নাসরীন সুলতানা মিতু লিখেছেন কুলীন শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে
ছোটবেলায় বড় বড় পরীক্ষায় ততোধিক বড় বড় রচনা লিখতে হতো আমাদের। বাংলা ও ইংরেজি দুটো সাব্জেক্টেই- এইম ইন লাইফ বা জীবনের লক্ষ্য। ভবিষ্যৎ ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারদেরদের ভিড়ে পরীক্ষার হল উপচে পড়ত। খাতার পর খাতা, পাতার পর পাতা। শিক্ষকরা নাকে চশমা এঁটে সেই বিশাল সাহিত্যে বানান ভুল খুঁজে বেড়াতেন, বাকি কিছু না দেখলেও চলে। একই বই বা গাইড থকে উগড়ে দেয়া কয়েকশ ছেলেমেয়ের জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের বিশেষ পার্থক্য থাকার কথা না! নিজের ছোটবেলার কথা বলছি যদিও; এখনকার ছেলেমেয়েরাও সেই ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার মরণপণ শপথ থেকে খুব একটা সরে এসেছে বলে মনে হয় না!
মুখস্থবিদ্যার খপ্পরে পড়ে ছোটবেলার সেই রচনা লিখতে গিয়ে আমাদের আসল ‘এইম’ উদ্ঘাটিত না হলেও আমাদের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় কিন্তু আমাদের খুব সুনির্দিষ্টভাবে জীবনের লক্ষ্য ঠিক করে দিয়েছে!
আমাদের জীবনের লক্ষ্য ‘শিক্ষিত’ হওয়া, লুঙ্গি বদলে প্যান্ট পড়া, স্যান্ডেল খুলে শু পড়া; বাইসাইকেল ফেলে নিদেনপক্ষে একটা ‘টয়োটা করলা’ কেনা, এবং এসবকিছুর জন্য প্রথমে একটা ‘ভালো’ চাকরিতে ঢোকা!
ভাবি, আপনার ছেলে বাসায় নেই? গেছে কই? অফিস ট্যুরে সিঙ্গাপুর? বাহ! বাহ! ও কোথায় আছে এখন? কোন টেলিকম? বেতন কত? ওরে ব্বাপস!! ও আসলে ছোটবেলা থেকেই অনেক ভালো ছাত্র ছিল তো! এসএসসি, এইচএসসিতে গোল্ডেন ফাইভ পাওয়া। আগেই জানতাম ও অনেক ভালো কিছু করবে!
আমাদের দেশের নব্বই ভাগ ‘ভালো’ শিক্ষার্থী এইটুকু পড়ে চোখ কচলে তাকাবে, আহা! এমন একটা চাকরি কি আছে তার কপালে? পরের সেমিস্টারে কোমরবেঁধে পড়াশোনা করতে হবে! হুঁ হুঁ বাবা, দ্যাখো কী রেজাল্ট করি এবার! আর ইদানিং চাকরির বাজারে ইংরেজির যা কদর! স্পোকেনের কোর্সটাও শুরু করতে হবে এবার! গ্রাম থেকে আসা ক্ষ্যাত ছেলেগুলার চেয়ে ইংরেজি ঢের ভালো তার এমনিতেই, একটু চর্চা করলে আর কেউ দাঁড়াতে পারবে না!
লেখাপড়া করে যে, গাড়িঘোড়া চড়ে যে- মধ্যযুগের শ্লোক। তার মানে মধ্যযুগেও লেখাপড়ার উদ্দেশ্য সেই গাড়িঘোড়াতেই ছিল। সময়ের তোড়ে ঘোড়ার জায়গায় মোটর জুড়েছে, কিন্তু লেখাপড়ার উদ্দেশ্য কি পাল্টেছে? আমরা কি আদৌ চাই পাল্টাতে? ঔপনিবেশিক শাসকের কেরানি হওয়ার জন্য প্রবর্তিত যেই শিক্ষাব্যবস্থা, সেখান থেকে এই স্বাধীন দেশের আমরা ঠিক কতটুকু সরে এসেছি? পার্থক্য এই যে ব্রিটিশরাজের বদলে হুকুমের প্রভু এখন কর্পোরেট কোম্পানিগুলো। ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগেও মানুষের যেই ইনকামের রেঞ্জ ছিল, রাতারাতি যেন তা বদলে গেল এই বাণিজ্যের দুনিয়ায়। নিম্ন-আয়ের চাকরিগুলোর বেতনের খুব হেরফের না হলেও উপরের দিকে গ্রাফ উঠেছে লাফিয়ে লাফিয়ে। এবং হঠাৎ করেই আমাদের প্রয়োজনের ধরনও গেছে বদলে। বাসায় বিশাল এলসিডি স্ক্রিনের টিভি আর হাতে আইফোন না থাকলে ঠিক যেন চলছে না! এক পড়তি স্টাইলের শাড়ি গিন্নি আর কতদিন পরবে? অফিস পার্টিতে কলিগদের কাছে ইজ্জত থাকে না যে! বান্ধবীর বাচ্চার জন্মদিনের অনুষ্ঠান হচ্ছে গুলশানের বিশাল কাঁচঘেরা বুফে রেস্তোরাঁয়, সেখানে ছোটখাটো গিফট নিলে মুখ থাকে? এতোসব ভুঁইফোড় সামাজিক চাহিদা বাদ দিলেও আরও নানা রঙের চাহিদার অপশন তৈরি করতে একপায়ে খাড়া ভারতীয় সমাজের রঙিন মুখোশস্বরূপ বলিউডি চ্যানেলগুলো কিংবা নানা পণ্যের বিজ্ঞাপনের কালার প্যালেট। সামাজিক এই সব খণ্ডচিত্রের দীর্ঘমেয়াদী ফলস্বরূপ সমাজে; বিশেষত শহুরে সমাজে একইসাথে জন্ম নেয় এক ধরনের উন্নাসিকতা এবং হীনমন্যতা; বিপদজনকভাবে যখন মানুষের স্ট্যাটাসের একমাত্র পরিমাপক হল অর্থনৈতিক মানদণ্ড।
এতটুকু পড়ে মনে হতে পারে ধান ভানতে শিবের গীত গাইছি কেন। কেউ কেউ এর মাঝে কমিউনিজমের গন্ধও পেতে পারেন! একটু খোলাসা করি।
একটি দেশের সার্বিক সমাজব্যবস্থায় অনেকগুলা সম্প্রদায় থাকে, অনেকগুলি ইউনিট থাকে; প্রত্যেকটা অংশের পারষ্পরিক মিথষ্ক্রিয়াতেই সমাজ এগিয়ে যায়। এখন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার দিকে একটু তাকাই। শিক্ষা মানুষের সামাজিকীকরণের একটি বড় মাধ্যম। মানুষকে সমাজের উপযুক্ত করে গড়ে তোলা শিক্ষার একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। শৈশব থেকে যদি শুরু করি, সমাজের একটি অংশ হিসেবে তাকে গড়ে তুলতে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কতটুকু কার্যকর? আমাদের দেশে একসময় স্কুলের স্বল্পতা থাকলেও এখন অন্তত শহরাঞ্চলে স্কুল আর দুষ্প্রাপ্য নয়। বরং ক্ষেত্রবিশেষে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি; মানের ব্যাপারে প্রশ্ন থাকলেও। এখন এমনকি আবাসিক এলাকাতেও বাচ্চাদের স্কুল দু-একটা থাকেই; তারপরেও কোনো এক রহস্যজনক কারণে আগের দিনের মতোই দুই-তিন ক্রোশ পথ পাড়ি দিয়ে পুরো শহরে যানযট বাঁধিয়ে বিশাল গন্ধমাদনের ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে স্কুলে যায় স্কুল্গামী শিশুরা। কারণ একটাই- ‘ভালো’ স্কুলে পড়া!
এখন প্রশ্ন হল- এই ভালো স্কুলের সংজ্ঞা কী?
ঢাকা শহরকে বিবেচনায় রাখলে এখানকার তথাকথিত ভালো স্কুলগুলোকে একটু লক্ষ্য করি। বাচ্চা ‘মানুষ’ করার ক্ষেত্রে কোনো এক অদ্ভুত কারণে জীবন-সমাজবিচ্ছিন্ন বিজাতীয় ভাষার বিজাতীয় কারিকুলামের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোর ওপর আমরা ভরসা করি বেশি! দীর্ঘদিন ইংরেজিভাষী গোত্রের দাসত্ব মস্তিষ্কে এখনও চেপে আছে আমাদের, কিন্তু এটাই কি একমাত্র কারণ?
ইংরেজি জানাটা আমাদের দেশে ‘এলিট’ হবার পূর্বশর্ত, সে বহুকাল আগে থেকেই। কিন্তু সমস্যা গুরুতর হওয়া শুরু করে যখন এই ব্রাহ্মণত্ব আরোপ করা শুরু হয় শৈশব থেকে। ঢাকা শহরের একাধিক স্বনামধন্য ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের কথা জানি, যেখানে বাচ্চা ভর্তি করতে হলে শুধু বিশাল মোটা অঙ্কের টাকাই যথেষ্ট নয়, বাবা-মাকে আলাদা ইন্টারভিউ দিতে হবে নিজেদের যথেষ্ট ‘যোগ্য’ পরিবার হিসেবে প্রমাণ করার জন্য। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে বাবা-মাকে তাদের উচ্চতর শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হয়, আক্ষরিক অর্থে সার্টিফিকেট দেখিয়ে! স্বাভাবিকভাবেই এই অসুস্থ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যে ‘সৌভাগ্যবান’ শিশুরা এই কুলীন স্কুলগুলোতে ভর্তি হয়, তাদের পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থান হয় খুবই সাদৃশ্যপূর্ণ। ফলে এই শিশুদের কখনোই জানার সুযোগ ঘটে না যে তাদের একটা ‘ক্লাস পার্টির’ যে বাজেট, এই দেশের অধিকাংশ পরিবারের কয়েক মাসের যাবতীয় খরচ তাতে অনায়াসে হয়ে যায়! একটি স্বাচ্ছন্দ্যের বুদবুদের মধ্যে অপুষ্ট শৈশব কেটে যায় এই ব্রয়লার শিশুদের, জীবন সম্পর্কে কোনো বাস্তব জ্ঞান ছাড়াই!
ইংরেজি মাধ্যম তো গেল, ঢাকা শহরের বেশিরভাগ নামিদামি বাংলা মাধ্যমের স্কুলগুলোর চিত্রও কিন্তু খুব আলাদা নয়। এখানেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা সামাজিকভাবে মোটামুটি ‘হোমোজেনাস’, ফলে সমাজের অন্য ‘স্ট্যাটাসের’ সমবয়সীদের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ তাদের কখনোই ঘটে না। নিজেদের ‘গোত্রের’ বাইরের কাউকে নিজের জায়গায় বসিয়ে চিন্তা করাটা তাই তাদের কাছে হয়ে দাঁড়ায় অসম্ভবের কাছাকাছি। বন্ধুর বাবাকে দেখলে সালাম দিয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়া ভদ্র ছেলেটিও তাই একই বয়সী রিকশাওয়ালাকে নির্দ্বিধায় হাঁক দিয়ে বলে, ‘এই খালি যাবি?’ আমাদের শিক্ষা ‘অপ্রেসড’দের জন্য নয়। আমাদের শিক্ষা অর্থনৈতিক মানদণ্ডে নিচের সারির মানুষদেরকে তাদের আত্মমর্যাদার জায়গাটা দেখিয়ে দিতে ব্যর্থ; তাই প্রতিনিয়ত অপমানিত দুর্বল রিকশাওয়ালা নতমুখে তাকে নিয়ে রওনা দেয় গন্তব্যে। যাত্রীর আসনে বসা কানে ইয়ারফোন গোঁজা ছেলেটির মাথায়ও আসে না যে চালক মানুষটির সন্তানও হয়তো তারই বয়সী, সামাজিকভাবে তার জন্য নির্দিষ্ট কোনো সস্তা স্কুল বা মাদ্রাসা তার এখনকার ঠিকানা। একটি মানুষকে বিচার করার অনেকগুলো মানদণ্ডের মধ্যে সবচেয়ে স্থুল যে অর্থনৈতিক মানদণ্ড; তাই দিয়েই নিয়ন্ত্রিত হয় এই ‘অসামাজিক প্রজন্মের’ যাবতীয় আচরণ ও বুদ্ধি বিবেচনা। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া খালি গায়ে লুঙ্গি পরিহিত প্রৌঢ় তাই তার ততোটা শ্রদ্ধা ও মনোযোগ কাড়তে পারেন না, যতটা পারেন পাজেরো-আরোহী স্যুটেড আঙ্কেল। এই উচ্চ-মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণীর ছেলেমেয়েদের একটি বিরাট অংশ সাধারণের নাগালের বাইরের দামি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হয়ে কুলীন সমাজে নিজেকে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত করে। একটি ক্ষুদ্র ভাগ্যবান অংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পায় ও জীবনে প্রথমবারের মত নিজের গণ্ডির বাইরের মানুষদের সংস্পর্শে এসে কিছুটা হলেও সামাজিকতার স্বাদ পায় (সম্ভবত বাংলাদেশে একমাত্র পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই সব সামাজিক শ্রেণীর সহাবস্থান ধরে রেখেছে এখন পর্যন্ত। আর এই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে ‘সুশীল সমাজ’ শ্রেণীটির উদ্ভব!)।
কিন্তু সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন এই এলিট গোত্র; অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যারা দেশের মূল অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক; দেশের আমজনতার সাথে তারা কীভাবে একাত্ম হবে যেখানে সাধারনের জীবনযাপন, মূল্যবোধ সম্পর্কে তাদের বিন্দুমাত্র ধারণা নেই?
এতক্ষন যেই গোত্রের কথা হলো তারা সমাজের মুষ্টিমেয় কুলীন সম্প্রদায়। এবার একটু অন্যদিকে তাকাই।
একটি স্বাধীন দেশের বিয়াল্লিশ বছর অতিক্রান্ত হবার পরেও আমরা এখন পর্যন্ত আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে পারিনি যাতে তা ‘চাকরির নিমিত্তে’ পড়ালেখা- এই ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে পারে। সমাজের তুলনামূলক কম স্বচ্ছল ও অস্বচ্ছল পরিবারের সন্তানদের তাই গোটা শিক্ষাজীবন চলে যায় একটি স্বচ্ছল ভবিষ্যতের আশায়। শিক্ষার একটি কাজ অবশ্যই মানুষের অবস্থার পরিবর্তন করতে সাহায্য করা, কিন্তু তার মানে অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতার জন্য তাকে হীনমন্যতার দিকে ঠেলে দেয়া নয়। চকচকে কর্পোরেটদের দিকে তাকিয়ে বড় বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলা তরুণদের আত্মবিশ্বাসী করতে পুরোপুরি ব্যর্থ আমাদের শিক্ষা। যার ফলে ক্রমান্বয়ে জন্ম নেয় হতাশা, হতাশা থেকে ক্রোধ।
এই ভারসাম্যহীনতার চূড়ান্ত প্রতিফলন আমরা দেখি মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্রে। কুলীন সমাজে এই দুই গ্রুপ পুরোপুরি অপাংক্তেয়। অথচ কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা একটি দেশের উন্নয়নে বিরাট অবদান রাখতে সক্ষম, সক্ষম দেশে কার্যকর মানবসম্পদ গড়ে তুলতে; বিশেষত আমাদের মতো জনবহুল দেশে। দুঃখের বিষয় হলেও সত্য, আমাদের শিক্ষিত সমাজেরও বেশির ভাগ মানুষের পরিষ্কার কোনো ধারণাই নেই শিক্ষার এই ধারা সম্পর্কে। মাদ্রাসা শিক্ষার ক্ষেত্রে এই চিত্র আরও ভয়াবহ। বাংলাদেশের নিম্নবিত্ত শ্রেণীর একটি বিশাল অংশের শিক্ষাদানের দায়িত্ব কাঁধে চাপিয়ে দেবার পরেও এই শিক্ষাব্যাবস্থার প্রতি আমাদের নীতিনির্ধাকদের যথাযথ মনোযোগ আকর্ষণ হয়নি কখনোই। বরং মধ্যযুগীয় কারিকুলামের কাঁধে ভর দিয়ে খুঁড়িয়ে চলা এই ব্যবস্থার প্রতি দেশের শিক্ষিত ‘এলিট’দের অবহেলা ও বিমাতাসুলভ সন্দেহপ্রবণ আচরণ তাদের ঠেলে দিয়েছে প্রতিদ্বন্দ্বীর ভুমিকায়। বড় বড় কথা বলা আমরা প্রগতিশীলরাও শিক্ষার এই ধারার প্রতি আন্তরিকতার প্রমাণ দিয়েছি এমন নজির বিরল। কুয়ার ব্যাং বলে প্রতিনিয়ত উপহাস করেছি কিন্তু কুয়া থেকে টেনে তোলার চেষ্টা করিনি কখনই। এতিমখানায় বড় হওয়া যে ছেলেটির জীবনে একবেলা ভালো খেতে পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার, তাকে আমরা বরাবর দেখে এসেছি সন্দেহের চোখে। ড্রইংরুমে এসির বাতাসে বসে দেয়া আমাদের সুশীল থিওরি তাই তাদের বিন্দুমাত্র স্পর্শ করে না। বর্তমানে দেশের রাজনীতির স্মরণকালের ভয়াবহতম টানাপোড়েনের সময় আমরা অভিযোগের তীর নির্দেশ করছি সেই জনগোষ্ঠীর প্রতি, যাদের আমরা নিয়ান্ডারথাল মানুষের থেকে বেশি সম্মান দিতে যাইনি কখনো। তাদের আজকের যেই ক্রোধ তা তো কোনো হঠাৎ ঘটনা নয়!
আজ বগুড়ার যেই সংস্কারাচ্ছন্ন মাদ্রাসার ছেলেটি মনের চোখে চাঁদের বুকে সাঈদীকে দেখে আবেগে চোখে পানি এনে ফেলছে, তার সাথে আমাদের ড্রইংরুমের শিক্ষিতদের পার্থক্য আসলে ঠিক কতটুকু? ব্লগ সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণাহীন যে ছেলেটি আজ ‘নাস্তিক ব্লগার’ জবাই করতে ঢাকায়, তার অজ্ঞানতার জন্য একমাত্র দায়ী আমাদের প্রকট বিভাজিত সমাজ। মানুষের জীবনে বেঁচে থাকতে হলে কিছু না কিছু আঁকড়ে বাঁচতে হয়। ‘শিক্ষিত’ হওয়ার অহঙ্কারে আমরা পায়ে ঠেলেছি এই বঞ্চিত হতাশাগ্রস্থ গোষ্ঠীকে; ‘প্রগতি’ শুধুই একটা শ্রেণীর জন্য- এই সত্য প্রতিষ্ঠা করেছি নির্দ্বিধায়; জীবনে অপশন বেছে নেওয়ার জন্য ধর্ম ছাড়া আর কিছুই তো আমরা রাখিনি তার জন্য। তাই আজ যেই ছেলেটা একজনের মুখের কথায় চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে ছুটে আসে মতিঝিলে, তাকে দুষবো সেই অধিকার আমাদের নেই। আমাদের যুক্তির চেয়ে মাদ্রাসার মাওলানার বয়ানের বিশ্বাসযোগ্যতা তার কাছে অনেক বেশি, এবং সেটি যতটা না সেই মৌলভীর যোগ্যতা, তার চেয়ে অনেক বেশি আমাদের ব্যর্থতা।
এই মুহূর্তে আমাদের দেশ যে সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তা যতটা না রাজনৈতিক তার চেয়ে বেশি সামাজিক। একটি অপুষ্ট ব্যর্থ শিক্ষাব্যবস্থার ফলাফল হিসেবে আমরা এই ছোট্ট দেশে জন্ম দিয়েছি একটি প্রচণ্ড ভারসাম্যহীন শ্রেণীব্যবস্থার, সহযোগিতার বদলে সম্পর্কগুলো হয়ে দাঁড়িয়েছে সন্দেহের, আতঙ্কের, প্রতিহিংসার। কৃষিভিত্তিক একটি সমাজে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভ করা মানুষ কৃষিকাজ করতে লজ্জ্বাবোধ করে। এই লজ্জ্বা আমরা কোথায় রাখি? ‘ক্ষ্যাত’ শব্দটা যে সমাজে গালি, সেখান থেকে কী আশা করব আসলে আমরা? নীতিবোধ শেখার বদলে ধর্ম ক্লাসে আমরা সারাজীবন যে যার ধর্ম তোতাপাখির মতো মুখস্থ করেছি, সত্যিকারের নৈতিকতা আমাদের কাছেও ঘেঁষেনি! সামষ্টিক চিন্তার বদলে আমরা খালি নিজেরা বড় হতে চেয়েছি, নিজের গণ্ডিতে বসে বাহবা কুড়াতে চেয়েছি; পিছিয়ে পড়া সতীর্থদের টেনে তোলার বদলে বিদ্রূপ করেছি তাদের নিয়ে; ভিন্নমতকে শ্রদ্ধা করার মত সহনশীলতা অর্জন করার বদলে ভিন্নমতের মানুষের সাথে গড়ে তুলেছি বিভেদের প্রাচীর। দেশকে আমার নিজের ভাবতে শিখেছি, ‘নিজেদের’ ভাবতে শিখিনি। নিজেরাই আমরা নিজেদের ঠেলে দিয়েছি অসুস্থতম সঙ্ঘাতের মাঝে।
আমাদের শেকড়হীন শিক্ষা আমাদের অক্ষরজ্ঞান দিয়েছে, অর্থ উপার্জনের উপায় বাতলে দিয়েছে, কিন্তু আমাদের মানুষ করতে পারেনি; নিজেকে, মানুষকে সম্মান করতে শেখায় নি। কাজের থেকে এই সমাজে কাজের পারিশ্রমিক বেশি সম্মানীয়, মনুষ্যত্বের থেকে ব্যাঙ্ক-ব্যালান্স! কোটি কোটি কর্মক্ষম যুবককে উদ্যোক্তা হবার স্বপ্ন দেখতে শেখায়নি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, শিখিয়েছে বহুজাতিক কোম্পানির দাসত্ব করার এটিকেট, টেনে নামিয়েছে অপ্রয়োজনীয় অসম সামাজিক লড়াইয়ে- যেই লড়াই আসলে দিন শেষে নিজের সঙ্গে নিজের।
যতদিন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এদেশের এক একটি ছেলেমেয়েকে এদেশের জল, হাওয়ার উপযোগী করে ‘আমাদের’ একজন হিসেবে গড়ে না তুলবে; সামাজিক শ্রেণীগুলোর মধ্যে কোনোরকম ভারসাম্য তৈরি করতে না পারবে- এই ধরনের পরিস্থিতি বার বার আসবে। আর সেজন্য দায়ী থাকব আমরাই!
নাসরীন সুলতানা মিতু: প্রভাষক, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
লেখক পরিচিতি
সম্পাদক বাংলাদেশের শিক্ষা
এই লেখাটি সম্পাদক কর্তৃক প্রকাশিত। মূল লেখার পরিচিত লেখার নিচে দেওয়া হয়েছে।