আগামী বছরের প্রাথমিকের বই থেকে কমানো হয়েছে ৫৮০ পৃষ্ঠা। তবে দুই স্তরে কতো পৃষ্ঠা কমানো হয়েছে তার পরিসংখ্যান এখনও বোর্ড বের করতে পারেনি। এক্ষেত্রে বইয়ের অপ্রয়োজনীয় অধ্যায় বাদ দেওয়া হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই অপ্রয়োজনীয় অধ্যায় পূর্বে কীভাবে সংযোজিত হয়েছিলো আর এখন বাদ দেওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়া হয়েছে কিনা তা বোর্ড এখনও সেভাবে প্রকাশ করেনি।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড বা এনসিটিবি শিক্ষাক্ষেত্রে জাতির জন্য এক গুরুদায়িত্ব পালন করছে। বর্তমান সরকারের বিনামূল্যে বই বিতরণ কর্মসূচি শুরুর পর তাদের দায়িত্ব বেড়ে গেছে বহুগুণ। শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক তৈরি, ছাপানো ও বিতরণসহ অনেক কর্মকাণ্ড পারিচালনা করতে হয় বোর্ডকে। এই বিশাল কর্মযজ্ঞ পালন করা একটি দুরূহ কাজ। তারপরেও সামান্য ত্রুটিসহ প্রতিবছরই শিক্ষার্থীদের হাতে মোটামুটি সঠিক সময়ে বই পৌঁছে যাচ্ছে। এজন্য জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। আগামী শিক্ষাবর্ষের জন্য ২৭ কোটি নতুন বই ছাপানো হচ্ছে। বোর্ড চেয়ারম্যান জনাব মোস্তফা কামাল উদ্দিন  বলেন, ”সব বাধা অতিক্রম করে শিক্ষার্থীদের হাতে নির্ধারিত সময়ে বই পৌঁছে দিতে আমরা বদ্ধপরিকর।” বোর্ড কর্মকর্তা কর্মচারীদের ব্যস্ততা এবং কর্মতৎপরতা বলে দিচ্ছে যে, বোর্ড এই দুরূহ কাজটি এবারও সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে পারবে।

শিক্ষার সাথে সরাসরি জড়িত বলে দু-একটি পর্যবেক্ষণ এখানে উল্লেখ করবো। পৃথিবীতে সহজতম কাজগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে কোনো ব্যাক্তি বা বিষয়ের সমালোচনা করা। আর কঠিনতম বিষয়ের মধ্যে একটি হচ্ছে নতুন কিছু তৈরি করা। তবে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় গঠনমূলক সমালোচনা সামনে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এবং গুণগত উপকরণ তৈরির ক্ষেত্রে অবদান রাখে। এই বিষয়টির দিকে লক্ষ্য রেখে  দু-একটি বিষয় এখানে তুলে ধরছি।

বিভিন্ন সংবাদপত্র প্রচার করছে যে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের বইয়ের বোঝা কমিয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড। এসব স্তরের বিভিন্ন শ্রেণীর পাঠ্যবইয়ের অপ্রয়োজনীয় অধ্যায় বাদ দিয়ে পৃষ্ঠাসংখ্যা কমানো হয়েছে। আগামী বছরের জানুয়ারী মাসেই এসব পাঠ্যবই পড়ানো শুরু হবে। বোর্ড কর্মকর্তারা জানান, আগামী বছরের প্রাথমিকের বই থেকে কমানো হয়েছে ৫৮০ পৃষ্ঠা। তবে দুই স্তরে কতো পৃষ্ঠা কমানো হয়েছে তার পরিসংখ্যান এখনও বোর্ড বের করতে পারেনি। এক্ষেত্রে  বইয়ের অপ্রয়োজনীয় অধ্যায় বাদ দেওয়া হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই অপ্রয়োজনীয় অধ্যায় পূর্বে কীভাবে সংযোজিত হয়েছিলো আর এখন বাদ দেওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়া হয়েছে কিনা তা বোর্ড এখনও সেভাবে প্রকাশ করেনি। বোর্ডের প্রধান সম্পাদক ড. সরকার আবদুল মান্নান এ ব্যাপারে  বলেন, ”বইয়ের পৃষ্ঠা আরও কমানোর পক্ষে আমরা। বইয়ের বোঝা কমাতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা  আমাদের মাথায় ছিল। সে হিসেব মাথায় রেখেই আগামী বছরের বই তৈরি করা হয়েছে।” এখন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা তাই বইয়ের পৃষ্ঠা কমানো হয়েছে- বিষয়টি একটু কেমন যেন মনে হয়।এখানে শিক্ষা বিশেষজ্ঞ, শিক্ষা গবেষক, শিক্ষক, সচেতন অভিভাবক এবং শিক্ষার্থী সবার মতামত এবং ফিডব্যাক নিয়ে বইয়ের বোঝা কমানো বা বাড়ানো দরকার।

দীর্ঘ ১৭ বছর পর নতুন পাঠ্যসূচি অনুযায়ী আগামী বছরের বই ছাপানো হয়েছে। এই সতেরো বছরে বিশ্বের অনেককিছুই পরিবর্তিত হয়েছে। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে আমাদের শিক্ষার্থীদের পরিচিতি দরকার। সেক্ষেত্রে বোর্ড একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পাশাপাশি সমসাময়িক ঘটনার ওপর ৩০টি নতুন বিষয় বিভিন্ন শ্রেণীর পাঠ্যবইয়ে স্থান পেয়েছে। এটিও একটি চমৎকার উদ্যোগ। নিম্ন-মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক স্তরে যেসব বিষয় নতুনভাবে সংযোজন করা হয়েছে সেগুলো হচ্ছে- সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, সড়ক নিরাপত্তা ও ট্রাফিক আইনবিধি, মুক্তিযুদ্ধ, ঐতিহাসিক আগরতলা মামলা, এইচআইভি ভাইরাস, প্রতিবন্ধি শিশু, জেন্ডার সমতা, নারীর প্রতি সহিংসতা, নারী উন্নয়ন, নারী অধিকার, নারী নির্যাতন, যৌতুক, নারী উন্নয়ন নীতি ও আইন বিধি, মানবাধিকার, শিশু অধিকার, শিশু অধিকার আইন, শিশুশ্রম, শিশু আইন, আইন শৃঙ্খলা, নারী ও শিশু অধিকার, নারী ও শিশু পাচার, বয়ঃসন্ধিক্ষণ ও কৈশোর, প্রজনন স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন, দুর্যোগ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনী, ধুমপান, মাদকাসক্তি, আর্সেনিক দূষণ, খাদ্যে ভেজাল, খাদ্য পুষ্টি, ইনফ্যান্ট নিউট্রিশন, মানসিক স্বাস্থ্যে, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির ভাষা সংস্কৃতি, দুর্নীতি, মাশরুম চাষ, চিংড়ি চাষ, জ্বালানী সংরক্ষণ ও বিদ্যুৎ সাশ্রয়, জীবন দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা, যৌন হয়রানি, জনগণের  তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার, ব্রতচারী, গার্ল গাইড, বয় স্কাউটস, ভুমি ব্যবস্থাপনা ও জরিপ। এ বিষয়গুলো অত্যন্ত জরুরি এবং আধুনিক। আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম এ বিষয়গুলো সম্পর্কে যাতে সঠিকভাবে জ্ঞানলাভ করতে পারে সেজন্য বোর্ড এই বিষয়গুলো সংযোজন করেছে । আমরা তাই বোর্ডকে স্বাগত জানাই।

পুরো ব্যবস্থাপনাকে সচল ও কার্যকর রাখার নিমিত্তে বোর্ড কর্তৃপক্ষ বেশ কিছু প্রশংসনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বই সরবরাহ বিষয় তদারকি করার জন্য ৫ সদস্যের কেন্দ্রীয় মনিটরিং কমিটি গঠন করা হয়েছে । প্রেসগুলো ঠিকমত কাজ করছে কিনা সেজন্য ২২ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে।  বই পাঠানো, গ্রহণ, সংরক্ষণ সংক্রান্ত একটি নীতিমালা জারি করা হয়েছে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও মাদ্রাসার আগামী শিক্ষাবর্ষ শুরু হতে আর মাত্র এক  মাস বাকি। এরই মধ্যে  উপজেলা পর্যায়ে পাঠ্যপুস্তক পাঠানো শুরু হয়েছে। চট্টগ্রাম, রংপুর ও সিলেট বিভাগের বিভিন্ন উপজেলায় প্রায় ৭০ শতাংশ প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও মাদ্রাসার ৪০ শতাংশ বই পৌছেছে। ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে সব বই পাঠিয়ে দেওয়া হবে। ২০১৩ সালের প্রথম দিন শিক্ষার্থীর হাতে তুলে দেওয়া হবে। ঐদিন বই উৎসব পালিত হবে দেশে। মাধ্যমিক স্তরে (বাংলা ও ইংরেজি) ভার্সন ১১ কোটি ৬৫ লাখ ১২ হাজার ১৮০, ইবতেদায়ী ও দাখিল স্তরে ৩ কোটি ৭৭ লাখ ৯৬ হাজার ৫৮০ এবং প্রাথমিক ১০ কোটি ৭১ লাখ ৬৮২ হাজার ২৬৭ বই ছাপানো হচ্ছে।

আরেকটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই সেটি হচ্ছে বোর্ডের এই বিশাল কর্মযজ্ঞ পরিচালনার জন্য আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার অত্যন্ত জরুরি। আমার এই বিষয়টি কিছুটা অবাক করার মতো মনে হয়েছে যে, বোর্ড কর্মকর্তাদের তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার নেই। তাদের কম্পিউটার বা ইন্টারনেটের ব্যবহার নেই বললেই চলে। কিছু কিছু কর্মকর্তা নিজেদের ইচ্ছায় হয়তো নিজেদের ল্যাপটপে ব্যবহার করছেন, অফিসিয়ালি করছেন না। হার্ডকপি নিয়ে কাজ করছেন। কোনো লেখক কিছু জমা দিতে হলে মেইলে দিতে পারছেন না, তিন-চার ঘণ্টা সময় নষ্ট করে এবং ভয়াবহ ট্রাফিক জ্যাম পেরিয়ে বোর্ডে গিয়ে কোনো কাগজপত্র বা উপকরণ জমা দিতে হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করলে বলছেন তার ইমেইল ঠিকানা নেই। ই-লার্নিং-এর যুগে সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় অথচ এনসিটিবির মত অত্যন্ত দায়িত্বশীল একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাগণ তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করছেন না- এটি অনেক প্রশ্নের উদ্রেক করে।  একদিকে যেমন এতে প্রচুর সময় নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে তারা শিক্ষার অভিভাবক হয়ে কীভাবে শিক্ষাঙ্গনে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার শেখাবেন সেটি একটি বড় প্রশ্ন।

ইংরেজি ভার্সনের বই বাংলা থেকে হুবহু অনুবাদ করা হয়। কিছু কিছু বাংলা বই বিষয়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বা গুণগত মানসম্পন্ন নয়। সেই বই থেকে যখন হুবহু ইংরেজি অনুবাদ করা হয়, তাতে বিষয়টি ভালোভাবে ফুটে উঠে না। এখানে যেটি করতে হবে তা হচ্ছে প্রয়োজনীয় এবং সম্পর্কিত অধ্যায়গুলো ইংরেজি মিডিয়ামের বই থেকে নিয়ে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকদের দ্বারা পরীক্ষা করাতে হবে। ভাষা দেখানোর জন্য হয়ত ইংরেজির অভিজ্ঞদের দেখাতে হবে। এখন যেটি করা হয়েছে তা হচ্ছে নিম্নমানের বাংলা থেকে তাড়াহুড়ো করে ইংরেজি করিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা। এটি ইংরেজি ভার্সনের শিক্ষার্থীদের খুব একটি উপকারে আসবে না। সময়ের স্বল্পতা ও বিশাল বইয়ের সমাহারের কারণে বোর্ড বিষয়টিকে হয়তো সেভাবে নজর দিতে পারেনি, তবে ভবিষ্যতে বিষয়টি বোর্ড খেয়াল রাখবে বলে আশা রাখি। বোর্ড কর্তৃপক্ষ তথা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এই বিশাল কর্মযজ্ঞ এবং মহতী উদ্যোগের সাফল্য কামনা করি।

Sending
User Review
0 (0 votes)

লেখক সম্পর্কে

মাছুম বিল্লাহ

মাছুম বিল্লাহ

মাছুম বিল্লাহ ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত রয়েছেন। তিনি সাবেক ক্যাডেট কলেজ, রাজউক কলেজ ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। বর্তমানে তিনি ইংলিশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইট্যাব)-এর প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

মন্তব্য লিখুন

একটি মন্তব্য

  • আমাদের লক্ষীপুর স্কুলে কিছু সরকারী বই এখনো ছাত্র/ছাত্রীদের হাতে পৌছে নি। আর আমি একটা কথা জানতে চাই সরকারী যে বই ছাত্র/ছাত্রীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়, তা কি পুনরায় স্কুলে জমা দিয়ে নতুন বই নিতে হয়?
    আর যে বই গুলো বিনা মূল্যে বিতরেণর জন্য দেওয়া হয় তা কেন ফেরত দিতে হয়।

    আমাদের স্কুলের নাম লক্ষীপুর উচ্চ বিদ্যালয় বেলাব-নরসিংদীতে অবস্থিত।