শিক্ষানগরী হিসেবে সারা দেশে সুপরিচিত রাজশাহীর শিক্ষাখাতের সবচেয়ে বড় বিকাশ হয় মূলত গত শতাব্দীর মাঝামাঝিতে। ১৮৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত রাজশাহী কলেজ ছাড়া বর্তমান সময়ে রাজশাহীর শিক্ষায় নেতৃত্ব দিচ্ছে এমন প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রায় সবগুলোয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এই সময়টাতে। এই সময়ে রাজশাহীর শিক্ষা ও সামাজিক উন্নয়নে যে ক’জন সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাদের মধ্যে মাদার বখশ অন্যতম। আজকের লেখায় আমরা জানার চেষ্টা করবো বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই মানুষটিকে নিয়ে।

জন্ম ও শিক্ষা

একাধারে শিক্ষাবিদ, রাজনীতিক, আইনজীবী, সমাজসেবক ও ভাষাসংগ্রামী এই ক্ষণজন্মা এই মানুষটির জন্ম  ১৯০৫ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন রাজশাহী জেলার নাটোর মহকুমার সিংড়া থানার স্থাপনদীঘি গ্রামে। জন্মের পর মাদার বখশের জীবনের প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্ব শেষ হয় নিজ গ্রামেই। ১৯২২ সালে সিংড়ার চৌগ্রাম উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণিতে ম্যাট্রিক পাশ করেন তিনি। এরপর রাজশাহী কলেজ থেকে ১৯২৪ সালে আইএ এবং ১৯২৬ সালে বিএ ডিগ্রি অর্জন করে পশ্চিমবঙ্গে পাড়ি জমান। সেখানে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ১৯২৮ সালে ইতিহাসে এমএ এবং কোলকাতা রিপন কলেজ হতে ১৯২৯ সালে বিএল ডিগ্রি লাভ করেন তিনি।

কর্মজীবন

কর্মজীবনে মাদার বখশ বৃহত্তর রাজশাহীর নওগাঁ এবং মুর্শিদাবাদে শিক্ষকতাও করেন। মাত্র দু’বছরের শিক্ষকতা  জীবন ছেড়ে ১৯৩৪ সালে রাজশাহীতে ফিরে এসে আইন পেশা ও সমাজসেবায় মনোনিবেশ করেন। এই সময়ে দরিদ্র ও অসহায়দের পক্ষে বিনা সম্মানীতে মামলা লড়ার কারণে সুখ্যাতি লাভ করতে থাকেন। চল্লিশের দশকের শুরুতে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়ে রাজশাহীর (আত্রাই, বাগমারা ও মান্দা) প্রতিনিধি হিসেবে ১৯৪৬ সালে অবিভক্ত বাংলার বঙ্গীয় আইন পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান আইন পরিষদের সদস্য এবং ১৯৫০ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত রাজশাহী পৌরসভার (বর্তমানে রাজশাহী সিটি করপোরেশন) প্রথম নির্বাচিত পৌর চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। তার এসব রাজনৈতিক পরিচয়ও শিক্ষাখাতে তার অবদানকে নিয়ে গেছে আরো পরিসরে।

রাজশাহীর শিক্ষা ও মাদার বখশ

রাজশাহী তথা উত্তরাঞ্চলের শিক্ষাব্যবস্থায় সবচেয়ে বড় সংযোজনটি হয় ১৯৫৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। আর এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পিছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছেন মাদার বখশ। নিজের রাজনৈতিক অবস্থানকে তিনি কাজে লাগিয়েছেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি কাজে। কেনোনা, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন রাজশাহী তথা এ অঞ্চলের মানুষের চাকা ঘুরানোর একমাত্র জ্বালানি হতে পারে শিক্ষা।

এমন উপলব্ধিতেই ১৯৫৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি রাজশাহীর ভূবন মোহন পার্কে এক জনসভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে মাদার বখশ সরকারকে হুশিয়ার করে বলেন, ‘যদি রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন না হয়, তবে উত্তরবঙ্গকে একটি স্বতন্ত্র প্রদেশ দাবি করতে আমরা বাধ্য হব।’

শুধু তাই নয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে তিনি পাকিস্তান সরকারে মন্ত্রিত্বের লোভনীয় প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন মাদার বখশ। নানামুখী আন্দোলন সংগ্রাম পেরিয়ে অবশেষে ১৯৫৩ সালের ৩১ মার্চ প্রাদেশিক আইনসভায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা আইন পাশ হয়। নতুন উপাচার্য প্রফেসর ইতরাত হোসেন জুবেরীকে সঙ্গে নিয়ে মাদার বখশ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামো পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরুর পর তিনি নিজেও আইন বিভাগের জ্যেষ্ঠ অবৈতনিক শিক্ষক হিসেবে যুক্ত হন।

রাজশাহীতে মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও তার ভূমিকা ছিলো অনন্য। তার নেতৃত্বেই ১৯৪৯ সালে রাজশাহীতে প্রথম বেসরকারি মেডিকেল স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়, যা ১৯৫৫ সালে সরকারীকরণ করা হয় এবং ১৯৫৮ সালে কলেজটিকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল নামে নামকরণ করা হয়। ১৯৬৬ সালে রাজশাহী হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজও প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।

এছাড়া ১৯৫৪ সালে সোবহানিয়া উচ্চ বিদ্যালয় (বর্তমানে কোর্ট একাডেমি নামে পরিচিত), ১৯৬০ সালে লক্ষ্মীপুর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়, রাজশাহী মহিলা কলেজ, রাজশাহী গার্লস মাদ্রাসা (বর্তমানে গার্লস হাইস্কুল), রাজশাহী মুসলিম হাইস্কুলসহ আরো অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন মাদার বখশ।

স্মৃতিতে মাদার বখশ

কীর্তিমান এই মানুষটি আজ আর আমাদের মাঝে না থাকলেও তিনি বেঁচে আছেন তাঁর কর্মে। শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর অবদানের স্বীকৃতি দিতে বিচ্ছিন্নভাবে নেয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। মরহুম মাদার বখশ-এর প্রতি সম্মানার্থে ১৯৭৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মিত একটি আবাসিক ছাত্র হল ‘মাদার বখ্শ হল’ নামে নামকরণ করা হয়।

রাজশাহী টিচার্স ট্রেনিং কলেজের একটি ছাত্রাবাসেরও নামকরণ করা হয় মাদার বখশ-এর নামে। এছাড়া রাজশাহীর শহরের জিরো পয়েন্ট থেকে কোর্ট পর্যন্ত প্রশস্ত মহাসড়কের নাম ‘মাদার বখ্শ সড়ক’ নামকরণ করে রাজশাহী সিটি করপোরেশন। জন্মস্থান নাটোরের সিংড়া উপজেলার স্থাপনদীঘি গ্রামের প্রবেশপথে ভাষাসৈনিক মাদার বখশ গেট তৈরি করা হয়েছে। তাঁর নামে আরও স্থাপিত হয়েছে ‘মাদার বখশ আইডিয়াল স্কুল’ (১৯৮৬) ও ‘মাদার বখশ গার্হস্থ্য অর্থনীতি মহিলা কলেজ’ (১৯৮৬)।

দেশবরেণ্য চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান ১৯৮১ সালে ‘মাদার বখশ স্মৃতি পদক’ প্রদান উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকায় এক শুভেচ্ছা বাণীতে বলেন, ‘মাদার বখশের মতো এরকম মহাপুরুষ আরো পাঁচজন হলে দেশের অনেক অভাব পূর্ণ হতো, শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্র অনেক উপকৃত হতো এবং গুণী, শিল্পী, সাহিত্যিক ও সমাজসেবীদের মর্যাদা হতো। দেশের শিল্প ও সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নতুন কিছু অনুভব করতে পারতাম।’

কিছু আক্ষেপ

১৯৬৭ সালের ২০ জানুয়ারি পরলোকগমন করেন কীর্তিমান এই মানুষটি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য রাজশাহীর শিক্ষাবিপ্লবের এই অগ্রসৈনিক তাঁর প্রাপ্য মূল্যলয়ন পাননি। মাদার বখশ-এর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই তাঁর জন্মদিবস বা মৃত্যুবার্ষিকী উদযাপন করা হয় না। এসকল প্রতিষ্ঠানে পড়ুয়া শিক্ষার্থীরাও কীর্তিমান এই মানুষটি সম্পর্কে জানেন খুব সামান্যই। কিংবদন্তি এই শিক্ষাবিদের স্মৃতি রক্ষা কিংবা অবদানকে স্বীকৃতি দিতে জাতীয়ভাবেও কখনো নেয়া হয়নি কোনো উদ্যোগ। এমন পরিস্থিতি চলমান থাকলে হয়তো কিংবদন্তি এই শিক্ষাবিদের অবদান হারিয়ে যাবে কালের গহ্বরে

Sending
User Review
0 (0 votes)

লেখক সম্পর্কে

ফুয়াদ পাবলো

ফুয়াদ পাবলো

ফুয়াদ পাবলো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী।

মন্তব্য লিখুন