এই বিশ্বমারি কোভিড-১৯ শিক্ষাব্যবস্থা ও আমাদের জীবনের অনেক কিছু বদলে দিয়েছে ও দিচ্ছে। অবধারিতভাবে, প্রথম চাপটা এসে পড়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর। পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশেই সবার আগে বন্ধ করা হয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বদলে গেছে শিক্ষাপ্রদান, মূল্যায়ন ও গবেষণার পদ্ধতি।

পরিবর্তিত এই পরিস্থিতি কতদিন চলবে তা জানা নেই আমাদের। তবে এই পরিস্থিতির স্বরূপটা কেমন, বিশেষত উন্নত দেশগুলোয় এবং পাশাপাশি আমাদের নিজেদের দেশেও, সেটায় এক ঝলক নজর বোলানোর প্রচেষ্টা এই লেখাটায়।

যেহেতু প্রতিষ্ঠানগুলো এখন বন্ধ, কাজেই শিক্ষাপ্রদানের মূল মাধ্যম হয়েছে দূরশিক্ষণ প্রকল্প বা প্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষাপ্রদান। এই দূরশিক্ষণ প্রকল্প যেসব মাধ্যম ব্যবহার করে, সেসব হচ্ছে রেডিও, টেলিভিশন, ইন্টারনেট, গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, মোবাইল ফোন।

বাংলাদেশে আমরা নব্বইয়ের দশকে টিভির মাধ্যমে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের দূর শিক্ষণ পদ্ধতি ব্যবহৃত হতে দেখেছি যা উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার অংশ ছিল। উন্নত দেশে আনুষ্ঠানিক, উপানুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার জন্যে আলাদা টিভি চ্যানেলও ছিল বা আছে যা আজকাল ইন্টারনেটে নানান ওয়েবসাইট, ইউটিউব চ্যানেল, ফেসবুক পেজ, গ্রুপ ইত্যাদির মাধ্যমে বিস্তৃত। রেডিওতে শিক্ষামূলক অনুষ্ঠানের কথা এখনো অনেকের মনে থাকতে পারে, বাংলাদেশে গোষ্ঠীভিত্তিক কৃষিবিষয়ক অনুষ্ঠানের কথা মনে এল এই প্রসঙ্গে। পত্রপত্রিকায় আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার উপকরণ ছাপা হওয়াও নৈমিত্তিক ব্যাপার। অনেকেই জানেন, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও আছে অনেকের মূলধারার আনুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনলাইন কোর্স করার। দিনে দিনে অনলাইন কোর্স ও শিক্ষার্থীর সংখ্যা নানা কারণে বেড়ে চলেছে।

তবে গত মাস তিনেক ধরে দুনিয়াভর শিক্ষার্থীদের বেলায় যেভাবে শিক্ষাপ্রদান চলছে, তাকে কেউ কেউ নাম দিয়েছেন ক্রাইসিস ডিস্ট্যান্ট লার্নিং (crisis distance learning) বা আপৎকালীন দূর শিক্ষণ। সবকিছুই যখন ঘরে আবদ্ধ, তখন শিক্ষাও তার সাথে যাতে খাপ খাইয়ে নিতে পারে, সেটা নিশ্চিত করা হয় এর মাধ্যমে। এধরনের শিক্ষার প্রকরণ নানা জায়গায় নানারকম। কোথাও বাসায় শিক্ষোপকরণ বা বাড়ির কাজ পাঠানো ও সেসব সমাপ্ত করে পরে নির্দিষ্ট জায়গায় দিয়ে-আসা, কোথাও টেলিফোনে শিক্ষাদান, কোথাও আগে রেকর্ড-করা ভিডিও বা তাৎক্ষণিক ভিডিও উপস্থাপন, কোথাও নির্দিষ্ট সময়ে অনলাইনে ভিডিও কনফারেন্স, কোথাওবা শুধু অনলাইনে বাড়ির কাজ জমা দেওয়া, এমনকি পরীক্ষাও।

এসব ব্যাপারে সম্ভাবনা যেমন আছে, তেমনি দেখা দেয় সমস্যাও। সমস্যাগুলো শুধু শিক্ষার্থীদের তরফে আসে এমনটা নয়, শিক্ষকদেরও জন্যেও হতে পারে। এমনকি, কোথাও কোথাও এমনটাও দেখা গেছে যে আগের চাইতে এখন বরং পড়াশুনোর পেছনে সময় ও শ্রম অনেক বেশি দিতে হচ্ছে, উভয় পক্ষেই। শিক্ষক এখন বহুমুখী ভূমিকায় অবতীর্ণ। কখনো তিনি নিয়মকানুন বানাচ্ছেন দূর শিক্ষণের, কখনো তিনি নিজেই এসব নিয়মের প্রশিক্ষক, কোথাও তিনি আনুষ্ঠানিক শিক্ষক, কোথাওবা কারিগরি সমস্যার সমাধান দানকারী, কখনো তিনি গ্রন্থাগারিক, কখনো রূপ নিচ্ছেন মিডিয়া বিশেষজ্ঞের, কখনো তিনি উপদেষ্টা, কখনো এমনকি স্বাস্থ্য, কোভিড-১৯ বা মানসিক অবস্থা নিয়েও পরামর্শক।

যেহেতু সময়টা বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা-থাকার ও পরীক্ষার সময়ের মধ্যেই পড়েছে, তাই নতুন নিয়মকানুন তৈরি ও পরিপালনের ব্যাপারগুলো অনেক সময়েই হয়ে পড়েছে চটজলদি সমাধানের বিষয় এবং সময়ের সাথে ভুলত্রুটি থেকে শিক্ষা নিয়ে সেসব আরো উন্নত করার চেষ্টা চলছে। আজ যেসব নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, কাল হয়তো তার কিছুটা বদলে যাচ্ছে। পরীক্ষা পদ্ধতি বা মূল্যায়নের ধরন কিছুটা শিথিল করা হয়েছে। পাঠদানের বেলায় সময় কিছুটা কমিয়ে-আনা হয়েছে কোথাও কোথাও। কোথাও আবার আনুষ্ঠানিক পাঠদানের বদলে স্রেফ সহায়ক হিসেবে কাজ করছেন প্রশিক্ষকেরা। শেষটা মূলত বিদ্যালয়ের, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মোটামুটি অনলাইনে শিক্ষাদান বহাল রেখেছে।

সবার আগে দেখা হচ্ছে, যারা শিক্ষার্থী, তাদের সবার ইন্টারনেট লাইন আছে কিনা এবং সেটা শিক্ষণের জন্যে যথাযথ কিনা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বেশ কিছু অঙ্গরাজ্যে নিম্নবিত্ত, অবৈধ অভিবাসী এরকম নিম্ন আয়ের পরিবারের বিদ্যালয়গামী শিশুকিশোরদের জন্যে স্বল্প ব্যয়ে গতিসম্পন্ন ইন্টারনেট ও এমনকি মোবাইল ফোন, বা আরো দামি ল্যাপটপ যেমন আইপ্যাড বা ক্রোমবুক দেওয়া হচ্ছে, ফেরত দেওয়ার শর্তে। বিশ্ববিদ্যালয়ে অবশ্য সেটা তেমন হচ্ছে না। তবে কিছু কিছু শিক্ষোপকরণ দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে যা সবাইকে দেওয়া সম্ভবপর নয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় অবশ্য শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন মাত্রায় কিছু অর্থসহায়তা দেওয়ারও চেষ্টা করা হচ্ছে নানাভাবে। আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা এদিকে বেশিই সমস্যাক্রান্ত।

প্রাসঙ্গিকভাবে চলে আসে শিক্ষক বা প্রশিক্ষকদের নিজস্ব প্রশিক্ষণের ব্যাপারটাও। যেহেতু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় সবকিছুই অনলাইনে সফটওয়্যারকেন্দ্রিক, তাই সব শিক্ষকেরই ন্যূনতম ভিডিও কনফারেন্সিং সফটওয়্যার ব্যবহারে অভ্যস্ত হতে হয়। কোথাও কোথাও এসব সফটওয়্যার ব্যবহারে শিক্ষকদের কিছুটা প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, কোথাও নিজেদের উদ্যোগে শিখে নিতে বলা হয়েছে। যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর ক্লাস শেষকরার, পরীক্ষা নেওয়ার ও ফলাফলের চাপ বেশি, তাই কোথাও কোথাও কিছুটা সময় দিয়ে ক্লাস বন্ধ রেখে শিক্ষকদের নিজস্ব পাঠপরিকল্পনা উপস্থাপন করতে বলা হয়েছে, তাঁদের পাঠ্যসূচি, শিক্ষাদান পদ্ধতি ও মূল্যায়ন পদ্ধতিও পরিবর্তন বা সংস্কার করতে বলা হয়েছে যা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনুমোদনসাপেক্ষে পরে ব্যবহৃত হয়েছে।

মূল্যায়ন পদ্ধতির বেলায় কোথাও পরীক্ষা হয়েছে অনলাইনে বা উন্মুক্ত বই প্রক্রিয়ায়, কোথাও হয়েছে সুনির্দিষ্ট সময় ধরেই আগের মত, এবং আশা করা হয়েছে যে তারা নিজস্ব নৈতিকতা বজায় রেখেই পরীক্ষা দেবে। মূল্যায়ন প্রক্রিয়া কোথাও কিছুটা শিথিল করা হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষার্থীদের এই সিমেস্টারের ফলাফল লেটার গ্রেডের পাশাপাশি সরাসরি পাস-ফেল প্রক্রিয়ায় বেছে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে । ঠিক কত শতাংশ পেলে পাস হবে, সেটাও বিশ্ববিদ্যালয়ভেদে ভিন্নতর হয়েছে।

এছাড়া একটি বড়সড় সমস্যা নিয়ে দেখা দিয়েছে গবেষণার ব্যাপারটি। উন্নত দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা একটি বেশ বড় অংশ। এখানে উচ্চশিক্ষা মানেই প্রায় ক্ষেত্রে গবেষণামুখী শিক্ষা। কোভিড-১৯ এই ব্যাপারটিও সমস্যাকীর্ণ করে তুলেছে। শিক্ষকেরা এখানে নানা সরকারি ও বেসরকারি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে গবেষণার জন্যে অর্থানুকূল্য পান। কিছু গবেষণা বাসায় বসে করার সুবিধে থাকলেও, যেমন আইটি, গাণিতিক সমস্যা, কম্পিউটার মডেল ইত্যাদি, অনেক গবেষণার জন্যেই গবেষণাগার ব্যবহার করতে হয়। কিছু কিছু তো মাঠ পর্যায়েও যাওয়ার দাবি রাখে।

পরিবেশ, উদ্ভিদজগৎ, প্রাণিজগৎ, এমনকি মানব সমাজ বা জাতিগোষ্ঠী থেকে তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ করতে গেলে বাইরে যাওয়া অনেক সময়েই বাধ্যতামূলক। এসব ক্ষেত্রে আপাতত গবেষণা থমকে আছে। বিকল্প কোনো উপায় পাওয়া যায় কিনা সে-নিয়ে চিন্তা চলছে। মানুষদের নিয়ে যেখানে কাজ করা হয় সেসবের বেলায় সীমিতভাবে প্রতিটা ব্যাপার আলাদা করে দেখে দেখে অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে। যেহেতু বিষয়টি অভূতপূর্ব, সমাধানও তাই যথাযথ হচ্ছে না সবখানে। কেউ ঠেকে শিখছে, কেউ দেখে।

আমরা যদি এসব শিক্ষাদান পদ্ধতির উপস্থাপনের দিকটা দেখি তাহলে সেটা দুরকম মডেল অনুসরণ করে। একটা তাৎক্ষণিক উপস্থাপন (synchronous delivery method), যেখানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর পারস্পরিক তথ্যের ও আলাপের আদানপ্রদান হয় সরাসরি এবং আরেকটি সময়সাপেক্ষ উপস্থাপন (asynchronous delivery method), যেখানে এসব আদানপ্রদান সরাসরি হয় না, সময় নিয়ে হয়। সাধারণ মুখোমুখি শিক্ষাপ্রদানের ধরনের বদলে এসব পদ্ধতিতে বেশ সম্ভাবনা রয়েছে। শিক্ষার্থীকে রাখা হল শিক্ষাপ্রদানের কেন্দ্রে এবং শিক্ষকেরা সমস্যা-সমাধানের পদ্ধতি ব্যবহার করে শিক্ষার্থীর মনোনিবেশ, সৃজনশীলতা এবং মননশীলতার উচ্চতর প্রয়োগ ঘটালেন।

এক্ষেত্রে ব্যবহার করতে হবে শিক্ষণ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি (learning management systems), অনলাইন শিক্ষাপরিবেশ (online learning environments) এবং সমন্বয় ঘটাতে হবে তাৎক্ষণিক চলৎসাক্ষাৎকার (synchronous video conferencing) ও সময়সাপেক্ষ আলোচনা ক্ষেত্রের (asynchronous discussion forums)। খেয়াল রাখতে হবে যেন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের নিজেদের মধ্যে এবং শিক্ষোপকরণের সাথে শিক্ষার্থীর পারস্পরিক বোঝাপড়া যথাযথ ও সুদৃঢ় হয়।

আমি যেসব কথা বললাম বা উদাহরণ দিলাম, এগুলো মূলত উন্নত বিশ্বে কোভিড-১৯ সময়ের শিক্ষাদান ও মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে। বাংলাদেশে কোভিড-১৯-এর বিদ্যালয়ের দূর শিক্ষণ পদ্ধতি হিসেবে সারা দেশে ২৯ মার্চ থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর সব সরকারি ও বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৬ষ্ঠ থেকে ৯ম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের জন্যে সকাল ৯ট থেকে ১২টা অবদি সংসদ টিভিতে সপ্তাহে পাঁচ দিন শ্রেণীভেদে ১ থেকে ৩টি ক্লাস প্রচার করে, প্রতিটি ক্লাসের মেয়াদ হয় ২০ মিনিট। এই ক্লাসগুলোয় শিক্ষা দেওয়া হয়, সাথে বাড়ির কাজ। বিদ্যালয় খুললে বাড়ির কাজগুলো জমা দিতে হবে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের কাছে এবং তিনি সেসবের মূল্যায়ন করবেন যা ধারাবাহিক মূল্যায়নের অংশ হবে।

এরই ধারাবাহিকতায় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ‘ঘরে বসে শিখি’ কার্যক্রমের আওতায় ৭ই এপ্রিল থেকে ১ম থেকে ৫ম শ্রেণীর জন্যে দিনে ২০ মিনিট করে সংসদ টিভিতে ক্লাস সম্প্রচার করে। এক্ষেত্রেও একই রকমের মূল্যায়নের ব্যবস্থা রাখা হয়। এছাড়া, মাদ্রাসার দাখিল শিক্ষার্থীদের জন্যে ‘আমার ঘরে আমার মাদ্রাসা’, ও কারিগরি শিক্ষার্থীদের জন্যে ‘ঘরে বসে কারিগরি শিক্ষা’ কার্যক্রম চালু হয়েছে সংসদ টিভিতে। তবে সরকারি কোনো মহাবিদ্যালয় বা বিশ্ববিদ্যালয়ে দূর শিক্ষণের ব্যবস্থা চালু হয়েছে বলে আমার জানা নেই, ভুলও হতে পারে।

যেহেতু বাংলাদেশে ইন্টারনেটের গতি তুলনামূলকভাবে কম এবং অনেক জায়গায় ইন্টারনেট সেবা অপ্রতুল বা অনুপস্থিত, সেহেতু সংসদ টিভি তুলনামূলকভাবে, যা বাংলাদেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে একটি টিভি থাকলেই দেখা যায়, একটি ভালো উপকরণ হতে পারত। এছাড়া, নানান শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিশেষত বেসরকারি, তাদের নিজেদের মত করে শিক্ষাপ্রদান ও মূল্যায়ন ব্যবস্থা জারি রেখেছে। বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়ে কোথাও কোথাও তাৎক্ষণিক চলৎসাক্ষাৎকার (synchronous video conferencing) ও সময়সাপেক্ষ আলোচনা ক্ষেত্রের (asynchronous discussion forums) ব্যবহার করা হচ্ছে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও তাইই হচ্ছে ক্ষেত্রবিশেষে। সামগ্রিকভাবে গবেষণাগারভিত্তিক গবেষণা আপাতত বন্ধ রয়েছে। তবে পরবর্তী শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হওয়ার বা মাধ্যমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণীতে যাওয়ার বা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বর্ষ থেকে অন্য বর্ষের বা স্নাতক শেষ করে স্নাতকোত্তর শ্রেণীতে বা স্নাতকোত্তর শেষ করে ডক্টরেট ডিগ্রিতে যাওয়ার বিষয়গুলো এখনো পুরোপুরি সুরাহা হয়নি। মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা করা হলেও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা গেছে আটকে, কখন শুরু হবে তারও সুনির্দিষ্ট কোনো ঠিকঠিকানা নেই। গবেষণার ব্যাপ্তি বাংলাদেশে কম বলে সেদিকে খুব বড়সড় সমস্যা না-হওয়ার সুযোগই বেশি।

এই কোভিডকালে দূর শিক্ষণ পদ্ধতি যেমন বাধ্যতামূলক হয়ে পড়েছে, তেমনই এর বেশ কিছু সমস্যাও আছে। উন্নত বিশ্বের বেলায় যেমন, তেমনি আমাদের দেশেও। উন্নত বিশ্বে বিদ্যালয়গুলোয় বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে শিশুদের খাবার দেওয়া হত। অনেক বিদ্যালয়ে সেসব বন্ধ হলেও কোথাও কোথাও সেসব সীমিত আকার চালু রাখা হয়েছে যেহেতু অনেক দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত পরিবারের ওপর চাপ পড়ে যায়। কিন্তু এর সাথে সংক্রমণের ঝুঁকিও বাড়ে বৈকি। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে মিড ডে মিল চালু রাখা হয়েছে বেশ কিছু রাজ্যে যার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ ও কেরালা অন্যতম। এছাড়া শিশুদের এবং বড়দের শরীরচর্চা ও মানসিক সমস্যাও দেখা দিতে পারে এই বদ্ধাবস্থায়।

উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সাধারণত মানসিক অবস্থার অবনতি হলে পরামর্শক থাকেন যা এখনো চলমান।

এছাড়া, ইন্টারনেট সংযোগ, যন্ত্রপাতির অভাব, হাতেকলমে কাজ শেখার অসম্ভাব্যতা, মূল্যায়ন পদ্ধতির পরিবর্তন এসব সমস্যা নিয়ে আরো অনেক কাজ করার আছে। বিত্তভিত্তিক শ্রেণীপার্থক্যের সমস্যাও প্রকটতর হয়েছে উন্নত দেশগুলোতে এই কোভিডকালীন শিক্ষাব্যবস্থায়। দরিদ্রেরা বরাবরের মতনই পিছিয়ে গেছে নানাদিকে। কর্মরত দম্পতির সন্তানদের আশ্রয়স্থল হিসেবে দিবাযত্ন কেন্দ্রগুলোও বন্ধ যা আরো সমস্যা বাড়িয়েছে।

সমস্যার এখানেই শেষ নয়। শিক্ষকেরা সন্দেহ করছেন, শিশুরা ঘরে-থাকায় তাদের ওপর পরিবারের সদস্যদের নির্যাতন বা নিপীড়নগুলোও প্রকাশ্য হচ্ছে কম। এমনিতেই গৃহবন্দি দশা মানসিক অবস্থা অবনত করতে প্রভাব রাখে। নারীদের ওপর এই সময়ে নির্যাতন নানা দেশে বেড়ে গেছে বলে জানা গেছে যদিও শিশুদের ব্যাপারে তেমন তথ্য মেলেনি। কিন্তু সেটা হওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

বাংলাদেশে এমনিতেই শিক্ষার মান ও শিক্ষিতের হার উন্নত দেশের তুলনায় পিছিয়ে। এই দুর্যোগে সেটা আরো পিছিয়ে পড়ছে। ঝরে-পড়ার আশঙ্কা বেড়েছে, শিক্ষাজীবন দীর্ঘায়িত হওয়ার ঝুঁকি বেড়েছে, এবং দূর শিক্ষণ পদ্ধতি খুব বেশি ফলপ্রসূ হওয়ার তেমন প্রমাণ মিলছে না।

এই দুঃসময় দ্রুত যাওয়ার নয়। তাই নতুন বাস্তবতার সাথে মিলিয়ে উন্নত বিশ্বের মত আমাদেরও নতুন পথ খুঁজে বের করতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থা ও কোভিড-১৯ পরিস্থিতে এমন পথ খুঁজতে হবে যা আমাদের আর্থসামাজিক পরিস্থিতি ও এই বাস্তবতার সাথে মানানসই। শিক্ষা পরিস্থিতির দুর্বলতর অবস্থা আরো ক্ষতিগ্রস্ত হোক, এটা আমরা কেউই আশা করি না। একটি সভ্য দেশ গড়ার প্রচেষ্টায় সেটা আমাদের জন্যে নিতান্তই বড় ক্ষত ও ক্ষতির কারণ হবে। শিক্ষার সাথে জড়িত বিশেষজ্ঞ, শিক্ষক, কারিগরি বিশেষজ্ঞ, অভিভাবক প্রতিনিধি, ও ছাত্র প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত দলের সমন্বিত চিন্তা ও প্রচেষ্টাই আমাদের উত্তরণের সহায়ক হতে পারে।

আমরা আমাদের দেশের শিক্ষা পদ্ধতির মসৃণতর অভিযাত্রা চাই নতুনতর স্বাভাবিকতায়।

প্রাসঙ্গিক তথ্যসূত্র

https://mohonsworldnu.com/archives/5459

https://www.newamerica.org/education-policy/reports/pandemic-planning-for-distance-learning-scenarios-and-considerations-for-prek12-education-leaders/introduction/#context

Sending
User Review
0 (0 votes)

লেখক সম্পর্কে

হিল্লোল দত্ত

হিল্লোল দত্ত

হিল্লোল দত্ত একজন ব্যাংকার। মূলত পাঠে আগ্রহী। জীবন ও সমাজের পরিবর্তন দেখার ইচ্ছে। অনুবাদক।

মন্তব্য লিখুন