আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক জিজ্ঞেস করেছিলেন, “বাংলাদেশে কি কোনো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে?” আমি উত্তরে বলেছিলাম, বাংলাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয় সবই সরকারি (৬৬ হাজার)। এছাড়া বেসরকারি পর্যায়েও ৮০ হাজারের অধিক বিদ্যালয় রয়েছে, তবে সেগুলোর তেমন কোন স্বীকৃতি নেই।
তারপরও একটু স্বচ্ছল পরিবারের ছেলেমেয়েরা বেসরকারিগুলোতে পড়ে বিশেষ করে শহর এলাকায়। তিনি বললেন, “তাহলে সব প্রাথমিক শিক্ষকই এমপিওভুক্ত”? আমি উত্তর দিলাম, “না। এমপিওর বিষয়টি প্রাথমিকে নয়, এটি মাধ্যমিক ও উচ্চ-মাধ্যমিকের ক্ষেত্রে প্রয়োজ্য”।
তৃতীয় প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন, “বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা কোনো শ্রেণি পর্যন্ত? অষ্টম পর্যন্ত তো, তাই না”? আমি বললাম, “না। এটি পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত”। তখন তিনি আমাকে আবার বললেন, “আপনি শিওর”? আমি উত্তর দিলাম, “শিওর। ২০১০ সালের শিক্ষানীতিতে এটি পর্যায়ক্রমে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করার পরামর্শ দেয়া হয়েছিল, কিন্তু সরকার সেটি করতে পারেনি। এত সহজে পারার কথাও নয়”।
আমাদের দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে এ ধরনের অবাক করা প্রশ্ন ও আলোচনা প্রায়শই শুনতে পাবেন। প্রাথমিক শিক্ষাকে যখন অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করার পরামর্শ দেয়া হলো, আমি তখনই বিভিন্ন কাগজে লিখেছিলাম এটি একটি অবাস্তব কথা! কারণ প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করা মানে ৬৬ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতিটিকে কমপক্ষে আরও তিনটি নতুন কক্ষ তৈরি করতে হবে। তার বাজেট কোথায়?
সেই প্রশ্নের কোনো উত্তর ছিলো না। বিগত সরকার তার প্রথম মেয়াদে এটি ঘোষণা দেয়ার পর কোনো বছরই প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীতকরার কোনো বাজেট রাখেনি। বিষয়টি খুর রহস্যজনক মনে হতো!
৬৬ হাজার বিদ্যালয়েই যদি তিনটি করে শ্রেণিকক্ষ নতুন করে করতে হয়, তার মানে কয়েকশত নয়; কয়েক হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন। সেটি কি সম্ভব?
আসা যাক অন্য একটি বিষয়ে। বর্তমানে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যারা পড়াচ্ছেন, তাঁরা কি তাহলে প্রাথমিক শিক্ষক হতে চাইবেন? অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত যদি প্রাথমিক শিক্ষা হয়, তাহলে মাধ্যমিক শিক্ষা দু’বছরেরর হবে, অর্থাৎ নবম ও দশম? আমরা কি মাধ্যমিককে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত করার কোনো বাস্তব পরিকল্পনা হাতে নিতে পেরেছি?
আবার প্রাথমিকে যারা আছেন, তাদের মধ্যে ক’জন ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াতে পারবেন? সেটিরও কোনো জবাব ছিলনা। কিন্তু অবাক করে শুনলাম, তখনকার প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার বললেন, “প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন, কাজেই বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা এখন অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত এবং এটি হয়েই গেছে, এটি নিয়ে আর কোনো কথা নেই”।
আমি সাথে সাথে যুক্তি দিয়ে বললাম, এটি কীভাবে সম্ভব? শুধু ঘোষণা দিলেই কি হয়? উপর্যুক্ত বিষয়গুলোর কী হবে? কিন্তু তাঁর কথা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন, অতএব এটি হয়ে গেছে। কিন্তু এটি যে হবে না, হওয়ার কথাও নয়, সেটি ১৪-১৫ বছর আগেই বলেছিলাম; কারণ বিষয়টি ছিলো সঠিক পরিকল্পানবিহীন।
কিন্তু এর মধ্যে ঝামেলা একটি পাকিয়ে গেছে! দেশের ৭২৯ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত চালু করা হয়েছিল। এগুলোতে কী হচ্ছে সে খবর তেমন একটা পাওয়া যাচ্ছিলো না।
বর্তমানে সরকারির ‘কনসালটেটিভ কমিটি’ সুপারিশ করেছে ওই ৭২৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণি বাদ দিতে হবে। কারণ, তাঁরা খোঁজ নিয়ে দেখেছেন, সেগুলো তেমন প্রোডাকটিভ নয়, নামমাত্র চলছে।
কিন্তু গত এক সপ্তাহ ধরে প্রাথমিক শিক্ষক নেতৃবৃন্দ বিশেষ করে এই ৭২৯টির সাথে যারা জড়িত তাঁরা বলছেন, “এটি হতে দেয়া যাবে না, কারণ শিক্ষাকে পেছন দিকে নেয়া যাবে না, সামনে যেতে হবে”। এ কথার যুক্তি আছে! তাছাড়া একটি বিষয় শুরু করে এভাবে বাদ দেয়া মানে তো শিক্ষকদের জন্য প্রেস্টিজের ব্যাপার।
দ্বিতীয়ত, যেসব এলাকায় কাছাকাছি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নেই, সেসব স্থানের শিক্ষার্থীরা ঝরে যেত যদি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় না থাকতো। দেশ চায় বাল্যবিবাহ রোধ করতে, কিন্তু গ্রামীণ অভিভাবকগণ নিরাপত্তার কারণে ও মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দূরে অবস্থান করায় অধিকাংশ নারী শিক্ষার্থী বাল্যবিবাহরে শিকার হয়।
সেটিও এসব এলাকায় রোধ করা সম্ভব হয়েছে বলে নেতৃবৃন্দ দাবি করছেন। আর পিছিয়ে পড়া শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সরকারি প্রাথমিকে পড়েন, এটি জানাই আছে। তারা যখন এই সুযোগটি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাচ্ছে, সেটি তাদের জন্য একটি আর্শীবাদও।
প্রাথমিক শিক্ষকদের গোলটেবিল বৈঠকে সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খান বলেছেন, “আমরা যখন প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত নিয়ে পারি, তখন শিক্ষার গুণগত মান পরিবর্তন হবে। প্রাথমিক শিক্ষা যেসব স্কুলে অষ্টম শ্রেণি নেই তাদেরকেও এটা বুঝতে হবে। এটা শুধু ৭২৯টি স্কুলের শিক্ষকদের আন্দোলন নয়, এই আন্দোলন সব শিক্ষকদের মর্যাদার লড়াই”।
এটি অবশ্যই শিক্ষকদের মর্যাদার লড়াই। শিক্ষকদের একভাবে রাষ্ট্র মর্যাদা প্রদান করার চেষ্টা করবে, আবার আরেকভাবে নামাবে, সেটি কারুরই কাম্য নয়। তিনি আরও বলেন, “অষ্টম শ্রেণির শিক্ষাকার্যক্রম বন্ধের যে সিদ্ধান্ত, তার বিরুদ্ধে এই আন্দোলন প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থাকে আরো উন্নত করার আন্দোলন। জাতি ও জনগণকে সেবা করার আন্দোলন, বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার আন্দোলন। ৭২৯টি স্কুলে অষ্টম শ্রেণি চালু আছে তা ফেরত নিতে দেবো না। এটি নিয়ে কোনো আপস নয়। বরং আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে আরও সাড়ে চার হাজার স্কুলকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করতে হবে”।
একজন সচিব বা সাবেক সচিব একথা বলতে পারেন। আবার মন্ত্রীও বলেছিলেন যে, প্রধানমন্ত্রী যেহেতু ঘোষণা দিয়েছেন আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা এখন থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত এবং এটি হয়েই গেছে! কিন্তু আমরা সাধারণ নাগরিক হিসেবে দেখেছি এটি সম্ভব ছিলো না এবং এখনও সম্ভব নয়।
সাড়ে চার হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে ডিসেম্বরের মধ্যে অষ্টম শ্রেণিতে উন্নীত করা মানে ‘পান্তাভাত আর কাঁচামরিচ’ নয়। এটি বিশাল রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত! বিশাল অর্থনৈতিক কাণ্ড! আর এটি অন্তবর্তীকালীন সরকারের নিজস্ব কোনো এজেন্ডাও নয়, এটি তাদের দায়িত্বও নয়, এটি তাদের দ্বারা সম্ভবও নয়।
আর ডিসেম্বরের মধ্যে মানে এটি করার বা দাবি করার কোনো মানেও নেই, অন্তত একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে এটি বলতে পারি।
তবে, শিক্ষক নেতৃবৃন্দ বিষয়টির জন্য আন্দোলন চালিয়ে যাবার কথা বলেছেন। বলেছেন, শিক্ষাকে তাঁরা ব্যবসার অংশ হতে দিতে রাজি নন। তাঁরা আরও বলেন যে, এনজিওরা শিক্ষা দেবে আর আমাদের ৬৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকবে না, সেটি তারা হতে দিবেন না।
তবে, এনজিওর সাথে সেই বিষয়টি আর নেই। দেশের শীর্ষস্থানীয় কিছু এনজিও দাতাসংস্থার অর্থে বিশেষ ধরনের প্রাথমিক বিদ্যালয় দেশে চালু করেছিল। এখন অর্থের অভাবে সেগুলো আর সে অবস্থায় নেই। এখানে এনজিওগুলো যা করতে পারতো, তা তারা করেনি। তারা শুধু বেইলি ব্রিজের মতো কাজ করেছে, যার কোনো স্থায়ীত্ব নেই। কাজেই এনজিওগুলোকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
দৈনিক শিক্ষা ও আমাদের বার্তার প্রধান সম্পাদক একবার বিষয়টি নিয়ে এক টকশোতে বলেছিলেন যে, “দুধ একটি পুষ্টিকর খাবার। আনারসও একটি উৎকৃষ্ট দেশি ফল। কিন্তু দুটি ভালো জিনিসকে একত্রে করে খেলে খাদ্যে বিষক্রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকে বেশি। কাজেই সেটি অনেকেই এড়িয়ে চলেন”।
একইভাবে প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বিষয়টি শুনতে খুব ভালো লাগে। দেশের সকল শিশুকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত মৌলিক শিক্ষা দিতে পারলে সেটি রাষ্ট্রের জন্য ও নাগরিকদের জন্য একটি আশির্বাদ; কিন্তু সেটি কি হওয়ার মতো পরিস্থিতি দেশে ছিল বা এখনো আছে?
পৃথিবীর বেশ কিছু দেশে প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত আছে। তবে বেশিরভাগ দেশেই সেটি ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত। সেটি মানানসই আমাদের জন্য অনেকটাই মানানসই। কিন্তু একলাফে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত হওয়ার নয়। সেটি অবাস্তব। যদিও সচিব ও মন্ত্রীরা বলতে পারেন, কিন্তু আমরা পারি না।
স্বাধীনতার ৫৪ বছরেও এটি করা সম্ভব হয়নি। সেটি আমরা কীভাবে ডিসেম্বরের মধ্যে আশা করতে পারি? আগামী বছর নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সরকার রাষ্ট্রক্ষমতায় এলে দেখা যাবে তারা কবে সেটি করতে পারেন কিংবা তাদের এজেন্ডায় প্রাথমিক শিক্ষা কোথায় কী অবস্থায় থাকে সেটি এখন দেখার বিষয়।
তবে, ব্যতিক্রম ছাড়া সরকারি প্রাথমিকের মান নিয়ে প্রশ্ন তো সবার রয়েছেই। এখানে তো কাজ করার আছে অনেক। নেতৃবৃন্দ সেটি নিয়ে সঠিক কোনো পরিকল্পনার কথা বললে বেশি গ্রহণযোগ্যতা পাবে বলে আমি মনে করি।
এখন এই ৭২৯টিকে যদি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসেবে রাখা হয়, তাহলে সেটি হবে এক ধরনের খাপছাড়া ব্যাপার। কারণ, আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা কি পঞ্চম শ্রেণি নাকি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই অধ্যাপক তাহলে আমাকে আবার বলবেন, “বলেছিলাম না যে, আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত! তাই এই ৭২৯টিকে গভীর পর্যবেক্ষণ ও এগুলোর ওপর একটি গবেষণা করে যদি দেখা যায় যে, এখানকার নিম্নশ্রেণির অধিক সংখ্যক শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়গুলোর মাধ্যমে উপকৃত হচ্ছে, কিংবা বিদ্যালয়গুলোতে ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণি পড়ানোর মতো যোগ্য শিক্ষক রয়েছেন, ক্লাস ঠিকমতো হচ্ছে, তাহলে এই বিদ্যালয়গুলোকে সরকারী মাধ্যমিকে রূপান্তরিত করা যেতে পারে।
প্রথমে জুনিয়র হিসেবে প্রথমে চালু রেখে পরবর্তী কয়েক বছরের মধ্যে দশম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করতে হবে। যেসব শিক্ষক ঠিকভাবে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ভালোভাবে পড়াচ্ছেন, তাদেরকে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে পদোন্নতি দেয়া যেতে পারে।
কিন্তু আবেগের বশবর্তী হয়ে বা অবাস্তব কোনো বিষয় দ্বারা পরিচালিত হয়ে কোনো সিদ্ধান্ত আমাদের নেয়া বা নেয়ার জন্য সরকারকে চাপ প্রয়োগ করার আগে দ্বিতীয়বার ভাবতে হবে।
লেখক পরিচিতি
মাছুম বিল্লাহ বাংলাদেশে ইংলিশ টিচার্স অ্যাসেসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইট্যাব)-এর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি পূর্বে ক্যাডেট কলেজ ও রাজউক কলেজের শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন। কাজ করেছেন ব্র্যাকের শিক্ষা কর্মসূচিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে। তিনি ভাব বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসেবেও কর্মরত রয়েছেন। তিনি নিয়মিত শিক্ষাবিষয়ে নানা প্রবন্ধ লিখছেন।