আ.ন.স হাবীবুর রহমান: উনিশ শত আশি এবং নব্বইয়ের দশক জুড়ে আমাকে বয়স্ক সাক্ষরতা নিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রশিক্ষণ চালাতে হয়েছে। কাজ করতাম এফআইভিডিবি (সিলেটে) ব্যবহারিক শিক্ষা কার্যক্রমে। আমাদের উদ্ভাবিত বয়স্ক সাক্ষরতা উপকরণ ব্যবহার করে অনেক এনজিও। আমাদের উপকরণের চাহিদা যারাই দেখতো তাদের মধ্যমস্তরের কর্মীদের (প্রশিক্ষক) হয় সিলেটের খাদিম নগরে গিয়ে প্রশিক্ষণ দিতে হতো আর না হয় আমরা গিয়ে প্রশিক্ষণ দিতাম। কোনো কোনো প্রশিক্ষণে নির্বাহী পরিচালকেরাও অংশ নিতেন।
প্রশিক্ষণ হতো ১০ দিনের আর প্রায় ক্ষেত্রে এটি একজনকেই চালাতে হতো। প্রথম চার বছর জেমস জেনিংস আর আমি মিলে সামাল দিতাম, পরবর্তীতে আসলেন মোহাম্মদ মহসীন (১৯৮৫) সালে এবং মঈনুস সুলতান ( ১৯৮৭)। আমার চাকরির সময়কালে সবশেষে নজরুল ইসলাম মঞ্জুর (১৯৮৮) ।বছরে ছ’মাস সিলেটে বা ঢাকায় আর ছ’মাস বিভিন্ন জেলায়। বয়স্ক সাক্ষরতা বিষয়ে দশ দিনের প্রশিক্ষণ একা পরিচালনায় কিছুটা যে বক্তৃতাকেন্দ্রিক হতো তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু মার্কসবাদের শেখা অ,আ,ক,খ এর প্রভাবে যে অংশগ্রহণকারীদের তন্ময় রাখা যেতো তা আজ মনে করলে বিষ্ময় জাগে। প্রশিক্ষণগুলো ছিল আবাসিক আর চলতো রাত দশটার পর পর্যন্ত। অবশ্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অংশগ্রহণমুখী পদ্ধতি ব্যবহার করায় ক্লান্তি দেখতাম না কারো মধ্যে।
একেকটা প্রশিক্ষণে জনা ত্রিশেক অংশ নিতেন। প্রশিক্ষণ শেষে বেদনাবিধুর পরিবেশের সৃষ্টি হতো। সেই অভিজ্ঞতার আলোকেই এই লেখা। এখানে বলে রাখি এনজিও কর্তৃক পরিচালিত প্রশিক্ষণ তখনও এতো পরিকল্পিত ছিল না। আমরা নিজেরাই ছিলাম উদ্ভাবক। একা দশ দিন প্রশিক্ষণ চালানো! আজকাল এটা কল্পনা করা যায় না এবং এটি গ্রহণযোগ্যও হবে না। কিন্তু আমরা তখন পেরেছি। এখন আমরাও পারবো না বা আমাদের ঐ সময়কার বয়েসিরাও পারবে না। ভূমিকাটা এখানে শেষ করি । আশা করি অভিজ্ঞতার ডালি নিয়ে পরের পর্বগুলো সাজাবো।
দুই.
বয়স্ক শিক্ষার সাথে জড়িয়ে আছে ইংরেজি শব্দ Non-Formal Education (NFE)। বয়স্ক সাক্ষরতা যেহেতু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নয়, তাই এটি NFE। ইংরেজি Non-Formal Education (NFE) শব্দমালার উৎপত্তি দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধোত্তর সময়ে। এখনো ইংরেজি সাধারণ অভিধানে এটি যুক্ত হয়নি। বাংলায় এর প্রতিশব্দ কী হতে পারে! পশ্চিম বাংলায় কেউ কেউ ব্যবহার করছিলেন ‘প্রথামুক্ত শিক্ষা’ বা ‘বিধিবহির্ভূত শিক্ষা’। আমাদের কাছে শব্দ দুটোকে যুৎসই মনে হয়নি, তাই আমরা ‘অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা‘ শব্দটি ব্যবহার শুরু করলাম। অবশ্য ১৯৮৭ সালের দিকে Non-Formal Primary Education (NFPE) শুরু করলে তারা ‘উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা’ শব্দমালা ব্যবহার করতে থাকে। শিশুদের জন্য যথাযথ হলেও বয়স্কদের ক্ষেত্রে এ অনুবাদটি তেমন যায় না। তথাপি এখন বাংলাদেশে সরকারিভাবে এ শব্দটিই স্বীকৃত হয়েছে।
বয়স্কদের জন্য অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা হচ্ছে অনেক ব্যাপক। লাইন করে ইরি ধান রোপন, সারের ব্যবহার শেখা, ডায়রিয়ার সময় লবণ গুড়ের শরবত বানাতে শেখা, গর্ভবতী মা ও শিশুর যত্ন শেখা সবকিছুই অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার আওতায় পড়ে। সবুজ বিপ্লবের সময় (১৯৫০এর দশক) থেকে শুরু করে আমাদের দেশের মানুষ প্রতিষ্ঠানের বাইরে অনেক কিছুই শিখছে যা অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। তাই বলে এটিকে অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা (Informal Education) ‘র সঙ্গে গুলিয়ে ফেললে হবে না। অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শেখানোর জন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের পরিকল্পনা থাকতে হয়। এ পরিকল্পনায় থাকে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য যা প্রাতিষ্ঠানিকের মতো সময় ও অর্থ ব্যয় সাপেক্ষ যেমনি নয়, তেমনি অনানুষ্ঠানিকের মতো আপনিতেই শেখা যায় না।
যা–ই হোক আমরা বয়স্কদের জন্য সাক্ষরতাকেন্দ্রিক যে কর্মসূচি চালাতাম তা ছিল অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অংশ। তাই প্রশিক্ষণে অপ্রাতিষ্ঠানিক (উপানুষ্ঠানিক শব্দও ব্যবহার করতে পারেন) শিক্ষার ওপর বিস্তৃত আলোচনা হতো। আমাদের প্রশিক্ষণে Formal Education, Informal Education & Non-Formal Education- শিক্ষার এ তিনটি প্রকরণের পার্থক্য নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হতো যাতে বয়স্ক সাক্ষরতা পরিচালনায় নিয়োজিত কুশলীরা কোনো বিভ্রান্তির মধ্যে না পড়েন।
শুরুতে আমরা একটি বিষয় প্রতিষ্ঠিত করতাম যে, শিশুদের শিক্ষাদান আর বয়স্কদের জন্য পাঠ পরিচালনা কখনো এক হতে পারে না। বয়স্করা অনেক অভিজ্ঞতার জনক। তাই বয়স্কদের শিক্ষায় নিয়োজিত ব্যক্তি শিক্ষক নন, তিনি সহায়ক বা Facilitator। তিনি নিজেও শিখবেন অংশগ্রহণকারীদের কাছ থেকে। এটি হচ্ছে Two way learning। শিক্ষার্থী আর সহায়ক এ দুটো শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে চালিত হতো বয়স্ক সাক্ষরতা। এখানে উল্লেখ প্রয়োজন যে, ব্র্যাক ১৯৭৭ সাল থেকে বয়স্ক শিক্ষার এ ধারার সূত্রপাত ঘটায় যা ৮০ এর দশকের শুরু থেকে সমৃদ্ধতরভাবে এফআইভিডিবি বিকশিত করে।
তিন.
দশ দিনের প্রশিক্ষণ তা যদি প্রশিক্ষকদের জন্য হতো তাহলে ৪ দিন এবং সহায়কদের জন্য হলে ৩ দিন থাকতো সমাজ ও শিক্ষা প্রসঙ্গে দার্শনিক বিষয়সমূহ আলোচনা যাতে গ্রামীণ জ্ঞানকে গুরুত্ব দেওয়া হতো। অংশগ্রহণকারীগণ গ্রামীণ সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থান বিশ্লেষণ করতেন। সাধারণত তা হতো গত ২৫ বছরের। এর মধ্যে প্রান্তিক কৃষক থেকে ভূমিহীন বা দিনমজুরে, দরিদ্র থেকে নিঃস্ব হওয়ার প্রক্রিয়াটি তারা যেভাবে দেখেছেন বা জেনেছেন তা ওঠে আসতো।
প্রসঙ্গ আসতো ৭৪ এর দুর্ভিক্ষের। এর ফলে কীভাবে ভূমিহীনের সংখ্যা বেড়েছে তার বিশ্লেষণ হতো। যখন এর জন্য বন্যা, খরা এসবকে দায়ী করা হতো অংশগ্রহণকারীগণই বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্তে পৌঁছতেন এসব কি শুধু দরিদ্রদের জন্য হয়? এরকম প্রাকৃতিক দুর্যোগে ধনী আরো ধনী হয় কীভাবে। এভাবে তাঁরাই রাষ্ট্রযন্ত্রের অবস্থান বুঝতেন। ঐ সময় শুধু আমরা নই, অন্য অনেকেই একটি পিরামিডে জনসংখ্যা ও সম্পদের অবস্থান নির্ধারণ করা হতো। এটি প্রায়শ মাইক্রো অর্থনীতির আলোকে আলোচিত হতে পারতো। প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণকারীগণই পিরামিডে জনসংখ্যা ও সম্পদের অবস্থানগত বৈপরিত্য চিহ্নিত করতেন। সাধারণভাবে যা দেখা যেতো যে ১০ ভাগ মানুষের হাতে ৬০ ভাগ সম্পদ আর ৬০ ভাগ মানুষের হাতে ১০ ভাগ সম্পদ এবং ২৫ বছর আগে যে এ অবস্থান এতো খারাপ ছিলো না বা নিজেরা নিজেদের সংরক্ষণ না করলে পরের ২৫ বছরে যে আরো শোচনীয় হবে এ ধারণাটি প্রতিষ্ঠিত হতো আর বয়স্ক শিক্ষাকে এ অবস্থা পরিবর্তনে কীভাবে অনুঘটক হিসেবে ব্যবহার করা যায় তা বিস্তারিতভাবে অংশগ্রহণমূলক আলোচনায় বেরিয়ে আসতো।
শুধু অর্থনৈতিক নয় সামাজিকভাবে দরিদ্র মানষের অবস্থানও বিশ্লেষিত হতো। যদিও ধর্মীয় দিক নিয়ে আলোচনা অনেকটা স্পর্শকাতর, কিন্তু বর্তমান অবস্থায় ধর্মীয় অনুশাসন কাদের স্বার্থকে সংরক্ষণ করার জন্য সমাজপতিরা চেষ্টা করেন তা খোলাখুলি আলোচনা হতো। সিলেটে সরাসরি বয়স্ক শিক্ষার সহায়ক হিসেবে ক’জন গ্রামীণ ইমাম কাজ করতেন। প্রশিক্ষণে তাঁদেরকে বেশ সক্রিয় দেখতাম। তাঁরা একবার ৫ টি মসজিদের মোতাওয়াল্লির অবস্থান বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছিলেন যে, তিনটিতেই আছেন এমন লোকজন যারা বিচার পঞ্চায়েতে পক্ষপাতিত্ব করেন, টাকা লগ্নি লাগিয়ে কম দামে কৃষকের ধান কিনেন, মেয়েদের অর্থনৈতিক কাজে যোগদানের বিরোধিতা করেন ইত্যাদি। মোট কথা সমাজের অবস্থান বদল ছাড়া যে, অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠিত হবে না এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে পরিবর্তনে ভূমিকা রাখায় অংশগ্রহণকারীগণ প্রত্যয় ব্যক্ত করতেন। বলাবাহুল্য প্রশিক্ষক হিসেবে আমরা কথা বলতাম শতকরা ৫০ ভাগের কম, অংশগ্রহণকারীরাই সক্রিয় আলোচনা করতেন।
চার.
শিক্ষা নিয়ে প্রতিটি প্রশিক্ষণে আলোচনা জমজমাট হতো। আমরা যে খুব একটা পাওলো ফ্রেইরি পড়েছি বা আইভান ইলিচের লেখার সঙ্গে পরিচিত ছিলাম এমনটি নয়। কিন্তু মনে হয় তাদের মূল বক্তব্যগুলো অনুধাবণ করে তার বিস্তরণে সচেষ্ট ছিলাম। আইভান ইলিচ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে ক্রেতা–বিক্রেতার সম্পর্ক হিসেবে তুলে ধরেছেন। তাঁর মতে, এখানে শিক্ষক বা শিক্ষা প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ হচ্ছে বিক্রেতা আর শিক্ষার্থীরা হচ্ছে ক্রেতা। যার যত বেশি কেনার সামর্থ্য আছে সে তত বেশি শিক্ষা কিনতে পারছে। তিনি আরেকটি উদাহরণে বলেছেন যে, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার শিক্ষার্থীরা হচ্ছে এমন একটি বাসের যাত্রী যার গন্তব্য বিষয়ে তারা জনে না। এরকম শিক্ষার আয়োজনকে তিনি তামাশা হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
অন্যদিকে পাওলো ফ্রেইরি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থাকে ব্যাংক সিস্টেম হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেছেন, শিক্ষক হচ্ছেন জ্ঞানের ভাণ্ডার আর শিক্ষার্থীদের মস্তিস্ক হচ্ছে জ্ঞান জমা রাখার ব্যাংক। আর পরীক্ষা হচ্ছে চেকবইয়ের পাতা। যার মাথায় যত বেশি জ্ঞান জমা হয়েছে সেখান থেকে তত বেশি চেক বই দ্বারা ওঠানো যাবে। যার মাথায় চেকের অঙ্কের চেয়ে কম জমা হয় সে অকৃতকার্য।
পাওলো ফ্রেইরির দর্শন মতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা হচেছ একমুখী। এখানে থাকে দু’টি পক্ষ– শিক্ষক আর ছাত্র। শিক্ষক মনে করেন তিনি সব জানেন। ছাত্ররা মনে করে তারা কিছুই জানে না আর শিক্ষক সব জানেন। তাই জানতে হবে শিক্ষকের কাছ থেকেই– নিজেরা একে অন্যের কাছ থেকে কিছুই শিখতে পারে না। একের পর এক সারিতে বসা, শিক্ষক ছাড়া অন্যের কাছ থেকে জানতে না চাওয়া এবং শিক্ষকের প্রশ্নের জবাব দেওয়া ইত্যাদি আয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বৈশিষ্ট্য। এর ব্যত্যয় করা শাস্তিযোগ্য।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার এরকম আয়োজন একপক্ষকে নিরব করে রাখে। তারা যখন বড় হয় পিয়ন থেকে উপরের যেকোনো কেউকেটা হয় তখন তারা নিজেদের চারপাশের মানুষকে এমনটিই রাখতে চায়। তাইতো শহর থেকে যাওয়া আমলা যিনি জীবনে কৃষিকাজ করেননি তিনিও গ্রামে গিয়ে কৃষককে উপদেশ দিতে ছাড়েন না। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার এই আদলেই গড়ে ওঠেছে আমাদের সমাজ।
এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র মানুষকে মনে করা হয় তারা কিছু জানে না। মুষ্টিমেয় লোক নিজেদেরকে সবকিছুর বিধান পত্র দাতা হিসেবে দেখেন। যুগযুগ যাবৎ এরকমটি চলে আসায় সাধারণ মানুষও মনে করতে থাকেন আমরা কিছুই জানি না, উনারা সবকিছু জানেন। তাই একজন ভূমিহীন কৃষককে যখন তার দশ বছর আগের অবস্থা জিজ্ঞেস করেন, তিনি জানান তাঁর দুই বিঘা জায়গা ছিল। এখন নাই কেন জানতে চাইলে বলেন তা কী করে বলবো? আমরা মুষ্টিমেয়ের প্রতিনিধিরা জানিয়ে দেই ‘মিয়া তুমি পরিশ্রম কর না, তোমার সন্তান বেশি, তুমি অশিক্ষিত’। পাওলো ফ্রেইরি এ অবস্থাকে বলেছেন নিরবতার সংস্কৃতি (Culture of Silence)। বিশ্লেষণমুখী সচেতনতা তৈরি করে তার এ নিরবতা বা অদৃষ্টবাদিতা ভাঙা যায়। তখন সে দেখতে পায়, একবার বন্যা এলো, ফসল হলো না, মহাজনের কাছে চলে গেলো তার জমি। বন্যা তো মহাজনের জন্যও এসেছিলো, তাহলে সে জমি হারালো আর মহাজন জমি বাড়ালো। পাওলো ফ্রেইরি শিক্ষায় এ রাজনীতি জানাকে গুরুত্ব দিয়েছেন।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার এসব দিক নিয়ে আলোচনা শেষে অংশগহণকারীদের মধ্যে একটা বিতর্ক প্রতিযোগিতা হতো। প্রায়শ এর শিরোনাম থাকতো ‘প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মধ্যেই প্রতিক্রিয়াশীলতার বীজ নিহিত রয়েছে।’ প্রস্তুতি নিয়ে বিতর্ক হতো। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার দোষ বিষয়ে এতো তথ্য উপাত্ত দেওয়া হতো যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রস্তাবনার পক্ষই জয়ী হতো।
পাঁচ.
আমরা বয়স্ক শিক্ষার যে দিকটির ওপর গুরুত্ব দিতাম তা হচ্ছে ‘ব্যবহারিক সাক্ষরতা‘ ( Functional literacy)। এটি কেবল লেখাপড়া বা সাক্ষরতা নয়, এর সাথে সংশ্লিষ্ট হচ্ছে অংশগ্রহণকারীর জীবন। ছয় মাসের একটি কোর্স যার মাধ্যমে তাঁরা সহজ বই পড়তে পারেন, প্রয়োজনীয় বিষয় লিখতে পারেন এবং হিসাব লিখে রাখতে পারবেন।এর সাথে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তাঁদের দৈনন্দিন জীবন জীবিকা নিয়ে বিশ্লেষণমুখী সচেতনতা। সাক্ষরতা ও বিশ্লেষণমুখী সচেতনতার সমন্বয় হচ্ছে ব্যবহারিক সাক্ষরতা। ১৯৮১ সালে আমরা এমন একটি কোর্স কর্ম নির্ভর গবেষণা পরিচালনার (Action Research) মাধ্যমে প্রণয়ন করেছিলাম। এর উপকরণমালায় ছিলো ’ব্যবহারিক লেখাপড়া’ প্রাইমার , সহায়ক অনুসরণিকা, চার্ট, ফ্লাশ কার্ড । জেমস জেনিংস এতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এর বৈশিষ্ট্য ছিল–
(১) নিজেদের জীবনকেন্দ্রিক কোনো একটি ছবির চার্ট প্রদর্শন করা হতো। ছবির বিষয়বস্তু অংশগ্রহণকারীগণই ব্যাখ্যা করতেন। এর মধ্যে নিজেদের সমস্যা চিহ্ণিত করতেন।
(২) সমস্যার ঐ পিন পয়েন্টকে অনুসরণিকায় বিস্তৃত করা থাকতো। এ নিয়ে সহায়ক আলোচনা করতেন। সমগ্র দলকে ৩/৪ টি দলে ভাগ করে ১০/১৫ মিনিটের দলীয় আলোচনা থাকতো যাতে প্রত্যেকে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে পারেন। তারপর দলীয় নেতার মাধ্যমে উপস্থাপন। এ প্রক্রিয়াটিকে ফ্রেইরির ভাষায় বলা হতো সংলাপ। এ সংলাপ অনুশীলনই নিরবতার সংস্কৃতি থেকে অংশগ্রহণকারীদের সোচ্চার অবস্থায় উত্তরণে সহায়তা করতো।
(৩) চার্ট থেকে ছবি কেন্দ্রিক বাক্যের সঙ্গে পরিচয়। বাক্য থেকে জোর দেওয়া হতো একটা শব্দে। ঐ শব্দ থেকে বর্ণ বা চিহ্ন ক্রমান্বয়ে পরিচয় করানো হতো। এর জন্য থাকতো ফ্লাশ কার্ড। কোনো শব্দ বানান করানো হতো না। অর্থাৎ অংশগ্রহণকারী ফ্লাশ কার্ডের মাধ্যমে শব্দ, বর্ণ ও চিহ্ন সবগুলোর সাথে পরিচিত হতো । নতুন পাওয়া বর্ণ ও চিহ্ন সহযোগে সিলেবল অনুশীলন করানো হতো। তাঁদের মধ্যে দৃষ্টায়ত্ব শব্দভাণ্ডার (Sight vocabulary) গড়ে উঠতো। এর পড়ার অংশ বানান না করে পড়ার ক্ষমতা তৈরি করতো। শব্দের ভেতরের বর্ণ, চিহ্ন তাঁরা ঠিকই চিনতেন, কিন্তু বানান করে পড়ার প্রবণতায় পড়ার গতি কমে যা বোধগম্যতাকে ক্ষতগ্রস্ত করে।
(৪) প্রাইমারের মধ্যেই লেখা চর্চার স্পেস থাকতো। তাঁরা নানাভাবে শব্দ, বর্ণ বা চিহ্ন লিখতেন এবং এগুলো আয়ত্ব করে ফেলতেন। আর সংখ্যা তো তাঁরা জানেন, শুধু লেখা শেখানোর দায়িত্ব পালন করতেন সহায়ক।
(৫) প্রতিদিন পড়ার একটি অংশ থাকতো যা প্রাইমারে প্রশ্ন এবং উত্তরের আকারে সাজানো থাকতো। পড়ার অংশটি দু’জন দু’জন করে পড়তেন। একজন পড়তেন প্রশ্ন অন্যজন উত্তর অর্থাৎ এখানেও সংলাপ।
(৬) প্রাইমার প্রণয়নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো পড়ার অংশের শব্দ নিয়ন্ত্রণ। একই শব্দ বিভিন্ন অবস্থানে বারবার ব্যবহার করা। বিভিন্ন বিষয়কে কেন্দ্র করে প্রায় ৫০০ শব্দে সমগ্র কোর্স সাজানো ছিল। আর একেকটি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে গড়ে ১৫ বার। এ কারণেই ছয় মাস সময়ে অংশগ্রহণকারীগণ এতোটা শিখতে পারেন। প্রতিদিনের শেষে তাদের মধ্যে যে আত্মবিশ্বাস তৈরি হতো এটিই এতো কষ্টকর জীবন চালানোর পরও বয়স্ক সাক্ষরতা ক্লাসে তাদের সোৎসাহে উপস্থিত থাকার প্রেরণা জোগাতো।
(৬) এ উপকরণ দ্বারা ১৫ থেকে ২০ জনের একটি বয়স্ক সাক্ষরতা দলকে পরিচালনার জন্য সনদপত্রধারী শিক্ষকের প্রয়োজন পড়ে না। বাংলা ভালোভাবে বুঝে পড়তে পারেন এমন নারী পুরুষ অঙ্গীকার আর প্রশিক্ষণের মিশ্রণে এরকম শিক্ষা দল পরিচালনা করতে পারেন। আমরা দেখেছি এরকম কোর্স দ্বারা লেখাপড়া শেখা বেশ কিছু নারী পরবর্তীতে সহায়কের দায়িত্ব পালন করেছেন।
(৭) সহায়ক শিক্ষার্থীদের কোনো অবস্থায় অশিক্ষিত মনে করতে পারেন না। প্রতি ধাপেই অংশগ্রহণকারীগণ নিজেদের জ্ঞানের স্বাক্ষর রাখেন।
দশ বছর ব্যবহারিক লেখাপড়ার এ উপকরণমালা সারা দেশের দুই শতাধিক এনজিও ব্যবহার করেছেন। সকলের কাছ থেকে পাওয়া ফিডব্যাক এবং আমাদের পর্যবেক্ষণের আলোকে ১৯৯০ সালে একই পদ্ধতি অনুসরণ করে শূন্যতাসমূহ পূরণ করে ‘ব্যবহারিক সাক্ষরতা’ নামে নতুন উপকরণ তৈরি করা হয়।
প্রশিক্ষণে উপকরণ প্রণয়নের ইতিহাস এবং এর পরিচালনা পদ্ধতি নিখুঁতভাবে উপস্থাপন ও এর অনুশীলন নিশ্চিত করা হতো।
ছয়.
বাংলাদেশে Non-Formal Education এর দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। সেই সবুজ বিপ্লব থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত মানুষ শিখছে নানাভাবে। উচ্চ ফলনশীল ফসল/শস্য/ ফল থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যশিক্ষার রকমারি দিক। এসব মানুষকে শিখতে হয়েছে। এর ফলে কৃষি উৎপাদন বেড়েছে, আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে, মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। এসবের ফলে সামগ্রিকভাবে মানুষের উন্নয়ন হলেও শোষণ, বৈষম্য, মানবাধিকার হরণ, নারীপুরুষ অসমতা. পরিবেশের বিপর্যয় এসব হ্রাস পায়নি। আর এসবের শিকার হচ্ছে মুলত দরিদ্র সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। বয়স্ক শিক্ষার মাধ্যমে এদের সাক্ষর করার কাজে পাওলো ফ্রেইরি দেখিয়েছেন এমন এক শিক্ষার পন্থা যা মানুষকে শোষণ–বঞ্চনা এবং অমর্যাদা থেকে মুক্তি দেবে। একে তিনি অভিহিত করেছেন মুক্তিদায়ী শিক্ষা( Liberating Education) নামে। আমরা শিক্ষার্থী পর্যন্ত এ ধারণার বিস্তরণের চেষ্টা করতাম
মুক্তিদায়ী শিক্ষার প্রথম কথাই হচ্ছে বঞ্চিত মানুষ নিজেরাই হচ্ছে নিজেদের ত্রাতা, কেউ এটা করে দিয়ে যাবে না। এজন্য দরকার ঐক্যবদ্ধভাবে বিশ্লেষণমুখী সচেতনতার প্রয়োগ। এই বিশ্লেষণমুখী সচেতনতা বোঝাতে গিয়ে মানুষের চেতনার বর্তমান অবস্থান নিয়ে আলোচনা হতো। এটা হচ্ছে সম্মোহনী বা যাদুময় স্তর। এ স্তরে মানুষ থাকে অদৃষ্টবাদী। কপালে লেখা বলেই গরিব বা আমি মূর্খ, এতো কী আর জানি! চারপাশের পরিবর্তন সে দেখে, মনে করে এগুলো তো হচ্ছে। এ পরিবর্তনে যে তার অবদান আছে তা সে ভেবেও দেখে না। শোষণ, অমর্যাদা, বৈষম্য এসবকে স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নেয়। এটিকে যে দর্শন বাক্য দিয়ে প্রকাশ করা যায় তা হচ্ছে ‘Man is in the World’।
এ সম্মোহনী স্তর থেকে মানুষকে বিশ্লেষণমুখী (Critical Awareness) স্তরে উত্তরণের জন্যই প্রয়োজন মুক্তিদায়ী শিক্ষা। মুক্তিদায়ী শিক্ষা তাকে সমস্যা চিহ্নিত করতে সহায়তা করবে। অর্থাৎ সমস্যাটা কী, কেন এটি সমস্যা, কীভাবে এটি সমস্যা, কে এই সমস্যা তৈরি করেছে তা পুঙ্খানুপঙ্খভাবে আলোচনা হবে। আর এটি কখনও একা বের করা যাবে না। এর জন্য প্রয়োজন দলীয় সংলাপ (Dialogue)। আমরা বয়স্ক সাক্ষরতাকে এরকম একটি সংলাপের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে দেখতে চেয়েছি। এসব আলোচনার সাথে মিল রেখে লেখাপড়ার পাঠ সাজানো হয়েছে।
এরকম কোর্সকে অংশগ্রহণকারীগণ বিনোদন হিসেবে দেখেন। প্রতিদিন আলোচনা থেকে শেখার নির্যাস তিনি বলতে পারেন আর দেখতে পান ঐদিন নিদেন পক্ষে একটি বর্ণ ও আগের শেখা বর্ণ চিহ্ন মিলিয়ে দু’তিনটা শব্দ পড়তে শিখেছেন। এ পড়াটা শুধু শব্দ পড়া নয় এটি তার জীবনকেও পাঠ করার সামিল।
এ বিবরণ পড়ে মনে হতে পারে যে, সনদপত্রধারী লোকজন ছাড়া এরকম শিক্ষাদল পরিচালনা সম্ভব নয়। কিন্তু এটি ঠিক নয়। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া জানা আর্থসামাজিকভাবে শিক্ষার্থীদের অবস্থানের হলেই তিনি এরকম শিক্ষাদল সুচারুরূপে পরিচালনা করতে পারেন। তবে কমপক্ষে ১০ দিনের আবসিক প্রশিক্ষণ দিয়ে শুরু করতে হবে। আবসিক এই কারণে যে, সংলাপ এবং পদ্ধতি অনুসরণের বিষয়গুলো তারা বেশি সময় অনুশীলন করতে পারেন।
সাত.
আসলে বয়স্ক সাক্ষরতা তথা ব্যবহারিক সাক্ষরতার প্রয়োজনীয়তা কতটুকু? সব বয়স্কদের কি এরকম শিক্ষা দলে নেওয়ার পরিকল্পনা সফল হবে? এরকম কিছু প্রশ্নের উত্তর নিয়ে আজকের কথাবার্তা। ব্যবহারিক শিক্ষা একজন মানুষকে তার নিজের চারপাশের অবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করে। সে নিজেকে পরিবর্তনের নিয়ামক শক্তি হিসেবে দেখে। অর্থাৎ সে বাস্তবতার দর্শক নয়, বাস্তবতায় প্রতিক্রিয়া ব্যক্তকারী একজন মানুষ। নিজেকে অবজেক্ট থেকে সাবজেক্ট (কর্তা) হিসেবে আবিষ্কার করতে পারে। তখন দর্শনের বাক্য ‘Man is in the world’ রূপান্তরিত হয় ‘Man is with the world’ এ। ‘পরিবর্তন হচ্ছে থেকে পরিবর্তন করছি ’ ভাবনায় নিয়ে যায়। নির্দেশিত বিধানপত্রের দিকে না তাকিয়ে সে প্রতিটি কাজকে বিশ্লেষণ করতে পারে।
ধরা যাক, রাসায়নিক সার দিলে ফসলের ফলন বাড়বে এটি একটি সত্য কিন্তু চূড়ান্ত সত্য নয়। রাসায়নিক সার ব্যবহারে পরিবেশের বিপর্যয় হবে, সার নির্ভরশীলতা জমির উর্বরতা কমায় ইত্যাদি বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করে সে জৈব সার ব্যবহারে নিজেকে প্রস্তুত করতে পারবে। তেমনি একটি দক্ষতা অর্জনের জন্য শ্রম দেওয়ার আগে সে এর ভালো–মন্দ, লাভ–ক্ষতি সব দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হবে। নেতা নির্বাচনে সে একই পদ্ধতি অবলম্বন করবে– যা দেখছে তাকেই সত্য হিসেবে মেনে না নিয়ে আসলে যা, তা উদ্ভাবন করবে। কাজেই ব্যবহারিক শিক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বটে। কিন্তু এটি খুব আয়েসে সম্পন্ন করা যাবে না। যারা ব্যবহারিক সাক্ষরতার ব্যবস্থা করতে চান তাদের সাথে অংশগ্রহণকারীদের পূর্ব–সম্পর্ক থাকতে হবে যা তাদের প্রতি আস্থা স্থাপন বোঝায়। এরকম সংগঠনই ব্যবহারিক সাক্ষরতায় বয়স্কদের উদ্বুদ্ধ করতে পারে। এর জন্য ব্যক্তিগত যোগাযোগ, দলগত সভা এসব খুবই দরকারি।অংশগ্রহণকারীগণ এর মাধ্যমে প্রতিশ্রুতি দেন যে পরবর্তী ছ’মাস তারা সপ্তাহে পাঁচ দিন দেড়/দুই ঘণ্টা করে উপস্থিত থাকবেন। এরকমটি ব্যবহারিক সাক্ষরতা ছাড়া উন্নয়নের আর কোনো কর্মসূচিতে সম্ভব নয়। ব্যবহারিক সাক্ষরতায় সচেতনতার কোন স্তরে তারা উপনীত হবেন তা দেখানো যাবে না, কিন্তু পড়া, লেখা ও হিসাবের দক্ষতার লাভ তারা দেখতে পান।
বয়স্কদের কি বাধ্যতামূলকভাবে সাক্ষরতায় নিয়ে আসা উচিত কি না? বয়স্ক মানুষ নিজেরা সিদ্ধান্ত নেবেন তারা এরকম শিক্ষায় যোগ দেবেন কিনা। উদ্বুদ্ধ করে এরকম শিক্ষার আয়োজন নিষ্ফল হয়। আর কারা তাদের উদ্বুদ্ধ করতে পারেন তা আগেই বলা হয়েছে। এমতাবস্থায় বয়স্কদের জন্য ব্যবহারিক সাক্ষরতা একটি ধীর প্রক্রিয়া। দু’ বছরের পরিকল্পনা নিয়ে যদি মোট নিরক্ষর বয়স্ক জনগোষ্ঠীর পাঁচ শতাংশকে এরকম কার্যক্রমে জড়িত করা যায় এর প্রভাব হবে অনেক। কোনো সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি করে বয়স্কদের ব্যবহারিক শিক্ষায় আসতে বাধ্য করা মোটেই যৌক্তিক নয়। যেসব সংগঠন প্রচেতনীকরণ সাক্ষরতা কোর্স চালিয়ে সীমিত সংখ্যক নারী পুরুষকেও ব্যবহারিক সাক্ষরতায় নিয়ে আসতে পেরেছেন তাদের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের গুণগত মানই আলাদা। ব্যবহারিক সাক্ষরতা ব্যতীত অন্যান্য ক্ষেত্রে দলে সাপ্তাহিক আলোচনা পরিচালনার আয়োজন অনেক সংগঠনই করে, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেগুলো ঋণ দেওয়া আর কিস্তি আদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে।
আট.
এর মধ্যে ৩৪ বছর হয়ে গেলো এফআইভিডিবি’র উদ্ভাবিত বয়স্ক সাক্ষরতা উপকরণ উন্নয়নের। আমরা বলেছিলাম এটি কর্ম নির্ভর গবেষণার মাধ্যমে উন্নয়ন করা হয়েছে। এর প্রক্রিয়াটি ব্যাখ্যা করা যাক। এর আগে ছ’মাস বিদ্যমান দু’টি পদ্ধতির তুলনামূলক সার্থকতা যাচাই করা হয়েছে। এর একটি ছিল কুমিল্লা পদ্ধতি আর অন্যটি ব্র্যাক পদ্ধতি।
কুমিল্লা পদ্ধতিতে সাক্ষরতার আধুনিক দিকটির বেশ প্রতিফলন ছিল। মৌলিক সাক্ষরতার জন্য তাদের একটি বই ছিল (‘বড়দের পড়া’ নামে)। প্রয়াত আব্দুল কুদ্দুছ, যিনি পাকিস্তানি আমলে কুমিল্লায় প্রতিষ্ঠিত বয়স্ক সাক্ষরতা উপ অধিদপ্তরের এডিপিআই ছিলেন। বয়স্ক শিক্ষার জন্য আজীবন নিবেদিত এ ব্যক্তিত্বের প্রতি জানাচ্ছি শ্রদ্ধাঞ্জলি। ঐ বইয়ে ছবি থেকে শব্দ পদ্ধতিতে বর্ণ পরিচয় করানো হতো। বইটির কলেবর ছিল ছোট এবং শিক্ষার্থীরা বুঝে শেখার বদলে সব মুখস্থ করে ফেলত। আর ব্র্যাক পাওলো ফ্রেইরির শিখন তত্ত্ব অনুসরণ করে ছ’মাসের ব্যবহারিক শিক্ষা পাঠমালা প্রণয়ন করেছিল। লেখাপড়ার চেয়ে প্রচেতনীকরণের ওপরই সেখানে অধিক গুরুত্বারোপ করা হয়েছিল। ১৯৮০’র দশক জুড়ে বাংলাদেশের অনেক সংস্থাই ব্র্যাক পদ্ধতি অনুসরণ করতো। পরবর্তীতে শিশু শিক্ষায় মনোনিবেশ করে ব্র্যাক বয়স্ক শিক্ষার ঐ প্রক্রিয়াটিই পরিত্যাগ করেছিল।
১৯৮০ সালের শেষ দিক থেকে এ দুটো পদ্ধতির তুলনামূলক সাফল্য মূল্যায়ন করতে গিয়ে দেখা যায় যে, ব্র্যাক পদ্ধতিতে অংশগ্রহণকারীদের সচেতনতার স্তর অনেক ভালো , কিন্তু তাদের বেশির ভাগই নাম ঠিকানা লেখার বেশি যেতে পারে না। অন্যদিকে কুমিল্লা পদ্ধতির শিক্ষার্থীরা বর্ণ চিহ্ন ঠিকই শিখে কিন্তু পড়া বা লেখায় তা কমই প্রয়োগ করতে পারে। তাদের সচেতনতার স্তরও অনেক নিচে। দু’টো পদ্ধতিতেই ঝরেপড়ার হার ছিল অনেক বেশি। এ তুলনা থেকে এ সিদ্ধান্তে পোঁছানো সম্ভব হয় যে, বাংলাদেশের দরিদ্র নারী–পুরুষের জন্য এমন পদ্ধতি উদ্ভাবন করতে হবে যাতে লেখাপড়া ও সচেতনতার স্তরের মধ্যে একটা সামঞ্জস্য থাকে আর ঝরে পড়া রোধের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা থাকে।
তুলনামূলক মূল্যায়ন ছিলো অংশগ্রহণকারীদের চাহিদা নিরূপণের ভিত্তি। শুরু হয় শিক্ষাক্রমের কাঠামো তৈরির কাজ। শিক্ষার্থীরা প্রথম দুই মাস কী কী জানবে, কীভাবে বর্ণ বা চিহ্নের বিন্যাস করা হবে ইত্যাদির একটি কাঠামো প্রণয়ন করা হয়, প্রথম পাঁচ দিনের পাঠও তৈরি হয়।
এফআইভিডিবি’তে সুন্দর হস্তাক্ষর ছিলো একজন কর্মীর। তার হাতের লেখা দিয়ে পাঠ সাজানো হতো এমনভাবে যেন শিক্ষার্থীরা এরমধ্যেই পড়া লেখা ও সংখ্যা চর্চার সুযোগ পান। এফআইভিডিবি’র একটি ছোট অফসেট মেশিন ছিল যাতে করে প্রতি পাঠের ৫০ কপি ছাপানো হতো (ঐ সময় এরকম মেশিন আর কোথাও ছিলো কি না জানি না)। খাদিম নগরের পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে অনেক আলাপ আলোচনা করে দুটো শিক্ষা দল (একটি নারী এবং অন্যটি পুরুষ) সংগঠিত করা হয়। দিনে নারী দল আর রাতে পরিচালিত হতো পুরুষ দল।
জেমস এবং আমি দায়িত্ব নিলাম পুরুষ দল পরিচালনার আর আমাদের সহকর্মী দীপ্তি রোজারিও পরিচালনা করতেন নারী দল। প্রথম ৫ দিনের পাঠ আমরা ৮ দিনে শেখাতে পেরেছি এবং সে অনুযায়ী তা বিভাজিত করা হয়েছিল। প্রতিদিন দিনে আমরা প্রাইমার এবং সহায়ক অনুসরণিকার পাঠের অংশ তৈরি করতাম আর রাতে পাঠ পরিচালনা করতাম। দিনে দীপ্তি রোজারিও’র শিক্ষাদলও মনিটরিং করে ফিডব্যাক নিতাম। এ অনুযায়ী নতুন পাঠ লেখা হতো ও আগের পাঠের সংশোধন ও পরিমার্জন করা হতো। আমরা যেভাবে দলীয় আলোচনা, সাধারণ আলোচনা কিংবা জুটিতে আলোচনা করতাম সে অনুযায়ী সাজানো হতো সহায়ক অনুসরণিকা।
এর সাথে ব্যক্তিগত বিষয় বলে নিই। বিযের আনুষ্ঠানিকতা শেষে স্ত্রীকে ঘরে তোলার দশ দিন পরই এফআইভিডিবিতে আমার কাজ শুরু হয়। সকাল ৮ টায় অফিসে পৌঁছা, তিনটায় বাসায় এসে আবার সন্ধ্যার সময় দূরে শিক্ষাদল পরিচালনায় যাওয়া এসব নিয়ে এমন অবস্থায় ছিলাম যে কাউকে নিজের চাকুরির ধরন কী তা বোঝাতে পারতাম না। এক বছর এভাবে ব্যস্ত থাকার পর থেকে শুরু হয়েছিল অন্যরকম কাজ। মাসের ১৫/২০ দিন দেশের কোথাও না কোথাও ব্যবহারিক শিক্ষার প্রশিক্ষণ পরিচালনা যাকে সহজে বলা যায় প্রশিক্ষণের ফেরিওয়ালা। (চলবে…)
আ.ন.স হাবীবুর রহমান: উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ও সাক্ষরতা বিশেষজ্ঞ।
লেখক পরিচিতি
সম্পাদক বাংলাদেশের শিক্ষা
এই লেখাটি সম্পাদক কর্তৃক প্রকাশিত। মূল লেখার পরিচিত লেখার নিচে দেওয়া হয়েছে।