শিক্ষাগুরু বা শিক্ষককে নিয়ে ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’ বিষয়ে কাজী কাদের নেওয়াজের কবিতাখানি নিশ্চয়ই সবার মনে আছে। কবিতাটির শেষাংশ ছিলো এরকম:
”উচ্ছ্বাস ভরে শিক্ষক তবে দাঁড়ায়ে সগৌরবে,
কুর্ণিশ করি বাদশাহর তরে কহেন উচ্চরবে-
‘আজ হতে চিরউন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির
সত্যই তুমি মহান উদার বাদশাহ আলমগীর।”
আজ সেই শিক্ষকও নেই, সেই বাদশাহও নেই। কবিতাখানি আছে হয়তো বড়ই অনাদরে।
জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ অনুসারে শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৩০টি। এই ৩০টি উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যর অধিকাংশই নির্ধারিত হয়েছে শিক্ষার্থীর নৈতিক, মানবিক, সামাজিক ও আবেগিক ও সৃজনশীলতার বিকাশ নিশ্চিতের জন্য। এগুলোর আলোকেই শ্রেণিভিত্তিক প্রান্তিক যোগ্যতাসমূহ নির্ধারণ করা হয়েছে হয়তো!
‘হয়তো’ শব্দটি উচ্চারণ করা হয়েছে এজন্য যে, ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’ কবিতাটি পড়ানো হয় ’বাংলা ভাষা’র যোগ্যতা নিশ্চিত করার জন্য। যে কারণে কবির নাম, কবিতার ৮-১০ চরণ শুদ্ধ উচ্চারণে ছন্দ ঠিক রেখে বলতে পারা, লিখতে পারা এবং শব্দার্থ, বাক্য গঠন, কবিতার সারাংশ বা সারমর্ম বলতে ও লিখতে পারাটাই হয়ে ওঠে যোগ্যতা বিচারের মাপকাঠি।
আবার এসবের জন্য বাজারে তৈরি নোট বই বা গাইড বই সবকিছুই সহজলভ্য। প্রকাশনীভেদে নোট বা গাইডের মান ভিন্ন হলেও এসব বইয়ে পাঠ্যবইয়ের প্রশ্নসমূহ মাথায় রেখেই উত্তর রাখা হয়। শেখাটা হয় মুখস্থনির্ভর। প্রান্তিক যোগ্যতার আশি ভাগ অর্জনের প্রধান অন্তরায় এই নোট বা গাইড বই। শিক্ষকের প্রধান কাজ হচ্ছে বাড়ির কাজ হিসেবে গাইড বইয়ের পৃষ্ঠা নম্বর বলে দেয়া ও পরবর্তী দিন সে-অনুসারে পড়া আদায়।
আমি কি ভাবি কখনো যে আমার জীবিকা নির্বাহের বেতনের অর্থ কোথা থেকে আসছে? এটি সম্পূর্ণ জনগণের অর্থ। কিছুটা আসে সরাসরি বিদ্যালয়ের বিবিধ ফি হিসেবে, বাকিটা সরকারের রাজস্ব থেকে। সুতরাং জনগণের প্রতিই আমার জবাবদিহিতা প্রথম হওয়া উচিত।
পরীক্ষার প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে কেন্দ্রিয়ভাবে আর উত্তরপত্র হচ্ছে নোট বা গাইড বই। প্রাইভেট শিক্ষক আর কোচিং সেন্টারগুলোও বিদ্যালয়ের মতোই আচরণ করছে। এমনটিই যদি হবে, শিক্ষাগুরুর মর্যাদা কেমন করে রবে? দক্ষতা, যোগ্যতা, জ্ঞান কিংবা দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে শিক্ষকের ভূমিকা তাহলে কী থাকে? শিশুরা কেনো বিদ্যালয়ে যাবে কিংবা যেতে চাইবে?
আমি শিক্ষক হিসেবে এখন ভয় করি আমার নিয়োগদানকারী বা চাকুরি রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষকে। আর মাস শেষে বেতনের চেকে সই করে যে বা যারা তাদেরকে। অতএব, তারা খুশি থাকলেই একজন শিক্ষক হিসেবে আমার জীবন সার্থক ও স্বাচ্ছন্দময়। আমি কি ভাবি কখনো যে আমার জীবিকা নির্বাহের বেতনের অর্থ কোথা থেকে আসছে? এটি সম্পূর্ণ জনগণের অর্থ। কিছুটা আসে সরাসরি বিদ্যালয়ের বিবিধ ফি হিসেবে, বাকিটা সরকারের রাজস্ব থেকে। সুতরাং জনগণের প্রতিই আমার জবাবদিহিতা প্রথম হওয়া উচিত।
আমার সন্তান বলে, “বাবা বিদ্যালয়ে আমি কেনো যাবো? ওখানে স্যাররা কিছুই পড়ান না, শুধু গাইডের পৃষ্ঠা নম্বর দিয়ে দেন।” তারপরও আমি তাকে বিদ্যালয়ে যেতে বাধ্য করি। পিতা হিসেবে তখন নিজেকে অনেক ব্যর্থ মনে হয়। প্রতিটি বিদ্যালয় তার নিজস্ব একটি সংস্কৃতি ধারণ ও লালন করে। শিক্ষার্থী, শিক্ষক বা শিক্ষাগুরু, অভিভাবক, কর্তৃপক্ষ সকলে সেই সংস্কৃতির অংশ। এখানে সব পক্ষকে একটি আদর্শ মান বজায় রাখতে হয়, না হলে সংস্কৃতিটা অপসংস্কৃতিতে রূপ নিতে থাকে। আমি যদি আমার দায়িত্ব ও দায়বদ্ধতাকে ভয় করি, তবে আমার সম্মান কেড়ে নেয় এমন শক্তি কারোর নেই।
আমার পিতা একজন বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তি ছিলেন। সম্মানজনক সরকারি চাকরি করতেন এবং তাঁর জীবদ্দশায় একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। আমি লক্ষ্য করতাম, শিক্ষাগুরুদেরকে কতোটা ভক্তি করতেন তিনি। নিজের গঠিত বিদ্যালয়ের শিক্ষক কিংবা নিজ সইয়ে যে শিক্ষকের বেতন হতো সকলকেই আকুন্ঠ সম্মান করতেন তিনি। আমার বিশ্বাস, আমার পিতার সম্মান শিক্ষকদের নিকট একটুও কমেনি, বরং অনেক বেশি বেড়ে গিয়েছিলো। তখনকার সময়ে সব থেকে ফাঁকিবাজ শিক্ষকটিও আমার পিতার সমালোচনা করার সাহস পাননি; কেনোনা জঘন্য ব্যক্তিটিও ব্যক্তিত্ব ও সততার মূল্য দিতে বাধ্য।
তখনকার সময়ে বরিশালের অন্যতম একটি মানসম্মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিলো আমাদের বাড়ির পাশের প্রাথমিক বিদ্যালয়টি, কেননা সেটির ব্যবস্থাপনায় কোনো ক্রটি কম ছিলো। অভিভাবক কিংবা কর্তৃপক্ষ উভয়েরই উচিত শিক্ষাগুরুদেরকে যথাযথ সম্মান করা। এখানে তাঁদের বেতন, পদক্রম কিংবা ব্যক্তিগত সম্পদ সম্মানের প্রধান বিবেচ্য বিষয় হতে পারে না। যদি কেউ মানুষকে অসম্মান করে নিজে সম্মান আশা করেন, তাহলে তিনি মূর্খ ছাড়া কিছু নন।
আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, শিক্ষাগুরু বা শিক্ষকের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে নানাবিধ উদ্যোগ থাকা উচিত। বর্তমান যেসব উদ্যোগ রয়েছে, তার পাশাপাশি নিম্নোক্ত উদ্যোগসমূহ হয়তো শিক্ষাগুরুদের মর্যাদাবৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে:
১) শিক্ষা বিভাগ, জনপ্রশাসন বা অন্য যেকোনো বিভাগের কর্মকর্তাসহ স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি সকলে একজন শিক্ষকের সাথে কীরূপ আচরণ করবেন তার একটি আদর্শ মান থাকা প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে সম্বোধন, নির্দেশনা, আদেশ, অনুরোধ এগুলো হবে সম্মানজনক।
২) শিক্ষাগুরু বা শিক্ষকদেরকে কোনোমতেই তথ্য সংগ্রহকারী হিসেবে কাজে লাগানো যাবে না। এলাকার টয়লেট গণনা থেকে শুরু করে ভিক্ষুকের তালিকা তৈরিতে শিক্ষকগণকে নিয়োজিত করা হয়ে থাকে, এটি সম্পূর্ণরূপে পরিহার করতে হবে।
৩) সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিজ সন্তানকে ভর্তির ক্ষেত্রে শিক্ষকদের একটি সম্মানজনক কোটা থাকবে এবং প্রতিষ্ঠানে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত ফি থেকে কমপক্ষে ৫০ শতাংশ ছাড় থাকবে।
শিক্ষকদেরকে কোনোমতেই তথ্য সংগ্রহকারী হিসেবে কাজে লাগানো যাবে না। এলাকার টয়লেট গণনা থেকে শুরু করে ভিক্ষুকের তালিকা তৈরিতে শিক্ষকগণকে নিয়োজিত করা হয়ে থাকে, এটি সম্পূর্ণরূপে পরিহার করতে হবে।
৪) শিক্ষকদের জন্য নির্ধারিত বেতনের বাইরে একটি বিশেষ ভাতা চালু করা যেতে পারে।
৫) রাষ্ট্রের যেকোনো সেবাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে শিক্ষকগণ সর্বাধিক অগ্রাধিকার পাবেন এমন আইন প্রণয়ন করা যেতে পারে।
৬) যেকোনো পাবলিক অনুষ্ঠানে শিক্ষকদের জন্য সামনের দিকের সারি নির্ধারণ করা থাকবে।
৭) শিক্ষাগুরুর মর্যাদা বিষয়ে পাঠ্যবইয়ে অনেক বেশি বিষয়বস্তু সংযুক্ত করতে হবে।
৮) একজন শিক্ষক বা শিক্ষাগুরু হিসেবে মৃত্যুবরণ করলে তাকে মর্যাদাপূর্ণভাবে দাফন বা সৎকার করতে হবে।
লেখক পরিচিতি
মো: সাইদুল হক বাংলাদেশে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় শিক্ষাবিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।