আমাদের জন্য এটি একটি আনন্দের সংবাদ যে, শত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ সরকার শিক্ষাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়ার পক্ষে। শিক্ষাক্ষেত্রে গৃহীত সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ যেমন বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ, উপবৃত্তি, বিভিন্ন শিক্ষা প্রকল্প যেমন সেকায়েপ, এসইএস ডিপি গ্রহণ তারই প্রমাণ। সারাদেশে গত ৯ মার্চ শুরু হয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহ। দুই বছর পর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবার এ সপ্তাহ পালন করছে। ঝড়ে পড়ার হার রোধ, শ্রেষ্ঠ শিক্ষকদের সম্মাননা দেওয়াসহ নানা কর্মসূচি পালন করা হয় এ সপ্তাহে। মন্ত্রণালয়ের ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের নিয়মিত অনুষ্ঠান হলেও এবারের শিক্ষা সপ্তাহ শিক্ষকদের জন্য অন্য ধরনের এক আনন্দ নিয়ে এসেছে। আর সেটি হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিকক্ষকদের বেতন স্কেল উন্নীতকরণ এবং তাদের পদমর্যাদা বৃদ্ধির ঘোষণা আসা। আর এ ঘোষণা এসেছে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে। এতে প্রাথমিক শিক্ষক সমাজের স্বভাবতই উৎফুল্ল হওয়ার কথা। পূর্বের ৩৭ হাজার ৬৭২ সরকারি বিদ্যালয়ের পাশাপাশি নতুন সরকারি হওয়া প্রায় ২৬ হাজার বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নতুন এ সুবিধা পাবেন।
আমরা সরকারের এ ঘোষণাকে স্বাগত জানাই। কারণ প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক এবং অবৈতনিক হওয়া সত্ত্বেও এই গুরুত্বপূর্ণ স্তরটির অবস্থা খুব একটা ভালো নেই বিভিন্ন কারণে। এর প্রধান একটি কারণ হচ্ছে গুণগত ও যুগোপযোগী শিক্ষা প্রদান করা হয় না সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে, কারণ মানসম্পন্ন শিক্ষক আমরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিয়োগ করতে পারি না এ স্তরে। প্রধান শিক্ষক ও শিক্ষকদের বেতন স্কেল উন্নীতকরণের ফলে আমরা আশা করি মেধাবীরা প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষকতা পেশা গ্রহণ করার জন্য উৎসাহী হবেন। আর মেধাবীরা যখন এ স্তরে শিক্ষাদান শুরু করবেন তখন আমরা নিশ্চিতভাবে গুণগত শিক্ষাদান নিশ্চিত করতে পারবো এ স্তরে। আমরা সরকারের কাছে আরও একটি আবেদন জানাতে চাই। সেটি হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষায় মেধাবী এবং উচ্চশিক্ষিত তরুণদের শুধু প্রাথমিক শিক্ষক বিবেচনায় বেতন কাঠামো ঠিক না করে তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী বেতন স্কেল নির্ধারণ করা এবং ভবিষ্যতে তাঁরা যাতে মাধ্যমিক এবং কলেজ পর্যায়ে শিক্ষকতা প্রদান করার সুযোগ পান। এ ধরনের প্রাকটিস অনেক দেশে আছে, আমরাও করতে পারি। এটি করা হলে নিশ্চিতভাবে মেধাবীরা এ পেশায় আকৃষ্ট হবেন।
সরকার প্রাথমিক শিক্ষাকে পঞ্চম শ্রেণিতে উন্নীত এবং অষ্টম শ্রেণি পর্যায়ে শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করার পরিকল্পনা করেছে। রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে প্রাথমিক সপ্তাহ-২০১৪-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন। এটি শিক্ষার জন্য আরেকটি প্রশসংনীয় উদ্যোগ। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সরকারের এ ঘোষণা বাস্তবায়ন করা উচিত বলে আমরা মনে করি। তিনি বলেন, তাঁর সরকার প্রাথমিক স্তরে কম্পিউটার শিক্ষা বাধ্যতামূলক ও নারী শিক্ষার অগ্রগতির জন্য উপবৃত্তি কার্যক্রম অব্যবহত রেখেছে। সরকার এখানে একটি ভালো নজির স্থাপন করেছে। আমাদের দেশে সাধারণত পূর্ববর্তী সরকারের নেওয়া যত ভালো পদক্ষেপই হোক না কেন, পরবর্তী সরকার তা বাতিল করে দেয়। এখানে তার ব্যত্যয় ঘটেছে। এটি প্রশংসার দাবিদার। তিনি বলেন, শতভাগ সাক্ষরতা অর্জনের লক্ষ্যে বয়স্কদের জন্য উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়নের অঙ্গীকার পূরণে ইতিমধ্যে সরকার একটি প্রকল্প অনুমোদন করেছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত এ অনূষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী সরকারি কর্মকর্তা, শিক্ষক, স্থানীয় নির্বাচিত প্রতিনিধি এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সম্মননা ও পদক প্রদান করা হয়। প্রধনামন্ত্রী সেই সঙ্গে জাতীয় পর্যায়ে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকারী ২৫০ জন শিক্ষার্থীর মাঝে মেডেল ও সনদ বিতরণ করেন। তিনি আরও বলেন, তার সরকার ইতোমধ্যে ৯৯ হাজার ১৮১ জন শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এক প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। তাতে বলা হয় যে, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকদের গ্রেড-১১ অনুযায়ী মূল স্কেলের বেতন হবে ছয় হাজার চারশত টাকা এবং প্রশিক্ষণবিহীন শিক্ষকদের গ্রেড-১২ তে মূল বেতন স্কেল হবে পাঁচ হাজার নয়শত টাকা। সহকারী শিক্ষকদের গ্রেড-১৪ অনুযায়ী মূল বেতন স্কেল হবে পাঁচ হাজার দুইশত টাকা এবং প্রশিক্ষণবিহীনদের গ্রেড-১৫তে চার হাজার নয়শত টাকা। প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে এটি একটি মাইলফলক। সরকারের এতো কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করার পরেও আমরা শতভাগ শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে নিয়ে আসতে পারিনি। সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, ২০১৩ সালে ২৬.২ ভাগ প্রাথমিক শিক্ষার্থী ঝড়ে পড়েছে মূলত দারিদ্রের কারণে। এ অবস্থা থেকে বের হওয়ার জন্য সবাইকে কার্যকরর পন্থা গ্রহণ করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে মাধ্যমিক শিক্ষার কথাও চলে আসে। ফ্রেব্রুয়ারি মাসের ৯ তারিখে ২০১৪ সালের এসএসসি পরীক্ষা শুরু হয়েছে। এবার অংশগ্রহণকারী পরীক্ষার্থীর সংখ্যা রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। ১৪ লাখ ৩২ হাজার ৭২৭ জন শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করছে এ পরীক্ষায়। তবে নবম শ্রেণিতে যারা নিবন্ধন করেছিলো তাদের মধ্যে এক লাখ ৬৬ হাজার ৮৪৭ জন শিক্ষার্থী এবারের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করছে না। আটটি সাধারণ শিক্ষাবোর্ড, মাদ্রাসা ও কারিগরি বোর্ডে নবম শ্রেণিতে ১৪ লাখ ৪২ হাজার ৬ জন শিক্ষার্থী নিবন্ধন করেছিল। তাদের মধ্যে থেকে নিয়মিত শিক্ষার্থী হিসেবে পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে ১২ লাখ ৭৫ হাজার ১৫৯ জন। অবশিষ্ট এক লাখ ৬৬ হাজার ৮৪৭ জন নিয়মিত শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে না। কেন নিচ্ছে না তার বিশ্লেষন একেক দল বিশ্লেষক একেকভাবে করছেন। আন্তঃবোর্ড সমন্বয় সাবকমিটির আহবায়ক ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপিকা তাসলিম বেগম বলেন, চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশ নেয়ার আগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থীদের টেস্ট পরীক্ষা নিয়ে থাকে। এ পরীক্ষায় যারা উত্তীর্ণ হতে পারে না তাদের এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হয় না। এ ছাড়াও শারীরিক অসুস্থতা, পরিবারের অসামর্থ্যতা, ব্যবসায় জড়িয়ে পড়া ইত্যাদি কারণেও অনেকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে না। আবার কোনো কোনো শিক্ষা বিশেষজ্ঞ বলছেন যে, সৃজনশীল পদ্ধতির ভীতির কারণে অনেক শিক্ষর্থী চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে না। গত বছরের রসায়নসহ বিজ্ঞানের বিষয়গুলোতে শিক্ষার্থী ফেল বা অকৃতকার্যের হার ছিল বেশি। যার প্রভাব পড়েছিল চূড়ান্ত ফলাফলে। এ ভীতি থেকে অনেকেই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেনি।
অভিভাবক ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু বলেন, এটি পুরোপুরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতা ছাড়া আর কিছু নয়। কারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সঠিকভাবে শিক্ষর্থীদের পাঠদান নিশ্চিত করে গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে। সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতিও এর অন্যতম কারণ। এ পদ্ধতি সম্পর্কে শিক্ষকরাই ভালো জানেন না। তারা এ পদ্ধতিতে পাঠদান করবেন কীভাবে? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এখন পাঠাদনের চেয়ে নানাভাবে কোচিং আর ফি আদায়ের দিকেই বেশি মনোযোগী।
এবার এসএসসিতে রেকর্ড সংখ্যক পরীক্ষার্থী অংশ নেয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে অনিয়মিত পরীক্ষার্থীর সংখ্যা এক লাখ ৫৫ হাজার ৯৩৬ জন। এদের মধ্যে এক বিষয়ে অকৃতকার্য পরীক্ষার্থীর সংখ্যা হচ্ছে ৮৭ হজার ৯০৭ জন, দুই বিষয়ে ১৫ হাজার ৮৪৪ জন, তিন বিষয়ে তিন হাজার ৫৮৭ জন এবং চার বিষয়ে ৮১৩ জন। সব বিষয়ে অকৃতকার্য পরীক্ষার্থী হচ্ছে ৪৭ হাজার ৭৮৫ জন। এ ছাড়া ইমপ্রুভমেন্ট বা ফলাফলের মান উন্নয়নের জন্য পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে ১৬৩২ জন শিক্ষার্থী। বিভিন্ন বিষয়ে ফেল করা শিক্ষার্থীদের মানের ব্যাপারে বিরাট প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। এসব বিষয়ে সরকারকে বিশেষভাবে মনোযোগী হতে হবে।
এমপিওভুক্ত হোক আর না হোক, কোনো স্কুল শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে উচ্চহারে ভর্তি ফি বিশেষ করে উন্নয়ন ফি যাতে না নেয় সে ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। বিধানটি আবার নতুন করে সম্প্রতি জারি করা হয়েছে। বলা হয়েছে, বাংলা মাধ্যমে শিক্ষার্থীপ্রতি উন্নয়ন ফি সর্বোচ্চ তিন হাজার টাকা ও ইংরেজি মাধ্যমে পাঁচ হাজার টাকাসহ ভর্তি ফি যথাক্রমে আট ও দশ হাজার টাকার বেশি নেওয়া যাবে না। কিন্তু কে মানছে এ নিয়ম আর কে মানছে না তা নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। আর সরকার উদ্যোগ নিতে যাওয়া মানে কিছু সরকারি কর্মকর্তার ঘুষ গ্রহণ করার পথ উন্মুক্ত করা আর ছাত্রনেতা বা স্থানীয় নেতাদের পকেট গরম হওয়া। এসব ব্যাপারে সরকারকে বাস্তবমুখী চিন্তা করতে হবে ও নির্দেশনা দিতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে যত কিছুই করা হোক না কেন, শিক্ষা এখনও বাণিজ্য, শিক্ষা এখনও পণ্য। শিক্ষাকে এখনও ‘অধিকার’ হিসেবে গণ্য করা হচেছ না। শিক্ষা নাগরিকদের অধিকার আর সরকারকেই নাগরিকদের এ অধিকার সঠিকভাবে নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক পরিচিতি
মাছুম বিল্লাহ বাংলাদেশে ইংলিশ টিচার্স অ্যাসেসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইট্যাব)-এর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি পূর্বে ক্যাডেট কলেজ ও রাজউক কলেজের শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন। কাজ করেছেন ব্র্যাকের শিক্ষা কর্মসূচিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে। তিনি ভাব বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসেবেও কর্মরত রয়েছেন। তিনি নিয়মিত শিক্ষাবিষয়ে নানা প্রবন্ধ লিখছেন।