সমাজ, রাষ্ট্র, দর্শন এবং পারিপার্শ্বিকতার সাথে শিক্ষকদের পরিচিতি এবং শিক্ষাদান ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অনেকে মনে করেন, শিক্ষকদের এগুলো জানার এবং শিক্ষাদানের সাথে কি সম্পর্ক আছে? শুধু পাঠ্যবই পড়ানো নয়, পাঠ্যবইয়ের পাঠকে শিক্ষার্থীদের উপযোগী করে তোলার জন্য একজন শিক্ষকের বাহ্যিক জ্ঞান অবশ্যই থাকতে হবে।
ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচি সুবিধাবঞ্চিত কমবেশি ৫০০ গ্রামীণ স্কুলে প্রতিবছর এসএসসি পরীক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ সহায়তা দিয়ে থাকে। কারণ তাদের প্রাইভেট পড়ার সুযোগ এবং সামর্থ্য নেই, শিক্ষকস্বল্পতা, পূর্ব থেকেই কঠিন বিষয়গুলোতে সঠিক পাঠদান না হওয়ার কারণে দেশের স্বাভাবিক এসএসসি পরীক্ষার্থীদের চেয়ে এসব স্কুলের পরীক্ষার্থীরা অনেক পিছিয়ে থাকে। এগুলোর প্রধান সমন্বয়ক হিসেবে বিভিন্ন ধরনের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সাথে নতুন পরিচয়ের মাত্রা যোগ হয়েছে আর নতুন কিছু বিষয়ের গভীরে যাওয়ারও সুযোগ হয়েছে। বিশেষ সহায়তার মধ্যে সহজ ও উন্নত পদ্ধতিতে ছাত্রছাত্রীদের কাছে বিষয়গুলোর জন্য বই, প্রশ্নপত্র ইত্যাদি দেয়া হয়ে থাকে। তারপরেও কোনো কঠিন সমস্যায় পড়লে যাতে তারা ব্র্যাকের সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিবর্গের সাথে যোগাযোগ করতে পারে সেজন্য কয়েকটি সেল নম্বর দেয়া আছে। সেল নম্বরগুলোতে প্রায় প্রতিদিন বিভিন্ন ধরনের ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক এবং অভিভাবকগণ ফোন করে থাকেন। কিছু শিক্ষকদের ফোনের আলাপ এখানে তুলে ধরছি।
“হ্যালো এইডা কি ব্র্যাক ব্যাংক?” আমি উত্তরে বলি- না, এটি ব্র্যাক ব্যংক নয়। আপনি কি জানতে চাচ্ছেন, আপনার পরিচয়টা দেন।
উত্তর আসে, তাইলে এইডা কী? আমি প্রশ্ন করি, আপনার কী দরকার সেটা বলেন। ঠিকভাবে বলতে পারেন না এবং পরিচয়ও দেন না, যেটি আসলে প্রথমেই দেয়া দরকার। যখন বারবার অনুরোধ করার পর তাদের পরিচয় দেন তখন আমি নিজেই লজ্জা পাই। প্রধান শিক্ষক ফোন করে বলেন, এইডা কি ব্র্যাক অফিস। আমি উত্তরে বলি, হ্যাঁ, ব্র্যাক প্রধান কার্যালয়। উত্তরে বলেন, প্রধান কার্যালয় কি রংপুর?
আমি নিজে সরাসরি শিক্ষক ছিলাম, এখনও শিক্ষকদের নিয়েই কাজ করি। তাদের যে কোন ধরনের সমস্যা আমার সমস্যা মনে হয়, আমি শিক্ষকদের অনেক উঁচু স্থানে দেখতে চাই। একজন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক যদি না জানেন যে, কোন সংস্থার প্রধান কার্যালয় একটা জেলা শহরে হতে পারে না, তাহলে তারা আমাদের ভবিষ্যত নাগরিক যারা দেশের কর্ণধার হবেন তাদের কি শিক্ষা দিয়ে থাকেন? সিলেট থেকে এক শিক্ষক ফোন করে বলছেন, আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনাদের হেড অফিসে আসতেছি পুস্তক নেয়ার জন্য। আমি ভাবলাম- উনি বোধ হয় বর্তমানে ঢাকায় আছেন, অতএব কিছুক্ষণের মধ্যে অফিসে আসবেন। আমি ফোনে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি ঢাকায়? উত্তরে উনি বললেন না, আমি সিলেটে। তাহলে আপনি কীভাবে কিছুক্ষণের মধ্যে হেড অফিসে আসবেন? উনি বললেন, আমি আপনাদের হেড অফিস চিনি। অর্থাৎ ব্র্যাকের সিলেট অফিস চিনেন এবং সেটাকেই উনি হেড অফিস ধরে নিয়েছেন। অর্থাৎ অনেক শিক্ষকদেরই এই অবস্থা।
এ প্রসঙ্গে আমার শিক্ষকতা জীবনের একটি কথা মনে পড়ে গেল। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে সদ্য শিক্ষকতায় প্রবেশ করেছি। গিয়ে দেখলাম অনেক শিক্ষক নোট বানিয়ে ঐ নোট দিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়াচ্ছেন। সেখানে ইংরেজিতে একটি প্যারাপ্রাফ থাকত ’হাউ টু বি কাম এ নার্স’। সবাই লিখত “আফটার এসএসসি পাশ, ওয়ান ক্যান টেইক টু ইয়ার্স নার্সিং ট্রেনিং এ্যট ঢাকা মেডিকেল কলেজ”। নার্সিং তখন প্রতিটি মেডিকেল কলেজেই চার বছরের ডিপ্লোমা হিসেবে পড়ানো হতো। দুই বছরের নার্সিং ট্রেনিং তখন নেই বললেই চলে। শিক্ষকদের বিষয়টি জানা নেই বলে ছাত্রছাত্রীদের ওই নোট করা গৎবাধা প্যারাগ্রাফই পড়াতেন, আসল জিনিস জানাতে পারতেন না। অথচ একজন শিক্ষককে চোখ কান খোলা রাখতে হবে এসব ব্যাপারে।
আর একজন গণিত শিক্ষকক্ষের পরিচিতি পুরো ক্যান্টনমেন্টে অংকের জাহাজ হিসেবে। কারণ উনি অনেক অংকের রেজাল্ট মুখস্থ বলতে পারতেন। এখানে কৃতিত্বের যে তেমন কিছু নেই তা কেউই ভেবে দেখছেন না। কারণ উনি নিজে বিএসসি পাশ করার পর ২৫ বছর যাবত অংকই করাচ্ছেন, আর আমাদের পরীক্ষা পদ্ধতিতে ঐ বইয়ের বাইরে কোন অংক আসে না। যে কেউ ২৫ বছর নয়, দু বছর অংক করালেই উত্তর বলে দিতে পারবেন। যেমনটি ঘটেছিলো আমার ক্ষেত্রে। আমি উচ্চ-মাধ্যমিক পর্যন্ত বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম। এসএসসি পাশ করার পর মনে আছে অনেক অংকের উত্তর মুখস্থ হয়ে গিয়েছিলো। অনেক ছেলেমেয়েরা আমার কাছে পড়তে আসতো এবং ভাবত আমি অংকে নিশ্চয়ই জাহাজ বা এই জাতীয় কিছু হবো। যাই হোক, জাহাজ পরীক্ষা করার জন্য আমার উক্ত সহকর্মীকে বিসিএস গাইড থেকে একটি অংক দিয়েছিলাম। দেখলাম বেচারা ঘেমে যাচ্ছেন। বহুবার বহুভাবে চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত বললেন অংকটি আপনাকে আগামীকাল করে দেই। আসলে আমি তাকে পরীক্ষা করার জন্য যে উনি আসলে কতটা ক্রিয়েটিভ এবং কতটা অরজিনালিটি অংকে আছে তা দেখার জন্য, অংকটি আগামীকাল করার জন্য নয়। আমি তাকে শুধু ধন্যবাদ দিয়ে দিলাম। এই হলো আমাদের শিক্ষকদের ক্রিয়েটিভিটির নমুনা। বইয়ের বাইরে একটুও যাবেন না, যেতে চান না। পুরো সমাজে বাহবা কুড়ান আর শিক্ষার্থীদের ক্রিয়েটিভ হওয়ার কোনো সুযোগ দেন না।
আমাদের দেশের কয়েক বছরের এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র দেখলে বুঝা যায় আমাদের শিক্ষকগণ কতোটা ক্রিয়েটিভ। দশ বছরের প্রশ্নপত্র ঘাটলেও দেখা যায় অনন্য ব্যতিক্রম ছাড়া কোনো বছরই প্রশ্নপত্রের কোনো আইটেম শিক্ষকদের নিজেদের সৃষ্ট নয়। সব আইটেমই পূর্ববর্তী বছরের কিংবা বাজারের কোনো বই থেকে হুবহু নেয়া। একটি আইটেমও শিক্ষকরা নিজে তৈরি করেন না। যদি কোনো শিক্ষক নিজ থেকে কোনো প্রশ্নপত্র তৈরি করেন তাহলে তাকে ধরা হয় অযোগ্য শিক্ষক। কারণ মনে করা হয়, তিনি প্রশ্ন কমন ফেলতে জানেন না। এখন দামী শিক্ষক হচ্ছেন কে কত সহজ সাজেশন তৈরি করতে পারেন, কে কত সহজে প্রশ্নপত্র কমন ফেলতে পারেন। ক্রিয়েটিভিটির কোনো স্থান নেই অথচ শিক্ষকতা ব্যাপারটি পুরোটই ক্রিয়েটিভ, পুরোটাই আনন্দের ।
লেখক পরিচিতি
মাছুম বিল্লাহ বাংলাদেশে ইংলিশ টিচার্স অ্যাসেসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইট্যাব)-এর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি পূর্বে ক্যাডেট কলেজ ও রাজউক কলেজের শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন। কাজ করেছেন ব্র্যাকের শিক্ষা কর্মসূচিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে। তিনি ভাব বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসেবেও কর্মরত রয়েছেন। তিনি নিয়মিত শিক্ষাবিষয়ে নানা প্রবন্ধ লিখছেন।