আলোচ্য বিষয়সমূহ
জেন্ডার হলো সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে কোনো একটি সমাজের নারী-পুরুষের প্রত্যাশিত আচরণ। অর্থাৎ, সমাজে একজন নারী-পুরুষ কী করবে কিংবা কী করতে পারবে না সমাজ কর্তৃক তা নির্ধারণ করে দেওয়াই হচ্ছে জেন্ডার। জেন্ডার কোনো অপরিহার্য বিষয় নয়, বরং এটি সমাজসৃষ্ট ও পরিবর্তনযোগ্য। আর জেন্ডারের ভিন্নতার কারণে কোনো ব্যক্তি যখন তার অধিকার, সম্মান, মর্যাদা কিংবা অন্যান্য যেকোনো ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হন, তাই জেন্ডার বৈষম্য।
ভারতীয় উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে জেন্ডার বৈষম্যের শিকার নারীরা। বিশ্বব্যাপি জেন্ডার বৈষম্যকে দুটি মোটাদাগে বিভক্ত করা হয়। একটি হলো, নারী-পুরুষের দৈনন্দিন কাজ ও দায়-দায়িত্বে জেন্ডার ভিত্তিক শ্রমবিভাজনে অসমতা। অন্যটি হলো অধিকার, পছন্দ, ক্ষমতা, সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষেত্রে নারীর অধিকারহীনতা বা পর্যাপ্ত সুযোগের অভাব। জেন্ডার বৈষম্য দূরীকরণের জন্য সামগ্রিক শিক্ষাপ্রক্রিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
জেন্ডার শিক্ষা ও সমাজ
জেন্ডার শিক্ষা ও সমাজ পরষ্পরের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। জেন্ডার মূলত সমাজ কর্তৃক সৃষ্ট। সমাজই নির্ধারণ করে দেয় একজন নারী কিংবা পুরুষ সেই সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে কী ধরনের আচরণ করতে পারবে কিংবা কোনটা পারবে না। তাই জেন্ডার ও সমাজ অবিচ্ছেদ্য ব্যাপার। জেন্ডার থেকে সমাজকে আলাদা করা যায় না। আবার আনুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রক্রিয়াকে ঐতিহাসিক নিরিখে দেখতে গেলে দেখা যাবে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে সমাজে জন্ম নেওয়া একজন ব্যক্তিকে ঐ সামাজিক প্রেক্ষাপটের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ আদর্শ, মূল্যাবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ ঘটিয়ে ঐ সমাজের একজন সামাজিক সদস্যে পরিণত করার জন্য। তাই শিক্ষা ও সমাজ অবিচ্ছেদ্য বিষয়। আবার শিক্ষা দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটিয়ে নারী পুরুষের অধিকার ও মূল্যাবোধ সম্পর্কে ব্যক্তিকে সচেতন করে তোলে। তাই জেন্ডার, সমাজ ও শিক্ষা সামগ্রিক ব্যাপারটিই পারস্পরিক আন্তঃসম্পর্কিত।
জেন্ডার সমতার ভ্রান্ত ধারণা!
জেন্ডার সমতায়ন নিয়ে সমাজের নিরক্ষর, স্বল্পশিক্ষিত, এমনকি তথাকথিত উচ্চশিক্ষিত সমাজের মধ্যেও ভ্রান্ত ধারণা বিরাজমান। নারী-পুরুষের সমতার কথা বললেই একদল মনে করেন, নারী-পুরুষ তো জৈবিকভাবে আলাদা এবং বৈজ্ঞানিকভাবেও তো নারী-পুরুষ মধ্যে আলাদা। সেক্ষেত্রে নারী-পুরুষ সমান কীভাবে হয়?
প্রকৃত অর্থে নারী-পুরুষের সমতায়ন বলতে নারী-পুরুষ সমান মর্যাদা এবং অধিকার নিশ্চিত করার বিষয়টিকে বোঝায়। নারী-পুরুষ, জাতি,ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষেরই মানবাধিকার হিসেবে সমান মর্যাদা ও অধিকার পাবার অধিকার রয়েছে। ৪৮’র মানবাধিকার সনদ বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তের সকলের সেই মানবাধিকারকেই প্রতিষ্ঠিত করেছে। আমাদের সমাজে নারী-পুরুষভেদে অধিকার ও মর্যাদায় পরিলক্ষিত হয় ব্যাপক বৈষম্য। জেন্ডার সমতায়ন মূলত জেন্ডার বৈষম্য দূর করে নারী-পুরুষসহ প্রতিটি মানুষের এসব অধিকার, সম্মান ও মর্যাদা ও নিয়েই কাজ করে। জৈবিকভাবে এবং জন্মগতভাবে নারী-পুরুষের শারীরিক গড়নের পার্থক্য জেন্ডার সমতায়নের কোন আলোচ্য বিষয় নয়। শিক্ষার মাধ্যমে প্রতিটি মানুষের মধ্যে মানবিক বোধের জাগরণ ঘটে। ফলে শিক্ষা প্রতিটি মানুষের মধ্যে অপরের প্রতি মর্যাদা, অধিকার ও শ্রদ্ধাবোধকে জাগ্রত করে তোলে।
প্রতিটি ধর্মই নারী-পুরুষের সমান অধিকার ও মর্যাদার কথা বলে। তো আলাদা করে জেন্ডার বৈষম্য দূরীকরণ নিয়ে কাজ করা কেন দরকার? নৃ-তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণে মানুষ যেসব আদর্শ, বিশ্বাসের ধারণ ও অনুশীলনের মাধ্যমে জীবন যাপন করে তা-ই ধর্ম। প্রতিটি ধর্মই মানুষকে নমনীয়তা শেখায়, শেখায় পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, তথাপি ভালো মানুষ হবার জন্য ব্যক্তির বসবাসকৃত সমাজ স্বীকৃত যেসব বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার সেগুলোই শেখায় ও অনুশীলনে উদ্বুদ্ধ করে ধর্ম। সচেতন দৃষ্টিতে দেখলে দেখা যাবে, আমাদের সমাজে প্রতিটি ধর্মই নারী-পুরুষের অধিকার সংক্রান্ত ব্যাপারে ধর্মীয় অনুশাসন পালনে ব্যাপারে আমরা উদাসীন। যার ফলে ধর্মীয় বিধিবিধানে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সমতা কিংবা নায্যতার দৃষ্টিভঙ্গি বিদ্যামান থাকলেও বাস্তবে অনুশীলনের জায়গাতে বরাবরই অনীহা দেখা যায়। তাই জেন্ডার সমতায়নের যে নারী-পুরুষের অধিকার নিয়েই কাজ করে, সেই ব্যাপারটিকে জনসাধারণের মধ্যে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করতে হবে। ধর্মীয় সুশিক্ষার মাধ্যমে কট্টরপন্থীতা দূরীকরণ করে পরিপূর্ণ শিক্ষার মাধ্যমে ধর্মীয় উদারতারবাদের অনুশীলন ঘটাতে হবে।
জেন্ডার বৈষম্য দূরীকরণে শিক্ষা
শিক্ষার কী কিংবা শিক্ষার কাজ কী তা সংজ্ঞায়ন করা বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। বলা যেতে পারে, ব্যক্তির সার্বিক বিকাশসাধনের মাধ্যমে বিজ্ঞানমনস্ক, আধুনিক, রুচিশীল ও যুক্তিশীল মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার প্রক্রিয়াই হলো শিক্ষা।
জেন্ডার বৈষম্যের অন্যতম কারণ নারী-সম্পর্কে সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন ভ্রান্ত ধারণা কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস। তাই মনে করা হয় শিক্ষার মাধ্যমেই কুসংস্কার ও ভ্রান্ত ধারণা দূরীকরণ ও দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তন সাধনের মাধ্যমেই জেন্ডার বৈষম্য দূরীকরণ সম্ভব। কিন্তু শিক্ষা ব্যবস্থার বিভিন্ন অংশ যদি হয় ত্রুটিপূর্ণ, তবে তা উল্টো জেন্ডার বৈষম্যকেই ছড়িয়ে দিতে পারে।
বেঞ্জামিন ব্লুমসের মতে, শিক্ষা কেবল জ্ঞানীয় ক্ষেত্রের বিকাশেই কাজ করে না বরং আবেগীয় ও মনোপেশিজ ক্ষেত্রেও বিকাশ সাধন করে। তাই প্রকৃত শিক্ষা কোন আদর্শ/দৃষ্টিভঙ্গি সর্ম্পকে পরিপূর্ণ ধারণা প্রদান করে আবেগীয় ক্ষেত্রেও ইতিবাচক পরিবর্তন সাধন করে। পাশাপাশি ব্যক্তির মনোপেশিজ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেও সেসব উপলব্ধির প্রকাশ ঘটে। শিক্ষা প্রথমত সকলের মাধ্যমে নারী-পুরুষ তথা প্রতিটি মানুষকে মানুষ হিসেবে উপলব্ধি করতে শেখায় যা তার আবেগীয় এবং মনোপেশিজ কর্মকান্ডের মাধ্যমে প্রকাশ ঘটে। যার ফলে ভিন্ন জেন্ডারের প্রতি সকল নেতিবাচক, কুসংস্কারাচ্ছন্ন দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটিয়ে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ ঘটায়। প্রতিটি ব্যক্তি নিজের অধিকার ও মর্যাদা সর্ম্পকে সচেতন হয়ে ওঠে এবং তার জীবনের কর্মকান্ডের মাধ্যমেও তা প্রকাশ পায়। আবার বিদ্যালয়ে যখন দীর্ঘ সময় ধরে জেন্ডার সমতায়নের অনুশীলন চলে তাও ব্যক্তির মধ্যে জেন্ডার ধারণার বিকাশ ও অনুশীলনকে আত্মীকরণ করে সহয়তা করে।
শিক্ষা তো কেবল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, অনানুষ্ঠানিকভাবে পরিবার, বন্ধু-বান্ধব তথা সমাজ বা সামাজিক প্রতিষ্ঠানের থেকে অনানুষ্ঠানিকভাবে আমরা প্রতিনিয়ত নানান কিছু শিখি। তাই কোন সমাজে যদি জেন্ডার সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা বিরাজমান থাকে তবে ঐ সমাজের একজন সদস্য জেন্ডার নিয়ে নেতিবাচক ধারণাকেই নিজের মধ্যে ধারণ করবে। সমাজে জেন্ডার সমতায়ন সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণার বিস্তৃতি ঘটলে অনানুষ্ঠানিকভাবে জেন্ডার বৈষম্য দূরীকরণের ধারণা শিশুদের মধ্যে বিকশিত হবে। শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য হলো মিলেমিশে একসাথে বসবাস করা (দেলর কমিশন, ২০০৪)। জেন্ডারসহ সকল বৈষম্য দূরীকরণ করে একসাথে মিলেমিশে বসবাস করতে শেখায় শিক্ষা।
জেন্ডার বৈষম্য দূরীকরণে পাঠ্যপুস্তক
পাঠ্যপুস্তক কীভাবে জেন্ডার বৈষম্যকে প্রভাবিত করে তা বলার আগে সেই গরীব চাষী গণি মিয়াকে দিয়েই শুরু করি:
“গণি মিয়া একজন গরীব কৃষক। তিনি মাঠে কঠোর পরিশ্রম করে। গণি মিয়ার স্ত্রী গণি মিয়ার জন্য বাসায় রান্নাবান্না করেন এবং সন্তান লালন-পালন করেন”।
গল্পটি প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তকের একসময়কার সাধারণ একটি গল্প ছিলো। গল্পটি আপাতঃদৃষ্টিতে স্বাভাবিক বলে মনে হলেও গল্পটি জেন্ডার বৈষম্যমূলক। শিশু গল্পটি পড়তে গিয়ে নিজের মনের মধ্যে একটি ধারণা তৈরি করে নেবে। পরিবারের পুরুষ সদস্যদের কাজ বাইরে কাজ করা। পরিবারের নারী সদস্যদের কাজ বাসায় কাজ করা ও সন্তান লালন-পালন করা। আবার পরিবারের পুরুষ সদস্য কঠোর পরিশ্রম করবেন অর্থাৎ তার কাজের স্বীকৃতি প্রদান করা হবে। অন্যদিকে নারী সদস্যদের গৃহস্থালীর কাজকে কাজ হিসেবেই ধরা হবে না বরং অবমূল্যায়ন করা হবে। গল্পের মাধ্যমেই শিশুর মধ্যে অবচেতন মনেই নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক মনোভাব সৃষ্টি হতে পারে। যার জন্য পাঠ্যপুস্তকের অব্যবস্থাপনা তাৎপর্যপূর্ণভাবে দায়ী। তবে ব্যাপারটি এমনও নয় যে পাঠ্যপুস্তকে যদি সরাসরি জেন্ডার কনসেপ্ট নিয়ে ইতিবাচক ধারণা দেওয়া হয় কেবল তাতেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটবে।
যেকোনো পাঠ্যবইয়ে কী পড়ানো হচ্ছে সেটার পাশাপাশি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে পাঠ্যবইয়ের কনটেন্ট, গ্রাফিক্স ডিজাইন ইত্যাদি কিভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে সেটাও জেন্ডার বৈষম্য তৈরীতে মারাত্মক প্রভাবক। দেখা যেত, আগের বইগুলোতে খেলাধুলার ছবি থাকলে সেখানে ছেলেরা খেলতে দেখা যেত ক্রিকেট বা ফুটবল অন্যদিকে মেয়েদের দেখা যেত হাঁড়ি-পাতিল কিংবা পুতুল নিয়ে খেলতে। শিশুরা অনুকরণ প্রিয়, সে যা দেখে তা-ই অনুকরণ করতে চায়, চায় বিশ্বাস করতে। এভাবে কিন্তু আস্তে আস্তে শিশুর মধ্যে জেন্ডার স্টেরিওটাইপের ধারণা জন্মে যায়। ফলে নারী পুরুষের মধ্যে ভেদাভেদের শিক্ষালাভ করে স্বয়ং বই থেকেই!
বর্তমান সময়ে একীভূত শিক্ষার বিকাশের ফলে পাঠ্যপুস্তকগুলো অনেকটাই জেন্ডার সংবেদনশীল হয়ে উঠছে। পরিমার্জিত হচ্ছে পাঠ্যবিষয়বস্তু, বইয়ের গ্রাফিক্স ডিজাইন, বইয়ের বিন্যাস। তাই শিক্ষার মাধ্যমে জেন্ডার বৈষম্য দূরীকরণের জন্য সর্বপ্রথম পাঠ্যপুস্তককে জেন্ডার সংবেদনশীল হতে হবে। কোন ভাবেই যেন পাঠ্যপুস্তক জেন্ডার বৈষম্যমূলক বার্তা বহন না করে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তু নির্বাচন, গ্রাফিক্স ডিজাইন ইত্যাদির মাধ্যমে জেন্ডার সমতায়নের বার্তা দিতে হবে।
পাঠ্যপুস্তকের সকল কনটেন্ট ও গ্রাফিক্যাল বিষয়গুলোকে জেন্ডার সংবেদনশীল করে তোলা হলেই যে জেন্ডার সমতায়ন প্রতিষ্ঠা হবে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে জেন্ডার নিয়ে ইতিবাচক ধারণার বিকাশ ঘটবে, ব্যাপারটি তেমন নয়। বিদ্যালয় অনুশীলনে কতটা জেন্ডার সংবেদনশীলতা দেখা হচ্ছে সেটাই মূলত জেন্ডার সমতায়নে কাজ করবে। বিশেষত বিদ্যাল পর্যায়ে পাঠ্যপুস্তক শিক্ষা ব্যবস্থার অপিহার্য অংশ বলে জেন্ডার সমতায়নের জন্য পাঠ্যপুস্তককে জেন্ডার সংবেদনশীল হওয়া অত্যন্ত জরুরি।
জেন্ডার বৈষম্য দূরীকরণে শিক্ষক
যেকোনো শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষকের ভূমিকা অনস্বীকার্য। আবার শিক্ষাব্যবস্থাটি যদি হয় শিক্ষক কেন্দ্রিক তাহলে তো আর কথা নেই। পুরো শিক্ষা ব্যবস্থার নেপথ্যে কাজ করেন শিক্ষক। বলা হয়ে থাকে বিদ্যালয় হলো সমাজের ক্ষুদ্র সংস্করণ। বিদ্যালয়ের কর্মকাণ্ডের যেসব অনুশীলন দেখা যায় তার প্রতিফলন সমাজে পড়ে। তাই শিক্ষকের যেকোনো বৈষম্যমূলক আচরণ জেন্ডার বৈষম্যকে প্রভাবিত করতে পারে। আবার শিক্ষকের ইতিবাচক ভূমিকা জেন্ডার বৈষম্য দূরীকরণেরও ভূমিকা রাখতে পারে। জেন্ডার বৈষম্য দূরীকরণে শিক্ষকের দৃষ্টিভঙ্গিকে সর্বপ্রথম জেন্ডার নিরপেক্ষ করতে হবে। শিক্ষক তার সকল শিক্ষার্থীর মধ্যে জেন্ডার সংবেদনশীলতা বিষয়টিকে তুলে ধরবেন। শিক্ষক প্রত্যহ শ্রেণিতে যেসব কাজকর্মের মাধ্যমে শিখন শেখানোর কার্যক্রম পরিচালিত করেন সেগুলোকে জেন্ডার লেন্সের মাধ্যমে দেখতে হবে। আত্মমূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষক যদি শ্রেণিকার্যক্রমে জেন্ডার বৈষম্যকে মূল্যায়ন করতে পারেন তবে জেন্ডার বৈষম্য দূরীকরণ করা সম্ভব। শিক্ষককে লক্ষ্য রাখতে হবে তিনি শ্রেণির সবাইকে সমানভাবে দেখছেন কিনা, অন্যথায় জেন্ডার বৈষম্য দূরীকরণের সকল প্রক্রিয়া ব্যর্থ হবে। যেকোন সমাজে শিক্ষকের ভূমিকা কেবল ক্লাসরুমেই সীমাবদ্ধ নয়, সমাজের সকল কার্যক্রমেও শিক্ষকের একটি বড় ধরনের প্রভাব থাকে। শিক্ষক যদি তার কমিউনিটি কিংবা বিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত এলাকায় জেন্ডার সমতায়ন বিষয়ে যদি সঠিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রচার প্রচারণা করতে পারেন তবে তা নিঃসন্দেহেই ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে।
এখনও অনেক প্রান্তিক সমাজে নারীশিক্ষা নিয়ে কুসংস্কার দেখা যায়। শিক্ষক এখানে একটি ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারেন। শিক্ষক ইউনিয়ন পরিষদ বা স্থানীয় প্রশাসনের সাথে যৌথভাবে কাজের মাধ্যমে গ্রামবাসীদের সাথে মিটিং বা আলোচনা সভার আয়োজন করে নারীশিক্ষা নিয়ে গ্রামবাসীদের মধ্যে সচেতনতা তৈরীর চেষ্টা করতেন পারেন। সবার মধ্যে নারীশিক্ষার গুরুত্ব ও তাৎপর্য তুলে ধরতে পারেন। শিক্ষক চাইলে স্থানীয় কমিউনিটির সহায়তায় এ-ধরনের সমস্যা নিয়ে গণ-আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেন। নারী শিক্ষা কেবলমাত্র একটি উদাহরণ। জেন্ডার বিষয়ক যেকোনো সমস্যা সমাধানে শ্রেণিকক্ষের বাইরেও শিক্ষকের কাজ করতে পারেন। আর শিক্ষক যখন বিদ্যালয়ের কর্মকান্ডে সরাসরি জেন্ডার সমতায়নের অনুশীলন করবেন সেটা নিঃসন্দেহে জেন্ডার বৈষম্য দূরীকরণে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে।
শিক্ষাক্রম ২০২২-এ জেন্ডার সংবেদনশীলতা
শিক্ষাক্রমকে বলা হয় যেকোন দেশের সামগ্রিক শিক্ষা পরিকল্পনা যেখানে ঐ দেশের সামগ্রিক শিক্ষার রূপকল্প কেমন হবে তার সামগ্রিক চিত্রায়ন থাকে। “মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত দেশপ্রেমিক, উৎপাদনমুখী, অভিযোজনে সক্ষম সুখী ও বৈশ্বিক নাগরিক” হিসেবে গড়ে তোলার রূপকল্প নিয়ে সদ্য বাস্তবায়িত হতে যাওয়া শিক্ষাক্রম ২০২২ নানান কারণে দেশের বিভিন্ন মহলে ব্যাপকভাবে আলোচিত ও সমালোচিত। সকল আলোচনা সমালোচনাকে ছাপিয়ে বাস্তবায়ন হতে যাওয়া নতুন শিক্ষাক্রমও জেন্ডার বিষয়ে সংবেদনশীলতার বিষয়টি লক্ষ্যণীয়। বর্তমান শিক্ষাক্রমের রূপরেখায় জেন্ডার ও একীভূততার নায্যতামূলক দৃষ্টিভঙ্গি (Equitable View) গ্রহণ করা হয়েছে। শিক্ষাক্রমের রূপকল্প বর্তমানের সীমাবদ্ধতামূলক দৃষ্টিভঙ্গির থেকে ন্যায্যতামূলক দৃষ্টিভঙ্গিতে অবস্থান্তরের জন্য জেন্ডার ও একীভূততা সংশ্লিষ্ট চিন্তার ক্ষেত্রে, ধারণায়, জেন্ডার ও একীভূততার লক্ষ্যদল নির্ধারণে, কর্মসূচি পরিকল্পনায়, সূচক নির্ধারিত ও সার্বিক ধারণায় একটি বড় রুপান্তরের প্রয়োজন বলে মনে করে। সে সম্পর্কে শিক্ষাক্রম ২০২২’র রূপরেখায় বলা হয়েছে:
“শিক্ষাক্রম উন্নয়ন থেকে শুরু করে, শিখন-সামগ্রী তৈরি, শিখন-শেখানো পদ্ধতি, মূল্যায়ন, শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও শ্রেণি পর্যায়ে বাস্তবায়নসহ সকল ধাপে তা জেন্ডার সংবেদনশীল ও একীভূত শিক্ষা সহায়ক করার জন্য একটি ব্যবহারিক চেকলিস্ট বা লেন্স তৈরি করা হবে যার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।”
নতুন শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়নের শিক্ষা ব্যবস্থার জেন্ডার বৈষম্য দূরীকরণের কার্যক্রম কতটা সফলভাবে বাস্তবায়ন হলো সেটার জন্য একটি দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হবে। বর্তমানে দেশের প্রায় প্রতিটি পর্যায়ে জেন্ডার বৈষম্য উল্লেখযোগ্যভাবে বিদ্যমান। বিদ্যালয় অনুশীলনেও যে ধরণের জেন্ডার বৈষম্য পরিলক্ষিত হয় তা দূরীকরণে শিক্ষাক্রমেরও দায়বদ্ধতা থাকে। তাই দেশের শিক্ষাক্রমে আরো বেশী জেন্ডার সমতায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। পাশাপাশি বিদ্যালয় পর্যায়ে জেন্ডার সমতায়ন নিশ্চিত করতে শিক্ষাক্রমের নীতিমালার অনুশীলন মনিটরিং এবং সুপারভিশনের আওতায় আনতে হবে।
জেন্ডার বৈষম্য দূরীকরণে স্থানীয় কমিউনিটি
জেন্ডার বৈষম্য দূরীকরণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা হলো সমাজের। কারণ জেন্ডার বিষয়টি সমাজ সৃষ্ট। সমাজই নির্ধারণ করে দেয় সমাজে কার ভূমিকা কী হবে কিংবা কে কী করবে। তাই জেন্ডার সমতায়নে স্থানীয় সমাজের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। জেন্ডার বৈষম্য দূরীকরণে স্থানীয় কমিউনিটির মধ্যে স্থানীয় সরকার প্রশাসন, সুশীল সমাজ, বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটি (এসএমসি), বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তিবর্গসহ সমাজের সকলের অংশগ্রহণ জরুরি। সভা-সমাবেশের মাধ্যমে সমাজের সদস্যদের মধ্যে জেন্ডার সংবেদনশীলতা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সরকারি বেসরকারি পর্যায়ের উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। কমিউনিটির নেতৃত্ব এনজিওর মাধ্যমে জেন্ডার সমতায়নের আন্দোলন গড়ে তোলা হলে কমিউনিটির সদস্যদেরও ক্ষমতায়ন ঘটবে পাশাপাশি সবার মধ্যে জেন্ডার সংবেদনশীলতা গড়ে উঠবে। জেন্ডার বৈষম্য দূরীকরণের ক্ষেত্রে জেন্ডার সম্পর্কে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গঠনের মাধ্যম জেন্ডার বৈষম্য দূরীকরণ সম্ভব।
প্রয়োজন ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস
জেন্ডার বৈষম্য দূরীকরণের জন্য সর্বপ্রথম প্রয়োজন দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটানো। জেন্ডার বৈষম্য যেহেতু সামাজিক সমস্যা, তাই জেন্ডার বৈষম্য দূরীকরণ কোন একক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সম্ভব নয়। স্থানীয় কমিউনিটি, শিক্ষাব্যবস্থা, বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা, শিক্ষক, শিক্ষাক্রম, পাঠপুস্তকসহ সামগ্রিকভাবে সবার অংশগ্রহণ এখানে অত্যন্ত জরুরি। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, জেন্ডার নির্বিশেষে সবাইকে নিজের অধিকার সর্ম্পকে সচেতন হতে হবে। সমাজ বিনির্মাণের মাধ্যমে সবাইকে নিয়ে একসাথে মিলেমিশে থাকার দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে হবে। আর এভাবেই গড়ে উঠবে বৈষম্যহীন একীভূত সমাজ।
বেশ ক’বছর আগে বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলের একটি ছোট্ট জেলায় বাল্যবিবাহের হার ছিলো পুরো দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ। একটি স্বনামধন্য আন্তর্জাতিক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ঐ অঞ্চলের বাল্যবিবাহ দূরীকরণের জন্য কাজ শুরু করে। এনজিওটি স্থানীয় প্রশাসন ও কমিউনিটির সাথে যৌথভাবে কাজ শুরু করে। স্কুল, কলেজ থেকে শুরু করে পুরো সমাজ ব্যবস্থায় বাল্যবিবাহ নিয়ে ব্যাপক প্রচার প্রচারণা শুরু করেন প্রতিষ্ঠানটি। ফলাফল হিসেবে কয়েক বছরের মাথায় জেলাটিকে বাল্যবিবাহমুক্ত হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং বিশ্বব্যাপি জেলাটির নাম বাল্যবিবাহ দূরীকরণের একটি রোল মডেল হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এই প্রেক্ষাপটে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) এ-ধরনের কাজের সূত্রপাত ঘটালেও আসলে কাজটি কিন্তু হয়েছে বিদ্যালয়, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ স্থানীয় কমিউনিটিসহ সমাজের সকলের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসে। তাই জেন্ডার বৈষম্য দূরীকরণ করে জেন্ডার সমতাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে হবে।
উপসংহার
জেন্ডার বৈষম্য দূরীকরণের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হলো জেন্ডার সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণাগত অস্পষ্টতা এবং নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। শিক্ষার মাধ্যমে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে জেন্ডার ও জেন্ডার বৈষম্য নিয়ে ইতিবাচক ধারণা সৃষ্টি করতে হবে। শিক্ষা প্রক্রিয়ার সঠিক অনুশীলন জেন্ডার বৈষম্য দূরীকরণ করতে পারে, গড়ে তুলতে পারে বৈষম্যহীন সমাজ। সমাজ বিনির্মাণের লক্ষ্যে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে হবে। আর এভাবেই শিক্ষার মাধ্যমে গড়ে উঠবে জেন্ডার সংবেদনশীল সমাজ।
লেখক পরিচিতি
শামস আল গালিব রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী। তিনি নিয়মিত শিক্ষার নানা প্রসঙ্গ নিয়ে লেখালেখি করেন।