মূল লেখাটি লিখেছেন: আবদুল্লাহ আল নোমান; প্রকাশ করেছেন: সম্পাদক, বাংলাদেশের শিক্ষা
ব্যাকরণ ও বিবিধ বইয়ের লেখক মোরশেদ হাসানের লেখার সাথে আমার পরিচয় শুবাচ-সূত্রে। শুবাচ হলো ‘শুদ্ধ বানান চর্চা’ নামের একটি ফেসবুক-গ্রুপ। এই গ্রুপে লেখকের একটা লেখা পড়ে খুব ভালো লেগেছিল। লেখাটি ছিল বাংলা ব্যাকরণ নিয়ে। লেখাটিতে তিনি প্রথাগতভাবে ব্যাকরণ নিয়ে আলোচনা না করে গল্পে গল্পে অত্যন্ত সহজ করে ব্যাকরণ নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। লেখাটি পড়ে আমি লেখককে ফেসবুকে বন্ধুত্বের অনুরোধ পাঠাই। এরপর থেকে তাঁর লেখা আমি নিয়মিত পড়ি; এবং ভালো লাগে বলেই পড়ি।
এই ভালো লাগা থেকেই এবার অমর একুশে গ্রন্থমেলায় মোরশেদ হাসানের প্রকাশিত ব্যাকরণ ও বিবিধ বইটি কেনার সিদ্ধান্ত নিই এবং সরাসরি লেখকের কাছ থেকেই বিকাশে টাকা পাঠিয়ে বইটি সংগ্রহ করি। বইটি এখনও সম্পূর্ণ পড়া হয়নি; তবে লেখকের অনেক লেখাই ফেসবুকের কল্যাণে আগেই পড়া হয়েছে। সে অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি, পেশায় একজন ডাক্তার হয়েও লেখক বাংলা ব্যাকরণের বিভিন্ন বিষয় সহজ-সরল ভাষায় গল্পে গল্পে উদাহরণসহ উপস্থাপনে সফল হয়েছেন। ব্যাকরণ বিষয়ে তাঁর লেখা সুখপাঠ্য।
একটু উদাহরণ দেখা যাক; লেখক লিখেছেন,
‘জুলিয়া মনোযোগের সঙ্গে আমাদের কথা শুনছিল। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ওকে বললাম, বেশি আলাপচারিতার এই হল ফল। খাঁটি গোরুর দুধ বনে গেল গাভীর খাঁটি দুধে।
-কিন্তু খাঁটি গোরুর দুধ কি শুদ্ধ নয়?
-অবশ্যই শুদ্ধ। দ্যাখো কিছুদিন আগে আমারও ধারণা ছিল ‘খাঁটি গোরুরদুধ’ বা ‘খাঁটি গোরুর-দুধ’ লেখা ভালো। এরও আগে মনে হত ‘গোরুর খাঁটি দুধ’ লেখা হলে ভালো হয়।…’
এটুকু পড়ে নিশ্চয়ই বোঝা যাচ্ছে লেখক কীভাবে ব্যাকরণের মতো গুরুগম্ভীর এবং অনেকাংশেই অনেকের কাছে ভীতিসঞ্চারী বিষয়টিকে কত সহজভাবে গল্পের আসরের ভাষায় বর্ণনা করেছেন।
বইটির নাম ব্যাকরণ ও বিবিধ। প্রকৃতপক্ষে বইটিতে ব্যাকরণের আলোচনা কম এবং বিবিধ আলোচনাই বেশি। যেমন, লেখক বাংলা বানানের প্রচলিত ভুলগুলো শব্দ ধরে ধরে আলোচনা করেছেন। তবে এখানে লেখকের মুনশিয়ানা এখানেই যে, তিনি শব্দের বানান নিয়ে আলোচনা করতে করতে বানানের নেপথ্যের সূত্রটাকে ব্যাখ্যা করেছেন এবং সেই ব্যাখ্যার প্রয়োজনেই তিনি ব্যাকরণের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন বারবার।
বইটিতে আছে ভাষার উৎপত্তি বিষয়ে প্রচলিত বিভিন্ন তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা, আছে ভাষা-পরিবার এবং বাংলা ভাষার উদ্ভব নিয়ে আলোচনা, আছে বাংলা লিপি নিয়ে আলোচনা। মোবাইলে বাংলা লেখার জন্য নির্দেশনামূলক লেখাটি বইটিকে অন্য মাত্রা দান করেছে।
বইটি পড়ে পাঠক মেজবানি, সোপ অপেরা, লেডিকিনি মিষ্টি, চকমিলান, হাস্তা লা ভিস্তা প্রভৃতি এ ধরনের আরও অনেক শব্দের অর্থ এবং ব্যুৎপত্তি সম্পর্কে জানতে পারবেন। জানতে পারবেন ‘পার’ ও ‘পাড়’ শব্দদুটির মতো আরও কিছু এ ধরনের শব্দের ব্যবহার সম্পর্কে।
আসলে বইটিতে কী আছে সে বিষয়ে আলোচনা করতে গেলে আরেকটা বই লেখা সম্ভব। তার চেয়ে বরং বইটির একটু সমালোচনা করে শেষ করি।
বইটি নিয়ে সমালোচনা করার আসলে বেশি কিছু নেই। বইটিতে কিছু মুদ্রণপ্রমাদ আছে এবং থাকাটাই স্বাভাবিক। লেখক বইয়ের ভূমিকাংশে সে দায় স্বীকার করেও নিয়েছেন। আশা করি পরবর্তী সংস্করণে লেখক সেগুলো শুধরে দেবেন। আমি অল্প পড়াতেই যে ভুলগুলো চোখে পড়েছে সেগুলো উল্লেখ করছি।
• সূচিপত্রে হিন্দুয়ানী (সঠিক: হিন্দুয়ানি) এবং মুসলমানী (সঠিক: মুসলমানি) বানান ভুল চোখে লেগেছে। ভেতরে আলোচনা অংশে বানানদুটি ঠিক আছে।
• সূচিপত্রে ‘মোবাইল ফোনে বাংলা টাইপিংয়ের নিয়ম’ শিরোনাম থাকলেও আলোচনা অংশে সেটি নেই।
• কিছু ভুল বানান চোখে পড়েছে। যেমন: কাত্যায়ণ (পৃ. ১৫), পদাবলী (পৃ. ১৮), আঙিকে (পৃ. ৩৩), পঙতি (পৃ. ১৫৯)।
• লেখক ‘–এরা’ যোগে বহুবচনের ক্ষেত্রে মনোযোগী হননি। যেমন: কোথাও তিনি লিখেছেন শিক্ষকেরা, উপসকেরা; আবার কোথাও লিখেছেন তরুণরা, প্রবীণরা। শেষোক্ত গঠনই বেশি চোখে পড়েছে। নিয়ম অনুযায়ী তরুণেরা, প্রবীণেরা হওয়া সমীচীন।
• বইয়ের অলঙ্করণে লেখক পরবর্তী সংস্করণে আরও যত্নবান হবেন বলে আশা করি। যেমন: ণ-ত্ব বিধানের পরিচিত ছড়াটি সেন্টার এলাইনমেন্ট করে দেওয়া যেত; প্রাচীন বাংলার জনপদগুলোর আলোচনায় আলোচ্য শিরোনাম বোল্ড করে দেওয়া যেত।
• বইয়ের প্রচ্ছদটি পছন্দ হয়েছে।
লেখাটি এখানেই শেষ করছি। শেষ করার আগে পাঠকদের উদ্দেশে বলছি, বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। দিন দিন অনাদরে অবহেলায় এই ভাষা আজ বিবর্ণ হয়ে উঠছে। অথচ বাংলা কতই না শ্রুতিমধুর, কতই না সৌকর্যময়। লেখক বাংলার প্রতি দরদ থেকেই বইটি রচনা করেছেন- এ কথা বইটি হাতে নিলেই বোঝা যায়। তাই বইটি কিনে পড়ুন এবং সংগ্রহে রাখুন। কথা দিলাম আপনার ১৫০ টাকা খরচ বৃথা যাবে না।
লেখকের উদ্দেশে বলছি, আপনি লিখতে থাকুন। আপনার জন্য রইল অনেক অনেক শুভ কামনা এবং ব্যকরণ নিয়ে এই অসাধারণ প্রয়াসের জন্য আপনাকে জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ।
আবদুল্লাহ আল নোমান: এমএ, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
লেখক পরিচিতি
সম্পাদক বাংলাদেশের শিক্ষা
এই লেখাটি সম্পাদক কর্তৃক প্রকাশিত। মূল লেখার পরিচিত লেখার নিচে দেওয়া হয়েছে।