বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা ও গবেষণা : পর্ব ৪

কিছুদিন আগে ঢাকা ট্রিবিউন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ভিসি প্রফেসর ড. চ্যাঙ-এর একটি সাক্ষাৎকার ছেপেছে, সেখানে গবেষণা নিয়ে কথাও ছিলো। সেদিন সকালে আমার বিভাগের অ্যালুমনি এ্যাসোসিয়েশনের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য যখন তৈরি হচ্ছিলাম, আমার স্ত্রী বললো যে, “ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ভিসি তো দেখি তার সাক্ষাৎকারে তোমার কথাগুলোই বললো”! অনুষ্ঠানে যাওয়ার ত্বরা ছিল বলে পড়া হয়নি; কিন্তু রাতে বাসায় ফিরে পড়েছি।

আসলে আমি বা প্রফেসর চ্যাঙ আমরা যা বলছি সেগুলো কোনো নতুন কথা নয়। এগুলো শতশত বছর ধরে যেই বিশ্ববিদ্যালয় ভালো করে তারা এসব পথে হেঁটেই ভালো করেছে। খারাপ হয়েছে যখন এসব পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে। এগুলো একটু এম্পিরিক্যাল ডেটা কিংবা দেশবিদেশের ভালো কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লে বা দেখলেই উপলব্ধি করা যায়।

যেমন প্রফেসর চ্যাঙ বলেছেন, “এখন থেকে আমাদের আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় হতে চেষ্টা করা উচিত। একটি সত্যিকারের আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় বানাতে হলে কেবল আন্তর্জাতিক শিক্ষক আর আন্তর্জাতিক কাররিকুলাম থাকলেই চলবে না। সর্বাগ্রে আমাদের গবেষণা বিষয়ে মাইন্ডসেটকে আন্তর্জাতিক হতে হবে।”


ইউনিভার্সিটি শব্দটির মাঝেই ইউনিভার্সাল শব্দটি অন্তর্নিহিত। অর্থাৎ সত্যিকারের ইউনিভার্সিটি হতে হলে একে সবদিক থেকে ইউনিভার্সাল হতে হবে।


সত্যি বলতে কি, আমার অনেক লেখায় অনেকবার লিখেছি যে ইউনিভার্সিটি শব্দটির মাঝেই ইউনিভার্সাল শব্দটি অন্তর্নিহিত। অর্থাৎ সত্যিকারের ইউনিভার্সিটি হতে হলে একে সবদিক থেকে ইউনিভার্সাল হতে হবে।

প্রথমত, অধ্যাপক চ্যাঙ তাঁর সাক্ষাৎকারে বলেছেন “তিনি সর্বাগ্রে চেষ্টা করবেন বিদেশি স্কলার ও ট্যালেন্টসদের ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে আনতে, যারা গবেষণা করবে। আপনারা যদি বিশ্বের যেকোনো ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকান, দেখতে পাবেন সেখানে অনেক বিদেশি শিক্ষক এবং বিদেশি শিক্ষার্থী আছে। তাদের খোলামেলা ক্যাম্পাস আছে যার অর্থ হলো নতুন চিন্তা ও নতুন মত গ্রহণের জন্য ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সদা প্রস্তুত।”

দ্বিতীয়ত, অধ্যাপক চ্যাঙ বলেছেন, “আমরা আন্তর্জাতিকমানের গবেষণা সেন্টার খুলতে চেষ্টা করবো।”

এবং তৃতীয়ত, “আমরা নিশ্চিত করবো যে, প্রতিটি শিক্ষার্থী যারা এখান থেকে পাশ করে বের হবে তাদের মধ্যে যেন “ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতার ছাপ থাকে যা তাকে অন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আলাদা অর্থাৎ স্বতন্ত্র মহিমায় উদ্ভাসিত করবে।”

এসব চিন্তা কি আমাদের কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি করছেন? সময় কোথায় তাঁদের? আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের একটি দিন কীভাবে কাটে তা কেউ পরখ করে দেখেছেন?

তাঁদের প্রতিটি দিন থাকে ৩-৫ বা তারও বেশি অনুষ্ঠান উদ্বোধনের দায়িত্ব, ৩-৪টি মিটিং, শতশত স্বাক্ষর করা, রাজনৌতিক মিটিঙে উপস্থিত থাকা ইত্যাদি। এসব কাজ বিশ্বের কোনো ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে করতে দেখবেন না। এরকম অকাজে এতো মূল্যবান সময় ব্যয় করলে আপন বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে ভাবার সময় কি আছে? দিবসের একটি বড় সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের মঙ্গল নিয়ে চিন্তা করতে হবে। গবেষণা নিয়ে চিন্তা করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক্যালি সাউন্ড শিক্ষক-গবেষকদের ডেকে এনে তাদের সাথে মতবিনিময় করতে হবে।

বর্তমান পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কি বিদেশী শিক্ষক, গবেষক (অর্থাৎ পিএইচডি শিক্ষার্থী ও পোস্ট-ডক) নিয়োগ দেওয়া সম্ভব? আমি অনেকবার লিখেছি, গবেষণা করার জন্য পিএইচডি শিক্ষার্থী ও পোস্ট-ডক ফেলো ছাড়া একটি বিশ্ববিদ্যালয় পূর্ণাঙ্গ হতে পারে না।


আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলে ৭৩-এর অধ্যাদেশ দিয়ে। শুনতে খারাপ লাগলেও বলতে বাধ্য হচ্ছি, এই অধ্যাদেশটিই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মানের ক্রমাবনতির অন্যতম কারণ। অধ্যাদেশটি আমাদের শিক্ষকদের অসীম স্বাধীনতা দিয়ে দিয়েছে যার যোগ্য আমরা কখনোই ছিলাম না।


আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলে ৭৩-এর অধ্যাদেশ দিয়ে। শুনতে খারাপ লাগলেও বলতে বাধ্য হচ্ছি, এই অধ্যাদেশটিই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মানের ক্রমাবনতির অন্যতম কারণ। অধ্যাদেশটি আমাদের শিক্ষকদের অসীম স্বাধীনতা দিয়ে দিয়েছে যার যোগ্য আমরা কখনোই ছিলাম না। সত্যি বলতে কি, এরকম একটি অধ্যাদেশ থাকলে তার সুযোগ নিতে আমরা স্বাভাবিকভাবেই বাধ্য থাকবো।

একটি সংবিধান বা যেকোনো কিছু যখন ‘অপরিবর্তনীয়’ বা স্ট্যাটিক থাকে সেটি কখনো মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না। সময়ের সাথে পরিবর্তন এবং পরিবর্ধন হওয়া উচিত ছিলো। পরিবর্তন বা বিবর্তনই হলো উন্নতির প্রাণ।

এ অধ্যাদেশ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়টিকে গবেষণামুখী হওয়া থেকে সরিয়ে নির্বাচনমুখী বানিয়েছে। ফলে আমরা শিক্ষক নিয়োগকে ভোটার নিয়োগে রূপান্তরিত করতে স্বার্থক হয়েছি। এমন অনেক শিক্ষক আছেন, যারা সারা বছরজুড়ে কেবল নির্বাচনী ক্যাম্পেইনই করেন। তার ওপর এ অধ্যাদেশের সুযোগে আমাদের সরকারগুলো সবসময় তার ক্ষমতা ধরে রাখা ও জনপ্রিয়তা অর্জনের খুঁটি হিসেবে ব্যবহার করেছে। আর আমরা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা এদের ঘুটি হিসেবে অবলীলায় ব্যবহৃত হয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়টিকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার চেষ্টা কখনো করা হয়নি।

আসলে আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফোকাস কখনো নতুন জ্ঞান সৃষ্টি ও সেই জ্ঞান বিতরণের কেন্দ্র ছিল না, কখনোই। শুরুতে যতটুকুই বা ছিলো, সেটি সময়ের সাথে ক্রমান্বয়ে কন্সিস্টেন্টলি এবং বিরামহীনভাবে কমে কমে আজ আর বিশ্ববিদ্যালয় বলে কিছু অবশিষ্ট নেই। সুষ্ঠু ভালো রাজনীতি করলেও দেশের উপকার হতো। এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০০ শিক্ষক দাঁড়িয়ে যদি সত্য কথা বলা শুরু করেন, দেশের কোনো সরকারের পক্ষে অন্যায়, চুরি, লুটপাট, ডাকাতি আর গণতন্ত্র হনন করতে পারতো না! শুধু ১০০ অকুতোভয় শিক্ষক দরকার।

দেশকে ভালোবাসলে, দেশের পরবর্তী প্রজন্মের প্রতি ন্যূনতম দায়িত্ববোধ থাকলে এই বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আমাদের দ্রুত কিছু করতে হবে। কারণ, ১৬ কোটি মানুষকে নিয়ে দেশকে সামনে এগিয়ে নিতে হলে মানসম্পন্ন শিক্ষার বিকল্প নেই। এই মুহূর্তে আমরা যা করছি তা হলো সার্টিফিকেট বিলিয়ে দিয়ে তুষ্ট করছি।


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০০ শিক্ষক দাঁড়িয়ে যদি সত্য কথা বলা শুরু করেন, দেশের কোনো সরকারের পক্ষে অন্যায়, চুরি, লুটপাট, ডাকাতি আর গণতন্ত্র হনন করতে পারতো না! শুধু ১০০ অকুতোভয় শিক্ষক দরকার।


আমাদের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক নিয়োগের শর্ত হিসেবে বাংলাদেশী নাগরিকের পরিবর্তে সার্কের নাগরিক করে আমরা যদি ভারত এমনকি আরও সম্প্রসারিত করে চীনকেও অন্তরভুক্ত করি, তাহলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন আসতো বলে মনে করি। এমিনিতে তো দেশে নানা দেশের লোকজন আইনি আর বেআইনিভাবে নানা পেশাতে কাজ করছে, শুধু শিক্ষাক্ষেত্র ছাড়া। অথচ এখানেই দরকার বেশি।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রতি একজন বিদেশিকে ভিসি হিসাবে নিয়োগ দিয়েছে। কিন্তু এটি সহজে হয়নি। তার জন্য স্যার ফজলে হাসান আবেদকে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করতে হয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষক নিয়োগটি উম্মুক্ত করে দেওয়া উচিত। আমরা ভালো কারিগর পেলে দেশের যুবসমাজ ভালো শিক্ষা পাবে। ভালো শিক্ষা পেলে দেশ এমনিতেই সুন্দর হয়ে যাবে।

বিশেষ করে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় চরম শিক্ষক সংকটে ভুগছে। তাছাড়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে যে কলেজগুলো আছে সেখানে এন্ট্রি লেভেলে অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর এবং অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর হিসাবে নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে যেন যারা বিদেশ থেকে পিএইচডি পোস্ট-ডক করে আসে তারা নিয়োগ পেতে পারে।

জনপ্রিয় নিবন্ধ

প্রাথমিক স্তরে ভাষা শেখা : বিষয় – বাংলা

ভাষার দক্ষতা চারটি— শোনা, বলা, পড়া, লেখা। আর ভাষা...

আগে ইংরেজি গ্রামার শিখবো, নাকি ভাষা শিখবো?

কোন ভাষার গ্রামার হলো ঐ ভাষার গঠন প্রকৃতি যার...

শিক্ষাব্যবস্থার হালচাল

অর্থনীতিবিদদের মতে, শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ সবচেয়ে লাভজনক এবং নিরাপদ রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ। অর্থনীতিবিদ এডাম স্মিথ, ডেভিড রিকার্ডো এবং মার্শালের মতে, শিক্ষা এমন একটি খাত যার কাজ হলো দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলে পুঁজির সঞ্চালন ঘটানো। শিক্ষার অর্থনীতি নিয়ে মৌলিক গবেষণায় অর্থনীতিবদ আর্থার শুল্জ ও রবার্ট সলো দেখিয়েছেন যে, প্রাথমিক শিক্ষায় বিনিয়োগ করলে সম্পদের সুফল ফেরত আসে ৩৫ শতাংশ, মাধ্যমিক শিক্ষায় ২০ শতাংশ, এবং উচ্চ শিক্ষায় ১১ শতাংশ।

আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা : পিএইচডির পর কী?

আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়, আমি নিজেও এ-নিয়ে...

ক্যাডেট কলেজে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে কিছু কথা

ক্যাডেটসমূহ বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।...

আরও কিছু লেখা

অধিক

    চাকরির জন্য শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতি

    আলেয়া পারভীন লীনা শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতি নিয়ে লিখেছেন দেশে বাড়ছে পাশের...

    সর্বজনীন পেনশনে নতুন সিদ্ধান্ত ও শিক্ষকদের মধ্যে অসন্তোষ

    স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থায় আগামী জুলাই থেকে...

    শিক্ষাব্যবস্থা ও কোভিড-১৯ : উন্নত বিশ্ব ও বাংলাদেশ

    এই বিশ্বমারি কোভিড-১৯ শিক্ষাব্যবস্থা ও আমাদের জীবনের অনেক কিছু...

    নিষেধাজ্ঞা, রাজনীতি ও বিশ্ববিদ্যালয়

    পার্থ প্রতীম দাস লিখেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি ও নিষেধাজ্ঞা নিয়ে রাজনীতি...

    ভুয়া জার্নাল ও গবেষণা-প্রবন্ধ প্রকাশ

    মাহমুদ হাসান আন্ডারগ্র্যাড শেষ করার পর বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর মতো আমারও...

    বোর্ড পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন কতোটা যথাযথ

    বোর্ড পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের কি যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হচ্ছে? রাজধানীর...

    বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে ক্লাস : বাস্তবতা কী বলে?

    বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্যাম্পাসে ক্লাস নেয়া বন্ধ হয়ে...

    প্রাসঙ্গিক নিবন্ধসমূহ

    নতুন লেখার খবর পান ইমেইলে
    বাংলাদেশের শিক্ষা প্রসঙ্গে নতুন লেখা প্রকাশিত হলে সেই খবর পৌঁছে যাবে আপনার ইমেইলে।