আমাদের দেশে ঠিক কবে, কখন, কীভাবে কোচিং সেন্টারগুলোর জন্ম হল তা নিশ্চিত করে বলা যাবে না। তবে বর্তমানে যে আমরা একটি কোচিং রাজ্যে বসবাস করছি তা বলে দিতে হয় না, অলিতে গলিতে নানান ধরণের কোচিং সেন্টারের উপস্থিতিই তার জানান দেয়। নিয়ন্ত্রনহীনভাবে গড়ে ওঠা এই বিপুল সংখ্যক কোচিং সেন্টার ও প্রাইভেট পড়ানোর স্থানগুলো আমাদের ছাত্রছাত্রীদের যে জিম্মি করে ফেলছে তা সুস্পষ্ট। এই কোচিং নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারের লক্ষ্যে ঢাকার শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের সংগঠন “অভিভাবক ঐক্য ফোরাম” এর পক্ষ থেকে সম্প্রতি একটি রিট আবেদন করা হয়। এর প্রেক্ষিতে সরকারি ও এমপিওভুক্ত স্কুলের শিক্ষকদের কোচিং করানোর ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করে প্রজ্ঞাপন জারির কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করে হাইকোর্ট। তবে তা প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের কোচিংয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। হাইকোর্টের এই রিটের কারণে আমাদের মাঝে এমন আশা আকাঙ্ক্ষার জন্ম নিচ্ছে যে কোচিং ব্যবস্থা হয়ত এবার একটি নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে আসবে।
শিক্ষার্থীদের একাডেমিক পড়াশোনায় সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যেই মূলত কোচিং সেন্টার ব্যবস্থার জন্ম। কিন্তু ক্রমশ তা লাভজনক ব্যবসায়িক চিন্তাচেতনার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। এর অন্যতম কারণ শিক্ষকদের দুর্বল বেতন কাঠামো। এ কথা খুব জোর দিয়েই বলা যায় যে আমাদের দেশে শিক্ষকদের বিশেষ করে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের বেতন কাঠামো অত্যন্ত কম। দুর্মূল্যের এই বাজারে ঐ বেতন দিয়ে পরিবার নিয়ে মানসম্মতভাবে বেঁচে থাকাই দায়। ফলে শিক্ষকরা কোচিং সেন্টার পরিচালনা করতে কিংবা প্রাইভেট পড়াতে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন কালক্রমে। সেই সাথে যুক্ত হয়েছে উচ্চাভিলাস ও ব্যবসায়িক চিন্তাচেতনা। ফলে কোচিং সেন্টারগুলো মানের থেকে মুনাফার দিকেই নজর দেয় বেশি। অল্প জায়গায় অনেকগুলো ছেলেমেয়েকে ‘রেডিমেড জ্ঞান’ প্রদানই এর লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে। আরও দুঃখজনক বিষয় হল এই ‘রেডিমেড জ্ঞান’ দিয়ে পরীক্ষায় ভাল ফলও লাভ করা যাচ্ছে।
কোচিং সেন্টার শব্দের অর্থ ‘শিক্ষণ ও অনুশীলন কেন্দ্র’। যেখানে কোন কিছু নিয়মিত শেখা ও অনুশীলনের সুযোগ আছে সেটিই কোচিং সেন্টার। সেই হিসেবে বিদ্যালয়ও এক ধরণের কোচিং। কিন্তু কোচিং বলতে আমরা এখন বিশেষ এক ধরণের স্থানকে বুঝি যেটা বিদ্যালয়ের অতিরিক্ত। যে শিক্ষাটা বিদ্যলয়ের শ্রেণীকক্ষে সম্পন্ন হওয়ার কথা সেটা এই জামানায় কোচিং সেন্টারে সম্পন্ন হচ্ছে। বিদ্যালয় গমন এখন আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। হালে
পড়াশোনা বলতে যেটা বোঝানো হয় অর্থাৎ নোট প্রদান, বুঝে না বুঝে তা মুখস্ত করা ইত্যাদি কোচিং সেন্টারেই হয়। প্রয়োজন বা অপ্রয়োজনে কোচিংয়ে দৌঁড়ানো চাই। পাঁচজন যায় দেখে ষষ্ঠজনও আগ্রহী হয়। তবে শ্রেণীকক্ষে প্রকৃত শিখন-শিক্ষণ কার্যক্রমের ব্যর্থতাই কোচিং ব্যবস্থার প্রসারের জন্য দায়ী তা সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়। কোচিং এর কি প্রয়োজন নেই? এ প্রশ্নের ঊত্তর এক কথায় দেয়া দুষ্কর। এখানে অনেকগুলো বিষয় মাথায় রাখতে হবে। শ্রেণীকক্ষের সব শিক্ষার্থী একভাবে শেখে না। কারও সময় বেশি লাগে আবার কেউ মূহুর্তেই পড়া বুঝে ফেলে। যারা অগ্রনী শিক্ষার্থী তাদের জন্য আসলে কোচিং এ যাওয়ার কোন যৌক্তিকতা নেই। যাদের বিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষে পাঠ বোঝার সমস্যা থেকে যায় তারা সাহায্যের জন্যে কোচিং এ যেতে পারে কিন্তু সেটি খুবই স্বল্প পরিসরে ও প্রয়োজন সাপেক্ষে হওয়া উচিত। কখনই সেটি মূল ধারায় আসতে পারে না।
কোচিং এর প্রকারভেদ আছে। একাডেমিক পড়া পড়ানোর জন্য কোচিং, ভর্তি কোচিং এবং বিশেষ কোন পরীক্ষায় অংশগ্রহণের নিমিত্তে কোচিং। বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম অনুসরণ করে বার্ষিক, অর্ধবার্ষিক, মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় কাঙ্ক্ষিত ফলাফল লাভের জন্যে রয়েছে একাডেমিক কোচিং। কাঙ্ক্ষিত বিদ্যলয় বা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য ভর্তি কোচিং এবং আইইএলটিএস, টোফেল বা জিআরই বা বিসিএস পরীক্ষা দেয়ার জন্য প্রস্তুতি কোচিং। একাডেমিক কোচিংয়ের ক্ষেত্রে আবার দু’টো ধারা দেখা যায়। একটা হল প্রাতিষ্ঠানিক কোচিং এবং আরেকটি হল স্যার/ম্যাডামের বাসা বা ভাড়া করা কক্ষ।
কোচিং সেন্টার বা প্রাইভেট পড়ানোর বিষয়টি এখন পুরোদমে অনেক মানুষের পেশা। এই পেশা বা ব্যবস্থাটি গড়ে ওঠার পেছনে যে কারণগুলোকে দায়ী করা যায় তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে বিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষে শিক্ষা কার্যক্রমের মানের নিম্নগামীতা। স্বল্প সময়ের মধ্যে প্রতিটি শিক্ষার্থীকে পাঠ বোঝানো, আলোচনা ও মূল্যায়নের জন্যে পর্যাপ্ত সময় পাওয়া যায় না। সেক্ষেত্রে পাঠে দুর্বলতা থেকে যায় বহু শিক্ষার্থীর। তখন তারা শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়তে যায় বা কোচিং সেন্টারগামী হয়। তবে এমন অভিযোগ অহরহই পাওয়া যায় যে অনেক শিক্ষক প্রাইভেট পড়ানোর জন্যে ইচ্ছে করে শ্রেণীকক্ষে আন্তরিকভাবে পাঠদান করেন না। যারা তার কাছে প্রাইভেট পড়ে তাদেরকে পরীক্ষায় নম্বর বেশি দেয়া হয়। পরীক্ষায় অধিক নম্বরের আশায় অনেকেই শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়তে যায়। আবার দেখা যায় যে প্রাইভেটে শিক্ষক নোট প্রদান করেন। বয়সের ব্যবধানের কারণে সেই নোট শিক্ষার্থীদের নিজের তৈরি নোটের চেয়ে অধিক মানসম্পন্ন হয়। যে শিক্ষার্থী পরীক্ষার খাতায় শিক্ষকের নোট মুখস্ত করে উত্তর প্রদান করে তার নম্বর নিজে থেকে উত্তর লেখা শিক্ষার্থীর চেয়ে বেড়ে যায়। ফলে তৈরি হয় এক অসম প্রতিযোগিতা। শিক্ষক পরোক্ষভাবে শিক্ষার্থীর সাথে প্রতিযোগিতার মাঠে নেমে পড়েন। তখন যেই শিক্ষার্থী প্রাইভেট পড়তে কোচিং সেন্টারে যেত না সেও যেতে বাধ্য হয়। আমরা কেন সেরকম অসম প্রতিযোগিতার সুযোগ করে দেব? শিক্ষার্থী যদি শিক্ষকের নোট পড়ে পরীক্ষায় ভাল ফল করে তাহলে তার সৃজনশীলতা কোথায় গিয়ে ঠেকবে? তার প্রকৃত শিক্ষা তো অর্জিত হবে না। ক্রমেই সে শিক্ষকের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠবে। একসময়ে নিজে থেকে কোন কাজ করার সামর্থ্য সে হারিয়ে ফেলবে। অনেক অভিভাবকই মনে করেন কোচিং সেন্টারে বা প্রাইভেটে পড়লে ছেলেমেয়ে ভাল শিখবে কিন্তু ধারণাটি সবক্ষেত্রে সত্য নয়। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকেই আমরা দেখতে পাই, বিদ্যালয়ে পড়ালেখার পরিবেশ যে কোন কোচিং সেন্টারের চেয়ে অনেক উন্নত হয়। কোচিং সেন্টারে অল্প জায়গায় বহু সংখ্যক শিক্ষার্থীকে ঠাসাঠাসি করে বসিয়ে জ্ঞান গলধঃগরন করান হয়। সেই শর্টকাটে লাভ করা জ্ঞান কতটা কার্যকর তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
ভর্তি কোচিংয়ের চিত্র আরও ভয়াবহ। রাষ্ট্রের সকল নাগরিককে প্রাথমিক শিক্ষার আওতায় আনা যেখানে রাষ্ট্রের অবশ্য কর্তব্য সেখানে প্রাথমিক বা প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ে কাঙ্ক্ষিত বিদ্যালয়ে শিশুকে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে নিজের আসনটি সুনিশ্চিত করতে হয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যে শিশুটি ভর্তি হবে তার তো কিছু জানার কথা না যে সে ভর্তি পরীক্ষা দেবে। তাকে এ ধরণের পরীক্ষায় বসিয়ে দেয়াটা কোনক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণের সংস্কৃতি ঐ পর্যায়ের ভর্তি কোচিংগুলোকে টিকিয়ে রেখেছে। আবার বিশ্ববিদ্যলয় পর্যায়ে ভর্তি কোচিং এখন যেন উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীতে পড়ার মতই আবশ্যিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোচিং ব্যতীত কেউই আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে সাহস পায় না। অথচ প্রতি বছর একই সিস্টেমের প্রশ্নপত্রে বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজগুলো ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে থাকে। ওয়েবসাইট এবং ভর্তি নির্দেশিকায় প্রশ্নপত্রের ধরণ সম্পর্কে ধারণা দেয়া থাকলে কোচিং করার কোন প্রয়োজনই হওয়ার কথা নয়। কোচিং সেন্টারগুলো আমাদের শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাসের জায়গাটি নষ্ট করে দিয়েছে। ভর্তি কোচিং রোধেও কার্যকর নীতিমালা হওয়া প্রয়োজন।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কোচিং ব্যবস্থা চালু রয়েছে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। পাশের দেশ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে কোচিং ব্যবস্থা রয়েছে কিন্তু সেগুলো বিরুদ্ধে ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকরা অনেকদিন থেকেই আন্দোলন করছেন। কোচিং সেন্টার ও শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতা নিয়ে সেখানে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়েছে। মালয়েশিয়াতে স্বল্প পরিসরে কোচিং বা প্রাইভেট পড়ানোর বিষয়টি দেখা যায়। কিন্তু সেখানে শ্রেণীকক্ষে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা হয় বলে ছেলেমেয়েদের কোচিংয়ে যাওয়ার প্রবণতা অনেক কম। কোন বিশেষ বিষয়ে দুর্বলতা থাকলে হয়ত কেউ সংশ্লিষ্ট বিষয়ের কোন শিক্ষকের শরণাপন্ন হয়। কিন্তু তা কোনভাবেই গণহারে নয়।
কোচিং সেন্টার এবং প্রাইভেট পড়ানোর ক্ষেত্রে একটি সুস্পষ্ট ও গ্রহণযোগ্য নীতিমালা সকলেরই কাম্য। কোচিং সেন্টার থেকে শিক্ষা যেন শ্রেণীকক্ষে ফিরে আসে সেটিও নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষা বিশেষজ্ঞ, শিক্ষক ও শিক্ষা প্রশাসকদের সাথে আলোচনা করে শ্রেণীকক্ষে মানসম্মত শিক্ষাদান কার্যক্রম নিশ্চিত করে কোচিং ব্যবস্থাকে সীমিত আকারে নিয়ে আসা প্রয়োজন। সরকারি অনুমোদনক্রমে বিশেষ নীতিমালার আওতায় স্বল্প সংখ্যক কোচিং সেন্টার থাকতে পারে কিন্তু তা যেন বিদ্যালয়ের বিকল্প হয়ে না ওঠে। শিক্ষকগণ যেন শ্রেণী কার্যক্রমে মনোযোগী হন সেজন্যে তাদের জন্য যুগোপযুগী বেতন কাঠামো নিশ্চিত করেই কোচিং ব্যবস্থা ও প্রাইভেট পড়ানো বন্ধ করা কিংবা কমিয়ে আনা সম্ভব। নতুবা জোর করে কোচিং বন্ধ করলেও শ্রেণীকক্ষের শিক্ষার মান উন্নত হবে না। শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। শিক্ষা নিয়ে আপোষ করার কোন সুযোগ নেই। তাই সুশিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক, যুগোপযুগী এবং বৈজ্ঞানিক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন এবং তা বিদ্যালয়কে কেন্দ্র করেই, কোচিং সেন্টারকে নয়।
লেখক পরিচিতি
আহমদ ইকরাম আনাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে শিক্ষাজীবন সম্পন্ন করে শিক্ষার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখালেখি করছেন।