সদ্য কলেজ পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করা আর পাঁচ বছর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করে এসে একটি উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি শিক্ষার্থী হিসেবে গবেষণার অভিজ্ঞতাকে কোনোভাবেই এক করে দেখি না। তবু এই বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ভিতর দিয়ে হাঁটতে গেলে ফিরে যেতে হয় সাত বছর আগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। কোথায় যেন একটি মিল রয়েই গেছে।

বলাই বাহুল্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা বাংলাদেশের যেকোনো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে যারা কিছুটা সময় পার করে এসেছেন, সেই ক্যাম্পাস অভিজ্ঞতার সাথে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনা না করাই শ্রেয় । তাই আমার পাঁচ বছরের কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা সজ্ঞানেই পাশে রেখে দিলাম।

নতুন করে নতুন এক দেশে নতুন এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পা দিয়ে যে দিনগুলোর কথা বার বার মনে পড়ে যায়, তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। মনে পড়ে সেই ক্যাম্পাস, সেই ক্লাসরুম, লাইব্রেরি, ক্যান্টিন, টিএসসি, চারুকলা আর সেই শোরগোল।

এখানেও ক্লাস শেষ হলেই একপাল শিক্ষার্থী শোরগোল করতে করতে এগিয়ে যায় ক্যাফে কিংবা লাইব্রেরির দিকে। তবে তাদের অত্যাধুনিক ক্যাফে কিংবা লাইব্রেরির সাথে আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনা চলে না। এখন ভাবলে অবাকই লাগে—এতো কম সুযোগ-সুবিধা নিয়ে, সকল বাধা উপেক্ষা করে কীভাবে পাশ করেছিলাম!

শুধু লাইব্রেরির কথাই যদি বলি, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিগুলো দেখলে মনে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বাধিক বাজেট বুঝি এখানেই চলে গেছে। এতো চমৎকার তার ব্যবস্থাপনা আর উপস্থাপনা যে সময় কাটানোর জন্য এর থেকে উত্তম জায়গা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে আর একটিও আছে কিনা সন্দেহ । আর সময় কাটানোর ফাঁকে ফাঁকে কীভাবে যেন পড়ায় একটু মন এসেই যায়।

লাইব্রেরিকে এখানে ভাগ করা হয়েছে কয়েকটি ভাগে। তার চমৎকার উদাহরণ হিসেবে লাইব্রেরিতে আমার প্রথমদিনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে চাই।

সুপারভাইজারের সাথে দেখা শেষ করে ভাবলাম লাইব্রেরিটা ঘুরে আসি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে দুইটি লাইব্রেরি, তার একটি ডিপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ের ভিতরে, আরেকটি বেশ দূরে। সিদ্ধান্ত নিলাম প্রথম দিন কাছের লাইব্রেরিটাই দেখবো। যেই ভাবা সেই কাজ।

করিডোরের তির-চিহ্ন অনুসরণ করে লাইব্রেরি খুঁজে বের করলাম। লাইব্রেরিতে ঢুকতেই আমাকে দেখে একজন এগিয়ে এসে জানতে চাইলেন (পাঠকের সুবিধার্থে কথোপকথন বাংলায় অনুবাদ করে দিচ্ছি)—

“আমি কি কোনোভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি”?

উত্তরে বললাম, “আমি এখানে নতুন, তাই লাইব্রেরিটা দেখতে এসেছি”।

তিনি জানতে চাইলেন, “আপনি কোন ডিপার্টমেন্ট থেকে এসেছেন, কী পড়ছেন”?

তাকে জানালাম, “আমি স্কুল অফ এডুকেশন-এর পিএইচডি শিক্ষার্থী”।

তখন তিনি যা জানালেন তার সারসংক্ষেপ করলে দাঁড়ায়, এডুকেশন ডিপার্টমেন্টের পিএইচডি শিক্ষার্থীদের সর্বদা সাহায্য করার জন্য একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত লাইব্রেরিয়ান আছেন। যেকোনো লাইব্রেরি-সংশ্লিষ্ট প্রয়োজনে আমি তার সাথে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারি। তার নাম, ফোন নাম্বার, অফিস রুম নাম্বার এবং ইমেইল ঠিকানা তিনি লিখে দিলেন। তবে লাইব্রেরির সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য সেই লাইব্রেরিয়ানকে দরকার হবে না, সেটাও জানালেন। বিশেষভাবে অনুরোধ করলেন যেন সময় পেলেই এডুকেশন লাইব্রেরিয়ানের সাথে যোগাযোগ করি । বুঝলাম, ডিপার্টমেন্টের দায়িত্বপ্রাপ্ত লাইব্রেরিয়ানের সাথে যোগাযোগ করাটা বিশেষ জরুরি।

অবশ্য কিছুদিনের মধ্যেই তার সুফল পেয়েছিলাম। কীভাবে হাজার হাজার আর্টিকাল থেকে প্রয়োজনীয় লেখা খুঁজে বের করতে হয় আর তাদেরকে কীভাবে রেফারেন্সিং-এর জন্য সংরক্ষণ করা যায়, কোন সফটওয়ার কীভাবে কাজ করে—এধরনের অনেক জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা সেই লাইব্রেরিয়ানের কাছ থেকে একক সেশন এবং দলীয় সেশনে জানতে পেরেছি। শুধু এন্ডনোট সফটওয়ার শিখতেই তিনটি সেশন লেগেছিলো।

যাই হোক, সে গল্প আরেকদিন হবে। এখন আসি লাইব্রেরিতে ঢোকার পরের ঘটনায়। লাইব্রেরিতে পদার্পণের আগে ধারণা ছিল আমি এক বিশাল লাইব্রেরিতে ঢুকবো, সিনেমার মত বইয়ের তাকগুলোতে চোখ রেখে বেড়াবো। লাইব্রেরিতে থাকবে পিনপতন নিস্তব্ধতা। কিন্তু অভিজ্ঞতা হলো ঠিক তার উল্টো।

প্রথমেই আমাকে শেখানো হলো, কীভাবে অনলাইনে লাইব্রেরির বই পড়া যায় এবং বইয়ের জন্য রিকুয়েস্ট পাঠাতে হয়। জানালো হলো, রিকুয়েস্ট পাঠানোর পর সেই বই লাইব্রেরির একটি রুমে অপেক্ষা করবে আর ইমেইলের মাধ্যমে জানানো হবে যে বইটি আমার অপেক্ষায় আছে। আমি স্টুডেন্ট আইডি এবং বইয়ের কোড স্ক্যান করে একটি রিসিপ্ট নিয়ে সেই রুম থেকে বইটি সংগ্রহ করতে পারবো। লক্ষ্য করলাম, সেই রুম  থেকে বের হওয়ার পথে একটি সিকিউরিটি স্ক্যানার বসানো আছে, ঠিক যেমনটি ঢাকার বড় বড় শপিং মলে থাকে।

তবে সব বই যে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে পাবোই এমন আশ্বাস তারা দিলেন না; বরং কোনো বই না পেলে আর কী কী মাধ্যমে সেই বই অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি থেকে অনলাইনে অনুরোধ পাঠিয়ে পড়ার সুযোগ পেতে পারি, তার কিছু দিকনির্দেশনা দিলেন।

তারপর দেখালেন, কোথায় কোথায় বসে শিক্ষার্থীরা পড়া বা লেখার কাজ করতে পারে। কোথায় বসে দলীয় কাজ করতে পারে, কোথায় খাবার গরম করে খাওয়া এবং পড়া দুটোই চালিয়ে যাওয়া যায়, যদি খাবার সাথে না থাকে তবে কোথা থেকে খাবার কিনতে হয়, নিরিবিলিতে পড়তে চাইলে লাইব্রেরির কোন অংশটি সবচেয়ে প্রযোজ্য ইত্যাদি। বুঝলাম লাইব্রেরিতে পিনপতন নিস্তব্ধতার ধারণাটি থেকে উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনেকটাই সরে এসেছে। লাইব্রেরিতে বসেও যে আলোচনা করা, খাবার খাওয়ার দরকার হতে পারে সে বিষয়ে তাদের বিচার-বিবেচনা সুস্পষ্ট।

তারপর সিড়ি বেয়ে ধীর পায়ে নেমে আসলাম এক বিশেষ রুমের সামনে । নিচু গলায় জানালো হলো, এই রুমে শুধু পিএইচডি শিক্ষার্থীরা বসেন। পিএইচডি শিক্ষার্থীদের স্টুডেন্ট কার্ড স্ক্যান করলে এর দরজা খুলে যাবে। সেদিন যদিও সেখানে ঢুকে বসা হয়নি, তবে পরে একবার সেই বিশেষ রুমে ঢুকে দেখেছিলাম, সেখানে বাইরের কোনো শব্দ তো ঢোকেই না; এমনকি মোবাইলের নেটওয়ার্কও কাজ করে না । মনে হয়েছিল এই বিশেষ রুমে বসে পড়ার বিশেষ সুবিধা হলো, পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেলেও টের পাওয়া যাবে না।

বিশ্ববিদ্যালয়টির পলিসি অনুযায়ী প্রতিটি পিএইচডি শিক্ষার্থীদের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট ওয়ার্কপ্লেস বরাদ্দ আছে। কেউ কেউ একটি বড় রুমে বা ল্যাবে ওয়ার্ক স্টেশনে বসেন, কেউ কেউ আমার মতো ছোট ছোট আলাদা রুমে বসেন। পাশাপাশি লাইব্রেরিতেও পিএইচডি শিক্ষার্থীদের জন্য এই বিশেষ ব্যবস্থা দেখে একটু অবাকই হয়েছিলাম। পরক্ষণেই নিজ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিগুলোর জীর্ণদশা স্মৃতিতে ভেসে উঠেছিলো।

অনার্স পড়ার সময় যদি লাইব্রেরির ওপর ভরসা করে থাকতাম, তবে আর অনার্স পাশ করা হতো বলে মনে হয় না। ক্লাস নোটের কপি, বইয়ের কপি, নীলক্ষেতের বাধাই করা বই ছিলো বলেই সে যাত্রায় উতরে গেছি। তবু মাস্টার্সে আর শেষ রক্ষা হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে তো নয়ই; ঢাকাতে কোথাও পাওয়া যাচ্ছিল না এডুকেশনাল সাইকোলজির বই। যাও বা একটা-দুটো বই নিউমার্কেটের একটিমাত্র দোকানে পাওয়া যাচ্ছিল, তা ছিল পুরানো এডিশনের ফটোকপি ও অসম্ভব দামী। তাই অগত্যা সুদূর কলকাতা থেকে বই আনানোর ব্যবস্থা করতে হয়েছিলো। তাতে খরচও পড়েছিল অনেক বেশি। বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে বইগুলো পড়ার সুযোগ পেলে সেদিন হয়তো এই বাড়তি খরচ থেকে আমার মধ্যবিত্ত পরিবার মুক্তি পেতো।

আমাদের মতো অনুন্নত দেশগুলোতে শিক্ষাখাতে বাজেটের এতই জীর্ণদশা থাকে যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিগুলোর কাছে আমাদের চাহিদা অতি ক্ষুদ্র। কোনোক্রমে চেয়ার-টেবিল পেতে পড়ার সুযোগ পেলেই আমরা আহ্লাদিত। তবে আশ্চর্য্য হলেও সত্য, দেশের মেধাবীরা এসকল বাধাবিপত্তি সামাল দিয়েই দাঁতে দাঁত চেপে এগিয়ে যাচ্ছে। তবে উন্নত দেশেগুলোর মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি এবং গবেষণার খানিকটা সুবিধাদি যদি শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক হতো, তাহলে সফলতার মাপকাঠিতে তারা হয়তো অন্য কোথাও পৌঁছে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারতো।

খানিকটা সুবিধা তৈরি করার জন্য কিন্তু খানিকটা সহযোগিতাই যথেষ্ট। আর সেজন্য প্রতিটি ডিপার্টেমেন্টের প্রতিটি শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীকে আলাদাভাবে সচেতন হওয়া জরুরি। বই আর লেখকের নাম বোর্ডে লিখেই শিক্ষকরা যেন তাদের দায়িত্ব থেকে সরে না দাঁড়ান। সেই বই বা তার একটি ফটোকপি যেন সকল শিক্ষার্থীর হাতে পৌঁছায় সেদিকে নজর রাখা উচিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক সাবেক শিক্ষার্থী দেশে ও দেশের বাইরে সফলতার সাথে বিভিন্ন জায়গায় কাজ করছেন। তাদের সহযোগিতাও বিশেষভাবে বিবেচনায় আনা যেতে পারে।

মনে হয় না এমন কোনো সাবেক শিক্ষার্থী আছেন যিনি বছরে একটি বই তার ডিপার্টমেন্টের লাইব্রেরিতে উপহার হিসেবে দিতে আপত্তি করবেন । যদি সঠিক উপায়ে তাদের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয় এবং বইয়ের উপরে কার উপহার সেটি লেখা থাকে, তবে আমার বিশ্বাস বেশিরভাগ সাবেক শিক্ষার্থীই উপহার দিতে রাজি হবেন। পাশাপাশি সেই বইগুলো সংরক্ষণ ও ব্যাবস্থাপনার জন্য একটি লাইব্রেরিতে একজন যোগ্য লাইব্রেরিয়ানই যথেষ্ট। আমাদের দেশে লাইব্রেরিয়ান পদটাকে যতোটা তুচ্ছ চোখে দেখা হয়, আদতে একজন সুযোগ্য লাইব্রেরিয়ান তিনজন সাধারণ লাইব্রেরি কর্মচারির থেকেও উন্নত লাইব্রেরি গঠনে বেশি ভূমিকা রাখতে পারেন।

এটি ঠিক রাতারাতি উন্নত বিশ্বের মত টকলোজি-সমৃদ্ধ লাইব্রেরি স্থাপনা হয়তো সম্ভব নয়, কিন্তু একে অপরের দিকে সহযোগিতামূলক হাত বাড়িয়ে দিলে নিঃসন্দেহে চমৎকার একটি লাইব্রেরির সূচনা অবশ্যই সম্ভব।

Sending
User Review
0 (0 votes)

লেখক সম্পর্কে

সাবরিনা স. সেঁজুতি

সাবরিনা স. সেঁজুতি

সাবরিনা স. সেঁজুতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করে বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অফ নিউক্যাসেলের স্কুল অফ এডুকেশনে পিএইচডি করছেন।

মন্তব্য লিখুন