বাড়িউদ্যোগশিক্ষাব্যবস্থার সংকট : উন্নত দেশের অনুসরণ নাকি স্থানীয় প্রয়োজন?

শিক্ষাব্যবস্থার সংকট : উন্নত দেশের অনুসরণ নাকি স্থানীয় প্রয়োজন?

শহরতলীর একটি বিদ্যালয়ে নব্বই জন শিক্ষার্থীর ক্লাস চলছে। একজন শিক্ষক কালো বোর্ডে সাদা চক দিয়ে পড়াচ্ছেন। এখানে নেই কোনো প্রজেক্টর, সাউন্ড সিস্টেম বা আধুনিক শিক্ষা উপকরণ। শ্রেণিকক্ষটিও বেশ জরাজীর্ণ, জানালার একটি পাল্লা নেই। সেখানে একজন শিক্ষক অত্যন্ত সাদামাটা পোশাকে, নিঃশব্দে পাঠদান করছেন।

ক্লাসে পিনপতন নিরবতা, এক মুহূর্তের জন্যও কারো মনোযোগ নষ্ট হচ্ছে না— এ যেন সবাই একাগ্রভাবে শ্রবণ করছে। সময় কীভাবে গড়িয়ে গেল, শিক্ষার্থীরা তা বুঝতেই পারল না। শিক্ষক আবার ছুটলেন পরবর্তী ক্লাসে। কী সেই সাদাসিধে কৌশল, যা শুধু চক এবং ডাস্টারের সাহায্যে নব্বই জন শিক্ষার্থীর মনোযোগ ধরে রেখেছে? আমরা জানি না, এবং সত্যি বলতে, জানতেও চাই না।

আমাদের দেশে যেখানে শিক্ষাব্যবস্থার সংকট, শিক্ষক সংকট, প্রশিক্ষণের অভাব, অবকাঠামোর দুরবস্থা, আর্থিক দৈন্য এবং আরও অনেক সমস্যা বিদ্যমান— তাহলে কীভাবে এমন শিক্ষকরা সফলতার সঙ্গে পাঠদান করছেন? এই প্রশ্ন কখনো আমাদের মনেও ওঠেনি। কেন?

কারণ আমরা চোখ রেখেছি উন্নত দেশগুলোর দিকে—ফিনল্যান্ড, ইউরোপ, আমেরিকা, জাপান—যাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে বিশ্বব্যাপী অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় মনে করা হয়। প্রথমদিকে, এই চিন্তা ইতিবাচক মনে হলেও, বাস্তবতাতে তা দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি ডেকে আনে। আজকের লেখায়, আমি তুলে ধরতে চাই, কীভাবে স্থানীয় জ্ঞানের অবমূল্যায়ন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রভাবিত করছে এবং কেন এটি আমাদের জন্য ক্ষতিকর?

আমাদের শিক্ষা পরিকল্পনা অনেকটাই উচ্চাভিলাষী, অন্তত অন্যান্য দেশের তুলনায়। আমরা এক লাফে ফিনল্যান্ড, জাপান, অস্ট্রেলিয়ার মতো হতে চাই, কিন্তু আমরা কখনোই আমাদের নিজস্ব প্রেক্ষাপট বা বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে কাজ করি না।

আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার যে ক্রমাগত পরীক্ষাগুলো চলছে, তা সবারই জানা। সরকার পরিবর্তন হলে শিক্ষাব্যবস্থাও পরিবর্তিত হয়, এবং কত কারণে পুরো বিষয়টি এলোমেলো হয়ে পড়ে, তা আমরা সবাই জানি। প্রায় সব উন্নত শিক্ষাব্যবস্থার অনুকরণে আমরা আমাদের পরিকল্পনা সাজানোর চেষ্টা করি, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে এসব পদ্ধতি আমাদের দেশে উপযুক্ত নয়।

কোনো দেশের শিক্ষাব্যবস্থার সংকট, সংস্কার বা উন্নয়ন নিয়ে কথা বললে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে স্থানীয় চাহিদা ও বাস্তবতা। যদি শিক্ষাব্যবস্থা এসবের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ না হয়, তবে তা তাত্ত্বিকভাবে সফল হলেও বাস্তব জীবনে কার্যকরী হবে না।

স্থানীয় চাহিদা বলতে বোঝায়, যে অঞ্চলে শিক্ষাকার্যক্রম চলছে, সেখানে মানুষের জীবনযাত্রা, অর্থনৈতিক অবস্থা, সাংস্কৃতিক চেতনা এবং অন্যান্য উপাদান কীভাবে শিক্ষার কাঠামো ও পদ্ধতিকে প্রভাবিত করছে, সেগুলোর সমষ্টি। উদাহরণস্বরূপ, আমাদের দেশের গ্রামীণ অঞ্চলে যেখানে শিক্ষা উপকরণের অভাব, অবকাঠামোগত দুরবস্থা এবং শিক্ষক সংকট রয়েছে, সেখানে উন্নত দেশের শিক্ষা পদ্ধতি অনুসরণ করা কার্যকর হবে না।

আর অন্যদিকে বাস্তবতা হলো, শিক্ষাব্যবস্থা যে পরিস্থিতিতে কাজ করছে, তা কেমন? আমাদের দেশের অনেক গ্রামের বিদ্যালয়ে দুর্বল অবকাঠামো, প্রশিক্ষণহীন শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের জন্য প্রয়োজনীয় সুবিধার অভাব রয়েছে। এসব বাস্তবতার সঙ্গতি না মেলালে গুণগত শিক্ষা অর্জন করা সম্ভব নয়।

তবে, যদি স্থানীয় চাহিদা এবং বাস্তবতার ভিত্তিতে শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো সাজানো হয়, তবে তা ওই অঞ্চলের জন্য কার্যকর হতে পারে। যেমন, যেখানে শিক্ষা উপকরণের অভাব, সেখানে সহজলভ্য বা স্থানীয় উপকরণ ব্যবহার করা যেতে পারে, এবং যেখানে শিক্ষক সংকট, সেখানে প্রযুক্তির মাধ্যমে শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করা যেতে পারে।

তাই স্পষ্টভাবে বলা যায়, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সংকট নিরসনে সংস্কার শুধু উন্নত দেশের মডেল অনুসরণ করে সফল হবে না। বরং স্থানীয় চাহিদা এবং বাস্তবতার ভিত্তিতে পদ্ধতি, উপকরণ এবং কার্যক্রম সাজানো উচিত। এতে শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়ন সম্ভব হবে এবং তা দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য দীর্ঘমেয়াদী উপকারী হবে।

আমরা এমন কিছু দেশের পদ্ধতি এবং কৌশল আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় প্রয়োগের চেষ্টা করছি, যা কেবল ছোট শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত (১০/১৫) বজায় রেখে কার্যকর, যেখানে ক্লাসরুমের পরিবেশ, শিক্ষক এবং অন্যান্য সিস্টেমের সমন্বয়ে শিক্ষার্থীদের বিকাশ ঘটানো হয়। সেখানে প্রতিটি শিশু সকালে খেয়ে স্কুলে আসে এবং তাদের পুষ্টির চাহিদা নিয়ে চিন্তা করার প্রয়োজন হয় না, এবং এপ্লাস বা গোল্ডেন এপ্লাস নিয়ে কোনো ধরনের উন্মাদনা নেই।

তবে আমাদের দেশের বাস্তবতায়, যেখানে বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির (এসএমসি) সভাপতি হয়ে থাকেন প্রায়ই স্থানীয় রাজনৈতিক মদদপুষ্ট একজন ব্যক্তি, যিনি নিজের স্বার্থে কাজ করেন, সেখানে এই মডেল কীভাবে কার্যকর হবে? যেখানে শিক্ষার্থীদের বাড়িতে প্রয়োজনীয় সহায়তার সুযোগ নেই, এবং আরও কত ধরনের শিক্ষাব্যবস্থার সংকট রয়েছে, তা তো বলে শেষ করা যাবে না।

তাহলে, কি আমরা সেই দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সরাসরি অনুসরণ করে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা গড়তে চাই?  আসলে, এটা আমাদের বাস্তবতায় কাজ করবে না, বরং তা শিক্ষাব্যবস্থার সংকট সৃষ্টি করবে।

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার অদূরদর্শী সংস্কার নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক গৌতম রায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক রূপক অর্থে শিক্ষাব্যবস্থাকে ট্রেনের সাথে তুলনা করে লিখেছিলেন: “সুযোগ পেয়েছি বলে ব্রডগেজ হাইস্পিড ট্রেনের অর্ডার দিয়ে ফেলেছি। রেললাইনে স্লিপার ও পাথর আছে কি না, সেটা দেখার ইচ্ছে জাগেনি। কে যেন বলছিলো, ওটা তো আসলে মিটারগেজের লাইন! তো? ট্রেন তো ভালো, আধুনিক, যুগোপযোগী!”

আমরা প্রায়ই এমনই কাজ করি—অবস্থা বুঝে না, কেবল আধুনিকতার দিকে ছুটে যাই, অথচ কখনো কখনো রেললাইনে এমনকি বিমান চালানোর চেষ্টাও করি।

শিক্ষাব্যবস্থার সংকট ও সংস্কার নিয়ে আলোচনার সাথে আরেকটি প্রসঙ্গও উঠে আসে, তা হলো গুণগত শিক্ষা। শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারের মূল উদ্দেশ্য হলো শিক্ষাব্যবস্থাকে গুণগত শিক্ষায় রূপান্তর, যাতে শিক্ষার্থীরা তাদের পরবর্তী শিক্ষাস্তরের জন্য প্রস্তুত করে তোলে।

তবে, যখন উন্নত দেশের শিক্ষা মডেল অনুসরণ করে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা গুণগত শিক্ষায় পরিণত করার চেষ্টা করি, তখন আমরা প্রায়ই আমাদের দেশের স্থানীয় চাহিদা ও বাস্তবতাকে অবহেলা করি। এর ফলে, শিক্ষাব্যবস্থার সংকট সৃষ্টি হয়, যা আমাদের ভবিষ্যত শিক্ষার জন্য একটি বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

গুণগত শিক্ষা বলতে এমন এক শিক্ষাব্যবস্থা বোঝানো হয় যা শিক্ষার্থীদের সামগ্রিক উন্নয়ন নিশ্চিত করে এবং তাদের ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি দেয়। বাংলাদেশের প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ মনজুর আহমদ গুণগত শিক্ষাকে এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন, “এটি এমন এক কাঙ্ক্ষিত মানের শিক্ষা যা পরবর্তী শিক্ষাস্তরে অধ্যয়নের জন্য শিক্ষার্থীকে সক্ষম করে তোলে”। কিন্তু এই সংজ্ঞা যদি বিস্তারিতভাবে দেখা হয়, তবে প্রশ্ন ওঠে, আমাদের বিদ্যালয় ও কলেজগুলো কি শিক্ষার্থীদের যথাযথভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রস্তুত করছে?

আজকাল আমরা যখন উন্নত দেশের শিক্ষাব্যবস্থা অনুসরণের চেষ্টা করি, তখন তা অধিকাংশক্ষেত্রেই আমাদের দেশের বাস্তবতা এবং চাহিদার সঙ্গে মেলে না। উন্নত দেশের মডেল অনুসরণ করে, আমরা যদি শুধু সেই পদ্ধতিগুলো একে একে বাস্তবায়ন করতে থাকি, তবে তা আমাদের জন্য কার্যকরী হবে না, উল্টো শিক্ষাব্যবস্থার সংকট বাড়াবে।

কারণ আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার সমস্যা এবং চাহিদা ভিন্ন। সুতরাং, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার করতে হলে, তা আমাদের দেশের বাস্তব পরিস্থিতি এবং চাহিদার ওপর ভিত্তি করে সাজানো উচিত।

এছাড়া, আমাদের মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষত বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের জন্য ২৫% নম্বরের ব্যবহারিক ক্লাস এবং পরীক্ষার অভিজ্ঞতা অত্যন্ত হতাশাজনক। হাতে গোনা কিছু প্রতিষ্ঠান ছাড়া, কোথাও এই ব্যবস্থা কার্যকরভাবে চালু হয়নি।

আমাদের দেশে যেসব ব্যবহারিক পরীক্ষা (পদার্থ, রসায়ন, জীববিজ্ঞান, উচ্চতর গণিত) হয়, তা মূলত কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকে এবং এর কোনো বাস্তব ফলাফল নেই। ফলে, আমরা প্রতিনিয়ত প্রযুক্তি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে পিছিয়ে পড়ছি। আমাদের শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞানের প্রায়োগিক বিষয়গুলো ছাড়াই শিক্ষাস্তর শেষ করে যাচ্ছে!

তাহলে প্রশ্ন ওঠে, কেন এসব অকার্যকর পদ্ধতির ব্যবহারিক ক্লাস চালানো হচ্ছে? আসলে, আমাদের দেশের বাস্তবতায় অনেক প্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত শিক্ষক, উপকরণ এবং ল্যাবরেটরি সুবিধার অভাব রয়েছে, যা ব্যবহারিক শিক্ষাকে কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে বাধা সৃষ্টি করে।

অথচ, আমরা উন্নত দেশগুলোর মতো পদ্ধতি ও কৌশল অবলম্বন করে প্রায়োগিক শিক্ষার গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলি, কিন্তু আমাদের দেশের বাস্তবতা তার পরিপন্থী। এই বৈপরীত্যকে বুঝে, আমাদের উচিত অকার্যকর ব্যবস্থাগুলো থেকে সরে এসে বাস্তবসম্মত সংস্কারের দিকে এগিয়ে যাওয়া।

বর্তমানে প্রচলিত ব্যবহারিক শিক্ষাকে আরো ফলপ্রসু এবং কার্যকরী করার জন্য, আমাদের বাইরে থেকে আমদানি করা কোনো কৌশল বা উপকরণের দিকে না গিয়ে, বরং স্থানীয় উপকরণ ও কৌশল ব্যবহার করতে হবে। স্থানীয় চাহিদা এবং পরিবেশ অনুযায়ী উপযুক্ত সমাধান তৈরি করে, শিক্ষার সংকট দূরীকরণে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

এক্ষেত্রে, যদি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সংকট সমাধান না হয়, তবে তা গুণগত শিক্ষার অর্জনে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়াবে। গুণগত শিক্ষার নানা দিক নিয়ে ব্যাপক আলোচনা রয়েছে।

‘শিক্ষাবিজ্ঞান এবং বাংলাদেশের শিক্ষা’ বইয়ে গুণগত শিক্ষা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, “গুণগত শিক্ষা প্রতিটি নির্দিষ্ট এলাকার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত প্রেক্ষিত বিবেচনায় রাখে এবং এসব অবস্থার প্রতিফলন ঘটিয়ে শিক্ষাক্রমের কাঠামো প্রদান করে। ফলে এরূপ শিক্ষা প্রতিটি অঞ্চলের জন্য প্রাসঙ্গিক এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকে যথাযথ হয়।”

এটি স্পষ্ট করে যে, গুণগত শিক্ষার অপরিহার্য উপাদান হলো স্থানীয় চাহিদা ও প্রয়োজনের ভিত্তিতে শিক্ষাকে ঢেলে সাজানো। সুতরাং, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সংকট নিরসনে তা সংস্কার করতে হলে, তা শুধু উন্নত দেশগুলোর মডেল অনুসরণ করে নয়, বরং দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত বাস্তবতা অনুযায়ী করা উচিত।

ইউনেস্কোর মতে, টেকসই উন্নয়নের জন্য শিক্ষার পূর্বশর্ত হলো গুণগত শিক্ষা। তাই, যদি শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার শুধু উন্নত দেশগুলোর মডেল অনুসরণে সীমাবদ্ধ থাকে, তবে তা দেশের টেকসই উন্নয়নের জন্য একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে। এজন্য, স্থানীয় চাহিদা এবং শিক্ষার্থীদের প্রকৃত প্রয়োজন বুঝে সংস্কার করা হলেই গুণগত শিক্ষা এবং একইসাথে দেশের টেকসই উন্নয়ন সম্ভব হবে।

এসব কিছু সঠিকভাবে বিবেচনায় নিয়ে, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সংকট নিরসনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, স্থানীয় চাহিদা এবং বাস্তবতার ভিত্তিতে একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করা, যেখানে শিক্ষার্থীদের আসল প্রস্তুতি নিশ্চিত করা যাবে। আমাদের দেশে শিক্ষাব্যবস্থা যতোটা সম্ভব বাস্তবসম্মত ও কার্যকর হতে হবে, যাতে প্রত্যেক শিক্ষার্থী উপযুক্ত প্রস্তুতি নিয়ে ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারে।

সদ্য স্থগিত হওয়া শিক্ষাক্রম নিয়ে মাঠপর্যায়ের একটি গবেষণার কাজ করার সুযোগ হয়েছিল, যেখানে শিক্ষকের পাশাপাশি কমিউনিটি, অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্ট সকলের সরাসরি মতামত নেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম।

সেখান থেকে প্রাপ্ত মতামতগুলোকে এককথায় বলতে গেলে একটি অভিন্ন ধারায় অভিমত প্রকাশ করেছে—শিক্ষার এই পরিবর্তন বাংলাদেশের বিদ্যালয় এবং সমাজের বাস্তব চাহিদা, প্রেক্ষাপট এবং অবস্থাকে যথাযথভাবে প্রতিফলিত করছে না এবং এটার জন্য তারা একেবারেই প্রস্তুত নয়।

বরং এটি এক ধরনের চাপিয়ে দেওয়া বিষয়, যা সমাজের প্রকৃত মনোভাব, আদর্শ এবং দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তাহলে প্রশ্ন হলো, আমাদের শিক্ষা পরিকল্পনা কেমন হতে পারতো, যা আমাদের দেশের বাস্তবতার সঙ্গে আরও সঙ্গতিপূর্ণ হতে পারতো?

আমাদের শুরুটা হওয়া উচিত ছিলো নিরপেক্ষ জায়গা থেকে, যেখানে দেশের বাস্তব চাহিদা এবং শিক্ষার প্রকৃত সমস্যা সম্বন্ধে সঠিক ধারণা পাওয়া যায়। চাহিদা যাচাইয়ের মাধ্যমে, সকল অংশীজন—শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, কমিউনিটি—এদের মতামত সংগ্রহ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এই মতামত ভিত্তিক পরিকল্পনা প্রণয়ন না করে, শুধু উন্নত দেশের মডেল অনুসরণ করা সঠিক নয়, কারণ আমাদের দেশের বাস্তবতা এবং চাহিদা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এছাড়া, আমাদের উচিত ছিলো দেশের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শহরের স্কুলগুলো পর্যন্ত সফল শিক্ষকদের কৌশলগুলো নিয়ে গবেষণা করা।

অনেক বড় ক্লাসরুমে, যেখানে শিক্ষার্থী সংখ্যা বেশি, কীভাবে সফলভাবে পাঠদান করা যায়, সেই কৌশলগুলো আমাদের বাস্তবতায় প্রয়োগ করা উচিত। কোচিং সেন্টারের যে কৌশলগুলো ৫০-৮০ জন শিক্ষার্থীর মনোযোগ ধরে রাখতে সক্ষম, সেগুলো আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে, যাতে শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত খরচে প্রাইভেট টিউশনের ওপর নির্ভরশীলতা কমানো যায়।

সবশেষে, শিক্ষাব্যবস্থার সংকট সমাধান করতে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে এমনভাবে পুনর্গঠন করতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা অতিরিক্ত খরচ ছাড়াই মানসম্মত শিক্ষা লাভ করতে পারে। শিক্ষাকে বাণিজ্যিকীকরণ থেকে দূরে রেখে, সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা উচিত।

স্থানীয় বাস্তবতা ও চাহিদার ভিত্তিতে শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কার করতে পারলে, তা সংকট দূর করে শিক্ষার্থীদের জন্য অনেক বেশি ফলপ্রসূ হবে। আমাদের দেশের সাংস্কৃতিক, সামাজিক এবং আর্থিক অবস্থাকে গুরুত্ব দিয়ে, স্থানীয় কৌশল ও উপকরণ ব্যবহার করে শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন করা একমাত্র পথ, যা টেকসই উন্নয়ন এবং গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করতে সাহায্য করবে।

লেখক পরিচিতি

শামস আল গালিব

শামস আল গালিব রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী। তিনি নিয়মিত শিক্ষার নানা প্রসঙ্গ নিয়ে লেখালেখি করেন।

আরও পড়ুন

ওমর শেহাবের ‘নতুন শিক্ষাক্রমে দুটি বড় ভুল’ : একটি ‘ব্যক্তিগত’ প্রতিক্রিয়া

ওমর শেহাব জানিয়েছেন, তিনি নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সেই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সম্প্রতি তিনি প্রথম আলোয় ‘নতুন শিক্ষাক্রমে...

মতামত

বিজ্ঞান চেতনা: প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কোন বিজ্ঞান শিখছে শিশুরা?

নাহিদ নলেজ বিজ্ঞান চেতনা নিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা কী- এ সম্পর্কে বিস্তর কথাবার্তা আমাদের সবার জানা। সেই প্রাথমিক শিক্ষাটুকুই যদি গলদপূর্ণ হয়, তাহলে আর কী কথা...

দেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আপনি কি সন্তুষ্ট?

মোঃ তৌফিক ইমাম চৌধুরী লিখেছেন বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে বর্তমানে শিক্ষাব্যবস্থা আছে তা নিয়ে কি আপনি পুরোপুরি সন্তুষ্ট? প্রাথমিক কিংবা নিম্নমাধ্যমিক শ্রেণীতে একজনকে অনেকগুলো বিষয়ে পড়তে...
নতুন লেখার খবর পান ইমেইলে
বাংলাদেশের শিক্ষা প্রসঙ্গে নতুন লেখা প্রকাশিত হলে সেই খবর পৌঁছে যাবে আপনার ইমেইলে।

এই বিভাগের আরও লেখা

মানুষের দুর্নীতিবাজ হওয়ার পেছনে শিক্ষকের দায় কতটা?

দুর্নীতিতে বাংলাদেশ বেশ কয়েকবার পুরো বিশ্বে দখল করেছে শীর্ষস্থান! বাংলাদেশে বড় বড় প্রকল্পে বড়...

মুখস্থবিদ্যা কতোটুকু গুরুত্বপূর্ণ?

নতুন শিক্ষাক্রমের প্রবর্তকেরা এবং তার সমর্থকরা এর পক্ষে যুক্তি হিসেবে সবার আগে মুখস্থবিদ্যার ওপর...

নতুন শিক্ষাক্রম : জাপানের সাথে তুলনা কতোটুকু প্রাসঙ্গিক?

বাংলাদেশে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাব্যবস্থার নতুন শিক্ষাক্রমের আবশ্যিক বিষয় জীবন ও জীবিকার ষষ্ঠ ও সপ্তম...

কেন ক্লাস করতে চায় না শিক্ষার্থীরা

শিক্ষার্থীরা কেন ক্লাস করতে চায় না এই প্রশ্নটি নতুন নয়। সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি...

শিক্ষকের মান ও গুণগত শিক্ষা

বিশ্ব শিক্ষক দিবস ২০২৩-এর প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে, "কাঙ্ক্ষিত শিক্ষার জন্য শিক্ষক: শিক্ষক স্বল্পতা পূরণ...

বিদ্যালয়ে মেয়ে শিক্ষার্থীদের মাসিক ব্যবস্থাপনা : প্রয়োজন যথাযথ উদ্যোগ

মেয়েদের মাসিক ঋতুস্রাব তাদের জীবনের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, যেটি বাংলাদেশের মেয়েদের ক্ষেত্রে দশ বছর...

আমরা কি পরীক্ষা ব্যবস্থাকে আনন্দময় করতে পেরেছি?

গত ১৪ আগস্ট ২০২৩ জাতীয় দৈনিক সমকাল পত্রিকা থেকে জানতে পারলাম ‘পরীক্ষা কেন্দ্রের সুষ্ঠু...

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বদলি এখন সময়ের দাবি

বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষার মান নিয়ে বর্তমান সময়ের শিক্ষার্থী, অভিভাবক এমনকি শিক্ষাসংশ্লিষ্টগণও সন্তুষ্ট নন। এর...