রাসেল লিখেছেন শৈশব নিয়ে
আমার ছেলের শৈশব এখন। বয়েস বাড়ছে, হামাগুড়ি দেওয়া ছেলে বড় হয়ে বর্ণমালার ধাপ পেড়িয়ে এখন বানান করে পড়তে শিখেছে। যেকোনো উৎসাহী বাবার মতো আমিও আগ্রহী হয়ে এখন বইয়ের দোকানে গিয়ে বই খুঁজি, বাংলা বই, যে বই বানান করে আমার ছেলে কল্পনায় তার নিজের জগতটা তৈরি করে নেবে, সে জগতে তার বন্ধু কে হবে, কিভাবে যে বন্ধুত্বা শিখবে সেটা তারই ঠিক করে নেওয়ার কথা।
তবে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে উজার হচ্ছে খেলার মাঠ, স্কুলগুলো এখন এক একটা বাস্কবাড়ী, সেখানে এক কোনে একটা স্লাইড, একটা সি-স আর একটা দোলনা ঝুলিয়ে এসি রুমে শিশুশিক্ষাপ্রদানের বন্দোবস্ত আমার পছন্দ না কিন্তু এর বাইরে কোনো বিকল্প নেই আমার সামনে, আমাকে অগ্যতা মেনে নিতে হয়, আমি মেনে নেই, আমাদের সীমাবদ্ধ ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশে ১৬ কোটি মানুষের বসবাস, চাষের জমি, ঘুমানোর বিছানা, রাস্তা আর নদী বন জঙ্গল পাশাপাশি থাকবে না, একজন মানুষের সাথে অন্য একজন মানুষের দুরত্ব কমে যাবে, এরপর মানুষের ঘাড়ের উপর পা রেখে পার হবে মানুষ রাস্তায়, সুতরাং অসহ্য দুষণাক্রান্ত শহরে শিশুপার্কে গিয়ে কয়েকঘন্টা আনন্দ কেনবার ধকল ভেবেই ঘরের কোণেই বন্দী করে রাখি ওকে।
কিন্তু সেই সীমাবদ্ধ ঘরে অসীমের দরজা খুলে দিতে পারে বই, আমার ছেলের জন্য বইয়ের বাজার ঘুরে কিনবার বই পাই না। বর্ণমালা, ধারাপাত, জুরাসিক যুগের ডাইনোসরের গল্প, সমুদ্রতলের প্রাণীর সংবাদ, এইসব পাঠ্যপুস্তকের বাইরে আবোল তাবোল খুঁজি, যার কোনো অর্থ নেই, কোনো শিক্ষার চাপ নেই, নিখাদ আনন্দের জন্য পড়া যাবে এমন কিছু শিশুদের বই খুঁজতে গিয়ে দেখলাম আমাদের শৈশবের সাথেই সেইসব নির্বাসনে গিয়েছে। সময় বদলেছে, এখন কেউ নার্সারী রাইম আর ছেলেভোলানো ছড়া শোনায় না, বাচ্চাকে ঘুমপাড়ানী গান শোনায় না কেউ, সিডি বাজতে থাকে কম্পিউটারে আয় ঘুম, যায় ঘুম বাগদী পাড়া দিয়ে বাগদীরা সব মাছ ধরে কালো জামা গায়ে।
ঘুমপাড়ানী গানের যুগ শেষ হয়ে আসলো, মেনে নিচ্ছি নির্বিবাদে, আমাদের শিশুদের শৈশব মানেই লড়াই, ক্লাশে প্রথম হতে হবে, নাচে আর গানে হতে হবে সবার সেরা, তাকে নিয়ে আমরা টিভিভবনে ছুটবো, সে চাইল্ড ট্যালেন্ট হান্টে নাম লিখিয়ে গেয়ে নেচে ছবি এঁকে আমাদের সম্মানিত করে ফেলবে, এক কারণেই হাজার পয়সাপাত্তি খরচ করে শৈশবের শবদাহ করে তাকে বিভিন্ন ট্রেনিং সেন্টারে পাঠানো, শিশু ব্যাগ কাঁধে স্কুলে যায়, স্কুল থেকে ফিরে যায় গানের ক্লাশে, গানের ক্লাশ থেকে ফিরে বাজনার প্রশিক্ষণ, এরপর সন্ধ্যায় হাউজটিউটর শিশুর কানের কাছে গুনগুন করে- টুইঙ্কেল টুইঙ্কেল লিটল স্টার।
আমি আমার ছেলের জন্য এমন শৈশব চাই না, স্কুলে প্রথম হওয়া, গানে আব্বাসউদ্দিন আর বাজনায় আলাউদ্দিন না হলেও তার জীবন কেটে যাবে আনন্দে, এতসব হয়ে উঠবার চাপের তুলনায় বেঁচে থাকবার আনন্দে ভরে থাক তার সবটুকু সময়, সে নিজের মতো জীবনটা উপভোগ করুক। আর ওর জন্য উপভোগ্য একটা জীবন বানাতে প্রাণান্ত হতে হয় আমাকে, বাজারে বাংলায় শিশুতোষ কিছু নেই, কোলকাতা থেকে আমদানী হওয়া শিশুসাহিত্যের অনুলিপি প্রতিলিপির বাইরে গত ১০ বছরে তেমন ভালো মানের শিশুসাহিত্য কি লেখা হয়েছে বাংলাদেশে, শিক্ষাবিস্তারসহায়িকা হিসেবে শৈলী ডিজিটাল প্রকাশনী, টোনাটুনি যা করেছে সেটাও শিক্ষামূলক সিডি উৎপাদন, ছেলে পড়তে শিখবে, লিখতে শিখবে, ছেলে ফাটিয়ে ফেলবে কেউকেটা হয়ে, আমি এমনটা চাই না, চাই আলাদা কিছু আনন্দের উৎস। সুতরাং ডিজনীর শরণাপন্ন হই, ইংরেজী ভাষায় কার্টুন দেখিয়ে কতটুকু আনন্দিত করা যায় ওকে, সুতরাং বাংলায় সিসিমপুর খুলে বসি।
সিসিমপুরও সে অর্থে এক ধরণের শিক্ষাবিস্তার কর্মসূচি, নির্মাণকুশলতায় অন্য অনেক অনুষ্ঠানের তুলনায় এগিয়ে, কিন্তু তাদের প্রথম ৩টি ডিভিডি বের হওয়ার পর আর কোনো ডিভিডি আসে নি বাজারে, প্রতি সপ্তাহেই নতুন নতুন পর্ব প্রচারিত হচ্ছে, লোড শেডিং এর যন্ত্রনায় সবগুলো দেখা সম্ভব হয় না, আমরা প্রযুক্তি ব্যবহারের দিক থেকে নেহায়েত প্রস্তর যুগের মানুষের তুলনায় এক ধাপ এগিয়ে, সে কারণে ইউটিউব আর ইণ্টারনেট ঘেঁটেও কোনো সিসিমপুরের অনুষ্ঠান দেখা সম্ভব না।
তবে ইউএসএইডের অর্থানুকুল্যে প্রকাশিত সিসিমপুর হয়তো বাণিজ্যিক ভাবেই বাজারে চলে আসবে, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহ অস্থির দিনগুলোতে যে মানুষটা শিশুদের নিয়ে ভেবেছেন, তারও আগে যখন পূর্ব পাকিস্তানে টিভি সম্প্রচার শুরু হলো তখন যে মানুষটা তার পাপেট নিয়ে শিশুদের সামনে রঙ্গীন একটা জগত খুলে দিয়েছিলো, সে মানুষটা শত সীমাবদ্ধতার ভেতরেও বিটিভিতে বছরের পর বছর শিশুদের জন্য আলাদা অনুষ্ঠান করে গিয়েছেন। বিটিভির আর্কাইভে সেসব পঁচে নষ্ট হচ্ছে, মুস্তফা মনোয়ার আমাদের শৈশবকে রঙ্গীন করেছিলেন তার পাপেট নাচে, আমি বাজার ঘুরে হাজার বারেও সেসবের কোনোটাই খুঁজে পাই না।
বিটিভি চাইলেই পুরোনো সেসব অনুষ্ঠানের ডিভিডি করে বাজারে বিক্রী করতে পারে, যদি বিপননকৌশল নির্ধারণ করে নিতে পারে তবে এইসব আর্কাইভের অনুষ্ঠান বিক্রী করেই আরও একটি টিভি চ্যানেল সম্প্রচারের ব্যবস্থা হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের কর্তাব্যক্তিদের অলস মস্তিস্কে বিভিন্ন রকম কুটবুদ্ধি নাচানাচি করলেও এইসব ভাবনা আসে না। কাউকে না কাউকে এই ধারাটুকু বদলাতে হবে। আমার কাছে ক্ষমতা নেই, থাকলে আমি নিজেই হয়তো বিটিভির কর্তাব্যক্তিদের প্রলুব্ধ করতাম, এটার ব্যবসায়িক গুরুত্ব বোঝানের চেষ্টা করতাম।
বিটিভি পাপেটদের ছবি ছাপানো মগ, টি শার্ট আর রেপ্লিকা বিক্রী করতে পারে, ডিভিডির সাথে এইসব রেপ্লিকাও কেনা যাবে, সেটা হয়ে উঠবে ঘরের শোভা, আর ডিভিডি রিলিজের সবচেয়ে বড় সমস্যা এর অনুলিপি হয়ে যাওয়ার আশংকা, এখনকার প্রযুক্তি ব্যবহার করে যেকেউ হয়তো শতভাগ না হলেও অনুলিপি তৈরির বিষয়টাকে নিয়ন্ত্রন করতে পারবে, প্রয়োজন উদ্যোগের, এই উদ্যোগ নিলে হয়তো আমি বাজার ঘুরে ভালো মানের বই না পাই আনন্দিত চিত্তেই মুস্তফা মনোয়ারের ডিভিডি নিয়ে বাসায় ফিরবো, তা হয় না।
আমি বাজারে যাই, ২৫টা মাছ, ২০টা সবজি আর ৩০ পদের যানবাহনের তালিকা আর ছবিসমেত শিক্ষামূলক পুঁথি কিনতে বাধ্য হই, আমার ভালো লাগে না মোটেও, আমি বই মেলা আঁতিপাঁতি করে খুঁজে দেখি ডিজনীর কার্টুনের বাংলা ভাষ্য পাওয়া যায় সেখানে, আমাদের শৈশব বা শিশুউপযোগী কোনো প্রকাশনা নেই, কোনো অনুষ্ঠান নেই, কিন্তু এরপরও গন্ডায় গন্ডায় বাচ্চা হচ্ছে, তারা কোনো রকম উৎসাহ উদ্দীপনাবিহীন বেড়ে উঠছে।
আমরা তাদের শৈশব নিয়ে এই যে শবদেহ দাহ করে যে পাপ করছি তার প্রায়শ্চিত্ত করবার কোনো ভাবনাই আমাদের ভেতরে তৈরি হচ্ছে না। হয়তো কোনো একদিন দেশের কর্তাব্যক্তিদের সুমতি হবে, সেই সুমতি হওয়ার অপেক্ষায় আমরা দিন গুনছি, আমার ছেলে বড় হয়ে যাচ্ছে, হয়তো পাগলা দাশুর বদলে তার কৈশোরের সঙ্গী হয়ে উঠবে হ্যারি পটার, যে যাদুর ছড়ি ঘুরিয়ে যাই বলুক না কেনো, আমার ছেলে চমৎকৃত হবে, তার ভেতরে কোনো দিন জীয়নকাঠি মরণকাঠি বদলে দিয়ে ঘুমন্ত রাজকন্যার ঘুম ভাঙানোর কল্পনা জন্মাবে না, আমাদের শিশুদের কল্পনার ডানা আমরাই কাটছি, তাদের বাধ্য করছি জন্মেই বৃদ্ধ হয়ে যেতে।
লেখক: ব্লগার
লেখক পরিচিতি
সম্পাদক বাংলাদেশের শিক্ষা
এই লেখাটি সম্পাদক কর্তৃক প্রকাশিত। মূল লেখার পরিচিত লেখার নিচে দেওয়া হয়েছে।