ভালোকে নয়।
আসলে কারো উচ্চতর ডিগ্রি যেমন পিএইচডি হয়ে গেলে তার মাস্টার্স ডিগ্রি আছে কিনা সেটি দেখে তার যোগ্যতা বিচার করা ঠিক নয়। শিক্ষক নিয়োগে নিয়ম কেন করা হয়? নিয়ম হলো চালুনি। এটি যেমন অনাকাঙ্ক্ষিত বস্তুকে বাদ দেওয়ার কাজে ব্যবহৃত হয়, তেমনি নিয়ম তৈরি করা হয় খারাপকে বাদ দেওয়ার জন্য। ভালোকে নয়। সমস্যা হচ্ছে, আমরা নিয়মকে ব্যবহার করি ম্যানিপুলেট করার জন্য।
আমরা অতিমাত্রায় নিয়ম দেখাই ভালোকে বাদ দেওয়ার ক্ষেত্রে আর অতিমাত্রায় শিথিলতা দেখাই খারাপকে নেওয়ার জন্য। এখন এমন যদি হয় যে, পদার্থবিজ্ঞানের প্রভাষক নিয়োগের বাছাইয়ে একজন প্রার্থীর বিএস ডিগ্রি পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে আর মাস্টার্স ডিগ্রি তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে, তখন তাকে যদি বাছাই কমিটি কার্ডই না পাঠায় এই যুক্তিতে যে, বিজ্ঞপ্তিতে লেখা প্রার্থীর পদার্থবিজ্ঞানে বিএস এবং এমএস থাকতে হবে সেটা কি ঠিক?
হ্যাঁ, বাংলাদেশ এমনই হয়। মাস্টার্স তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানে হলে সেটি কি পদার্থবিজ্ঞান নয়? বরং ধারণা করা হয়, সেটিই উচ্চতর পদার্থবিজ্ঞান। এসব যুক্তিহীন যুক্তি কখন দেওয়া হয়? যখন সিস্টেমকে কলুষিত করতে হবে। যখন তাদের পছন্দের কেউ থাকে। এরা কি বিভাগ তথা বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু না শত্রু?
ব্যতিক্রর্মী প্রার্থীর জন্য ব্যতিক্রমী নিয়ম?
ব্যতিক্রমী প্রার্থীর জন্য নিয়মের ব্যতিক্রম করাই যে নিয়ম, সেই সাধারণ জ্ঞানটুকু পর্যন্ত আমাদের অনেকের নেই। আমরা নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটাই খারাপদের ক্ষেত্রে। আমাদের শিক্ষক নিয়োগ কমিটি গঠন প্রক্রিয়া এবং নিয়োগ প্রক্রিয়া দুটোই মারাত্মক ত্রুটিপূর্ণ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সদস্যরা হন চরমভাবে রাজনৈতিকভাবে চার্জড অথবা চরমভাবে অসৎ। এরা রাজনীতিকে ব্যবহার করেন দলীয় ও নিজ স্বার্থে। এদের কাছে ছাত্রছাত্রী ও দেশ কখনোই বিবেচ্য বলে প্রতীয়মান হয় না।
শুধু নিয়োগ না, প্রমোশনের ক্ষেত্রেও আমরা ব্যতিক্রমী ভালোদের ব্যতিক্রমী হিসাবে বিবেচনা করে উৎসাহ দিতে জানি না। ক্ষেত্রবিশেষে আমরা বরং উল্টোটা করি। তাহলে ব্যতিক্রমী মানুষ তৈরি হবে কীভাবে?
মাত্র কয়েকদিন আগেই শুনেছি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের এক মেধাবী শিক্ষার্থীর শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন অঙ্কুরেই গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক মেধাবীকে নিয়োগ পরীক্ষার কার্ডই পাঠায়নি, কারণ তাঁর মাস্টার্স নেই। অথচ তাঁর পিএইচডি আছে।
এর আগে আরও এক অত্যন্ত মেধাবীকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরি দেওয়া হয়নি। অভিযোগ, তাঁর আন্ডার-গ্রাজুয়েট ইঞ্জিনিয়ারিঙে ছিলো, পদার্থবিজ্ঞানে নয়। অথচ পৃথিবীসেরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি এবং পোস্ট-ডক ছিলো তাঁর। তাঁরা কি জানতো না যে, উক্ত প্রার্থীর পদার্থবিজ্ঞানে আন্ডার-গ্রাজুয়েট ডিগ্রি নেই? জানা সত্ত্বেও পিএইচডিতে ভর্তি করা মানেই সে ব্যতিক্রমী কেউ ছিলো।
প্রমোশনের ক্ষেত্রেও আমরা ব্যতিক্রমী ভালোদের ব্যতিক্রমী হিসাবে বিবেচনা করে উৎসাহ দিতে জানি না। ক্ষেত্রবিশেষে আমরা বরং উল্টোটা করি। তাহলে ব্যতিক্রমী মানুষ তৈরি হবে কীভাবে?
একই অজুহাতে আমাদের আরেক মেধাবীকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানে চাকুরি দিতে চাননি সংশ্লিষ্টরা। অথচ তারও পিএইচডি এবং পোস্ট-ডক ছিল। ওই সময় আমাদের সবার পরম শ্রদ্ধেয় হারুন স্যার না থাকলে হয়তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার চাকুরি হতোই না।
যার পিএইচডি আছে তাকে শিক্ষক হিসাবে নিয়োগের জন্য যদি মাস্টার্স আছে কিনা দেখা হয় অথবা এসএসসি বা এইচএসসি কিংবা বিএসসিতে জিপিএ ৫ বা ৩.৫ আছে কিনা সেটি দেখা মহাপাপ। যার পিএইচডি হয়েছে, সেখানে একমাত্র দেখার বিষয় কোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেছে, গবেষণাপত্রের সংখ্যা কতো আর তাদের মান কেমন ইত্যাদি।
নিয়মের বেড়াজাল
আমরা অত্যন্ত ব্যতিক্রমী ভালো কাউকে শিক্ষক হিসেবে চাকুরি দিতে না চাইলে নিয়মের বেড়াজাল ব্যবহার করতে একটি ওস্তাদ জাতি। আবার আমরাই অসম্ভব অযোগ্য কাউকে শিক্ষক হিসাবে চাকুরি দিতে চাইলে নিয়মকে কীভাবে পাশ কাটাতে হয় সে বিষয়টিও জানি।
নিয়ম করা হয় ছাকনি হিসাবে ব্যবহার করে খারাপকে বাদ দেওয়ার জন্য। ভালোকে নেওয়ার জন্য নিয়ম যেন বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। উদ্যেশ্য হলো ভালো শিক্ষক নেওয়া। সমস্যা হলো, আমরা ভালো কাজে নিয়মকে ব্যবহার করি না কিন্তু খারাপ কাজে নিয়মকে ব্যবহার করতে আমাদের কেউ আটকাতে পারে না। এজন্যই চারিদিকে এত অনিয়ম আর অনাচার।
যেখানে এ-ঘটনা ঘটেছে সেই বোর্ডের শিক্ষকদের উচিত ছিলো নিয়োগ স্থগিত করা। বলা উচিত, যে নিয়মে সবচেয়ে ভালো প্রার্থীকে কার্ড দেওয়া যায় না, সেই নিয়ম আগে পরিবর্তনের ডাক দিতে হবে। তারপর পরিবর্তন করে আবার নতুন করে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে শিক্ষক নেওয়া। না পারলে ওখান থেকেই আন্দোলন শুরু করা। এভাবে তো নিয়মের গ্যাড়াকল দেখিয়ে ভালোদের ফিরিয়ে দেওয়া যায় না!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও একই নিয়মে শিক্ষক নিয়োগ হয়। আমাদের এখানেতো প্রয়োজন দেখিয়ে মাস্টার্স ছাড়া শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে যদিও তাদের পিএইচডি নেই। ঢাকা এবং চট্টগ্রাম দুটোই ৭৩-এর অধ্যাদেশ দিয়েই পরিচালিত। সব সম্ভব। তাই এসব নিয়ম দেখিয়ে হাইকোর্ট দেখানো ঠিক না।
ব্যতিক্রমী প্রার্থীর জন্য নিয়মের ব্যতিক্রম করাই যে নিয়ম, সেই সাধারণ জ্ঞানটুকু পর্যন্ত আমাদের নেই। আমরা নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটাই খারাপদের ক্ষেত্রে। আমাদের শিক্ষক নিয়োগ কমিটি গঠন প্রক্রিয়া এবং নিয়োগ প্রক্রিয়া দুটোই ত্রুটিপূর্ণ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সদস্যরা হন চরমভাবে রাজনৈতিকভাবে চার্জড। তাঁরা রাজনীতিকে ব্যবহার করে দলীয় ও নিজ স্বার্থে। এদের কাছে ছাত্রছাত্রী এবং দেশ কখনোই বিবেচ্য বিষয় নয় বলে প্রতীয়মান হয়। শুধু নিয়োগ নয়, প্রমোশনের ক্ষেত্রেও আমরা ব্যতিক্রমী ভালোদের ব্যতিক্রমী হিসাবে বিবেচনা করে উৎসাহ দিতে জানি না। ক্ষেত্রবিশেষে আমরা বরং উল্টোটা করি। তাহলে ব্যতিক্রমী মানুষ তৈরি হবে কীভাবে?
লেখক পরিচিতি
ড. কামরুল হাসান মামুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।