নুরে আলম দুর্জয়

মুক্ত জ্ঞানচর্চায় দরকার স্বাধীনতা। বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক ও প্রশাসনিক স্বায়ত্তশাসনই পারে সেই স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে। কিন্তু দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেই স্বায়ত্তশাসন পরিণত হয়েছে আয়ত্তশাসনে। আর সম্ভবত এ কারণেই নির্মিত হয়েছে নতুন মিথ ডাকসু নির্বাচন। শিক্ষার্থীদের ভাবনার মূল কথা হলো ডাকসু হলে আমরা স্বাধীনতা পাবো, বঞ্চনার লাঘব হবে। সত্যিই কি তাই? বর্তমান কাঠামোর ডাকসু আদতে প্রশাসনিক স্বৈরক্ষমতারই অংশ যার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ ও দাসত্ব আরও পোক্ত হতে পারে। গঠনতান্ত্রিকভাবে উপাচার্যের আজ্ঞাবহ ডাকসু দিয়ে সত্যিকারের স্বাধীনতা আসবে না। এর জন্য চাই পরিবর্তন। চাই মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য মুক্ত ডাকসু।


প্রায় তিন দশক পর ডাকসু!

এদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ডাকসুর ভূমিকা ঐতিহাসিক ও অনস্বীকার্য। কখনও কখনও ডাকসু ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন সমার্থক হয়ে উঠেছে রচিত ইতিহাস ও রেটোরিকে। এর একটি কারণ ডাকসুর পথ-নির্দেশনাতেই এদেশের ছাত্র সংগঠনগুলো একজোট হয়ে উনসত্তর ও নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছিল। রাজনৈতিক দলগুলোর অন্তর্ঘাতমূলক সংকীর্ণতাকে অস্বীকার করে শিক্ষার্থী সমাজের এক অভূতপূর্ব ঐক্য দেখা গিয়েছিল।

গেল প্রায় তিন দশক ডাকসু নেই। বাম ছাত্র সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরেই ডাকসুর দাবি জানিয়ে আসছে। ডাকসু নির্বাচনের জন্য কত কাঠ-খড়, হাইকোর্ট-সুপ্রিমকোর্ট। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কর্তৃপক্ষ ‘পরিবেশের’ দোহাই দিয়ে বারবার ঝুলিয়ে  রেখেছিল। অথচ আজ হঠাৎ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কি দেখে নির্বাচনে এত আগ্রহী? খটকা একটু লাগেই।

গেল ৩০ শে ডিসেম্বর একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর সন্দেহ আরও ঘণীভূত হয়। আদতে ভোট হবে তো? নিজের ভোট নিজে দিতে পারবে তো শিক্ষার্থীরা? নাকি রাতেই ব্যালট ভরা থাকবে? আবাসিক হলে ভোটগ্রহণ করা হলে, অন্যরা কোনরকম পাহারাও দিতে পারবে না…। আবাসিক হলেই  নাকি ভোটগ্রহণের বিধান আছে। দাবি উঠলেও বিধান পাল্টাতে নারাজ কর্তৃপক্ষ। কিন্তু কেন?

তবে কি ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনগুলো ওয়াকওভার পেতে যাচ্ছে? বাম-ছাত্র সংগঠনগুলোর দাবিকে পুঁজি করে ডাকসু নির্বাচনের ভিত্তি রচিত হয়েছে। আর নির্বাচনে জেতার সব আয়োজন ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের জন্য। ডাকসু নির্বাচনে কলকাঠি নাড়া এবং তার গ্রহণযোগ্যতা কিভাবে তৈরি হচ্ছে তা ভেবে দেখার মতো।

ছাত্রলীগের দখলদারিত্ব-সন্ত্রাস এবং প্রশাসনিক স্বৈরতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান ‘ইন্সটিটিউশনালাইজড’ হবে ডাকসুর ক্ষমতা পেলে। এটা পরিস্কার।

এই ডাকসু কেমন ডাকসু?

আমরা একটু তলিয়ে দেখতে চাই আদতে ডাকসু কী? কী তার কাজ? কী তার ক্ষমতা ও ক্ষমতার বিন্যাস?

ঢাকা ইউনিভার্সিটি সেন্ট্রাল স্টুডেন্টস ইউনিয়ন, সংক্ষেপে ডাকসু বা ‘ছাত্র সংসদ’ বলি আমরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের আবাসিক বা সংযুক্ত শিক্ষার্থী এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক যেসব শিক্ষার্থীদের সরাসরি পাঠ দান করা হয় তাদেরই সমন্বয়ে এই ছাত্র সংসদ গঠিত [১]। অর্থাৎ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত সকল শিক্ষার্থী এর সদস্য। আর শিক্ষার্থীদের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হয় এই ‘ছাত্র-সংসদের’ কার্য নির্বাহী কমিটি—ভিপি-জিএস ব্লা ব্লা ব্লা।

ডাকসুর গঠনতন্ত্র অনুসারে, এই ছাত্র-সংসদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হল: ‘বিভিন্ন হলের’ শিক্ষার্থীদের মধ্যে সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক সহযোগিতা; একাডেমিক ও সহশিক্ষামূলক কার্যক্রমের সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা; সত্যিকারের নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা ও নেতৃত্বের বিকাশ ঘটানো; দেশের ভেতরে বাইরে অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সাংস্কৃতিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক সহযোগিতা উৎসাহিত করা [২]। কিন্তু এই উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য কী কী কাজ করবে ডাকসু?

ডাকসুর গঠনতন্ত্রে তা সুনির্দিষ্ট করে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। সংসদ-কমনরুম রক্ষণাবেক্ষণ করবে ও বছরে একবার ইনডোর গেম আয়োজন করবে এবং দৈনিক পত্রিকা ও সাময়িকী প্রদান করবে; বছরে অন্তত একবার জার্নাল ও অন্যান্য বুলেটিন প্রকাশ করবে; সময়মতো বিতর্ক প্রতিযোগিতা-বক্তৃতার আয়োজন ও সামাজিক সমাবেশ ঘটানো; বিতর্ক প্রতিযোগিতা আয়োজনের অংশ হিসেবে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিনিধি প্রেরণ অথবা আমন্ত্রণ; সমাজ সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে সদস্যদের মাঝে সমাজসেবার মানসিকতা গড়ে তুলবে। কিন্তু এই কাজগুলোর জন্যও লাগবে পদাধিকার বলে ডাকসুর প্রেসিডেন্ট উপাচার্য মশাইয়ের অনুমোদন। হুমমম… এমনটাই লেখা আছে গঠনতন্ত্রে [৩]।

বাহরে ডাকসু!

ডাকসুর কার্যক্রমের যে পরিধি এঁটে দেয়া আছে তার চেয়ে কম কিসে আমাদের পাড়া মহল্লার ক্লাবগুলো! গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ডাকসু তার নিজ প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজটা কি? তো, খেলাধূলা আর ডিবেট করা! এত গৌরবের ইতিহাস, প্রকাণ্ড সব ভিপি-জিএস, এত এত ইতিহাসখ্যাত মহানায়ক কি স্রেফ ডিবেট আর খেলাধূলা করে? কোথাও তো দেখলাম না, ডাকসু শিক্ষার্থীদের ইন্সটিটিউশনাল রাইটস সংরক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান। তাহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অধিকার নিয়ে কথা বলার সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নেই?

নির্মম হলেও সত্য যে, নে-ই। যদি না থাকে তবে প্রশাসনের অন্যায্য সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কথা বলবে কে? বেতন-ফি বাড়ালে কথা বলবে কে? শিক্ষার্থীদের উপর নিপীড়ণ-নির্যাতন হলে কথা বলবে কে? শিক্ষকদের ফলাফল ইঞ্জিনিয়ারিং, ব্যক্তিগত এনজিওর জন্য শিক্ষার্থীদের বেগার খাটানোর বিরুদ্ধে কথা বলবে কে? ডাকসুর কাজের  আওতা-পরিধির মধ্যে তো তাকে অধিকার সংরক্ষণের জন্য কোন দর কষাকষিরও কর্তৃত্ব দেয়া হয়নি। তাহলে এই ডাকসু নিয়ে আমরা কী করব? 

উপাচার্যের হিটলারি ক্ষমতা

পদাধিকার বলে ডাকসুর সভাপতি উপাচার্য। তিনিই নির্বাহী কমিটি ও অন্যান্য কমিটি এবং সাব-কমিটির সভায় সভাপতিত্ব করবেন। উপাচার্য সংসদের সর্বোচ্চ স্বার্থে যেকোনো সময় যেকোনো কার্যনির্বাহীকে অথবা সদস্যকে অপসারণ করতে পারবেন। এছাড়া তিনি চাইলে নির্বাহী সংসদকেই বাতিল করতে পারবেন এবং নতুন নির্বাচন ঘোষণা করতে পারবেন অথবা সংসদ গতিশীল রাখার জন্য তিনি যা উপযুক্ত বলে মনে করেন তাই করতে পারবেন।

এছাড়া উপাচার্য সিন্ডিকেটের অনুমোদনক্রমে যতকাল পর্যন্ত উপযুক্ত মনে করবেন সংসদকে  স্থগিত করার কর্তৃত্ব রাখবেন। এছাড়া তিনি নিয়ম-নীতি অনুসরণ করে সংসদ চলছে কি না সেটা দেখবেন; জরুরি অবস্থায়, অচল অবস্থায় অথবা গঠনতন্ত্র লঙ্ঘনে উপাচার্য সংসদের যথাযথ ভূমিকা বিবেচনা করে পদক্ষেপ নিতে পারবেন। এছাড়া উপাচার্য এসব নিয়মের ব্যাখা দিতে পারবেন এবং তার ব্যাখাই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে। শুধু তাই নয়, আরও আছে যে, উপাচার্যের অনুমতি ছাড়া ইউনিয়নের কোন সভা বা কোন বিষয়ের উপর আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে না [৪]।

বলা হচ্ছে ‘ইউনিয়ন’টি শিক্ষার্থীদের। অথচ এর চূড়ান্ত ক্ষমতা উপাচার্যের হাতে। তিনিই সর্বেসবা, একনায়ক। আদতে ১৯৭৩ সালের অধ্যদেশেও বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় উপাচার্যকে দেয়া হয়েছে বেশুমার ক্ষমতা। স্বয়ং হিটলারকেও এত ক্ষমতা দেয়নি নাৎসিরা। অথচ প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চর্চিত হচ্ছে এই ক্ষমতা।

১৯৭৩-এর অধ্যাদেশ অনুসারে বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাহী প্রধান হলেন উপাচার্য। তিনিই পদাধিকার বলে সিনেট-সিন্ডিকেটের সভাপতি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ-পদোন্নতি-প্রশাসনিক পদ বণ্টন সবকিছুরই প্রধান তিনি। পরিকল্পনা-বাজেট এমনকি ছুটি মঞ্জুর সকল কর্ম উপাচার্যকেন্দ্রিক [৫]।

কেন এই ক্ষমতা?

আমাদের দেশে বিপুল পরিমাণ শিক্ষক-শিক্ষার্থী নিয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একটি প্রকাণ্ড সমষ্টি। জ্ঞান চর্চার জন্য চাই স্বাধীনতা। সেই স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে স্বায়ত্বশাসন কথাটি উচ্চারিত হয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু ভয় একটা থাকেই। ভিন্ন মতের ভয়, প্রতিবাদের ভয়। বাংলাদেশের সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের কারণেই আমাদের রাষ্ট্র দলতান্ত্রিক। তাই দলতান্ত্রিক শাসকবর্গ তাদের অনুগত এমন এক স্বায়ত্তশাসনের ব্যবস্থা করেন, যেখানে উপাচার্যকে করায়ত্ব করতে পারলেই পুরো বিশ্ববিদ্যালয় করায়ত্ব হয়।

তাই পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতা কাঠামোটি ভীষণ কেন্দ্রীভূত এবং কর্তৃত্ব-ক্রমতান্ত্রিক। এই কর্তৃত্ব-ক্রমতন্ত্রের শীর্ষে থাকেন উপাচার্য। সিনেটের ১০৫ জন সদস্যের ভোটে সর্বোচ্চ ভোটধারী তিনজনের মধ্যে একজনকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেন আচার্য। আচার্য মানে রাষ্ট্রপতি। রাষ্ট্রপতি মাত্রই দলীয় লোক। ফলে দলীয় আনুগত্য থেকেই দলদাস উপাচার্য চয়ন করেন তিনি। একই সঙ্গে দলদাসত্বের শিক্ষক রাজনীতি আর রাষ্ট্রীয় আমলাদের পাহারায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের শুঁড় [৬]।

বিশ্ববিদ্যালয়ের যাবতীয় অনিয়ম দুর্নীতি দমন-পীড়ণ-নিষেধাজ্ঞা প্রযুক্ত হয় উপাচার্যের ক্ষমতা দ্বারা। আর  মাঠে থেকে এই প্রশাসনিক স্বৈরতন্ত্রের লাঠিয়াল হিসেবে তা বাস্তবায়ন করতে থাকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠন। বিনিময়ে মেলে ক্যাম্পাসের রাজত্ব, দখলদারিত্ব, ফাও খাওয়ার সুবিধা, গেস্টরুমে নিপীড়ণ, র‌্যাগিং ও সন্ত্রাসের একচেটিয়া আধিপত্য।

পুরো বিশ্ববিদ্যালয়কে বদ্ধ জেলাখানা বানিয়ে নিপীড়ণের একটি সিস্টেমেটিক ক্ষমতা হাতে পেয়েছেন উপাচার্য—  যিনি রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের প্রধান উপাঙ্গ। যে ডাকসু এই হিটলারি ক্ষমতার অধীন, তাল পাখার সেপাই সেই ডাকসু নিয়ে আমরা কী করব? 

ভিপি-জিএস কি মিনি এমপি-মন্ত্রী?

ডাকসুর প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হন শিক্ষার্থীদের সরাসরি ভোটে। তারপর? তারপর তারা আর কোনভাবেই শিক্ষার্থীদের কাছে জবাবদিহিতায় বাধ্য থাকেন না। গঠনতান্ত্রিকভাবে তো না-ই। ঠিক আমাদের সংসদের এমপি-মন্ত্রী সাহেবদের মতো। ব্যালটে আপনি-আমি ভোট দিয়ে নির্বাচন করি একজন ব্ল্যাঙ্কচেক প্রাপ্ত প্রতিনিধি। ক্ষমতায় গিয়ে তিনি ‘যা ইচ্ছা তাই’ করতে পারেন, আমার-আপনার কথা বলতে বা মত শুনতে বাধ্য নন।

তবে কি আমার-আপনার দায়িত্ব কেবল ব্যালটে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ বলা? জ্বি, একবারে তা-ই। ডাকসু প্রতিনিধিদের ‘রি-কল’ করার কোন নিয়মই গঠনতন্ত্রে নেই। রি-কল অর্থ নিজে যাকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছি, যেকোন মুহুর্তে সেই ভোট বাতিল করার অধিকার।

ডাকসুর গঠনতন্ত্র মোতাবেক, এর নির্বাহী প্রধান সহসভাপতি বা ভিপি। এছাড়াও আছেন সাধারণ সম্পাদক বা জিএসসহ নানা দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত ৮ জন সম্পাদক। ডাকসু থেকে ৫ জন প্রতিনিধি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধিপ্রণয়নকারী কর্তৃপক্ষ সিনেটের সদস্য। নির্বাহী কর্তৃপক্ষ সিন্ডিকেটে কোন সদস্য নেই। এখন ডাকসুতে খুব শিক্ষার্থীবান্ধব এবং আপোসহীন নেতৃত্ব নির্বাচিত হলেও উপাচার্যপন্থী সংখ্যাগরিষ্ঠ সিনেটরদের সামনে তারা সংখ্যালঘু। কোন শিক্ষার্থীবান্ধব প্রস্তাব উপাচার্যপন্থীদের সমর্থন ছাড়া ডাকসু প্রতিনিধিরা পাশ করাতে পারবেন না।

তাহলে তারা কি পারবেন? উপাচার্যের ইচ্ছায় শুধু তাবৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহশিক্ষামূলক কার্যক্রমের অথরিটি হতে এবং উপাচার্যের নির্দেশ তামিল করতে। আমরা কি আমাদের স্বাধীনতার পরিপন্থী এমন ব্ল্যাঙ্কচেক প্রাপ্ত প্রতিনিধি চাই? নাকি চাই গণ-অংশগ্রহণ? যেখানে আমিই আমার প্রতিনিধি? আমিই আমার কথা বলতে পারি?

হল আছে, বিভাগ নেই!!

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের দুই অংশ: কেন্দ্র ও হল। হল সংসদের জেনারেল রুলস অনুযায়ী হলের প্রাধ্যক্ষই হলেন সংসদের সভাপতি। কেন্দ্রীয় সংসদে উপাচার্যের যা ক্ষমতা এখানে প্রাধ্যক্ষর সেই এক ক্ষমতা। তাঁকে ছাড়া কিছু করা যাবে না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষার মূলক্ষেত্র তার বিভাগ। এখানেই তার শিক্ষা-প্রয়োজনের বেশিরভাগ জিনিস নিহিত থাকে। এখানেই তার পাঠ্যক্রম, গবেষণা, বই-পুস্তক, শিক্ষা সুবিধা-অসুবিধা, ফলাফল, বৃত্তি, মূল্যায়ন ইত্যাদি সংযুক্ত। সরাসরি একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষা সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় তত্ত্বাবধান করে বিভাগ। অথচ ডাকসুর সঙ্গে বিভাগের কোন সংযোগ নেই। ফলে ডাকসুর এই অসম্পূর্ণতা একদিকে যেমন বিভাগীয় শিক্ষকদের কর্তৃত্বপরায়ণ করে, তেমনই শিক্ষার্থীদের বঞ্চনার কোন লাঘবই হয় না। 

ডাকসুর গঠনতন্ত্র উপাচার্যের বিধি-নিষেধে ভরপুর। মুক্তচিন্তা ও জ্ঞান চর্চায় প্রতিবন্ধক। সর্বময় কর্তৃত্বসম্পন্ন কোনো সভাপতি, সহসভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, কিংবা একটি বিশেষ গোষ্ঠী কি সমস্ত শিক্ষার্থীর স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে পারে? না, একবিন্দুও না। সভাপতি বা নির্বাহী কমিটি দ্বারা উপর থেকে শিক্ষার্থীদের ঘাড়ের উপর চাপিয়ে দেয়া ফর্দ অনুসরণেই তখন শিক্ষার্থীরা বাধ্য। তাহলে কিসের গণতন্ত্র চর্চা? ডাকসুর নির্বাচনটা স্রেফ পরিণত হয়েছে বুদ্ধিবৃত্তিক দাস তৈরির এক গণতান্ত্রিক আয়োজনে।

তাহলে কি আমরা ডাকসু চাই না? চাই, আলবাৎ চাই। ডাকসুকে চাই আমার অধিকারের পক্ষে কথা বলার, লড়াই করার সংগঠন হিসেবে। মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণের অগ্রণী সংগঠন হিসেবে। কিন্তু কীভাবে?

মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের পথ

মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য চাই— মুক্ত ডাকসু। মুক্ত ডাকসু মানে উপাচার্যের আজ্ঞাবহ ক্ষমতার অনুগত ডাকসু নয়, গণতান্ত্রিক ডাকসু। ব্ল্যাঙ্কচেকপ্রাপ্ত প্রতিনিধি নয়, সরাসরি নিজেই অংশগ্রহণ। গঠনতান্ত্রিকভাবে ডাইরেক্ট ডেমোক্রেসি বা প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রই হবে এর ভিত্তি। প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র  মানে ক্ষমতায় সকল শিক্ষার্থীর অংশিদারিত্ব। কতকগুলো মৌলিক নীতির ভিত্তিতে বার্তাবাহক দ্বারা পরিচালনা। সমন্বয়ের জন্য স্বল্পমেয়াদী পদায়ন। বিলোপ করতে হবে সবধরনের হায়ারার্কি বা কর্তৃত্ব-ক্রমতন্ত্র।

আর এর জন্য প্রয়োজন ফেডারেটিভ সিস্টেম। কেমন হবে এর কাঠামো? বিভাগ এবং আবাসিক হলÑএই দুই অংশ নিয়েই গঠিত হবে ফেডারেটিভ সিস্টেম [৭]।

প্রথমত: আবাসিক হলে ব্লক হতে পারে এক একটি মৌলিক ইউনিট। প্রতিটি ব্লক থেকে ৫ জন (সংখ্যাটি কম বা বেশিও হতে পারে) বার্তাবাহক/দূত বা ডেলিগেট চয়ন করবেন সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীরা। এভাবে সব ব্লক থেকে বার্তাবাহক/দূত চয়ন করে কাজের সমন্বয়ের জন্য তাদের একটি ফেডারেটিভ সাধারণ সভা থাকবে। ব্লকের সাধারণ সভায় সকল শিক্ষার্থী মিলে যে গাইডলাইন দেবেন বার্তাবাহক/দূত শুধু সেই কথায় ফেডারেটিভ সাধারণ সভায় বলতে পারবেন। গাইডলাইনের বাইরে গেলে তাকে রিকল করা যাবে।

দ্বিতীয়ত: প্রতিটি বিভাগের প্রতি বর্ষে ২৫ জনে একজন করে বার্তাবাহক/দূত চয়ন করবেন শিক্ষার্থীরা। এই বার্তাবাহক/দূতদের সমন্বয়ের জন্য বিভাগীয় ফেডারেটিভ সভা থাকবে। হলের মতোই শিক্ষার্থী মিলে যে গাইডলাইন দেবেন বার্তাবাহক/দূত শুধু সেই কথাটিই ফেডারেটিভ সাধারণ সভায় বলতে পারবেন। গাইডলাইনের বাইরে গেলে তাকে রিকল করা যাবে।

তৃতীয়ত: হল ও বিভাগের ১ জন করে বার্তাবাহক নিয়ে ডাকসুর ফেডারেটিভ সভা গঠিত হবে। সেখানেও একইভাবে শিক্ষার্থীদের গাইডলাইনের মধ্যেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ডাকসুর ফেডারেটিভ সভা থেকে বার্তাবাহক/দূত সিনেট-সিন্ডিকেটে অংশ নেবেন। ক্ষমতার মৌলিক বিন্যাসটি হবে এখনকার চেয়ে উল্টো। নিচ থেকে যত উপরে যাওয়া যাবে ক্ষমতা ততোই কমতে থাকবে, সমন্বয় বাড়তে থাকবে।

চতুর্থত: পদায়ন হবে স্বল্পমেয়াদী। নির্দিষ্ট সময় পরপর স্বয়ংক্রিয়ভাবে বার্তাবাহক বদলে যাবে। ফেডারেটিভ সিস্টেম মানে সারা বছর ডাকসু, নির্বাচন ছাড়া গণ-অংশগ্রহণের ডাকসু। এভাবে প্রতিটি ইউনিট স্বাধীন এবং স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে উদ্ভাসিত হবে। নতুন ছাত্র সংসদের স্বাধীনতার ভিত্তি হবে অপরের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ না করা।

পঞ্চমত: কি হল কি বিভাগ; সিদ্ধান্ত গ্রহণের সকল প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীদের বার্তাবাহকরা যুক্ত থাকবেন। বিভাগের একাডেমিক কমিটিতে শিক্ষার্থীদের যুক্ত থাকার সাংবিধানিক ভিত্তি তৈরি করতে হবে। হলের যাবতীয় ব্যবস্থাপনায় শিক্ষার্থীরা যুক্ত থাকবে।

মুক্ত ডাকসু হতে পারে মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় গঠনের প্রথম সোপান। মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় মানে একাডেমিক ও কাঠামোগত স্বাধীনতা। রাষ্ট্র এবং যাবতীয় কর্তৃত্বর কবল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়কে মুক্ত করা। সত্যিকারের স্বায়ত্তশাসন তখনই সম্ভব যখন শিক্ষার্থীদের অধিকার এবং গণ-অংশদারিত্বের ব্যবস্থা চালু হবে। 

আমরা কেবল ডাকসু চাই না, চাই মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণে একটা মুক্ত ডাকসু।

তথ্যপঞ্জি

১. ডাকসুর গঠনতন্ত্র, ধারা ১

২. ডাকসুর গঠনতন্ত্র, ধারা ২

৩. ডাকসুর গঠনতন্ত্র, ধারা ৩

৪. ডাকসুর গঠনতন্ত্র, ধারা ৫

৫. মাহমুদ, আরিফ রেজা (২০১৭), বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসন অর্থায়ন: রাষ্ট্র-বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্ক পাঠ: মুক্তিপরায়ণ রূপকল্প; অরাজ, অরাজ.বাংলা

৬. প্রাগুক্ত

৭. প্রাগুক্ত

নুরে আলম দুর্জয়: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী। ছাত্র আন্দোলনের কর্মী।

মূল লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে অরাজ.বাংলা কর্তৃক প্রকাশিত অরাজ সাময়িকী ১-এ। বর্তমান সময়ের অন্যতম আলোচনার বিষয় হিসেবে ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রচুর আলোচনা হচ্ছে। তারই অংশ হিসেবে আমরা চেষ্টা করছি ডাকসু নিয়ে বিভিন্ন পক্ষ-বিপক্ষের মত প্রকাশ করছি। আমরা এ-বিষয়ে আলোচনা ও প্রবন্ধকে স্বাগত জানাই।

Sending
User Review
0 (0 votes)

লেখক সম্পর্কে

সম্পাদক বাংলাদেশের শিক্ষা

এই লেখাটি সম্পাদক কর্তৃক প্রকাশিত। মূল লেখার পরিচিত লেখার নিচে দেওয়া হয়েছে।

মন্তব্য লিখুন