শিক্ষার্থীর সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় বিদ্যালয়ের ভূমিকা রয়েছে। বাস্তব জীবনে আমরা অনেক বিষয়ের মুখোমুখি হই যেগুলো আমাদের আলাদা কিছু দক্ষতার দ্বারা সমাধান করতে হয়।

উপরের শ্রেণির অনেক শিক্ষার্থীকে (বাংলা ও ইংরেজি উভয় মাধ্যমেই) দেখেছি বড়দের সাথে এবং অপরিচিত একজন লোকের সাথে কিংবা কোনো ব্যক্তি যার সাথে বারবার দেখা হচ্ছে, তাকে কীভাবে সম্বোধন করতে হয় তা শিক্ষার্থীদের অনেকেই জানে না। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে পুঁথিগত শিক্ষা আমাদের বাস্তব জীবনের অনেক চাহিদাই মেটাতে পারে না। এগুলো পরিবেশ ও বিদ্যালয় থেকে শিখতে হয় অপুঁথিগত বিষয় হিসেবে। বিদ্যালয় সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং উপাদান।

বর্তমানে অনেক বেসরকারি সংস্থায় নারী গাড়িচালক দেখা যায়। ব্র্যাক এদিক দিয়ে বেশ এগিয়ে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের, পাহাড়ি অঞ্চলের এবং নিভৃত পল্লীর মেয়েরা ব্যস্ততম ঢাকায় এসে গাড়ি ড্রাইভিং শিখেছেন। চাকরি করছেন বিভিন্ন দেশি ও বিদেশি সংস্থায়।

তাদের সাথে সময় পেলেই কথা বলি। অবাক হতে হয় তাদের সামাজিকীকরণের বিষয়টি দেখে। চমৎকারভাবে তারা মানিয়ে নিয়েছেন ঢাকার ব্যস্ততম জীবনের সাথে। মানিয়ে নিয়েছেন অফিসের ব্যস্ততা ও কর্মকর্তাদের কাজের সাথে নিজেদের। চমৎকারভাবে কথা বলেন এই মেয়েরা, খোঁজখবর রাখেন দেশ-বিদেশের রাজনীতির। এ এক চমৎকার ও সফল সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার উদাহরণ।

আর ছেলে গাড়িচালকদের তো কথাই নেই, অসাধারণ তাদের অ্যাডাপ্টাবিলির ক্ষমতা। এসব গাড়িচালক যখন বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছে, তখন তারা হয়তো এতো স্মার্ট ছিলো না। ব্র্যাক ও কেয়ারের ড্রাইভিং বিদ্যালয় তাদের ঘুমন্ত প্রতিভা বিকাশের চমৎকার সুযোগ তাদেরকে এ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে।

আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রাক-প্রাথমিক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সর্বত্রই এ্যাকাডেমিক ফলাফলের জন্য সবাই মহাব্যস্ত। অথচ এসব প্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়ে আসার পর অনেকে সমাজে যেসব বাস্তব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয় সেগুলো সঠিকভাবে বা সাফল্যজনকভাবে মোকাবিলা করতে পারে না।

আমি ক্যাডেট কলেজে থাকাকালীন ক্যাডেট কলেজ থেকে পাস করে আসা মেধাবী শিক্ষার্থীদের সেনা অফিসার নিয়োগ পরীক্ষায় (আইএসএসবি) জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, বর্তমানে বাজারে চালের কেজি কতো করে? মোটা চাল কতো করে আর চিকন চাল কতো করে? কেউই সঠিক উত্তর দিতে পারেনি। তখন চালের কেজি ছিলো দশ থেকে পনের টাকা। ওদের কেউ বলেছে, তিন টাকা বা চার টাকা; কেউ কেউ বলেছিলো ত্রিশ টাকা, বত্রিশ টাকা ইত্যাদি। ফলে সেনাসদরের এজিস ব্রাঞ্চ (যে ব্রাঞ্চ ক্যাডেট কলেজ পরিচালনা করে) ক্যাডেট কলেজগুলোর অধ্যক্ষদের বলেছিলেন যে, ক্যাডেট কলেজগুলো কোচিং সেন্টার নয় যে শুধু এ্যাকাডেমিক বিষয়ে ভালো হলেই চলবে।


আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রাক-প্রাথমিক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সর্বত্রই এ্যাকাডেমিক ফলাফলের জন্য সবাই মহাব্যস্ত। অথচ এসব প্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়ে আসার পর অনেকে সমাজে যেসব বাস্তব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয় সেগুলো সঠিকভাবে বা সাফল্যজনকভাবে মোকাবিলা করতে পারে না।


ক্যাডেটরা অবশ্য খেলাধুলা, শারীরিক শিক্ষা, সাংস্কৃতিক কার্যকলাপ, প্রাথমিক সামরিক প্রশিক্ষণ এবং অতিরিক্ত শিক্ষাক্রমিক কার্যক্রম অনেক কিছুই করে থাকে। তারপরেও সমাজের কিছু বাস্তব বিষয় সম্পর্কে তারা জানে না। সে শিক্ষাকে সাফল্যজনক শিক্ষা বলা যায় না যে শিক্ষা শিক্ষার্থীকে প্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়ে আসার পর বাস্তব জীবনের সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য প্রস্তুত করে না।

শিশুকে নানাভাবে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার দ্বারা সমাজের উপযুক্ত সদস্য হিসেবে গড়ে তোলা হয়। এই প্রক্রিয়ার নাম সামাজিকীকরণ। এটি একটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া। শিশুর জন্মের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত চলে এ প্রক্রিয়া।

সমাজবিজ্ঞানী কিংসলে ডেভিসের মতে, সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার দ্বারা মানবশিশু পুরোপুরি সামাজিক মানুষে পরিণত হয়। প্রক্রিয়া ছাড়া শিশু তার ব্যক্তিত্বলাভে ব্যর্থ হয় এবং সমাজে সে একজন যোগ্য ও উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারে না।

অগবর্ন ও নিমকফ বলেন যে, সামাজিকীকরণ ছাড়া সমাজে জীবনযাপন একেবারেই সম্ভব নয় এবং সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার দ্বারা ব্যক্তি তার গোষ্ঠীর সঙ্গে মেলামেশায় সামাজিক মূল্যবোধ বজায় রাখে।

সমাজবিজ্ঞানী RT Schaefer-এর মতে, ‘ÔSocialization is the process whereby people learn the attitude, values and actions appropriate to individuals as member of a particular culture’। অর্থাৎ সামাজিকীকরণ হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে একটি নির্দিষ্ট সমাজের সদস্য হিসেবে ব্যক্তি তার নিজস্ব সমাজের মনোভাব, মূল্যবোধ এবং কার্যাবলি রপ্ত করে।

আমাদের বিদ্যালয়সমূহ পাঠগত জ্ঞান ও দক্ষতা বিতরণ করা ছাড়াও কতোগুলো দায়িত্ব পালন করে থাকে যেগুলো সমাজ জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সমাজে এগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে দেখা হয় না, ফলে শিক্ষার্থীরা সামাজিকীকরণ বিষয়ে পিছিয়ে থাকে।

আমরা যদি কোনো শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞেস করি, বিদ্যালয়ে তুমি কী শিখেছো? শিক্ষার্থী উত্তর দেবে যে, সে কোন কোন বিষয় শিখছে বা পড়ছে কিন্তু সে কখনই বলবে না যে, সে বন্ধু-বান্ধবদের সাথে ঘুরছে, আড্ডা দিচ্ছে ইত্যাদির কথা। সে শুধু বলবে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ইত্যাদি শিখছে। কিন্তু সে যে বন্ধু-বান্ধবদের সাথে থেকে কথা বলা শিখেছে, বিভিন্ন ধরন শিখেছে, কোন পরিবেশে কীভাবে কথা বলতে হয় শিখেছে তা কিন্তু সে বলছে না।


বিদ্যালয় কিন্তু দু’ধরনের কাজই করছে যাকে স্পষ্ট ও সুপ্ত কাজ বলা যেতে পারে। আমরা দৃশ্যমান কাজটিরই গুরুত্ব বেশি দিয়ে থাকি।


বিদ্যালয় কিন্তু দু’ধরনের কাজই করছে যাকে স্পষ্ট ও সুপ্ত কাজ বলা যেতে পারে। আমরা দৃশ্যমান কাজটিরই গুরুত্ব বেশি দিয়ে থাকি। আর তাই শিক্ষার্থী পাঠ্যবইয়ের বিষয় ছাড়া অন্য কথাগুলো আর বলছে না। সেও বুঝতে পারছে যে, ওগুলোর কথা কেউ জানতে চাচ্ছে না। কিন্তু ওই বিষয়গুলোরও যে অনেক গুরুত্ব রয়েছে সে কথা আমরা প্রায়শই ভুলে যাই।

জন্মের পর মানবশিশু একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে লালিত-পালিত হয় এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানের সংস্পর্শে এসে সমাজের একজন কাঙ্ক্ষিত সদস্য হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলে। এই ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় যেসব উপাদান ব্যক্তিকে একজন সামাজিক সদস্য হিসেবে গড়ে তোলে সেগুলোর মধ্যে বিদ্যালয় অন্যতম।

শিশু যখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যায় তখন সে দুটো সামাজিকীকরণ প্রভাবের কবলে পড়ে। যেমন, শ্রেণিশিক্ষক, অন্যান্য শিক্ষক ও সহপাঠী। শিশুকাল থেকে বৃদ্ধ হওয়া পর্যন্ত চলে সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া।

শিশুরা একটি বিশাল অংশের সময় কাটায় একে অপরের সাথে এবং এটি করতে গিয়ে একে অপরের ওপর মারাত্মক প্রভাব বিস্তারের সুযোগ পায়। একইভাবে বয়স্কদের ক্ষেত্রেও সহপাঠীদের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন, যোগাযোগ, মেলামেশা, চলাফেরা করা যেগুলো সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা পালন করে।

সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে বিদ্যালয়ের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পরিবারে জন্মের পর শিশু বিদ্যালয়ের সংস্পর্শে আসে এবং বিভিন্ন শিশুর সঙ্গে মিলেমিশে শিক্ষাগ্রহণ করে। বিদ্যালয় সমাজের একটি অংশ। এখানে এসে শিশু নিতেও শেখে এবং দিতেও শেখে, যা তাকে বৃহত্তর সমাজজীবনের সাথে খাপ খাইয়ে চলতে সাহায্য করে।

শিশুদের সমাজের চাহিদা অনুযায়ী উপযোগী মানুষ হিসেবে গড়ে তোলাই হচ্ছে শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য। অতএব বিদ্যালয়ের দায়িত্ব শুধু পাঠ্যপুস্তকের শিক্ষাই দান করা নয় বরং শিশুকে সমাজের আদর্শ ও মূল্যবোধ অর্জনের শিক্ষা দেওয়াও।

সমাজবিজ্ঞানী এমিল ডুর্খেইম বলেন, ‘কেবল বৃহত্তর সমাজের জীবন ধারাগত বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে পরিচয় করানো শিক্ষার একমাত্র কাজ নয়। পারিপার্শ্বিক  পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে যাতে চলতে পারে তার জন্য শিক্ষার্থীদের প্রস্তুত করাও শিক্ষার অন্যতম কাজ’।

শিশুদের বৃদ্ধি ঘটে নানাভাবে যখন তারা শিশু থেকে বড় হতে থাকে। তারা শুধু শারীরিকভাবেই বেড়ে ওঠে না, মানসিকভাবেও বেড়ে ওঠে। প্রতিটি শিশুই সুষম ব্যক্তিত্বের গড়ন নিয়ে বড় হতে থাকে যার ফলে কেউ হয় লাজুক, কেউ উচ্চাভিলাষী, মিশুক, সাবধানী ইত্যাদি। শিশু যখন বড় হওয়া শুরু করে তখন সে তার চারদিকের বিশাল জগতের ব্যক্তিত্ব, কার্যাবলি এবং অনুভূতি নিয়ে বেড়ে ওঠে।

বিস্তৃত অঙ্গনে প্রবেশের হাতেখড়ি শিশু বিদ্যালয় থেকেই অর্জন করে। শিশুর সামাজিকীকরণে বিদ্যালয়ের গুরুত্ব সম্পর্কে সমাজবিজ্ঞানী সলোমন বলেন, ‘The school must be looked upon as a force and secondary importance is only to the home in the development of human personality’।

সামাজিকীকরণ দ্বারা বুঝায় এক ধরনের পদ্ধতি যা ব্যক্তিকে নিজস্ব সত্তা অর্জন করতে শেখায়। পাশাপাশি অন্যের সাথে চলার জন্য জ্ঞান, ভাষা ও সামাজিক দক্ষতাসমূহ অর্জন করা বুঝায়। শিক্ষক ও শিক্ষার সাথে জড়িত সংশ্লিষ্টদের তৈরি এ্যাকাডেমিক শিক্ষাক্রমই শিক্ষার্থীরা শেখে না, তারা সামাজিক নিয়মকানুন এবং সমাজে চলার জন্য অন্যের সাথে কীভাবে আচার-আচরণ করতে হয় তাও শেখে।

সামাজিকীকরণের সাথে সাথে বিদ্যালয় আরেকটি স্পষ্ট কাজ করে থাকে আর তা হচ্ছে সাংস্কৃতিক নিয়মকানুন ও ধারা এবং মূল্যবোধ নতুন প্রজন্মের মধ্যে বাহিত করা। বিদ্যালয় বিভিন্ন ধরনের শিক্ষার্থীকে উপযোগী করে তৈরি করে একটি সমাজে প্রতিষ্ঠিত করে যেখানে সবাই একই  জাতীয় পরিচয় বহন করে এবং দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠে। নাগরিক শিক্ষাপ্রদান করে তাদের দেশপ্রেমিক হতে উদ্বুদ্ধ করে।

উদাহরণস্বরূপ, তারা বিদ্যালয়েই শেখে কীভাবে জাতীয় পতাকাকে সম্মান করতে হয়। জাতীয় বীরদের কীভাবে সম্মান জানাতে হয়। আর এ বিষয়গুলো শিক্ষার্থীদের অর্থাৎ দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিকদের শেখানোর দায়িত্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের। পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যারা শিক্ষাদান করেন তাঁদের।

শিক্ষকতা পেশা এজন্যই অন্যান্য পেশা থেকে আলাদা। একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীদের শুধু লেখাপড়াই শেখান না, সামাজিক দক্ষতাগুলো অর্জন করানোর জন্যও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কাজ করেন। বর্তমান যুগে সামাজিক দক্ষতাগুলোর গুরুত্ব আরও বেড়ে যাচ্ছে, ফলে বিদ্যালয়গুলোকে সেভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে।

সমাজে বর্তমানে চলছে এক অরাজক পরিস্থিতি। মেয়েরা বিদ্যালয়, মাদ্রাসা, রাস্তাঘাট, হাটবাজার কোথাও নিরাপদ নয়। তারা অন্য কোনো গ্রহের বাসিন্দা নয়, জঙ্গল থেকে আসা কোনো প্রাণী নয়। আমাদের সবার ঘরেই তারা নিতান্ত আপনজন, পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য।

অথচ তারা বাইরে বের হলেই অনেক নাজুক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে শিস বাজানো, কুরুচিপূর্ণ অঙ্গভঙ্গি করা, আজেবাজে মন্তব্য এমনকি ওড়না ধরে টান দেওয়া। তারপর ডাকাতের মতো, ছিনতাইকারীর মতো মেয়েদের ধরে নিয়ে ধর্ষণ করা, গণধর্ষণ করা। এটি হচ্ছে বাসে, রাস্তায়, পথে, নির্জন স্থানে, ঘরে, গার্মেন্টসে, অফিসে সর্বত্র। সমাজের এই চিত্র কীভাবে হলো?

অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তিবিধান নিশ্চিত করা না গেলে এর পুনরাবৃত্তি হতে থাকে। বিদ্যালয়েরও এখানে রয়েছে বিরাট ভূমিকা। বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের বুঝাতে হবে, যেসব মেয়ে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে, বাজারে যাচ্ছে, বিদ্যালয়ে যাচ্ছে তারা আমাদের ঘরের এবং সমাজের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। তাদেরও পূর্ণ অধিকার রয়েছে আমরা যেভাবে চলাফেরা করি সেভাবে করার।


শিক্ষকতা পেশা এজন্যই অন্যান্য পেশা থেকে আলাদা। একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীদের শুধু লেখাপড়াই শেখান না, সামাজিক দক্ষতাগুলো অর্জন করানোর জন্যও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কাজ করেন। বর্তমান যুগে সামাজিক দক্ষতাগুলোর গুরুত্ব আরও বেড়ে যাচ্ছে, ফলে বিদ্যালয়গুলোকে সেভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে।


শিক্ষার্থীদের আমরা বলতে পারি, ধরো, তোমার বোনের ওপর ওরকম হামলা হলো, তখন তোমার কেমন লাগবে? একইভাবে যেসব মেয়ের প্রতি অশালীন কর্থাবার্তা ছুড়ে দেওয়া হয় তাদের ভাইবোন, মা-বাবা এবং আত্মীয়-স্বজনদের কেমন লাগবে, তাদের কাছে ব্যাপারটি কেমন মনে হবে? নিজেকে সেই স্থানে বসাও। তুমি যেমন চাও না তোমার বোনকে, তোমার মাকে অন্য কেউ খারাপ কথা বলবে, কটূক্তি করবে। তাদের দিকে খারাপ দৃষ্টিতে তাকালে তোমার যেমন মনে হবে, অন্য মেয়েদের প্রতি আমরা যদি তেমনটি করি তাহলে তাদেরও ঠিক তেমনই লাগবে।

কাজেই আমরা এটি করবো না। এটি পরিবার, সমাজ ও ব্যক্তিজীবনেও পতন ডেকে আনে, ধ্বংস ডেকে আনে। এ কুঅভ্যাসগুলো আমরা অবশ্যই পরিহার করবো।

উঠতি বয়স থেকেই ছেলেরা এগুলো করতে শুরু করে। ধীরে ধীরে তারা চরম বখাটে, মাস্তান, ধর্ষক এবং খুনিতে পরিণত হয়। বিদ্যালয় থেকে সামাজিকীকরণের ওপর ভালো শিখন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে তার সুপ্রভাব সমাজে অনেকটাই পড়বে।

সমাজে এখন যে অবস্থা বিরাজ করছে, তা দেখে শিক্ষকরা ভাবতে পারেন যে, এ ক্ষেত্রে আমাদের কিছুই করার নেই। তা নয়। আমরা বিদ্যালয় থেকে শুরু করি কারণ এসব ছেলেমেয়েই দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিক। তারাই সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করতে যাচ্ছে। কাজেই তাদের সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়াটি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলে সমাজে ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসবে। বর্তমানকালে বখাটেরা সারাজীবন বখাটেপনা করতে পারবে না। তারা সমাজ থেকে, পৃথিবী থেকে এক সময় বিদায় নেবে, সেখানে নতুন প্রজন্ম সুন্দর চিন্তাচেতনা নিয়ে তাদের সেই জায়গা দখল করবে।

কাজের সুবাদে প্রতিদিনই বিভিন্ন ধরনের শিক্ষকের সাথে কথা হয়, ফোনালাপ হয়। শিক্ষকদের মধ্যে সামাজিকীকরণের বিষয়টি প্রত্যক্ষভাবে দেখা ও জানার সুযোগ এটি।

এখানকার অভিজ্ঞতা একটু কষ্টের। অনেক শিক্ষকের মাঝেই দেখেছি তাঁরা জানেন না কীভাবে নতুন কোনো মানুষের সাথে, অন্য একজন শিক্ষকের সাথে কথা বলতে হয়, কীভাবে সম্বোধন করতে হয়, আলোচনা শুরু করতে হয়, কোন বিষয় কীভাবে উপস্থাপন করতে হয়। যারা বাংলা-ইংরেজি পড়ান, তাঁদের মধ্যে দু’চারজন পাওয়া যায় যারা একটু কাঙ্ক্ষিত মানের। কিন্তু অন্যান্য বিষয় যেমন, গণিত, বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান যেসব শিক্ষক পড়াচ্ছেন তাঁদের অনেকেরই সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় রয়েছে বিশাল ঘাটতি।

এটি হয়তো তাঁদের দোষ নয় কারণ এ-ধরনের শিক্ষাগ্রহণের ক্ষেত্রে তাঁদের প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যা ছিলো কিংবা সেরকম পরিবেশও তারা পাননি। তবে একুশ শতকের শিক্ষক হিসেবে এগুলো তাঁদের অবশ্যই আয়ত্ত করতে হবে। তা না হলে তাঁরা কীভাবে দেশের জন্য যোগ্য ও দক্ষতাসম্পন্ন নাগরিক তৈরি করবেন?

Sending
User Review
1 (1 vote)

লেখক সম্পর্কে

মাছুম বিল্লাহ

মাছুম বিল্লাহ

মাছুম বিল্লাহ ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত রয়েছেন। তিনি সাবেক ক্যাডেট কলেজ, রাজউক কলেজ ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। বর্তমানে তিনি ইংলিশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইট্যাব)-এর প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

মন্তব্য লিখুন