বাংলাদেশে শিক্ষার সামগ্রিক উন্নয়নে শিক্ষকের বেতন বৃদ্ধিই কী সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি নয়?

বাংলাদেশে শিক্ষার যে নাজুক অবস্থায় রয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তৃতীয় বিশ্বের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় যতগুলো সমস্যা থাকার কথা তার সবগুলোই এখানে আছে। তৃতীয় বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থায় গলদ যত বেশি তথাকথিত বুদ্ধিজীবিদের পকেট ভারী করার সুযোগও তত বেশি। এই প্রজেক্ট, সেই প্রজেক্ট-প্রজেক্টের কোন অভাব নেই। যত্রতত্র এনজিও’রও অভাব নেই। বিদেশি ডোনারদের থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতানোই এদের কাজ।

যখন রাষ্ট্র তার অবশ্য পালনীয় কর্তব্যে ব্যর্থ হয় তখন বিদেশি দাতা গোষ্ঠীর মাধ্যমে ধনী রাষ্ট্রগুলো কিছু ফায়দা লোটার চেষ্টা করে। বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশে শিক্ষার উন্নয়ন নিয়ে বহু প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। একটি প্রকল্প শেষ হয়েছে তার দ্বিতীয় ফেজ শুরু হয়েছে।

দেশি বুদ্ধিজীবিরা বিশেষজ্ঞ হিসেবে নিয়েছে মোটা অংকের টাকা আর সাদা চামড়া ও চকচকে কালো চামড়ার বিদেশি বিশেষজ্ঞরা নিয়েছে মোটা অংকের ডলার। কিছু গ্রামীণ বিদ্যালয়ের কাঠামোগত পরিবর্তন হয়েছে, পাঠ্যক্রমে বিদেশি পাঠ্যপুস্তকের জটিল অনুবাদ কপি-পেস্ট করা হয়েছে।

এতে পাঠ্যক্রমের ধারাবাহিকতায় অসামঞ্জস্যতা প্রকট হয়েছে। আর যেটা হয়েছে সেটা হল বছরে বছরে শিক্ষাক্রমের পরিবর্তন। প্রচুর শিক্ষার্থী হয়েছে গিনিপিগ। বাংলাদেশে শিক্ষার মৌলিক গুণগত পরিবর্তন খুব সামান্যই হয়েছে। এর পেছনের কারণ খতিয়ে দেখলে দেখা যায় মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন শেষে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকরি গ্রহণ, বিদেশ গমন, শিক্ষা বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ না করা আমলা কর্তৃক শিক্ষাক্রম প্রস্তুতকরণ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণকে গণহারে শিক্ষাবিদ উপাধি দিয়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় বিশেষজ্ঞ হিসেবে জাতীয় পর্যায়ে কাজ করানো।

শিক্ষাবিজ্ঞান এখন এত বড় একটি ক্ষেত্র যে এটি নিয়ে দীর্ঘ সময়ে কাজ না করলে এবং তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক পর্যায়ে যথাক্রমে পড়াশোনা ও কাজ না করলে কোন স্থায়ী, গ্রহণযোগ্য ও মানসম্মত শিক্ষা পদ্ধতি উপহার দেওয়া সম্ভব নয়। তার চেয়েও বড় ব্যাপার হল, প্রচলিত শিক্ষাক্রমেই অনেক উন্নতমানের শিক্ষা নিশ্চিত করা যেত যদি মেধাবী ও উন্নত মানসিকতার তরুণরা গণহারে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিত। আইন যেমনই হোক না কেন যোগ্য ও সৎ বিচারপতি ঠিকই ন্যায়বিচার উপহার দিতে পারেন। ঠিক তেমনি শুধুমাত্র সমাজের উচ্চ মেধাস্তরের ছেলেমেয়েদের স্কুল পর্যায়ের শিক্ষকতা পেশায় সম্পৃক্ত করা গেলেই বর্তমান শিক্ষা সমস্যার সিংহভাগ সমাধান হয়ে যেত।

অতীব দুঃখের বিষয় হল, শিক্ষাখাতে ব্যয় হওয়া বিশাল অংকের টাকা কার্যকর উপায়ে ব্যয় না হয়ে বিদেশি উন্নয়ন ও দাতা সংস্থার কুটিল শর্ত অনুযায়ী অদক্ষ সরকারি লোকজন দ্বারা ব্যয় করা হয়।

বাংলাদেশে শিক্ষার উন্নয়নের বেশিরভাগ বাজেট চলে যায় উচ্চশিক্ষিত পিএইচডিধারী বিশেষজ্ঞগণের সম্মানীর পেছনে এবং প্রকল্পে ব্যবহৃত গাড়ি ও তার তেল কিনতে। এই টাকা যদি সমগ্র বাংলাদেশের শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ও শিক্ষার্থীদের শিক্ষা উপকরণ ক্রয়ে ব্যয় করা হত তাহলে শিক্ষার উন্নয়ন আজ পরিষ্কারভাবে দৃশ্যমান হত। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন ও সামাজিক মর্যাদা যদি উচ্চ হত তাহলে আমাদের উচ্চশিক্ষিত ও মেধাবী তরুণ সমাজ বাণিজ্যিক ব্যাংক, মোবাইল কোম্পানি প্রভৃতি বহুজাতিক কোম্পানির দিকে না ঝুঁকে নিজেদের শিক্ষকতার মহান পেশায় নিয়োজিত করত। এতে উপকার হত আমাদের দেশের।

আজ একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ব্যতীত আর কোন পর্যায়ের শিক্ষক মানুষ শখ করে হতে চায় না সামাজিক মর্যাদা ও স্বল্প সম্মানীর কারণে। বিষয়টি খতিয়ে দেখার প্রয়োজন বোধহয় এখনই।

জনপ্রিয় নিবন্ধ

প্রাথমিক স্তরে ভাষা শেখা : বিষয় – বাংলা

ভাষার দক্ষতা চারটি— শোনা, বলা, পড়া, লেখা। আর ভাষা...

আগে ইংরেজি গ্রামার শিখবো, নাকি ভাষা শিখবো?

কোন ভাষার গ্রামার হলো ঐ ভাষার গঠন প্রকৃতি যার...

শিক্ষাব্যবস্থার হালচাল

অর্থনীতিবিদদের মতে, শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ সবচেয়ে লাভজনক এবং নিরাপদ রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ। অর্থনীতিবিদ এডাম স্মিথ, ডেভিড রিকার্ডো এবং মার্শালের মতে, শিক্ষা এমন একটি খাত যার কাজ হলো দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলে পুঁজির সঞ্চালন ঘটানো। শিক্ষার অর্থনীতি নিয়ে মৌলিক গবেষণায় অর্থনীতিবদ আর্থার শুল্জ ও রবার্ট সলো দেখিয়েছেন যে, প্রাথমিক শিক্ষায় বিনিয়োগ করলে সম্পদের সুফল ফেরত আসে ৩৫ শতাংশ, মাধ্যমিক শিক্ষায় ২০ শতাংশ, এবং উচ্চ শিক্ষায় ১১ শতাংশ।

আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা : পিএইচডির পর কী?

আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়, আমি নিজেও এ-নিয়ে...

ক্যাডেট কলেজে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে কিছু কথা

ক্যাডেটসমূহ বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।...

আরও কিছু লেখা

অধিক

    জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯: কিছু আলোচনা

    শাহরিয়ার শফিক লিখেছেন জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯ প্রসঙ্গে গত ৭...

    বাজেটে শিক্ষা: অর্থমন্ত্রীর কাছে যা চাই

    প্রয়োজনে অর্থমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী একসঙ্গে বসুন এবং তারপর এ ব্যাপারে একটি কৌশল নির্ধারণ করুন। যে কাজটি করতে আপনারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, সেই কাজের একটা দৃশ্যমান প্রতিফলন দেখতে চাই আমরা।

    গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষা কেন?

    সমীর রঞ্জন নাথ লিখেছেন গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে...

    মানসম্মত ও টেকসই শিক্ষা উন্নয়ন

    শিক্ষা এই উন্নয়নকে ত্বরান্বিত ও টেকসই করতে পারে তখনি যখন শিক্ষা নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য নিশ্চিত করা হবে, একই সাথে উচ্চ শিক্ষিত ও নিম্ন শিক্ষিত মানুষদের মধ্যে ফারাক কমিয়ে আনা হবে। তবে শিক্ষা অর্জনের ধরন আর প্রদানের ধরনে পরিবর্তন আনতে হবে। পাঠ্য বইয়ের শিক্ষাকে বাস্তব জীবনের সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে।

    মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ: কেমন হতো যদি এমন শিক্ষাব্যবস্থা হতো?

    শহিদ শাকিল লিখেছেন শিক্ষামন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষামন্ত্রীর...

    রোগীর সামাজিক পরিবেশ ও আমাদের ডাক্তারি বিদ্যা

    আমার সচরাচর খুব একটা অসুখ হয় না। এদিক দিয়ে...

    শিক্ষাক্ষেত্রে ডিজিটালাইজেশন: সংশ্লিষ্টদের বিড়ম্বনা

    ডিজিটালাইজেশন তথা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতের সম্প্রসারণের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে তথ্যের আদান-প্রদানকে সহজলভ্য করে মানুষের সময়, শ্রম ও অর্থের সাশ্রয় করা। এক্ষেত্রে পরিকল্পনা প্রণয়ন পর্যায়ে দেশে বিরাজমান তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সুবিধা ও সুবিধাভোগীদের প্রযুক্তিজ্ঞানের কথা যেমন মাথায় রাখতে হবে, তেমনি গৃহীত পদক্ষেপ বা পদ্ধতি কতটা সুবিধা দিতে পারছে তাও নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে। আর তাহলেই আমরা এগিয়ে যেতে পারবো তথ্যপ্রযুক্তির অপার সম্ভাবনার রাজ্যে।

    গবেষণার নৈতিকতা বা এথিক্স

    (গবেষণার নৈতিকতা ব্যাপারে দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশে তেমন বেশি শেখানো হয়...

    প্রাসঙ্গিক নিবন্ধসমূহ

    নতুন লেখার খবর পান ইমেইলে
    বাংলাদেশের শিক্ষা প্রসঙ্গে নতুন লেখা প্রকাশিত হলে সেই খবর পৌঁছে যাবে আপনার ইমেইলে।
    পূর্ববর্তী নিবন্ধ
    পরবর্তী নিবন্ধ