যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চতর শিক্ষা: ফান্ডিং-এর সোনার হরিণ

উচ্চ শিক্ষার খরচ যুক্তরাষ্ট্রে বেশ বেশি, কাজেই নিতান্ত উচ্চবিত্ত ছাড়া নিজের পয়সায় পড়াটা কঠিন। রাজ্য সরকারের বিশ্ববিদ্যালয়ে খরচ কম। তবে রাজ্যের বাসিন্দাদের জন্য যে সুযোগ সুবিধা ও ফি-মাফ রয়েছে, সেটা বিদেশী ছাত্ররা পায় না। কাজেই বিদেশে পড়তে আসার আগে ভর্তির পাশাপাশি ফান্ডিং জোগাড় করাটা খুব দরকার।

কী রকম খরচ হবে?

দেখা যাক টিউশন ফি-র ব্যাপারটা। অধিকাংশ সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স বা পিএইচডি পর্যায়ে প্রতি সেমিস্টারে টিউশন ফি দেয়া লাগে কয়েক হাজার ডলার। যেমন, ফুল কোর্স লোড নিলে ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাসে গ্রাজুয়েট পর্যায়ে ইঞ্জিনিয়ারিং এ লাগে প্রতি সেমিস্টারে প্রায় ১২ হাজার ডলার, ইউনিভার্সিটি অফ ইলিনয়েও তাই লাগে। কিন্তু বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফি-টা এর প্রায় ২ গুণ — যেমন জন্স হপকিন্স মাস্টার্সেই লাগে ২১ হাজার। নিচের দিকের র্যাংকে থাকা জায়গাতে টিউশন কম লাগলেও সেটা বাংলাদেশের হিসাবে অনেক।

এতো গেলো কেবল টিউশন। থাকা-খাবার জন্য খরচটা জায়গা ভেদে নানা রকম। বড় বড় অনেক শহরে খরচ ব্যাপক। কারো সাথে রুম শেয়ার করে থাকলেও হয়তো বাড়িভাড়া বাবদ মাসে ৪০০/৫০০ ডলার চলে যাবে। মিডওয়েস্টের ছোট শহর গুলোতে খরচ কম। সেখানে ৩০০/৪০০ ডলারে আস্ত ১ রুমের অ্যাপার্টমেন্ট নিয়ে থাকা চলে। খাবার খরচ একা মানুষের ২০০-২৫০ ডলারে হয়ে যাবার কথা, চেষ্টা করলে আরো কমানো যায় (চীনাদের গাজর খেয়ে থাকার গল্প বহুল প্রচলিত!!)। আর দূরে কোথাও না গেলে এবং শহরে বাস সার্ভিস ভালো থাকলে গাড়ির দরকার নেই। সব মিলে একা কারো জন্য জায়গাভেদে ১০০০-১২০০ ডলার থাকা খাবার খরচে যাবে। বিশ্ববিদ্যালয় বেছে নেয়ার সময়ে তাই টিউশন ছাড়াও লিভিং কস্ট খেয়াল করে নিতে হবে।

খরচ যোগাবেন কীভাবে?

পিএইচডি পর্যায়ে প্রায় সবাই কোনো না কোনো উপায়ে ফান্ডিং পায়। ভর্তির সময়েই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফান্ডের গ্যারান্টি দেয়। আগের লেখাতেই বলেছিলাম, মাস্টার্স পর্যায়ে ফান্ডিং শুরুতে কমই পাওয়া যায়। তবে একবার এসে যাবার পরে ২য় সেমিস্টার নাগাদ চেষ্টা করে ফান্ড জোগাড় করা সম্ভব।

টিউশন ফি মাফ করার বেশ কিছু উপায় আছে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধার ভিত্তিতে টিউশন ওয়েইভার বা ফি-মাফ দেয়া হয়। মাস্টার্স বা পিএইচডি পর্যায়ে টিচিং অ্যাসিস্টান্ট বা রিসার্চ অ্যাসিস্টান্ট হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ পেলে বেতন পাওয়ার সাথে সাথে টিউশন মাফ হতে পারে, বা কম দিতে হতে পারে। আবার মেধাবী ছাত্রদের ভর্তির সময়ে ফেলোশীপ বা স্কলারশীপ দেয়ারও ব্যবস্থা আছে। কিছু নির্দিষ্ট বৃত্তিতে বাংলাদেশের ছাত্ররা বেশ ভালো সুযোগ পায়। যেমন, “আব্বাসী ফেলোশীপ” নামে একটা বৃত্তি ইউনিভার্সিটি অফ ইলিনয়ের ভারত, পাকিস্তান, ও বাংলাদেশের ছাত্র/ছাত্রীরা পায়। আবার দেশ থেকে ফুলব্রাইট নিয়েও অনেকে ইদানিং আসছেন।

অ্যাসিস্টান্টশীপ পেলে সপ্তাহে ১০ থেকে ২০ ঘণ্টা শিক্ষকতায় সহায়তা (যেমন, স্নাতক পর্যায়ে ক্লাস নেয়া, খাতা দেখা) অথবা প্রফেসরের গবেষণায় সহায়তা করতে হবে। টিচিং অ্যাসিস্টান্টশিপ বা টি এ পেতে হলে ডিপার্টমেন্টের অফিসে খোজ নিতে হবে সে ব্যাপারে। অনেক জায়গায় এজন্য টোফেল এর স্পিকিং অংশে ভালো স্কোর চায়। রিসার্চ অ্যাসিস্টান্টশীপ বা আর এ নির্ভর করে প্রফেসরের উপরে। ভর্তির আবেদন করার আগে থেকে প্রফেসরের সাথে যোগাযোগ করে সেটার ব্যবস্থা করা সম্ভব, অথবা ১ম সেমিস্টারে কারো সাথে ফ্রি কাজ করে ভালো কাজ দেখিয়ে পরে তার কাছ থেকে আরএ পাওয়া যেতে পারে। খেয়াল রাখতে হবে, আরএদের বেতন প্রফেসরের নিজের রিসার্চ ফান্ড থেকে আসে, আর সেটা পাওয়া না পাওয়া প্রফেসরের মর্জির উপরে নির্ভর করে। কাজেই ভালো কাজ দেখানো, গবেষণা ঠিকমতো করা, এগুলো ভালোভাবে করতে হবে। প্রফেসরদের সাথে ইমেইলে যোগাযোগ করা নিয়ে আরেকদিন লিখবো।

এছাড়াও উপার্জনের আরেকটা উপায় হলো ক্যাম্পাসের নানা জায়গা, যেমন লাইব্রেরিতে ঘণ্টা হিসাবে কাজ করা।

অফ ক্যাম্পাস কাজ করাটা শুরুতে যায় কি না, আমার এখন মনে পড়ছে না, তবে যতদূর জানি, প্রথম ৯ মাসে সেটার অনুমতি বের করা কঠিন। সেমিস্টার চলা কালে অন বা অফ ক্যাম্পাসে সপ্তাহে মোট ২০ ঘণ্টার বেশি কাজ করা যায় না। তবে গ্রীষ্মকাল বা দুই সেমিস্টারের মাঝের বন্ধে ৪০ ঘন্টা কাজ করা চলে।

উপরের সব পদ্ধতিতেও ফান্ডিং না হলে সর্বশেষ তরিকা হলো শিক্ষা ঋণ নেয়া। মার্কিনীদের জন্য সেটা ডাল ভাত, কিন্তু বিদেশী ছাত্রদের জন্য সেটা বেশ কঠিন। পরিচিত কেউ মার্কিন নাগরিক হলে এবং ঋণে কো-সাইন করলে (মানে ঋণের অংশীদার/জামিনদার হলে) তবেই ঋণ মিলতে পারে। তবে অনেক ক্ষেত্রে সেটা ছাড়া হয়তো উপায় থাকে না, যেমন কেবল কাজ করে দামি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির বছরে ৪০ হাজার ডলার টিউশন দেয়াটা প্রায় অসম্ভব — সেক্ষেত্রে টিউশন ওয়েইভার বা ঋণ ছাড়া উপায় নেই।

লেখক পরিচিতি

রাগিব হাসান

ড. রাগিব হাসান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্যা ইউনিভার্সিটি অব অ্যালাবামা অ্যাট বার্মিংহাম-এ অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। তিনি বাংলাদেশের শিক্ষার নানা প্রসঙ্গ নিয়ে নিয়মিত লেখালেখি করছেন।

জনপ্রিয় নিবন্ধ

প্রাথমিক স্তরে ভাষা শেখা : বিষয় – বাংলা

ভাষার দক্ষতা চারটি— শোনা, বলা, পড়া, লেখা। আর ভাষা...

আগে ইংরেজি গ্রামার শিখবো, নাকি ভাষা শিখবো?

কোন ভাষার গ্রামার হলো ঐ ভাষার গঠন প্রকৃতি যার...

শিক্ষাব্যবস্থার হালচাল

অর্থনীতিবিদদের মতে, শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ সবচেয়ে লাভজনক এবং নিরাপদ রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ। অর্থনীতিবিদ এডাম স্মিথ, ডেভিড রিকার্ডো এবং মার্শালের মতে, শিক্ষা এমন একটি খাত যার কাজ হলো দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলে পুঁজির সঞ্চালন ঘটানো। শিক্ষার অর্থনীতি নিয়ে মৌলিক গবেষণায় অর্থনীতিবদ আর্থার শুল্জ ও রবার্ট সলো দেখিয়েছেন যে, প্রাথমিক শিক্ষায় বিনিয়োগ করলে সম্পদের সুফল ফেরত আসে ৩৫ শতাংশ, মাধ্যমিক শিক্ষায় ২০ শতাংশ, এবং উচ্চ শিক্ষায় ১১ শতাংশ।

আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা : পিএইচডির পর কী?

আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়, আমি নিজেও এ-নিয়ে...

ক্যাডেট কলেজে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে কিছু কথা

ক্যাডেটসমূহ বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।...

আরও কিছু লেখা

অধিক

    উচ্চশিক্ষার মান: শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক

    শিক্ষাজীবনে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বর্তমান সময়ে...

    সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষা ব্যবস্থাপনা

    সরকারি হিসেবে এখন পর্যন্ত ৩১৭টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে। একই মন্ত্রণালয় এবং অধিদপ্তরাধীন হলেও অভ্যন্তরীণ শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে বিস্তর বৈসাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। বিদ্যালয়গুলোতে স্টাফিং প্যাটার্ন, শ্রেণী, শিফ্ট, লিঙ্গ এবং আরও কিছু বিষয়ের পরিপ্রেক্ষিতে পার্থক্য বিদ্যমান। তাছাড়া সুষ্ঠু তদারকি এবং নিয়ন্ত্রণের অভাবে শিক্ষকগণের আচরণগত পার্থক্যও রয়েছে। এই পার্থক্যগুলো আপাতদৃষ্টিতে খুব স্বাভাবিক মনে হলেও বিদ্যালয়ের পাঠদান কার্যক্রম ও কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ফলাফলে বেশ প্রভাব পড়ে।

    টেলিভিশন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিজ্ঞান শিক্ষা জনপ্রিয়করণ: একটি প্রস্তাব

    “কীভাবে বিজ্ঞান শিক্ষা জনপ্রিয় করা যায়”- এ নিয়ে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা যথেষ্ঠ ব্যস্ত সময় পার করছেন। মিটিং-সিটিং কম হচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষকদেরও ডাক পড়ছে হরহামেশা। শিক্ষামন্ত্রী মহোদয়ও একাধিকবার বিজ্ঞান শিক্ষা নিয়ে তার টেনশনের কথা প্রকাশ করেছেন। তাই আশা করবো, উল্লেখিত প্রস্তাবখানা সরকারের নীতি-নির্ধারকগণ বিবেচনা করে দেখবেন।

    মধ্যরাতে ‘ও’ এবং ‘এ’ লেভেল পরীক্ষা

    'ও' এবং 'এ' লেভেল পরীক্ষা সারা বিশ্বে ব্রিটিশ কাউন্সিলের অধীনে একইদিনে একই প্রশ্নপত্রে অনুষ্ঠিত হয়। যদি কোনো দেশে কোনো কারণে নির্দিষ্ট দিনে পরীক্ষা না হয়, তাহলে পরের বছর ছাড়া আর ওই পরীক্ষা নেওয়ার সুযোগ থাকে না।

    বিজ্ঞান চেতনা: প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কোন বিজ্ঞান শিখছে শিশুরা?

    নাহিদ নলেজ বিজ্ঞান চেতনা নিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা কী- এ সম্পর্কে...

    জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) এবং আমাদের নতুন বই

    আগামী বছরের প্রাথমিকের বই থেকে কমানো হয়েছে ৫৮০ পৃষ্ঠা। তবে দুই স্তরে কতো পৃষ্ঠা কমানো হয়েছে তার পরিসংখ্যান এখনও বোর্ড বের করতে পারেনি। এক্ষেত্রে বইয়ের অপ্রয়োজনীয় অধ্যায় বাদ দেওয়া হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই অপ্রয়োজনীয় অধ্যায় পূর্বে কীভাবে সংযোজিত হয়েছিলো আর এখন বাদ দেওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়া হয়েছে কিনা তা বোর্ড এখনও সেভাবে প্রকাশ করেনি।

    নিষেধাজ্ঞা, রাজনীতি ও বিশ্ববিদ্যালয়

    পার্থ প্রতীম দাস লিখেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি ও নিষেধাজ্ঞা নিয়ে রাজনীতি...

    প্রাসঙ্গিক নিবন্ধসমূহ

    নতুন লেখার খবর পান ইমেইলে
    বাংলাদেশের শিক্ষা প্রসঙ্গে নতুন লেখা প্রকাশিত হলে সেই খবর পৌঁছে যাবে আপনার ইমেইলে।