নারী সাংবাদিকের ওপর সাংসদ কামাল আহমেদ মজুমদারের চড়াও হওয়ার ঘটনার পর থেকে বিদ্যালয়ে ডোনেশন প্রথার বিষয়টি বেশ আলোচনায় এসেছে। বিদ্যালয়ে ডোনেশন প্রথার মাধ্যমে ভর্তির বিষয়টি এখন লুকোছাপার বিষয় নয়, বরং ঢাকার বিদ্যালয়গুলো ঘোষণা দিয়েই অভিভাবকদের কাছ থেকে প্রতি বছর বড় অংকের টাকা ডোনেশন নিচ্ছে। সাধারণত ডোনেশনের দুটো পদ্ধতি দেখা যায়- এক, বড় অংকের টাকা ডোনেশন দিলে ছাত্র বা ছাত্রীকে বিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ দেয়া হয়; দুই, যারা এমনিতেই ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে তাদের কাছ থেকে বাধ্যতামূলকভাবে কিছু টাকা ডোনেশন হিসেবে নেয়া হচ্ছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম বা বড় শহরের বিদ্যালয়গুলোতে ডোনেশন মোটামুটি চালু এবং সবার জানা বিষয়। ফলে সরকার ঢাকার বিদ্যালয়গুলোর জন্য সর্বোচ্চ ফি পাঁচ হাজার টাকা এবং ঢাকার বাইরের বিদ্যালয়গুলো তিন হাজার টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছিল।
ঝামেলাটা বেঁধেছে এজন্য যে, বিদ্যালয়গুলো সরকার-নির্ধারিত পরিমাণের বাইরে অতিরিক্ত টাকা নিচ্ছে অভিভাবকদের কাছ থেকে এবং সেটা ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। কিছু কিছু বিদ্যালয় অতিরিক্ত টাকা নেয়ার বিষয়টি মন্ত্রণালয়কে জানিয়ে রেখেছে, তবে জানিয়ে রাখা আর অনুমতি নেয়া সমার্থক কিনা তা অবশ্য জানা যায় নি। কামাল আহমেদ মজুমদারের ঘটনাটি না ঘটলে বিষয়টি এতোটা হাইলাইটেডও হতো কিনা সন্দেহ! এ ঘটনার পর শিক্ষামন্ত্রী এবং শিক্ষাসচিব ঢাকার অনেকগুলো বিদ্যালয়ের সাথে বৈঠক করেছেন, তবে তাতে শেষ পর্যন্ত সুরাহা হবে কিনা সন্দেহ রয়েছে।
বিদ্যালয়গুলো কেন নির্ধারিত ভর্তি ফি-র বাইরে অতিরিক্ত টাকা বিদ্যালয় উন্নয়ন তহবিলের নামে ডোনেশন নেয়? সহজ উত্তর হচ্ছে, বিদ্যালয়ের উন্নয়নের জন্য। আমাদের দেশের অধিকাংশ বিদ্যালয় মূলত জনগণের টাকায় প্রতিষ্ঠিত এবং বিদ্যালয়ের নানা কাজের জনগণই প্রথম এগিয়ে আসে। সরকার বিদ্যালয়ের উন্নয়নের জন্য বাৎসরিক যে পরিমাণ টাকা দেয়, তা কোনোমতেই যথেষ্ট নয়। এমনকি বিদ্যালয়ে নামীদামী কেউ বেড়াতে বা পরিদর্শনে গেলে তার জন্য চা-নাস্তার ব্যবস্থাও অনেক সময় শিক্ষকদের পকেট থেকে করতে হয়। গ্রামাঞ্চলে কোনো বিদ্যালয় টাকার অভাবে প্রয়োজনীয় কিছু করতে না পারলে বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যরা জনগণের কাছ থেকেই টাকা সংগ্রহ করে বিদ্যালয়ের সমস্যা মেটায়। এটিও একপ্রকার ডোনেশন। অর্থাৎ ডোনেশন প্রথাটি নতুন কিছু নয়। কিন্তু ঢাকা শহরে যে ডোনেশনের কথা শোনা যাচ্ছে, তার সাথে গ্রামাঞ্চলের উল্লিখিত ডোনেশনের পার্থক্য রয়েছে। ঢাকার বিদ্যালয়গুলোতে ডোনেশন অর্থ হচ্ছে একজন অভিভাবককে বাধ্যতামূলকভাবে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিতেই হবে। এ অর্থ আদৌ বিদ্যালয় উন্নয়ন খাতে ব্যয় হবে, নাকি শিক্ষকরা ভাগাভাগি করে নিবে তা জানার উপায় সীমিত। তাছাড়া গ্রামাঞ্চলের বিদ্যালয়গুলোতে ডোনেশন নেয়া হয় নির্দিষ্ট কাজের চাহিদা অনুযায়ী। ঢাকার সিস্টেম সেরকম নয়। বিদ্যালয় উন্নয়নের নামে নেয়া ডোনেশন শেষ পর্যন্ত শিক্ষকের ব্যক্তিগত উন্নয়নের কাজেই ব্যয় হয়- এটা এখানে ধরে নেয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। তাছাড়া একটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তো বলেছেনই- এই টাকা থেকে শিক্ষকদের বেতন দেয়া হয়। ঢাকা শহরে শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক ভর্তি ফি ও মাসিক বেতন কম নয়। প্রশ্ন ওঠে, এ টাকা থেকে কি শিক্ষকদের বেতন সংকুলান হয় না? প্রতিটি বিদ্যালয় সরকার থেকে কিছু না কিছু অর্থ পায়। অনেক শিক্ষকই থাকেন এমপিওভুক্ত। তারপরও যদি শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক বেতনের বাইরে ডোনেশন নেওয়া হয়, তাহলে বিদ্যালয়ের খরচ আর ডোনেশন নেওয়া অর্থের মধ্যে সামঞ্জস্য আছে কিনা, সেটি একটু খতিয়ে দেখা উচিত সরকারের।
ডোনেশন প্রথাটা বিদ্যালয়ে এতোটাই জাঁকিয়ে বসেছে যে, শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষাসচিবের সাথে বৈঠককালে কোনো কোনো বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তাদের বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতনের সরকারি বরাদ্দ (এমপিও) প্রয়োজনে না নেয়ার কথা বলেছেন। তার মানে, এমপিওর চাইতেও ডোনেশন তাদের কাছে লোভনীয়! ডোনেশনের পরিমাণের কারণে শিক্ষকবৃন্দ সম্ভবত ভুলে গেছেন, সরকার চাইলে এমপিও বাতিলের সাথে সাথে বিদ্যালয়ের কার্যক্রমও বন্ধ করে দিতে পারে বা তাদেরকে শিক্ষাকার্যক্রম থেকে বিরত রাখতে পারে। তখন তারা কী করবেন? সারা দেশের শিক্ষকবৃন্দ যেখানে এমপিওভুক্তির আশায় দিনের পর দিন অপেক্ষা করে, নিয়মতান্ত্রিকভাবে এমপিওভুক্ত করতে গিয়ে শিক্ষামন্ত্রী নাজেহাল হন, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা নতুনভাবে এমপিওভুক্তির তালিকা করেন, সেখানে কিছু বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক যখন এমপিওভুক্তির সুবিধা বাতিল করতে চান, তখন স্বাভাবিকভাবেই তাদের বিদ্যালয়ে ডোনেশনের যে রমরমা বাণিজ্য চলছে- তা পরিষ্কার হয়ে যায়।
সুতরাং বিদ্যালয়গুলো কেন ভর্তি ফি-র বাইরে বিদ্যালয় উন্নয়ন তহবিলের জন্য অতিরিক্ত ডোনেশন নেয় সে প্রশ্নের উত্তর অন্যভাবে খুঁজতে হবে। ঢাকা কিংবা চট্টগ্রাম শহরে প্রয়োজনের তুলনায় কম নাকি বেশি বিদ্যালয় রয়েছে, সেরকম কোনো হিসাব পাওয়া যায় না। কিন্তু ভালো বিদ্যালয়ের সংখ্যা যে মাত্রাতিরিক্ত কম, সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। ডোনেশন প্রথার ক্ষেত্রে ঢাকায় এসব তথাকথিত ভালো বিদ্যালয়গুলোই দেখা যাচ্ছে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। অভিভাবকরা স্বাভাবিকভাবেই তাদের সন্তানকে ভর্তি করানোর জন্য ভালো বিদ্যালয়গুলোকে অগ্রাধিকার দেয়। অপরদিকে যেহেতু ভালো বিদ্যালয় কম সুতরাং সেখানে ভর্তির প্রতিযোগিতা বেশি। অনেক অভিভাবকের টাকাপয়সারও অভাব নেই। সুতরাং সন্তানের ভালো পড়ালেখার আশায় তারা বিদ্যালয়ে ডোনেশন দিয়ে হলেও সন্তানকে পড়ানোর সুযোগটি গ্রহণ করতে বাধ্য হবে। অভিভাবকদের এই চাহিদাটিকে পুঁজি করে বিদ্যালয়গুলো ডোনেশনের ব্যবসায় নেমেছে। ঢাকা শহরের অলিগলিতে এখন প্রতি বছর কিন্ডারগার্টেন থেকে শুরু করে কলেজ পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। একেবারে নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও ভর্তির টাকার পরিমাণ নেহায়েত কম নয়। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা একেবারেই কম, শিক্ষক স্বল্পতাও রয়েছে। পাঠাগার কিংবা সহপাঠক্রমিক শিক্ষা কার্যক্রমও এগুলোতে হয় অত্যন্ত সীমিত পর্যায়ে। ঢাকার প্রতুল জনসংখ্যার কারণে যেহেতু বিদ্যালয় চালু করলেই প্রচুর শিক্ষার্থী পাওয়া যাচ্ছে, সুতরাং বিদ্যালয় স্থাপন এখন আসলে আর দশটি ব্যবসার মতোই হয়ে যাচ্ছে। আর এসব কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিভিন্ন নামীদামী বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক বা শিক্ষকবৃন্দ। এসব বিদ্যালয়ে সরকারি নিয়মকানুন কতোটা মানা হচ্ছে, তাও প্রশ্নসাপেক্ষ। সব মিলিয়ে বলা যায়, সন্তানের ভালো শিক্ষার জন্য অভিভাবকদের বিপুল চাহিদাকে পুঁজি করে বিদ্যালয়গুলো আসলে শিক্ষার ব্যবসায় নেমেছে।
এ প্রসঙ্গে এটিও উল্লেখ করা দরকার, বাংলাদেশে প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষা অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক। রাষ্ট্র ছয় থেকে এগার বছর বয়সী সব শিশুর পড়ালেখার দায়িত্ব নিয়েছে। সেই হিসেবে এই বয়সী কিংবা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিশুদের বিদ্যালয়ে পড়ালেখার জন্য তো একটি টাকাও খরচ হওয়ার কথা নয়! এই নিয়ম গরীব-ধনী সবার জন্যই প্রযোজ্য। একজন অভিভাবক যতো ধনীই হোন, রাষ্ট্র তার শিশুর জন্যও বিনামূল্যে শিক্ষার ব্যবস্থা করেছে। তাহলে বিদ্যালয়গুলো কোন হিসেবে প্রাথমিক পর্যায়ের শিশুদের ভর্তি বা অন্যান্য সময় বিদ্যালয় উন্নয়নের নামে ডোনেশন নিচ্ছে?
বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা সেক্টরটি এতোটাই বিশাল যে, এর সবকিছু সরকারকে একা সামাল দিতে গেলে হিমশিম খেতেই হবে। কোনো বিদ্যালয় সরকারকে না জানিয়ে ডোনেশন নেয়া বা এ ধরনের কার্যক্রম চালিয়ে গেলে সব সময় সরকারের সেটি নজরে না-ও আসতে পারে। এসব ক্ষেত্রে সাধারণত বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সদস্যরা সক্রিয় ভূমিকা পালন করে- অবশ্য তারাও যদি এ প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায় তাহলে ভিন্ন কথা। সেটি হলে অভিভাবকদের সচেতন হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। বিদ্যালয়ে সন্তানকে ভর্তির আগে অভিভাবকদের উচিত হবে এসব বিষয়ে খোঁজখবর নেয়া এবং প্রয়োজনে প্রতিবাদ করা। অবশ্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে অভিভাবকরাও নিরুপায় হয়ে যান, কারণ তাদের সন্তানকে ভর্তি করতেই হবে। তাছাড়া কার কাছে প্রতিবাদ করতে হবে সে সম্পর্কিত তথ্যও অনেকের জানা থাকে না। সুতরাং সব মিলিয়ে সরকারি মনিটরিং-এর বিকল্প যে নেই, তা পরিষ্কার। দেশের প্রতিটি উপজেলায় সরকারের পক্ষ থেকে উপজেলা শিক্ষা অফিসার বা সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসারবৃন্দ সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। কোনো বিদ্যালয় সরকারী সিদ্ধান্ত অমান্য করছে কিনা, সে ব্যাপারে তাদেরকেই মূলত অগ্রণী হয়ে খোঁজখবর নিয়ে প্রতিকারের ব্যবস্থা করতে হবে। দেশে যে যেভাবে পারছে জনগণকে জিম্মি করে নিজেরা লাভবান হচ্ছে। সরকারের শক্তিশালী মনিটরিং ব্যবস্থাই শুধু এক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে।
লেখক পরিচিতি
গৌতম রায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।