সান্ধ্যকোর্স পরিচালনা করেন মূলত ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের উক্ত বিষয়ের নিয়মিত কোর্সের শিক্ষকদেরই একটি অংশ। এই কোর্স পরিচালনার মাধ্যমে তারা অতিরিক্ত অর্থ উপার্জন করতে পারেন, যা তাদের মূল বেতনের থেকে আলাদা।
আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাদির অপ্রতুলতা আছে, এটি অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। ফলে সান্ধ্যকোর্স যে অতিরিক্ত অর্থ আয়ের রাস্তা তৈরি করে দিচ্ছে, তাতে অনেক শিক্ষকই আকৃষ্ট হন বা হচ্ছেন।
আবার, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকদের গবেষণার জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে যে থোক অর্থ বরাদ্দ করা হয়, তা এতই নগণ্য যে, অনেক শিক্ষকই মনে করেন এ-দিয়ে ভালোমানের কোনো গবেষণা পরিচালনা করা সম্ভব না। তদুপরি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকদের গবেষণার প্রয়োজনীয়তা ও চাহিদার ওপর ভিত্তি না করে বরং সকল শিক্ষকদের মধ্যেই মাথাপিছু হারে গবেষণাভাতা হিসেবে এই অর্থ বণ্টন করার চর্চা রয়েছে বলে জানা যায়। সেটিও কতটুকু যৌক্তিক, সেই প্রশ্ন তো থাকছেই!
আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাদির অপ্রতুলতা আছে, এটি অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। ফলে সান্ধ্যকোর্স যে অতিরিক্ত অর্থ আয়ের রাস্তা তৈরি করে দিচ্ছে, তাতে অনেক শিক্ষকই আকৃষ্ট হন বা হচ্ছেন।
ফলে দেখা যাচ্ছে, নিয়মিত শিক্ষার্থীদের নিয়মিত ক্লাসের বাইরেও অতিরিক্ত সময় দেওয়া কিংবা নতুন জ্ঞান সৃষ্টির লক্ষ্যে নানামুখী গবেষণায় নিজেদের নিযুক্ত করার যে চর্চা ও দায়বদ্ধতা বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের শিক্ষকদের নিকট সারা বিশ্বেই প্রত্যাশিত ও চর্চিত, সেখানে মারাত্মক ধরনের ব্যাতয় ঘটছে সান্ধ্যকোর্সের সাথে যুক্ত শিক্ষকদের বড় অংশের ক্ষেত্রে। এটি কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয়। এর ফলে প্রায়শই নিয়মিত শিক্ষার্থীদের নিকট থেকে শিক্ষকের কাছ থেকে পর্যাপ্ত সময় না পাওয়ার অভিযোগ উঠে আসছে নানা মাধ্যমে, পাশাপাশি গবেষণার কার্যক্রমেও ঘাটতি লক্ষ্যণীয়, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল স্পিরিটকেই ক্ষতিগ্রস্থ করছে।
এসব সমস্যাকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্যকোর্সের পক্ষে মতামত দানকারীদের যুক্তি অনুযায়ী সান্ধ্যকোর্স বহাল রেখে উপর্যুক্ত সমস্যাগুলোর সমাধান খোঁজার প্রয়াস সাময়িকভাবে দুয়েকটিসমস্যার খানিক সমাধান দিলেও মূল সমস্যা দীর্ঘমেয়াদে প্রকট হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। যে-কারণে সান্ধ্যকোর্স নামের কোর্সগুলোকে বহাল রাখার শর্টকার্ট সমাধানের রাস্তা থেকে বেরিয়ে এসে কিছুটা বিস্তৃত পরিসরে দেশের সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রে এই সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য কিছু ধারাবাহিক পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
উচ্চশিক্ষাকে যুগোপযোগী, কার্যকর, এর বিভিন্ন স্তরে যোগ্যতার নিরিখে সকলের জন্য প্রবেশগম্যতার সুযোগের সমতা বিধান এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সত্যিকার অর্থে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে কিছু করণীয় নিচে তুলে ধরতে চেষ্টা করছি। নীতিপ্রণেতা ও বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষসহ সকলেই তা ভেবে দেখতে পারেন।
১. পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাচেলর ও মাস্টার্স লেভেলের কোর্সগুলোর লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এবং ভর্তি প্রক্রিয়ার সংস্কার ও আধুনিকায়ন করা জরুরি। বিশেষত, ব্যাচেলর লেভেলে যারা নিয়মিত শিক্ষার্থী হিসেবে ভর্তি হন, সম্পূর্ণ কোর্স কোনোভাবে শেষ করতে পারলেই তাদের সকলের জন্য নিয়মিত মাস্টার্স লেভেলের সংশ্লিষ্ট কোর্সে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভর্তি হতে পারার যে সুযোগ এখন পর্যন্ত রয়েছে, সেটির পরিবর্তন হওয়া জরুরি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাচেলরের পাশাপাশি মাস্টার্স লেভেলের কোর্সেও সুনির্দিষ্ট যোগ্যতা ও প্রয়োজনে ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়মিত-অনিয়মিত নির্বিশেষে যেকোনো শিক্ষার্থীর ভর্তি হওয়ার জন্য সুযোগের সমতাবিধান নিশ্চিত করতে হবে।
২. উচ্চতর গবেষণা ও পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে মাস্টার্স লেভেলের কোর্সগুলোকে প্রয়োজনে দুইভাগে ভাগ করে পরিচালনা করার পদক্ষেপ নিতে হবে। সেক্ষেত্রে উচ্চতর গবেষণায় আগ্রহীদের জন্য থিসিসভিত্তিক মাস্টার্স ও পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধিতে আগ্রহী শিক্ষার্থীদের জন্য নন-থিসিসভিত্তিক প্রফেশনাল মাস্টার্স কোর্সের আয়োজন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ করতে পারে। আলাদা করে সান্ধ্যকোর্স নামে কিছু চালানোর প্রয়োজন হবে না সেক্ষেত্রে।
৩. পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ধরনের মাস্টার্স কোর্সকেই অবাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গী ও নীতিতে চালানোর পক্ষপাতি আমি ব্যক্তিগতভাবে। তারপরেও রাষ্ট্রীয়ভাবে অর্থ জোগানের সীমাবদ্ধতাটুকুকে কিছুটা হলেও যদি মেনে নেই, সেই প্রেক্ষাপটেও গবেষণাধর্মী মাস্টার্স ও প্রফেশনাল মাস্টার্সের জন্য শিক্ষার্থীর খরচের ব্যবধান কোনোভাবেই দ্বিগুণের বেশি হওয়া কাম্য নয়। সেক্ষেত্রেও প্রফেশনাল মাস্টার্স কোর্সের শিক্ষার্থীদের একটি নির্দিষ্ট অংশকে (হতে পারে ২০%) মেধার ভিত্তিতে গবেষণাধর্মী মাস্টার্স কোর্সের শিক্ষার্থীর সমপরিমাণ খরচে সমাপ্ত করার সুযোগ দেওয়ার বিধান রাখতে হবে।
৪. পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার খরচ জোগানোর দায়িত্ব মূলত রাষ্ট্রেরই, সারা বিশ্বেই তাই। সেক্ষেত্রে নানা প্রেশার গ্রুপ তৈরির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উচিৎ হবে তাদের বাজেট বাড়ানোর ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে অধিকতর সক্রিয় ভূমিকায় নিতে যাওয়ার জন্য নানামুখী অ্যাডভোকেসি কার্যক্রম পরিচালনা করা।
৫. বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য শিক্ষার্থীদের শিক্ষাব্যয় না বাড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অ্যাালামনাইদের কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা ধরনের উন্নয়ন কার্যক্রমে যুক্ত করা যায় এবং তাদের মাধ্যমে আয়বৃদ্ধির নানা পদ্ধতি চিন্তা ও তার বাস্তব রূপান্তর ঘটানো সম্ভব, তা নিয়ে পাবলিক-প্রাইভেট সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষই ভাবতে পারেন। পৃথিবীর নামকরা প্রচুর বিশ্ববিদ্যালয়েরই এই অ্যালামনাইদেরকে যুক্ত করে নানা ধরনের উদ্যোগ রয়েছে। আমাদের নীতিপ্রণেতারা সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে তা প্রয়োগের চেষ্টা করতে পারেন। পাশাপাশি, বিভিন্ন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশের ওপরে সরকার নির্দিষ্ট হারে শিক্ষা কর ধার্য করতে পারে কিংবা তাদের সিএসআর (CSR) যে ফান্ড থাকে, তার একটা অংশ শিক্ষাখাতে ব্যয় করার লক্ষ্যে সরকার একটি ট্রাস্ট গঠন করে সেখান থেকে শিক্ষার বিভিন্ন স্তরের পাবলিক ইনস্টিটিউশনগুলোর জন্য অর্থ বরাদ্দের ব্যবস্থা করতে পারে। এতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপকৃত হওয়ার সুযোগ বাড়বে।
৬. একটু পুরাতন আলাপ হলেও এটি জরুরি যে, শুধু বিশ্ববিদ্যালয় স্তরেই না, শিক্ষার সকল স্তরের সাথে জড়িত শিক্ষকদের বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর জন্য শিক্ষকদের জন্য সম্পূর্ণ আলাদা বেতন কাঠামো নির্ধারণ করতে রাষ্ট্রকে বাধ্য করতে হবে। শিক্ষা যে রাষ্ট্রের সবচেয়ে ভালো ও সফল বিনিয়োগের জায়গা, এটি সরকার ও নীতিনির্ধারক কেবল মুখে না আওড়িয়ে যাতে কাজেও পরিণত করে দেখায়, সেটি নিশ্চিত করার জন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক, অ্যালামনাই ও শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে যৌথ উদ্যোগ নিতে হবে।
৭. পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত ও স্থায়ী শিক্ষকদের কোর্স পরিচালনার পাশাপাশি বাধ্যতামূলকভাবে নিয়মিতভাবে আন্তর্জাতিক মানের গবেষণার সুযোগ ও ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। সেখানে শিক্ষকগণ তাদের সেই গবেষণা পরিচালনা, গবেষণাতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের শিক্ষার্থীদেরও প্রয়োজনে যুক্ত করা ও গবেষণাটি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশ করার জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা পাবেন। প্রয়োজনে শিক্ষকদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে এই গবেষণার বিষয়টিকে আরো ঘনিষ্ঠ ও কার্যকর নির্ধারক হিসেবে যুক্ত করে দিতে হবে। পাশাপাশি, শিক্ষার্থী কর্তৃক শিক্ষকদের বার্ষিক ভিত্তিতে মূল্যায়নের ব্যবস্থা করাও জরুরি।
উচ্চতর গবেষণা ও পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে মাস্টার্স লেভেলের কোর্সগুলোকে প্রয়োজনে দুইভাগে ভাগ করে পরিচালনা করার পদক্ষেপ নিতে হবে। সেক্ষেত্রে উচ্চতর গবেষণায় আগ্রহীদের জন্য থিসিসভিত্তিক মাস্টার্স ও পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধিতে আগ্রহী শিক্ষার্থীদের জন্য নন-থিসিসভিত্তিক প্রফেশনাল মাস্টার্স কোর্সের আয়োজন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ করতে পারে। আলাদা করে সান্ধ্যকোর্স নামে কিছু চালানোর প্রয়োজন হবে না সেক্ষেত্রে।
৮. কর্মক্ষেত্রে দক্ষ জনশক্তি তৈরির প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিন্ন বৈষম্যহীন প্রফেশনাল মাস্টার্স কোর্সের ব্যবস্থা করা হলেও সেখানে সকলের যে সংকুলান হবে, এমনটিও বাস্তব না। এই উভয় বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধিভুক্ত বিভিন্ন কলেজ বা বিশেষায়িত কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত ব্যবহারের সুযোগ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে বাজার চাহিদা অনুযায়ী দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট বিষয়ভিত্তিক অ্যাডভান্সড ডিপ্লোমা বা সার্টিফিকেশন কোর্সের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সেটি সকালে, বিকেলে, সন্ধ্যায় যেকোনো সময়ই হতে পারে। অংশগ্রহণকারী প্রফেশনালদের জন্য সুবিধাজনক সময় সেইখানে অন্যতম মুখ্য বিবেচনা হবে। তবে সেটিকে কোনোভাবেই অত্যাধিক ব্যয়সাপেক্ষ করা যাবে না। নন-প্রফিট পদ্ধিতিতে এই সমস্ত কোর্সের ব্যয় নির্ধারণ করা যেতে পারে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো নিয়মিত ও স্থায়ী নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকই এই সব কোর্স পরিচালনায় অংশ নিতে পারবেন না, আলাদা যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে তা করতে হবে।
এই প্রস্তাবগুলোই হয়তো যথেষ্ট নয়, আরও ভাবার সুযোগ আছে নিশ্চিতভাবেই। তবে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে প্রকৃত অর্থে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে ও দীর্ঘমেয়াদে এর সমস্যাগুলোর কার্যকর সমাধান নির্ধারণ করতে অবশ্যই সেসব ভাবনাকে উচ্চশিক্ষায় বিভিন্ন স্তরে অংশগ্রহণের জন্য সকল শিক্ষার্থীর সুযোগের সমতার যে নিশ্চয়তা থাকার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, তার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হওয়া বাঞ্ছনীয়।
লেখক পরিচিতি
কামরুস সালাম সংসদ শিক্ষা কর্মী ও সাবেক শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।