মিরন কুমার ভৌমিক, আকলিমা শরমিন, আসমা জাহান মুক্তা, তৌফিক হাসান, শেখ মোহাম্মদ আলী, গৌতম রায়: পৃথিবীর প্রায় সব জাতিই শিক্ষাক্ষেত্রে তাদের বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়িয়েছে। উন্নত রাষ্ট্রগুলো গত তিন দশকে তাদের শিক্ষার্থীদের পেছনে বিনিয়োগ প্রায় দ্বিগুণ করেছে; উন্নয়নশীল দেশগুলোও পিছিয়ে নেই। দুর্ভাগ্যবশত, বাংলাদেশ এক্ষেত্রে উদাসীন থেকেছে কিংবা অবহেলা করেছে। শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়ানোর ক্ষেত্রে সরকার সবসময়ই অর্থনৈতিক অবস্থার দোহাই দিয়ে থাকে, কিন্তু বাংলাদেশের সমান কিংবা কম অর্থনৈতিক ক্ষমতাসম্পন্ন দেশগুলো তাদের মতো করে বিনিয়োগ বাড়িয়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। উদাহরণ হিসেবে নেপালের কথা বলা যেতে পারে যাদের মাথাপিছু আয় আমাদের অর্ধেক কিন্তু শিক্ষার্থী-প্রতি বিনিয়োগ তিনগুণেরও বেশি। গত এক দশকে বাংলাদেশ শিক্ষাক্ষেত্রে বিনিয়োগ আগের চেয়ে বাড়ালেও তা এখনও প্রয়োজনের তুলনায় অনেক অপ্রতুল। আমাদের আজকের এ লেখার উদ্দেশ্য সদ্য-ঘোষিত বাজেটকে উপলক্ষ করে; বিশেষত প্রাথমিক ও শিক্ষা উভয় মন্ত্রণালয়ে যারা বাজেট অনুযায়ী কর্মসূচী পরিকল্পনা ও তৈরি করবেন তাদেরকে উদ্দেশ্য করে। আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে সমস্যার অন্ত নেই। কিন্তু কিছু সমস্যার সমাধান করা গেলে আমরাও আমাদের শিক্ষায় বিনিয়োগ থেকে অনেকটাই উপকৃত হতে পারব।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রায় শতভাগ অর্জনের কাছাকাছি পৌঁছে গেলেও এদের অর্ধেকই পুরো প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করতে পারে না। শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ একই শ্রেণীতে কয়েক বছর থেকে যায় এবং একটা সময়ে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত না করেই বিদ্যালয় ত্যাগ করে। ফলে আমাদের যতটুকুই শিক্ষাক্ষেত্রে বিনিয়োগ হচ্ছে, তার একটি বড় অংশ কার্যকরভাবে ফলপ্রসূ হচ্ছে না। অন্যদিকে যারা প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করছে, তারা কতোটুকু শিখছে- তাও একটি প্রশ্ন। মাধ্যমিক শিক্ষাক্ষেত্রেও দিনদিন পাশের হার বাড়লেও শিক্ষার্থীদের গুণগত শিক্ষা-অর্জন প্রশ্নবিদ্ধ। সবক্ষেত্রেই কারণ হিসেবে অনেক কিছু বলার আছে, কিন্তু দক্ষ শিক্ষকের অভাবই যে সবচেয়ে বড় কারণ তা আর প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। শিক্ষকই পারেন শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিদ্যালয়ের প্রতি আকর্ষণ তৈরি করতে, তার শিখনকে ফলপ্রসূ এবং সর্বোপরি তাকে একজন যোগ্য মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষকের দক্ষতাই শিক্ষার্থীদের শিক্ষা অর্জনের সবচেয়ে বড় প্রভাবক। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমাদের দেশে দক্ষ শিক্ষকের সংখ্যা প্রত্যাশার তুলনায় খুব কম। একটা সময় ছিল যখন অনেকে শিক্ষকতা পেশায় আসতেন শুধু এই পেশার প্রতি ভালোবাসা থেকে। কিন্তু আমরা কি এখন এমন শিক্ষকদের খুব একটা দেখা পাব? শিক্ষাজীবনে যারা খুব ভালো ফলাফল করে, তাদের কতোজন শিক্ষকতা পেশায় আসেন? তদুপরি, এ পেশায় যথাযথ প্রশিক্ষণ না থাকলে ভালো শিক্ষক হওয়া একেবারেই অসম্ভব। অনেকের ধারণা- শিক্ষক হতে গেলে নির্দিষ্ট কোনো পেশাগত যোগ্যতা লাগে না। এ থেকে বুঝা যায় আমরা এই পেশাটাকে কীভাবে দেখছি?
বাংলাদেশে শিক্ষকতা পেশা মোটেও আকর্ষণীয় নয় যে, এখানে ছেলেমেয়েরা হুমড়ি খেয়ে আসবে। সম্প্রতি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণীর মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া যদিও রেজিস্টার্ড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরকে জাতীয়করণের আওতায় আনার প্রচেষ্টা চলছে, কিন্তু এই উদ্যোগুলো বাস্তবতার নিরিখে অত্যন্ত কম। আধুনিক তরুণ সমাজ কেন তাহলে শিক্ষকতার দিকে ঝুঁকবে? বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে দেখলে, শিক্ষকতা পেশায় যোগদানের জন্য পেশাগত যোগ্যতা আবশ্যক এবং সেটি অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের। অনেক দেশ আছে যেখানে শিক্ষকতার জন্য ডিগ্রি নিতে পাঁচ বছর সময় লাগে, যেটি একটি স্বাভাবিক সম্মান ডিগ্রির চেয়েও বেশি সময়। শিক্ষকতার জটিল এবং কারিগরি বিষয়গুলো ভালোভাবে রপ্ত করার জন্য পর্যাপ্ত সময় দিতে হয়। শিক্ষকতা পৃথিবীর সব রাষ্ট্রেই সম্মানজনক ও গুরুত্বপূর্ণ পেশা হিসেবে বিবেচিত হয়। বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুবিধাদির বিচারেও শিক্ষকতা পেশা প্রথম দিকেই থাকে। খুব দূরে নয়, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের দিকে তাকালেই চলে। উন্নত দেশগুলোতে তো শিক্ষকতা পেশা হিসেবে বেশ ঈর্ষণীয়!
এ বিষয়ে আমাদের এই বিশদ আলোচনার মূল কারণটি হল শিক্ষকতা পেশার জন্য সঠিকভাবে শিক্ষায় বিনিয়োগ না করলে এখানে মেধাবী এবং দক্ষ লোকজন পাওয়া কঠিন। আর দক্ষ শিক্ষক না থাকলে সর্বোপরি শিক্ষাক্ষেত্রে যতোই বিনিয়োগ বাড়ানো হোক না কেন, তেমন উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সম্ভব নয়। শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়নের লক্ষ্যে নেওয়া সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচীর আমরা প্রশংসা করি, কিন্তু এসব ছোট ছোট কর্মসূচি আসলে খুব একটা পরিবর্তন আনতে পারবে না যদি না আমরা তাদের পেশাগত মর্যাদা এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট সুবিধাদি বাড়াতে না পারি।
এটি সত্যি, সরকারের একার পক্ষে একবারে এ সমস্যা সমাধান করা হয়তো সম্ভব নয়। কিন্তু সব সমস্যাকে একইসাথে চেষ্টা না করে আমরা একটি একটি করেও সমাধানের পথে যেতে পারি। সেক্ষেত্রে এই বাজেট-বরাদ্দ থেকে আমরা যদি কোনো সুনির্দিষ্ট কর্মসূচীর পরিকল্পনা করি কেবল শিক্ষকদের মর্যাদা এবং অবস্থান পরিবর্তনের জন্য, সেটি কি খুব অযৌক্তিক দাবি হবে? পাঁচ বছর মেয়াদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সব শিক্ষকের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির জন্য কিছু অর্থ আলাদা করে এ বছর থেকেই বরাদ্দ করা কি সম্ভব নয়? বাংলাদেশ সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে এখন বিলিয়ন ডলার প্রকল্প পরিচালনা করছে এবং অনেকক্ষেত্রেই দেখা যায় প্রকল্পের অর্থ সময়মতো খরচ করাও সম্ভব হয় না। এ বিষয়গুলোকে সমন্বয় করে কি আমরা পারি না শিক্ষকদের মর্যাদা এবং সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে কোনো প্রকল্প হাতে নিতে? তবে এ সুযোগ সব শিক্ষকদের জন্যই প্রযোজ্য হতে হবে; শুধু সরকারি বা বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য নয়।
প্রাথমিক বাজেট ঘোষণায় ২০১২-১৩ অর্থবছরে মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য সর্বমোট বাজেট ঘোষিত হয়েছে প্রায় ৩৯৩৯০ কোটি টাকা। শুধু শিক্ষায় বিনিয়োগ কতটুকু তা এখনও পরিষ্কার না, কেননা বাজেট বক্তৃতায় মানবসম্পদ উন্নয়নের আওতায় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ, সংস্কৃতি, ধর্ম, যুব ও ক্রীড়া ইত্যাদি ক্ষেত্রগুলোকেও বিবেচনা করা হয়েছে। ২০১১-১২ অর্থবছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে একত্রে ২০ হাজার ৩১৬ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল। আগের অর্থবছরের তুলনায় এ খাতে বৃদ্ধি মাত্র এক হাজার ৮৭৮ কোটি টাকা। এ বছরের চিত্রটি এখনো পুরোপুরি পরিষ্কার নয়। কিন্তু গত বছরের তুলনায় এ বরাদ্দ যে উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ানো উচিত তা নিয়ে কারোরই দ্বিমত থাকার কথা না। প্রাথমিক ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় উভয়কেই আমরা অনুরোধ করতে চাই, ‘শিক্ষকতা মহান পেশা’ ধারণা নিয়ে আমরা চলছি দীর্ঘদিন। কিন্তু এই মহান পেশার মানুষদের ন্যূনতম চাহিদা পূরণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা আমরা করছি না। এ বিষয়টি এখন থেকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা হলে বাংলাদেশের শিক্ষা সেক্টর এর প্রতিদান দেবে দ্রুতই। বর্তমান সরকারের আমলে প্রণীত যে নতুন শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করার কথা বলা হচ্ছে, সেটি সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে গেলেও শিক্ষকদের সংখ্যা ও দক্ষতা আকর্ষণীয় পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। সেটি করতে গেলেও বাজেট ও কর্মসূচীতে এর প্রতিফলন থাকা দরকার।
মোট বাজেটে কতো শতাংশ শিক্ষায় বিনিয়োগ করা দরকার তা নিয়ে নানা মত থাকলেও বলা হয় উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শিক্ষাখাতে জাতীয় বাজেটের কমপক্ষে ২৫ শতাংশ এবং জাতীয় আয়ের ৬-৮ শতাংশ বরাদ্দ রাখা দরকার। সম্প্রতি ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল (যিনি বর্তমান শিক্ষানীতি প্রণয়নের সাথে সরাসরি জড়িত ছিলেন) এক লেখায় জানিয়েছেন, সরকার এক্ষেত্রে জাতীয় আয়ের মাত্র ২.৪ ভাগ খরচ করে যা জাতীয় বাজেটের ১৩-১৪ শতাংশের কাছাকাছি। তাছাড়া এই ছোট বরাদ্দের সাথে প্রযুক্তি বা অন্য সেক্টরের বরাদ্দ ঢুকিয়ে শিক্ষাখাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দের দাবি করা হয়। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে শিক্ষার সাথে প্রযুক্তি এবং ২০০৮-০৯ অর্থবছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তির সাথে স্বাস্থ্যখাতকেও জুড়ে দেয়া হয়েছিল। শিক্ষাখাতে বাজেট বাড়লে সাধারণ মানুষ খুশি হয় কিন্তু এই ফাঁকিটা অনেকক্ষেত্রে ধরা সম্ভব হয় না। অর্থমন্ত্রীকে অনুরোধ জানাবো, এই বিষয়গুলোকে সংশোধিত বাজেটে গুরুত্বসহকারে বিবেচনার জন্য। সরকার নতুন শিক্ষানীতি উপহার দিয়েছে, এটি বাস্তবায়নের দায়ও সরকারের। বাজেট বরাদ্দের কারণে এটি বাস্তবায়িত না হলে সরকার নতুন শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে আন্তরিক নয়- এমনটাও অনেকের মনে হতে পারে।
দিন-বদলের বাংলাদেশের জন্য শিক্ষকরাই মূলত সামনের কাতারের কারিগর। তাঁদেরকে বাদ দিয়ে আর যাই হোক সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশের চিন্তা হবে আকাশকুসুম কল্পনা। আমরা কখনোই চাই না, আমাদের শিক্ষকরা তাঁদের জীবন-যাপনের ন্যূনতম দাবি আদায়ের জন্য রাজপথে নেমে আসুক, অনশন করুক এবং অবমাননার শিকার হোক। মনে রাখতে হবে, শিক্ষকদের পেছনে বিনিয়োগ কখনোই বৃথা যায় না বরং যুগে যুগে এটিই সবচেয়ে কার্যকর শিক্ষায় বিনিয়োগ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।
লেখকবৃন্দ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক শিক্ষার্থী। বর্তমানে বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষা গবেষক হিসেবে কর্মরত।
লেখক পরিচিতি
সম্পাদক বাংলাদেশের শিক্ষা
এই লেখাটি সম্পাদক কর্তৃক প্রকাশিত। মূল লেখার পরিচিত লেখার নিচে দেওয়া হয়েছে।