রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যবাহী আইন বিভাগ

মোঃ শাহ আলম লিখেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ নিয়ে

বাংলাদেশে আইন বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের বেশকিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। চাহিদার কারণে আইন শিক্ষার বিস্তার ঘটছে ক্রমাগতভাবে। তবে বর্তমানে সাতটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হলো: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় (সম্প্রতি বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিভাগটির যাত্রা শুরু হয়েছে)।

আইন বিষয়ে শিক্ষার প্রসারে বর্তমানে এসব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে নিঃসন্দেহে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন  বিভাগ অগ্রগণ্য এবং অন্যতম ঐতিহ্যবাহী। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ চালু হয় ১৯৫৩ সালে। ১৯৫৪ সালে এখানে আইন বিষয়ে দুই বছরের পাসকোর্স চালু হয়। ১৯৭০ সালে স্নাতক  ও ১৯৭৩ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি দেওয়া শুরু হয়। ১৯৭৩ সালে বিভাগটির নামকরণ হয় ‘জুরিসপ্রোডেন্স’। পরবর্তী সময়ে কোর্স দুটিকে এলএলবি (সম্মান) ও এলএলএম (মাস্টার্স) নামকরণ করা হয়। বর্তমানে এখানে এ দুটি কোর্সের পাশাপাশি এমফিল ও পিএইচডি কোর্সও চালু রয়েছে। রয়েছে সান্ধ্যকালীন দুই বছর মেয়াদি এলএলএম কোর্সও। এর এলএলবি (সম্মান) কোর্সটি অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোই চার বছর মেয়াদি আর এলএলএম (মাস্টার্স) কোর্সটি এক বছর মেয়াদি।

বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এই আইন বিভাগ ও অনুষদে ডীন হিসেবে নিয়োজিত আছেন বিশ্বজিত্‍ চন্দ এবং চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োজিত আছেন অধ্যাপক ড. আহসান কবির। এছাড়াও এখানে রয়েছেন সুদক্ষ ২৮ জন পূর্ণকালীন শিক্ষক। সর্বমোট প্রায় ৬০০ জন ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে এই বিভা

গটি তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। প্রতি বছর এখানে এলএলবি (সম্মান) কোর্সটিতে ভর্তির জন্য আসন সংখ্যা থাকে ১০০টি। মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে ছাত্র-ছাত্রীরা এখানে পড়ালেখা করার সুযোগ পায়।

এখানে  শুধু পুঁথিগত শিক্ষায় পাঠদান সীমাবদ্ধ থাকে না। নিয়মিত এখানে শিশু অধিকার, নারী অধিকার, উত্তরাধিকার, জুডিশিয়াল রিভিউ, সিভিল জাস্টিস সিস্টেম ইত্যাদি বিষয়ে বিভিন্ন সেমিনার ও ওয়ার্কশপের আয়োজন করা হয়ে থাকে। সম্প্রতি ইউএস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ইউএসএআইডি)-এর জাস্টিস ফর অল প্রোগ্রাম (জেএফএ)-এর উদ্দ্যোগে বিচার ব্যবস্থায় নারীর অংশগ্রহণ বিষয়ক সেমিনার অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়। এসব সেমিনার ও ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা আইনের বিভিন্ন তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক দিক সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জন করতে পারে। এছাড়াও ভবিষ্যতের একজন সফল আইনজীবি হিসেবে ছাত্র-ছাত্রীরা যাতে আইনের যেকোনো ঝুঁকি মোকাবেলা করতে পারে, সে জন্য এখানে মুট কোর্ট (Moot Court) নামে একটি কোর্স রয়েছে। এ কোর্সটিতে শিক্ষার্থীদের আদালতের কার্যধারা, বিভিন্ন ধরনের ড্রাফটিং, এ্যাডভোকেসী ইত্যাদি বিষয়ে হাতে কলমে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। সম্প্রতি এ কোর্সটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ফলে গ্রাজুয়েট যখন এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে ডিগ্রি গ্রহণ করে, তখন পুঁথিগত জ্ঞানের পাশাপাশি আদালতে প্র্যাকটিশনার আইনজীবি হিসেবে কাজ শুরু করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।

এছাড়াও আইন বিষয়ের অনেক মূল্যবান গ্রন্থ ও রেফারেন্স বই আইন বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক লাইব্রেরিতে রয়েছে। এসব লাইব্রেরিতে ডিএলআর, বিএলবি, বিএলসি, এমএলআর, বিএলটি, এডিসি ইত্যাদিসহ বাংলাদেশের সকল ল’ জার্নালের আপ-টু-ডেট কপি রয়েছে। লাইব্রেরি কার্ডের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা প্রয়োজনে বই বাসায় নিয়ে যেতে পারে।

যুগ যুগ ধরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীরা ‘বার কাউন্সিল’ ও ‘জেএসসি (জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশন)’ পরীক্ষায় প্রায় শতভাগ পাশ করে আসছে। এখান থেকে পাসকৃত প্রায় সহস্রাধিক ছাত্র-ছাত্রী দেশের বিভিন্ন আদালতে আইনজীবি হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। বিচার বিভাগে বিচারপতি, বিচারক ও ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে উল্লেখযোগ্য  সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী নিযুক্ত রয়েছেন। এছাড়াও প্রায় সহস্রাধিক আইন গ্রাজুয়েট দেশের ও বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন। এর পাশাপাশি প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়েও এই আইন বিভাগের অসংখ্য শিক্ষার্থী কর্মরত রয়েছেন।

এক কথায় বলতে গেলে, আইন শিক্ষাকে পুঁথিগত বিদ্যায় সীমিত না রেখে বাস্তবভিত্তিক ও পেশাভিত্তিক শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় একটি নতুন দিকমাত্রা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। দেশে আইন শিক্ষার বিস্তারে এবং বিচার বিভাগের পৃথকীকরণের ফলে যে বিপুল সংখ্যক মানসম্পন্ন আইনজীবির প্রয়োজন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ তা পূরণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার মাধ্যমে তার ঐতিহ্যকে সমুন্নত রাখতে সক্ষম হচ্ছে।

মোঃ শাহ্ আলম: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

জনপ্রিয় নিবন্ধ

প্রাথমিক স্তরে ভাষা শেখা : বিষয় – বাংলা

ভাষার দক্ষতা চারটি— শোনা, বলা, পড়া, লেখা। আর ভাষা...

আগে ইংরেজি গ্রামার শিখবো, নাকি ভাষা শিখবো?

কোন ভাষার গ্রামার হলো ঐ ভাষার গঠন প্রকৃতি যার...

শিক্ষাব্যবস্থার হালচাল

অর্থনীতিবিদদের মতে, শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ সবচেয়ে লাভজনক এবং নিরাপদ রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ। অর্থনীতিবিদ এডাম স্মিথ, ডেভিড রিকার্ডো এবং মার্শালের মতে, শিক্ষা এমন একটি খাত যার কাজ হলো দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলে পুঁজির সঞ্চালন ঘটানো। শিক্ষার অর্থনীতি নিয়ে মৌলিক গবেষণায় অর্থনীতিবদ আর্থার শুল্জ ও রবার্ট সলো দেখিয়েছেন যে, প্রাথমিক শিক্ষায় বিনিয়োগ করলে সম্পদের সুফল ফেরত আসে ৩৫ শতাংশ, মাধ্যমিক শিক্ষায় ২০ শতাংশ, এবং উচ্চ শিক্ষায় ১১ শতাংশ।

আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা : পিএইচডির পর কী?

আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়, আমি নিজেও এ-নিয়ে...

ক্যাডেট কলেজে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে কিছু কথা

ক্যাডেটসমূহ বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।...

আরও কিছু লেখা

অধিক

    বিদ্যালয়ে ভর্তির কোটা: অপ্রয়োজনীয় ভাবনার প্রতিক্রিয়া

    সংসদ সদস্যদের জন্য কোটা রাখার ব্যবস্থাটি গ্রহণযোগ্য ও বাস্তবসম্মত কিনা, সেটা বুঝার জন্য খুব বেশি চিন্তার প্রয়োজন পড়ে না; কিন্তু তিনি কী কারণে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য পর্যন্ত মন্ত্রণালয়ের অপেক্ষা করতে হলো তা বুঝা গেল না। গ্রহণযোগ্য ও বাস্তবসম্মত হওয়ার বিষয়টি কি তাহলে শুধু প্রধানমন্ত্রীর উপরই নির্ভর করছে? একটি দেশের প্রধানমন্ত্রীকে বড় বড় অনেক কাজ করতে হয়, অনেক সিদ্ধান্ত নিতে হয়, নানা কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। এরকম একটি আপাত ছোট বিষয়কে 'গ্রহণযোগ্য ও বাস্তবসম্মত' করার জন্য প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত যেতে হলো কেন? দেশের তাবত সিদ্ধান্তের জন্য কি তাহলে প্রধানমন্ত্রীর মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে? অন্য মন্ত্রীরা তাহলে কী জন্য আছেন?

    ফ্রান্সিসকো গার্দিয়া ফেরার: আধুনিক বিদ্যালয়: ধারণা, চর্চা ও বিবর্তন – পর্ব ৩

    যৌথশিক্ষাকে ফ্রান্সিসকো গার্দিয়া ফেরার খুবই গুরুত্বপূর্ণ দর্শন হিসেবে মনে...

    বাংলা ভাষায় শিক্ষাবিষয়ক বই

    বাংলা ভাষায় শিক্ষাবিষয়ক বই নিয়ে একটি তালিকা তৈরির প্রয়াস...

    ইংরেজি মাধ্যম এবং আন্তর্জাতিক ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের লেখাপড়া

    ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্রছাত্রীরা জাস্টিন বুইবেন বা অ্যাকর্ন-এর গান শোনে, তারা রুনালায়লা, সাবিনা ইয়াসমিন এবং লালনগীতি জানে না, জানে না মমতাজ কে। ইংরেজি মাধ্যমের একটি ছেলে বা মেয়েকে শুধুমাত্র ইংরেজি বলতে পারা এবং উপস্থাপন দক্ষতা ছাড়া প্রশংসা করার মতো তেমন আর কিছু নেই। তারপরও তারা যে শুদ্ধ ইংরেজি বলছে তা কিন্তু নয়। তারা আমাদের নিজস্ব কালচার সম্পর্কে অজ্ঞ, আমাদের সংস্কৃতিতে বিশ্বাস করে না বা শ্রদ্ধা দেখায় না। শিক্ষার যে মূল উদ্দেশ্য তা কিন্ত এখানে হচ্ছে না।

    শিক্ষকস্বল্পতা : ইউনেস্কো-টিচার টাস্কফোর্সের প্রতিবেদন রীতিমতো আঁতকে উঠার মতো

    শিক্ষকস্বল্পতা নিয়ে সম্প্রতি ইউনেস্কো একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। আমরা...

    বিশ্ব বিশ্ববিদ্যালয় সূচক ও বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা

    আবু সিদ লিখেছেন বিশ্ববিদ্যালয় সূচক নিয়ে সেন্টার ফর ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি...

    উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল এবং আমাদের রাজনীতি

    অন্যান্য পদক্ষেপের মধ্যে বর্তমান শিক্ষামন্ত্রীর এটি আরেকটি প্রশংসনীয় পদক্ষেপ যে, সেরা প্রতিষ্ঠান নির্ধারণের ক্ষেত্রে মানদণ্ড নির্ধারণে কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়েছে। শুধু শিক্ষার্থীর সংখ্যা বা জিপিএ-৫ পাওয়াই সেরা প্রতিষ্ঠান হওয়ার শর্ত হতে পারে না।

    জাতীয়করণ হলো, এরপর কী?

    আগামী দিনগুলোতে যদি এটা প্রতিষ্ঠা করা যায় যে, বিদ্যালয় জাতীয়করণ করা হলে তা গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করতে সহায়ক হয়, তাহলে তা নিশ্চয়ই মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রেও অনুঘটক হিসেবে কাজ করবে। তখন হয়তো এমপিওভুক্তি বা জাতীয়করণ নিয়ে এখনকার মতো বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আন্দোলন করতে হবে না। সরকারও চাইলে শিক্ষাখাতে জাতীয় আয়ের অন্তত ছয় শতাংশ বরাদ্দ রেখে এসব সমস্যার সমাধান সহজেই করতে পারে।

    প্রাসঙ্গিক নিবন্ধসমূহ

    নতুন লেখার খবর পান ইমেইলে
    বাংলাদেশের শিক্ষা প্রসঙ্গে নতুন লেখা প্রকাশিত হলে সেই খবর পৌঁছে যাবে আপনার ইমেইলে।