দেশে বসে শিক্ষা নিয়ে উচ্চশিক্ষার পথে আরেকটু অগ্রসর হওয়ার কথা আমার মতো অনেকের কাছেই মোটামুটি দিবাস্বপ্নের মতো। অবশ্য শুধু উচ্চশিক্ষা নয়; বর্তমানে বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থার যে নাজেহাল অবস্থা, তাতে বোধ করি দুদিন পর উচ্চ-মধ্য-নিম্ন সকল শিক্ষাই দিবাস্বপ্ন হয়ে মানুষের মনের গহীনে হারিয়ে যাবে। এই শিক্ষার দায়ভার কার?
শিক্ষা নামে যা থাকবে, তা হয়তো সার্টিফিকেট লেনদেনেই সীমাবদ্ধ হবে । নিঃসন্দেহে এমন দুঃস্বপ্নের মধ্যে আমি কিংবা আমার দেশের কেউ বসবাস করুক তা মোটেও কাম্য নয়, তবে এভাবে চলতে থাকলে সেদিন আর বেশি দূরে নয়।
ধাপে ধাপে স্কুল-কলেজের নানাবিধ আজগুবি বিধিবিধানকে পেছনে ফেলে উচ্চশিক্ষার দ্বারে এসে যারা পৌছেই যায়, তাদের অনেকেরই প্রকৃত উচ্চশিক্ষার নিশ্চয়তা দিতে ব্যর্থ হয় দেশের নানাবিধ সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে আমি যে বিষয় নিয়ে উচ্চশিক্ষা অর্জন করেছি এবং আরেকটু করতে চাচ্ছি, তা তো দেশের অর্ধেকের বেশি শিক্ষিত জনগোষ্ঠী না শুনেছেন আর না বোঝেন।
তাই দেশ যখন আমাদের দক্ষতাকে কাজে লাগাবার সুবর্ণ সুযোগ হারাচ্ছে, তখন স্বার্থপরের মতো জ্ঞানচর্চার সুযোগ পাওয়ার লোভে আর একটু ভালোভাবে বেঁচে থাকার তাড়নায় দলে দলে আমরা পাড়ি জমাচ্ছি বিদেশে। আর একবার বিদেশের মাটিতে পা পড়লে যা হয়, উন্নতমানের সুযোগ-সুবিধা, নিরাপদ জীবন আর এগিয়ে যাওয়ার গোটাকয়েক দ্বার না চাইতেই উন্মোচন। ফলে দেশ-পাগলা হয় দেশান্তরি।
ওই সামাজিক মাধ্যমে দেশ দেশ করে দুই-একটি বাক্য বিনিময় করে দেশভক্তির সমাপ্তি টানতে হয়। উপায়ও নেই এছাড়া । উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীদের জন্য জ্ঞানচর্চার যে বিশেষ সুবিধা দিচ্ছে, তা এড়িয়ে চলা যে প্রায় অসম্ভব!
ছোটবেলা থেকেই আমি যে খুব পড়ুয়া ছিলাম তা নয়। পরিবারের চাপে স্কুল ও কলেজে বিজ্ঞান বিভাগের অত্যাচারে জীবন যখন প্রায় দুর্বিষহ, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে ‘শিক্ষা’ নিয়ে পড়বো বলে, আর হঠাৎ করেই যেন শিক্ষা অর্জনের প্রতি আগ্রহ অনেকাংশে বেড়ে গেল । কেননা, তখনই প্রথম জানতে পারলাম শিক্ষা নামের যে কলার মোচা স্কুল-কলেজে বিক্রি হচ্ছে, তা আসলে শিক্ষা নামের কলঙ্ক । শিক্ষার প্রতি অনাগ্রহ ও অসফলতার জন্য দায়ী শিক্ষার্থীর মেধা নয়, স্বয়ং শিক্ষাব্যবস্থা। তবে শিক্ষাও যে বিনোদন হতে পারে, তা অনার্স এবং মাস্টার্স লেভেলে ছিল শুধুই পুঁথিগত বিদ্যা । তার সঠিক বাস্তবায়ন দেখার সুযোগ হলো উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্পণের মাধ্যমে।
এদের বিশ্ববিদ্যালয়ের নানাবিধ উন্নত সুযোগ-সুবিধা দেখে প্রথম দুই মাস অবাক হয়ে ক্যাম্পাস ঘুরে বেড়াতাম আর চিন্তার সাগরে ডুবে থাকতাম । মাঝে মাঝে চরম হাতাশায় ভুগতাম এই ভেবে, “তাহলে কি আমার ফেলে আসা শিক্ষাজীবন পুরোটাই বৃথা?” নানাবিধ ধনাত্নক-ঋণাত্নক চিন্তায় মুখ কালো করে বাড়ি ফিরতাম ।
ভাগ্যক্রমেই হোক আর দুর্ভাগ্যক্রমেই হোক, নিজ দেশের সরকারি আর বেসরকারি দুই ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়েই কিছু সময় থাকার অভিজ্ঞতা হয়েছে, কোথাও শিক্ষালাভের, কোথাও দানের প্রয়াসে । গরীব দেশে আবার শিক্ষালাভই কী, আর দানই কী, সবই গরীবী অভিজ্ঞতা ।
তবে আমার মূল কথা হলো, মধ্যম আয়ের দেশ বলে ঢোল পেটালেই কি দেশ এক ধাপ এগিয়ে যাবে, নাকি তাকে এগিয়ে নেবার জন্য জ্ঞানচর্চা বাঞ্চনীয়? একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয় উদ্বোধন না করে, নিয়ন্ত্রণহীন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সার্টিফেকেটের ব্যবসা করতে না দিয়ে দেশে যদি আজ একটি উন্নত মানের বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা যেত, তবে হয়তো আজ থেকে পঞ্চাশ, না হয় একশ বছর পর আমার মতো কোনো অভাগিনী উন্নত দেশের শিক্ষা মোহে পড়ে দেশান্তরি হতো না । দেশের সম্পদ দেশেই থাকতো। শিক্ষার জন্য এ দায়ভার কাকে দিবো?
একটি দেশকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য দেশের সকল মানুষকে উচ্চশিক্ষা নিতে হয় না, দরকার কিছু প্রকৃত শিক্ষিত মানুষের । সেটি আমরা নিশ্চিত করতে পারছি না । আর পারছি না বলেই সামাজিক অবক্ষয়, ধর্মান্ধতা, অসমতা দিনে দিনে বেড়েই যাচ্ছে । ধনীরা ধান্দাবাজি করে আরও ধনী হচ্ছে, পুরষ্কৃত হচ্ছে। আর দরিদ্র জনোগোষ্ঠী দরিদ্রই থেকে যাচ্ছে। কারণ যে অমর বাক্য শুনে শুনে বড় হয়েছি আমরা, “শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড”, তা আজো অমর। মেরুদণ্ডে যখন অসুখ ধরে, তখন পুরো জাতিকে সেই অসুস্থ শরীরটা টেনে বেড়াতে হয়; কিন্তু শিক্ষার এই দায়ভার কে নেবে? এ দায়ভার আমার, আপনার, পুরো জাতির।
লেখক পরিচিতি
ড. সাবরিনা স. সেঁজুতি অস্ট্রেলিয়ার নিউক্যাসল ইউনিভার্সিটিতে কর্মরত রয়েছেন।