মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবকে অনেকে মনে করেন ‘দরবেশ সম্রাট’। এর কারণ তিনি ছিলেন অত্যন্ত সৎ, ধার্মিক ও জ্ঞানপিপাসু ব্যক্তি। জ্ঞানী ব্যক্তিদের তিনি খুবই সম্মান করতেন। এই মহান সম্রাট দাক্ষিণাত্যের অজেয় মারাঠা শক্তিকে পদানত করার জন্য প্রায় ছাব্বিশ বছর দিল্লি ছেড়ে দাক্ষিণাত্যে অবস্থান করে লড়াই করেন। অবশেষে ১৬৯০ সালে দাক্ষিণাত্যে মোগল শক্তির জয় হলো। সম্রাট ভাবলেন তাঁর আরাধ্য কাজ শেষ হয়েছে। মোগলবিরোধী প্রবল মারাঠাশক্তি পদানত হয়েছে।

একজন বিখ্যাত ইতিহাসবিদ লিখেছেন, “… It was seen, all have been gained by Aurangzeb now. But in reality, it was lost! It was the beginning of the end.” মারাঠাদের দমন করতে গিয়ে দীর্ঘদিন দিল্লি ছেড়ে দাক্ষিণাত্যে অবস্থান করায় যে প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছিলো, মোগল সাম্রাজ্যের উত্তর, মধ্য ও পশ্চিমাংশের মধ্যে যে সমন্বয়হীনতার সৃষ্টি হয়েছিল, তার দীর্ঘ অনুপস্থিতির সুযোগে প্রশাসনের স্থানীয় আমলারা যে অপ্রতিহত ক্ষমতার দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছিলো, তা থেকে মোগল সাম্রাজ্য আর বেরিয়ে আসতে পারেনি। ফলে তাঁর মৃত্যুর অর্ধশতক পরেই মোগল সাম্রাজ্য বিদেশি শক্তির হাতে ক্ষমতা হারায়।

সম্রাট আওরঙ্গজেবের মতো মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ছাব্বিশ বছর ধরে (১৯৮৩-২০০৯) তাঁর দল ও সমমনাদের নিয়ে স্বাধীনতাবিরোধীদের বিরুদ্ধে লড়াই করে চুড়ান্ত বিজয় লাভ করে এখনও ক্ষমতাসীন রয়েছেন। যুদ্ধাপরাধীদের তিনি ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়েছেন। জামায়াত ও বিএনপি আজ সাংগঠনিকভাবে তছনছ হয়ে গেছে। জঙ্গি নেটওয়ার্ক প্রায় ভঙ্গুর। দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান হয়েছে। ব্যাংকে রিজার্ভ সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু হচ্ছে। খেলাধূলায় দেশ এগিয়েছে। দেশ-বিদেশে তিনি ব্যাপকভাবে সম্মানীত হচ্ছেন। সকল কিছুই মনে হচ্ছে শেখ হাসিনার নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। স্তাবকের দল সতত গেয়ে চলেছে: “দুকড়ি দত্ত, দুকড়ি দত্ত। ভূবনে অনুপম মহত্ত্ব!” কিন্তু তিনি কি জানেন, তাঁর প্রশাসন তাঁর জন্য কী ভয়ঙ্কর ফাঁদ তৈরি করতে চলেছে?


সকল কিছুই মনে হচ্ছে শেখ হাসিনার নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। স্তাবকের দল সতত গেয়ে চলেছে: “দুকড়ি দত্ত, দুকড়ি দত্ত। ভূবনে অনুপম মহত্ত্ব!” কিন্তু তিনি কি জানেন, তাঁর প্রশাসন তাঁর জন্য কী ভয়ঙ্কর ফাঁদ তৈরি করতে চলেছে?


বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে সুন্দর একটি পে-স্কেল উপস্থাপন করা সত্ত্বেও কেন চারিদিকে সবাই আন্দোলনমুখর হয়ে উঠছে। দেশের সবচেয়ে নিরীহ শ্রেণি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজ কেন আজ ক্ষোভে ফেটে পড়ছেন? একটু ভেবে দেখবেন কি? বিশ্বের একশজন প্রাগ্রসর চিন্তাবিদের মধ্যে ত্রয়োদশতম মর্যাদায় আসীন হয়েও কেন আপনি অষ্টম পে-স্কেলের শুভংকরের ফাঁকিটা বুঝতে পারেননি?

অষ্টম পে-স্কেলে বলা হয়েছে যে, এখন থেকে সরকারি চাকুরীজীবীগণ প্রথম শ্রেণি, দ্বিতীয় শ্রেণি কিংবা তৃতীয় শ্রেণি— এভাবে পরিচিত না হয়ে তারা তাদের বেতনের গ্রেড অনুযায়ী পরিচিত হবেন এবং সেভাবেই তাদের মর্যাদা নির্ধারিত হবে। অষ্টম পে-স্কেল অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সর্বোচ্চ ধাপ ‘প্রফেসর’ পদটি তৃতীয় গ্রেডের বেতনের সমতুল্য পদ। এর উপরে রয়েছে গ্রেড ছাড়াও আরও দুটি ধাপ। সুতরাং, অষ্টম পে-স্কেল অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের বেসামরিক প্রশাসনের কর্মকর্তা ও সমতুল্য সামরিক কর্মকর্তাদের তুলনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণকে পাঁচ ধাপ নিচে নামিয়ে দেয়া হয়েছে। অন্যান্য ভাতা ও সুযোগ-সুবিধার কথা তো বলাই বাহুল্য!

প্রথম থেকে তৃতীয় ধাপের সরকারি কর্মকর্তারা সার্বক্ষণিক গাড়ির সুবিধা পান। গাড়ি কেনার জন্য ২৫ লক্ষ টাকা সুদমুক্ত ঋণ পান, গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রতিমাসে ৪৫ হাজার টাকা পান, ভৃত্যভাতা পান মাসিক ৩০০০ টাকা, শিক্ষা সহায়ক ভাতা পান এক সন্তানের জন্য ১০০০ এবং দুই সন্তানের জন্য ২০০০ টাকা। এছাড়া আছে টেলিফোন ভাতা, আপ্যায়ন ভাতা ইত্যাদি। এগুলোর কিছুই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দেয়া হয় না।

দেশের সর্বোচ্চ মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় আসেন। সপ্তম পে-স্কেলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ প্রথম গ্রেডের বেতন পেতেন। তাদের কেন পাঁচ ধাপ নামিয়ে দেয়া হলো? কী তাদের অপরাধ? দেশের সর্বোচ্চ মেধাবীদের এভাবে অপমান-অপদস্ত করে যারা মনে করছেন সব ঠিক আছে, তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। কারণ ভবিষ্যতের কর্মকর্তাদের কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিকট থেকে পাঠ নিয়েই কর্মজীবনে প্রবেশ করতে হবে। এর কোনো বিকল্প পৃথিবীতে আবিস্কৃত হয়নি।

সন্দেহ নেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ‘মান’ কমেছে। কিন্তু আমলাদের মান কি বেড়েছে? কেন অফিসগুলোতে ফাইলের স্তুপ পড়ে থাকে? কেন সময়মত সিদ্ধান্ত দিতে না পারায় মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার বিদেশে ফেরত যায়? শেয়ারমার্কেট কেলেঙ্কারির জন্য কারা দায়ী? ব্যাংকে ঋণখেলাপি হয় কীভাবে? প্রশ্নপত্র ফাঁস হয় কীভাবে? বর্ষাকালেই কেন চলে রাস্তায় খোঁড়াখুড়ি? কেন লক্ষ লক্ষ মামলা ফাইলবন্দি হয়ে পড়ে থাকে আর বিচারের বাণী নিরবে-নিভৃতে কেঁদে ফেরে?


সামগ্রিকভাবে দেশের সকল পেশাতেই অদক্ষতা ও দুর্নীতি প্রবেশ করেছে। এর জন্য শুধু কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ‘দণ্ড’ দিতে হবে? সময়ের প্রয়োজনে সব পেশাতেই শুদ্ধি অভিযান চালানো হোক। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দিয়েই তা শুরু হোক, আপত্তি নেই।


সুতরাং বুঝতে হবে সামগ্রিকভাবে দেশের সকল পেশাতেই অদক্ষতা ও দুর্নীতি প্রবেশ করেছে। এর জন্য শুধু কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ‘দণ্ড’ দিতে হবে? সময়ের প্রয়োজনে সব পেশাতেই শুদ্ধি অভিযান চালানো হোক। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দিয়েই তা শুরু হোক, আপত্তি নেই। কিন্তু তা তাদের পেশাগতভাবে ‘অবনমন’ করে নয়; বরং পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা করে করতে হবে। আর এজন্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য ‘পৃথক পে-স্কেল’ দাবি করা হয়েছে।

সার্কভূক্ত বেশিরভাগ দেশেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য ‘পৃথক পে-স্কেল’ রয়েছে। দেশের বর্তমান শিক্ষানীতিতে শিক্ষকদের পৃথক পে-স্কেলের কথা আছে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী মেনিফেস্টোতেও শিক্ষকদের পৃথক পে-স্কেলের কথা আছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সর্বোচ্চ বেতন দিয়েছেন। সেনাবাহিনীর জন্য পৃথক স্কেল থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য কেন নয়? শিক্ষাখাত একটি উৎপাদনশীল খাত। এ উৎপাদনশীল খাতে জনগণের অর্থ ব্যয় না করে শুধু ‘আমলাতন্ত্র’ আর ‘সামরিকতন্ত্রের’ মতো অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় বৃদ্ধি করে টেকসই উন্নয়ন কিংবা টেকসই গণতন্ত্র আসবে না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যদি ‘অবনমন’ করা হয়, তবে মেধাবীরা আর এ পেশায় আসবে না। মেধাবী শিক্ষক না পেলে আপনি মেধাবী শিক্ষার্থী কোথায় পাবেন? মেধাবী আমলা কীভাবে পাবেন? মাননীয় অর্থমন্ত্রীর ভাষায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ যদি corrupted হয়ে থাকেন, তাহলে তাদের শিক্ষার্থীরা যারা আমলা হয়েছেন তারাও corrupted হতে বাধ্য। কেনোনা, evil begets evil.

Sending
User Review
0 (0 votes)

লেখক সম্পর্কে

সৈয়দ আব্দুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী

সৈয়দ আব্দুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী

ড. সৈয়দ আব্দুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী: সভাপতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

মন্তব্য লিখুন