১৯৯৪ সালে ইউনেস্কোর ২৬তম অধিবেশনে গৃহিত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে শিক্ষকদের অবদান স্মরণ করার জন্য দেশে দেশে ৪ অক্টোবর ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’ পালন করা হয়। আজ বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালনে কবি কাজী কাদের নেওয়াজ (১৯০৯-১৯৮৩)-এর ‘শিক্ষকের মর্যাদা’ কবিতাটিই মনে এলো সবার আগে। সেখান থেকেই শিরোনামটি নিয়েছি।

কবিতাটি আমাদের সময় বিদ্যালয়ে পাঠ্য ছিলো। বাংলার শিক্ষক এটি পড়ানোর সময় আবেগাপ্লুত হয়ে পড়তেন। নিজের সামান্য বেতন ও সামাজিক অবস্থানের কথা ভেবে হয়তো মনে মনে বিচলিত বোধ করতেন। সমাজে শিক্ষকের চেয়ে কেরাননির কদর বেশি জেনেও যারা অনিচ্ছুক শিক্ষক হয়েছেন, তাদের তো কোনো প্রস্তুতি কিংবা প্রতিজ্ঞা নেই ‍শিক্ষক হবার। অথচ শিক্ষকতা এমন কোনো কাজ নয় যে জবরদস্তি করে করানো যায়। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারি হয়ে যেকোনো দপ্তরে দাপ্তরিক নির্দেশমত কর্মসম্পাদন আর শিক্ষকতা কোনোমতেই এক নয়। উন্নত জীবনের স্বপ্নদর্শনে উদ্বুদ্ধ করার শিক্ষা তিনিই দিতে পারেন, যাঁর উন্নত জীবনের স্বপ্ন আছে।

একবার একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মীর প্রতি সম্মান দেখানোর বাড়াবাড়ি দেখে বিস্মিত হয়ে হিরোশিমা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এক শিক্ষককে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কেনো তিনি এমনটি করেন? তিনি উত্তরে বলেছিলেন, “আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে দেশের জন্য কী অবদান রাখছি তা গবেষণা করে বলতে হবে। কিন্তু একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মীর অবদান খালি চোখেই দেখতে পাই। তাঁর জন্যই তো এই দেশটা এতো পরিচ্ছন্ন।”

একজন শিক্ষকের এই দৃষ্টিভঙ্গি জাপানিদের জাতি হিসেবে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। কর্মীর হাতকে কীভাবে সম্মান দেখাতে হয়, তাও শিক্ষকের কাছেই শিখেছিলাম সেদিন। আমি সেদেশে একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে ‘গ্লোবাল টিচার’ হিসেবে বছরখানেক কাজ করেছিলাম। কাজের শেষে স্কুলের প্রধানকে বললাম আমার কাজের প্রত্যয়ন দেবার জন্য। তিনি বললেন, “তুমি যে ক্লাসে নিয়োজিত ছিলে, সে ক্লাসের ক্লাসটিচারই তোমাকে প্রত্যয়ন দিতে পারেন, আর কেউ নয়।” অর্থাৎ শিক্ষকদের প্রতি তাঁদের আস্থার জায়গাটা কেমন, সেটি তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। জাপানে স্কুল-শিক্ষক হবার প্রক্রিয়ার মধ্যে এমন একটি ব্যাপার আছে যে সেখানে সামান্য স্খলন সহনীয় নয় মোটেও!

এ-বছর নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখা হয়েছে। সে রূপরেখা নিয়ে ক’দিন বিস্তর কথকতা ও লেখালেখি চলছে। আমরা শিক্ষার মান্নোনয়ন চাই। আমরা শিক্ষাকে যুগোপযোগী করে তুলতে চাই। ২০৪১ সালে আমরা উন্নত দেশ হবো, তাই আমরা শিক্ষাকে উন্নত দেশের আদলে ঢেলে সাজাতে চাই। বর্তমান বছরটি মুজিব শতবর্ষ, স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী, কোভিড-১৯ মহামারীসহ নানা কারণে বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই শিক্ষার ব্যাপারেও সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে এখনই।

এবার তাই একটু শিক্ষকের মর্যাদা প্রসঙ্গে যাওয়া যাক। এদেশে এখনো আমরা শ্রদ্ধাভরে যাঁদেরকে ‘স্যার’ সম্বোধন করি, সেই শিক্ষকবৃন্দও বোধ হয় এখন আর ‘স্যার’ ডাক শুনে স্বস্তি পান না স্যার ডাকাডাকির জবরদস্তি দেখে। অথচ কদিন আগে স্বয়ং জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেছেন, “সরকারি সেবা নিতে আসা জনসাধারণকে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ বলে সম্বোধন করতে হবে, এমন কোনো নীতি নেই।”

তাহলে নীতিবহির্ভূতভাবেই স্যার/ম্যাডাম ডাকা চলছে খুব কায়দা করে? এমনকি কেউ কেউ স্যার ডাক শুনতে না পাওয়ার ক্ষোভে সেবাপ্রার্থীকে অপদস্ত করতেও ছাড়ছেন না! প্রজাতন্ত্রের বেতনভুক্ত কর্মচারিগণ জনগণের সেবক। অর্থাৎ জনগণের সেবা দেওয়ার জন্যই তো জনগণ তাদের বেতনাদি পরিশোধের নিমিত্তে রাষ্ট্রকে টাকা যোগায়। সেবক কেমন করে স্যার হয়ে গেলেন? বরং, উল্টোটিই তো হবার কথা যেমনটি সচরাচর উন্নত দেশে দেখেছি।

আমরাও তো উন্নত হবার পথে এগোচ্ছি। সদ্য স্বাধীন দেশের গণকর্মচারির আচরণ কেমন হবে, তা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান খুব স্পষ্ট করে বলে দিয়েছিলেন তখনই। সরকারি চাকরিজীবিদের উদ্দেশ্যে তিনি এক ভাষণে বলেন, “আমি সরকারি কর্মচারিদের বলবো, মনে রেখো; এটা স্বাধীন দেশ। ব্রিটিশ কলোনি নয়। পাকিস্তান কলোনি নয়। সাধারণ মানুষের মুখের দিকে একটু ভালোভাবে চেয়ে দেখো; তার চেহারাটা তোমার বাবার মত কিংবা ভাইয়ের মত। তারাই এদেশে বেশি সম্মান পাবে।”

আজ স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে এসেও কেনো গণকর্মচারিগণ স্যার ডাক শোনার জন্য ব্যাকুল? অথচ স্বতঃস্ফূর্ত ‘স্যার’ ডাক কেবল শিক্ষকের জন্যই। রাষ্ট্র অন্তত এই সম্মানটুকু শিক্ষকগণকে দিতে পারে, সবার চেয়ে বেশি বেতন দিতে যদি না-ই পারে। জার্মানিতে শিক্ষকদের বেতন সবার চেয়ে বেশি। জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেলকে একবার তাঁর দেশের বিচারক, ডাক্তার, প্রকৌশলীরা শিক্ষকদের সমান বেতন দাবি করলে তিনি তা প্রত্যাখান করেছিলেন। বলেছিলেন, “How can I compare you to those who taught you?”

সমাজ ও রাষ্ট্রে শিক্ষকের অবদানকে বঙ্গবন্ধুও বারবার অকুন্ঠচিত্তে উচ্চারণ করে গেছেন তাঁর ভাষণে। শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “আগামী প্রজন্মের ভাগ্য শিক্ষকদের উপর নির্ভর করছে। শিশুদের যথাযথ শিক্ষার ব্যত্যয় ঘটলে কষ্টার্জিত স্বাধীনতা অর্থহীন হবে।”

প্রশ্ন হলো, সকল শিক্ষক কি সেই সম্মানের যোগ্য? যোগ্য যদি না হন, তবে তাকে যোগ্য করে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে। অন্যথায় অযোগ্য শিক্ষকের কাছে যোগ্য আগামী প্রজন্ম আশা করা বৃথা। কীভাবে যোগ্য শিক্ষক আমরা পেতে পারি, তা নিয়ে বিস্তর পরামর্শ শিক্ষাবিদগণ দিয়েছেন। আমি সে প্রসঙ্গে আজ যাবো না। শুধু বলবো, যে শিক্ষককে আমরা সম্মান করতে পারব না তাঁর কাছে আমাদের সন্তানকে শিখতে পাঠাবার মতো বিরুদ্ধাচার যেনো না করি।

ইদানিং প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দেওয়ালে নানা লেখা দেখি। যেমন, “১. আমরা লেখাপড়া করি ভালো মানুষ হবার জন্য। ২. আমরা লেখাপড়া করাই ভালো মানুষ গড়ার জন্য।” কেবল দেওয়ালের লেখা দিয়ে যে কিছু বদলাবে না, তা তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি। শিশুর সামনে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ‘রোল মডেল’। সুতরাং শিশুকে ভালো মানুষ হবার শিক্ষা দিতে হলে ভালো শিক্ষকের বিকল্প নেই।

আমি বলতে চাই, আমাদের রাষ্ট্রাচারে শিক্ষকের সম্মানের জায়গাটি স্পষ্ট করা হোক। যোগ্যতার বিচার না করেই যদি কাউকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করা হয় তবুও তিনি শিক্ষক! তাই শিক্ষককে আগে সম্মান দিতে হবে। এরপরও যদি কোনো শিক্ষককে সম্মানের যোগ্য বলে মেনে নিতে আপত্তি ওঠে, তবে তাঁকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। বলে রাখা ভালো, আমি মূলত প্রাথমিক স্তরের শিক্ষকদের কথাই জোর দিয়ে বলছি। কেনোনা, বড় মানুষ হবার ভিত্তি তো প্রাথমিক শিক্ষাই।

বর্তমান সময়ে শিক্ষকগণের ওপর অশিক্ষকের জবরদস্তি কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে, তা একজন নিষ্ঠাবান প্রাথমিক শিক্ষকের ফেইসবুক স্ট্যাটাস থেকে বেশ অনুমান করা যায়। নিরাপত্তার স্বার্থে লেখাটিতে লেখক রূপকের আশ্রয় নিয়েছেন।

লেখাটি হুবহু তুলে ধরছি, “রাস্তাঘাট দীর্ঘদিন খারাপ থাকায় চৌধুরী সাহেবের গাড়িগুলোও সেই থেকে গ্যারেজে ফেলে রাখা। ওগুলোর বিভিন্ন যন্ত্রাংশে মরিচা পড়ে অচলপ্রায় অবস্থা। রাস্তাঘাট মেরামত হয়েছে। গাড়ি মেরামতের জন্য নির্ধারিত মিস্ত্রিদের হুকুম দেওয়া হলো, দ্রুত মেরামত করে গাড়িগুলো চলার উপযোগী করার। মিস্ত্রিরাও খুশি। গাড়ি না চললে ওদেরও কষ্ট হয়, ভালো লাগে না। গাড়িগুলো যেন ওদের হৃদয়েরই একটা অংশ। সবাই গ্যারেজে হাজির হলো। মন দিয়ে কাজ করা শুরু করল। সমস্যা হবে না। কারণ, তারা জানে কোন যন্ত্রাংশ কীভাবে মেরামত করলে দ্রুত চলার উপযোগী হয়। কিন্তু চৌধুরী সাহেব বেশ চিন্তিত। তিনি বরাবরই মেরামতের সময়ে পাশে থেকে মিস্ত্রিদের পরামর্শ দেন। মিস্ত্রিরাও সেভাবে করে এবং ভালো ফল পাওয়া যায়।

তবে এবার যেন মিস্ত্রিদের উপর ভরসা করতে পারছেন না চৌধুরী সাহেব। তিনি মিস্ত্রিদের কাজে লাগিয়ে দিয়ে দেশ-বিদেশের ইঞ্জিনিয়ারদের কাছ থেকে মেরামতের জন্য ফর্মুলার পর ফর্মুলা এনে দিতে থাকলেন তাদের কাছে। মিস্ত্রিরা খুব ওবিডিয়েন্ট। তারাও দিনরাত পরিশ্রম করে সেই ফর্মুলা অনুযায়ী কাজ করতে থাকল।

কিন্তু সমস্যা হলো একটাই। নানান ইঞ্জিনিয়ারের নানাবিধ ফর্মুলা মোতাবেক কাজ করতে যেয়ে মিস্ত্রিরা খেই হারিয়ে ফেলতে থাকল এবং মূল মেরামতের কাজে বেশ বিঘ্ন সৃষ্টি হলো। যেমন: একটি নাট খুলে পুনরায় লাগাতে হবে। এই কাজটি মিস্ত্রি ভালোভাবে করতে পারত। তবে তাকে করতে হবে ফর্মুলা অনুযায়ী।

অর্থাৎ, তাকে হয়তো বলা হলো প্রথমে নাটটি খোলার পূর্ব প্রস্তুতি হিসাবে নাটে তেল মাখিয়ে রাখতে হবে। কোন কোম্পানির তেল কতটুকু মাখাতে হবে, কত সময় অন্তর মাখাতে হবে, কত সময় মাখিয়ে রাখার পর সেটা খোলা শুরু করতে হবে, খুলে যাবার পর নাটটি কোন হাতে ধরতে হবে, কীসের উপর রাখতে হবে, কীভাবে নাটটি পরিষ্কার করতে হবে, কত পর আবার সেটা লাগাতে হবে, ইত্যাদি ঠিক ফর্মুলা অনুযায়ী করতে হবে। এবং যা যা সে করবে সব ফর্মুলায় উল্লেখ্য ছক মোতাবেক অবিকল লিখে রাখতে হবে।

সেটা আবার ওই ইঞ্জিনিয়ারগণ ভিজিট করবেন। ফর্মুলা অনুযায়ী যেন চলা হয় সে কথা কঠিন করে বলেও দিয়েছেন চৌধুরী সাহেব। মিস্ত্রিরা এখন তটস্থ ফর্মুলা বাস্তবায়নের ভিজিটাতঙ্কে। তারা নিশ্চিত যে, এতো ফর্মুলার চাপ না দিয়ে পাশে থেকে পূর্বের ন্যায় একটু পরামর্শ দিলেই এর চেয়ে ভালো ফল পাওয়া যেত। যাই হোক, এই গাড়িগুলোর সাথে মিস্ত্রিদের নিবিড় সম্পর্ক। তারা আশাবাদী যে, যত কষ্টই হোক ফর্মুলার কষ্ট বুকে চেপে রেখে আন্তরিকতার সাথে পরিশ্রম করে গাড়িগুলোকে তারা মেরামত করে চলার উপযোগী করে তুলবে ইন শা আল্লাহ।”

এবার একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের বক্তব্য দিয়ে শেষ করবো। শিক্ষাবিজ্ঞানের একজন নবীন শিক্ষক লিখেছেন, “ভবিষ্যতের শিক্ষাব্যবস্থা যোগ্য শিক্ষকের সংকটে পড়বে। এ সংকট উত্তরণে প্রযুক্তি আংশিক সহযোগিতা করলেও, দিনশেষে যেসকল দেশ শিক্ষকের দক্ষতা উন্নয়ন, আর্থসামাজিক নিরাপত্তা, স্বাধীনতা ও সম্মানের বিষয়ে যত্নশীল হবে তারাই মানসম্মত শিক্ষার দৌড়ে এগিয়ে থাকবে।”

Sending
User Review
0 (0 votes)

লেখক সম্পর্কে

জগজ্জীবন বিশ্বাস

জগজ্জীবন বিশ্বাস

জগজ্জীবন বিশ্বাস খুলনা সদর থানা রিসোর্স সেন্টারে ইনস্ট্রাক্টর হিসেবে কর্মরত। জাপান থেকে পিজিডি ইন টিচার ট্রেনিং ও ইউকে থেকে এমএ ইন এডুকেশন সম্পন্ন করেছেন।

মন্তব্য লিখুন