বাড়িগবেষণাগবেষণার নৈতিকতা বা এথিক্স

গবেষণার নৈতিকতা বা এথিক্স

(গবেষণার নৈতিকতা ব্যাপারে দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশে তেমন বেশি শেখানো হয় না। ফলতঃ অনেক জায়গায় এমনকি শিক্ষকদের মাঝেও এই বিষয়ে অজ্ঞানতাপ্রসূত নানা আনএথিকাল কাজের অভিযোগ পাওয়া যায়। অথচ গবেষণার ক্ষেত্রে এথিক্স খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এই লেখাটিতে তাই আলোচনা করা হয়েছে। )

গবেষণার ফলাফল নিয়ে গবেষণাপত্র বা রিসার্চ পেপার লিখার সময়ে একটা ব্যাপারে খুব কড়া নজর রাখতে হবে – লেখায় ব্যবহৃত কোনো কিছু যেন অন্য জায়গা থেকে কপি করা না হয়। রিসার্চ পেপারের ক্ষেত্রে plagiarism বা কুম্ভীলকবৃত্তি তথা সহজ কথায় কপি করা একেবারেই ভয়াবহ রকমের অপরাধ হিসাবে গণ্য করা হয়। রিসার্চের ক্ষেত্রে নানা রেফারেন্স ঘেঁটে অন্যদের কাজের কথা লিখতে হবে বটে, কিন্তু প্রতিটি বাক্য আসলে নিজের ভাষায় লিখতে হবে, আর অন্যত্র থেকে নেয়া অংশ হুবুহু কেবল তখনই দেয়া যাবে, যখন সেটা উদ্ধৃতির মধ্যে থাকবে আর মূল লেখকের নাম উল্লেখ করতে হবে। এমনকি খুব সাধারণ বাক্যের ক্ষেত্রেও সরাসরি তুলে দেয়া যাবে না, নিজের ভাষায় লিখতে হবে।

উদাহরণ দেই।

ধরা যাক, বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ডঃ আবুল গরুর উপরে একটা গবেষণাপত্রে লিখেছেন,

রিসার্চের ক্ষেত্রে নানা রেফারেন্স ঘেঁটে অন্যদের কাজের কথা লিখতে হবে বটে, কিন্তু প্রতিটি বাক্য আসলে নিজের ভাষায় লিখতে হবে, আর অন্যত্র থেকে নেয়া অংশ হুবুহু কেবল তখনই দেয়া যাবে, যখন সেটা উদ্ধৃতির মধ্যে থাকবে আর মূল লেখকের নাম উল্লেখ করতে হবে।

গরুর চারটি পা আছে। গরুকে মোটাতাজা করতে হলে দিনে চারবার করে ঘাস খাওয়াতে হবে।

এখন যদি গবেষক হাবুল তার পেপারে সরাসরি একই কথা লিখে গরুকে মোটাতাজা করা নিয়ে, তাহলে সেটা হবে চুরি।

ধরা যাক, হাবুল একটু সাবধান, সে এভাবে লিখলো,

গরুর চারটি পা আছে। গরুকে মোটাতাজা করতে হলে দিনে চারবার করে ঘাস খাওয়াতে হবে। [আবুল ২০১৩]

অর্থাৎ রেফারেন্স দিলো। এটাও কিন্তু গ্রহণযোগ্য না, কারণ এখানে লেখাটা যে আসলে আবুলের, তা উল্লেখ করা হয়নি উদ্ধৃতি চিহ্নের মাধ্যমে।

তাহলে কি হাবুল কখনোই আবুলের এই সংজ্ঞাটা দিতে পারবেনা? হ্যাঁ, পারবে, এটা হাবুল দুই ভাবে দিতে পারে –

তবে এই নিজের ভাষায় লেখারো একটা ব্যাপার আছে। বাক্যের কাঠামো ঠিক রেখে কেবল দুই একটা শব্দ পাল্টালে কিন্তু সেটা লেখাচুরির দায় এড়াতে পারে না। নিজের ভাষায় লেখা মানে পুরা ধারণাটাকে নিজের মতো করে বলা, যা আসল লেখার মতো শোনাবেনা।

আবুল বলেছেন, “গরুর চারটি পা আছে। গরুকে মোটাতাজা করতে হলে দিনে চারবার করে ঘাস খাওয়াতে হবে।”। [আবুল ২০১৩]

অর্থাৎ রেফারেন্স ও উদ্ধৃতিচিহ্ন দুইটাই ব্যবহার করে।

আরো ভালো হয়, যদি হাবুল নিজের ভাষায় লিখে।

গরু একটি চতুষ্পদ প্রাণী। ঘাস খেলে গরু মোটতাজা হয়। বিজ্ঞানী আবুলের মতে কেউ যদি তাঁর গরুকে মোটাতাজা করতে চান, তাহলে হলে সেই গরুটিকে প্রতিদিন চার বার করে ঘাস খাওয়াতে হবে। [আবুল ২০১৩]।

তবে এই নিজের ভাষায় লেখারো একটা ব্যাপার আছে। বাক্যের কাঠামো ঠিক রেখে কেবল দুই একটা শব্দ পাল্টালে কিন্তু সেটা লেখাচুরির দায় এড়াতে পারে না। নিজের ভাষায় লেখা মানে পুরা ধারণাটাকে নিজের মতো করে বলা, যা আসল লেখার মতো শোনাবেনা।

Self-plagiarism এর ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হবে। এক কুমিরের ছানাকে ৬ বার দেখানোর গল্পের মতো নিজের লেখা একের পর এক পেপারে ব্যবহার করে চলা যাবে না।

প্লেজিয়ারিজমের ফলাফল গবেষণার জগতে ভয়াবহ। আজকের এই ডিজিটাল যুগে নকল করে কেউ পার পায়না। IEEE এর ক্ষেত্রে একটা ব্ল্যাকলিস্ট আছে – কেউ এভাবে ধরা পড়লে তার নাম সেই তালিকায় ঢোকানো হয়, এবং বছর ৫-১০ বা আজীবনের জন্য সব কনফারেন্স বা জার্নাল থেকে তাকে নিষিদ্ধ করা হয়।

দুঃখজনক হলো, বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার নানা দেশে নৈতিকতা নিয়ে এই ব্যাপারটা খোলাসা করা হয় না, ফলে শিক্ষার্থীরা উচ্চ শিক্ষার্থে বিদেশে গিয়ে সমস্যায় পড়ে। কয়েকদিন আগে ভারতের এক জার্নালের এক নিবন্ধে দেখলাম আমার একটা গবেষণাপত্র থেকে দুইটা প্যারাগ্রাফ হুবুহু কপি করা হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে জার্নালের সম্পাদকের কাছে লিখিত অভিযোগ পেশ করা হলে সেই পেপারটি সরিয়ে নেয়া হতে পারে, এমনকি জার্নাল থেকে লেখককে নিষিদ্ধও করা হতে পারে।

প্লেজিয়ারিজমের ফলাফল গবেষণার জগতে ভয়াবহ। আজকের এই ডিজিটাল যুগে নকল করে কেউ পার পায়না। IEEE এর ক্ষেত্রে একটা ব্ল্যাকলিস্ট আছে – কেউ এভাবে ধরা পড়লে তার নাম সেই তালিকায় ঢোকানো হয়, এবং বছর ৫-১০ বা আজীবনের জন্য সব কনফারেন্স বা জার্নাল থেকে তাকে নিষিদ্ধ করা হয়।

কাজেই রিসার্চের ক্ষেত্রে নৈতিকতা মেনে চলুন। কারো লেখা যথাযথ রেফারেন্স বা সাইটেশন সহ ব্যবহার করুন। আর আরেকটা ব্যাপার হলো, কোনো পেপারে কারো অবদান থাকলে তা স্বীকার করুন। অল্প অবদান থাকলে কৃতজ্ঞতা স্বীকার অংশে বলুন, আর অবদান ভালো হলে সহ-লেখক হিসাবে পেপারে তার নাম দিন। রিসার্চের ক্ষেত্রে এই রকমের এথিক্স বা নৈতিকতা বজায় রাখার একেবারেই কোনো বিকল্প নাই।

(মূল লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে লেখক রাগিব হাসানের “গবেষণায় হাতেখড়ি” বইতে, প্রকাশক আদর্শ প্রকাশনী। লেখকের অনুমতিক্রমে এখানে পুনঃপ্রকাশিত। বানানরীতি লেখকের নিজস্ব।)

লেখক পরিচিতি

রাগিব হাসান

ড. রাগিব হাসান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্যা ইউনিভার্সিটি অব অ্যালাবামা অ্যাট বার্মিংহাম-এ অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। তিনি বাংলাদেশের শিক্ষার নানা প্রসঙ্গ নিয়ে নিয়মিত লেখালেখি করছেন।

আরও পড়ুন

ওমর শেহাবের ‘নতুন শিক্ষাক্রমে দুটি বড় ভুল’ : একটি ‘ব্যক্তিগত’ প্রতিক্রিয়া

ওমর শেহাব জানিয়েছেন, তিনি নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সেই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সম্প্রতি তিনি প্রথম আলোয় ‘নতুন শিক্ষাক্রমে...

মতামত

বিজ্ঞান চেতনা: প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কোন বিজ্ঞান শিখছে শিশুরা?

নাহিদ নলেজ বিজ্ঞান চেতনা নিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা কী- এ সম্পর্কে বিস্তর কথাবার্তা আমাদের সবার জানা। সেই প্রাথমিক শিক্ষাটুকুই যদি গলদপূর্ণ হয়, তাহলে আর কী কথা...

দেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আপনি কি সন্তুষ্ট?

মোঃ তৌফিক ইমাম চৌধুরী লিখেছেন বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে বর্তমানে শিক্ষাব্যবস্থা আছে তা নিয়ে কি আপনি পুরোপুরি সন্তুষ্ট? প্রাথমিক কিংবা নিম্নমাধ্যমিক শ্রেণীতে একজনকে অনেকগুলো বিষয়ে পড়তে...
নতুন লেখার খবর পান ইমেইলে
বাংলাদেশের শিক্ষা প্রসঙ্গে নতুন লেখা প্রকাশিত হলে সেই খবর পৌঁছে যাবে আপনার ইমেইলে।

এই বিভাগের আরও লেখা

আমাদের উচ্চশিক্ষা ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ব্যর্থতা

সিরাজুল হোসেন লিখেছেন আমাদের উচ্চশিক্ষা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যর্থতা প্রসঙ্গে কনজেনিটাল সিফিলিস ১৯৪৯ সালে ভারত-পাকিস্তান দেশ ভাগ...

বই পড়া কেন এতো গুরুত্বপূর্ণ?

তানিয়া কামরুন নাহার লিখেছেন বই পড়ার গুরুত্ব নিয়ে বই পড়া একটি মননশীল কাজ। চোখ, নাক,...

শ্রেণিকক্ষ গবেষণা : কী, কেন এবং কীভাবে

আপনি কি একজন শিক্ষক? আপনি কি মনে করেন, আপনি একজন গবেষকও বটে? আপনার উত্তর...

প্রধান শিক্ষকের ডায়েরি : পরিচিতি ও বর্ণনা

‘মুজিব বর্ষের আহ্বান প্রাথমিক শিক্ষার উন্নতমান’— এই শ্লোগানকে প্রতিপাদ্য করে সুদৃশ্য বর্ণিল মলাটে প্রধান...

সাক্ষাৎকার: দরকার সঠিক প্রস্তুতি

যেকোনো চাকরির পরীক্ষায় আবেদনের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো সাক্ষাৎকার। সেখানে সফল হওয়াই চাকরি...

বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা

বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা হচ্ছে না, গবেষণার পরিবেশ নেই, গবেষণা করার জন্য পর্যাপ্ত ফান্ড...

গবেষণা কী এবং কেন?

বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রায়ই একটি প্রশ্ন শুনতে হয়— গবেষণা কী,...

একাডেমিক স্বাধীনতা

একাডেমিক স্বাধীনতা কী? একাডেমিক স্বাধীনতা কী এর সংজ্ঞা সঠিকভাবে দেওয়া কিছুটা কঠিন। এটি বলতে সাধারণত ছাত্র-ছাত্রী,...