গত ১৪ আগস্ট ২০২৩ জাতীয় দৈনিক সমকাল পত্রিকা থেকে জানতে পারলাম ‘পরীক্ষা কেন্দ্রের সুষ্ঠু পরিবেশ রক্ষায়’ বিভাগের চেয়ারম্যানের মাধ্যমে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বরাবর দরখাস্ত দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী। পরীক্ষা ব্যবস্থাকে যথাযথ রাখতে আমি এই শিক্ষার্থীর সাহসিকতার প্রশংসা না করে পারছি না।
আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলাম, তখন কোনো এক সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষার সময় অর্থনীতি পরীক্ষা চলছিলো। হলে গার্ড দিচ্ছিলেন ইংরেজির একজন নবাগত শিক্ষক। তিনি পরীক্ষার হলে প্রবেশ করেই অনেক উচ্চস্বরে কথা বলছিলেন। তিনি যে নির্দেশনাই দিতেন সেটি এতোটা উচ্চস্বরে বলতেন— যেটি আমার কানে লাগছিলো।
কিন্তু কী করে বলি একজন শিক্ষককে যে তাঁর উচ্চস্বরে কথা বলা আমার বিরক্তির কারণ হচ্ছে? পরীক্ষার আগের রাতে আমি সারারাত জেগে পড়েছি, সকালে ভালোভাবে নাস্তাও করিনি। তাছাড়া অর্থনীতি বিষয়টি আমার কাছে ইতিহাসের সাল মুখস্তের চেয়েও খটকা লাগতো।
তাঁর চিৎকার-চেঁচামেচিতে পরীক্ষার হলে যখন কিছুই লিখতে পারছিলাম না, সবকিছু ব্রেইন-আউট হয়ে যাচ্ছিলো তখন আমি রেগে গিয়ে খাতা জমা দিয়ে পরীক্ষার হল থেকে বের হয়ে যাই। মনে হয়, পঁচিশ মিনিটের মাথায় আমি বের হয়েছিলাম। তিনি আমার কোনো সমস্যার কথা জানতে না চেয়ে খাতা জমা রেখে দেন। পরবর্তী ব্যাচের সাথে আমি অসমাপ্ত পরীক্ষাটি সম্পন্ন করি। তাঁর কারণে আমার যে সার্বিক ক্ষতি হয়, সেটি ছিলো অপূরণীয়।
কয়েকদিন আগে আমার সন্তান এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়। পরীক্ষার হলে নির্দষ্ট সময়ের ত্রিশ মিনিট পূর্বে উপস্থিত হওয়ার কথা। সে মতে, অভিভাবক হিসেবে আমি নির্দিষ্ট সময়ের আগেই তাকে কেন্দ্রে পৌছে দিই। কেন্দ্রের মুখে পুলিশ থাকে, তারপরও কেন্দ্রে প্রবেশের রাস্তাটিতে থাকতো মারাত্নক ভিড়। শিশুরা অভিভাবকের ভিড় ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করতে ভয় পেতো।
পরীক্ষার হলে প্রবেশ করে কর্তব্যরত শিক্ষকদের নানারকম ভুলের কারণে সঠিক সময়ে পরীক্ষা শুরু করতে পারেনি অনেক শিশু। শুনেছি ওই কেন্দ্রে ভুল করে ভিন্ন প্রশ্নপত্র চলে গিয়েছিলো। সেটি শুধরাতে প্রায় কুড়ি মিনিট লেগে যায় কেন্দ্র ব্যবস্থাপকদের। তিন ঘণ্টার পরীক্ষা কিন্তু তিন ঘণ্টাই হয়েছিলো সেদিন, কিন্তু এই ভুল নিয়ে কেউ কোনো উচ্চবাচ্য করেনি।
যে সকল কেন্দ্রের পরীক্ষার্থী সেদিন পূর্ণ সময় পরীক্ষা দিতে পেরেছে, তারা নিশ্চিত আমার সন্তানের চেয়ে বেশি লিখতে পেরেছে। সেটি ফলাফলে তারতম্য সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট নয় কি? এদিকে কুড়ি মিনিট কম পাওয়া শিক্ষার্থীদের মনের অবস্থা একটু বুঝুন! এ নিয়ে আমি লিখিত অভিযোগ করতে চাইলে আমাদের সন্তান এবং আমার স্ত্রী নিষেধ করলো। তাদের কথা হচ্ছে, এটা ছেলের ফলাফলে আরও বেশি ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে। সংশ্লিষ্ট শিক্ষকগণ নানাভাবে তাকে অসহযোগিতা করতে পারে।
এসএসসি পরীক্ষায় বর্তমান সময়ের কেন্দ্রের ভিতরের অভিজ্ঞতা আমরা সন্তানদের থেকেই পেয়ে যাই। একটু ভালো পারা শিক্ষার্থীদেরকে বাধ্যতামূলকভাবে নিজের খাতা ছেড়ে দিতে হয় পুরো হাউজে। আর অন্যান্য অপেক্ষাকৃত কম পারগ শিক্ষার্থীরা প্রয়োজনমতো সেখান থেকে টুকলি করে পরীক্ষা দেয়।
নিজের খাতা যখন নিজের কাছে থাকে না, সেখানে একজন শিক্ষার্থীর মনের অবস্থা কী হয়? একটু ভেবে দেখুন তো! আমি বিশ্বাস করি, ভালো ফলাফল সবারই করার অধিকার রয়েছে; কিন্তু সেটি একটি নিয়মতান্ত্রিক উপায়েই হতে হবে। কতক শিক্ষার্থীকে মানসিক চাপে রেখে পরীক্ষা ব্যবস্থাপনা একটি অপরাধ।
আমার জীবনে পরীক্ষা বিষয়ে আমি সবচেয়ে বেশি অভিজ্ঞতা লাভ করেছি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। এখানে লেখাপড়া করে কোমলমোতি শিশুরা, যাদের বয়স ৬-১১ বছরের মধ্যে। পরীক্ষা ব্যবস্থাকে তাদের কাছে ভীতি হিসেবে তুলে ধরা হয়, এবং এটি সযতনে করে থাকে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরাই। যেহেতু এই বয়সী শিশুরা প্রতিবাদ কিংবা প্রত্যুত্তরে অপারগ বা দুর্বল, সেই সুযোগটি নিয়ে থাকেন শিক্ষকেরা। চিৎকার-চেঁচামেচি, উচ্চস্বরে কথা বলা এবং কিছু না বোঝার দায়ে শিশুকে নানারকম ভর্ৎসনা দেয়া একটি নৈমত্তিক বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। পরীক্ষার হলে শিক্ষকদের এহেন আচরণে শিশুরা ভয়ে-আতঙ্কে পরীক্ষার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে।
প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি ঘটে থাকে স্বজনপ্রীতি। অর্থাৎ শিশুরা যদি একটু সম্ভ্রান্ত পরিবারের হয়, যদি শিশুটি কোনো শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়ে, তবেই তার জন্য থাকে বিশেষ খাতির-যত্ন এবং পরীক্ষায় অধিক নাম্বার। এভাবে একটি বৈষম্যমূলক অবস্থার মধ্যদিয়ে শিশুরা নিভৃতে বড় হচ্ছে যা নীরবে তাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে।
আমাদের দেশে পরীক্ষা শুরুর পূর্বে নানারকম ওরিয়েন্টেশন হয়ে থাকে যেখানে প্রাধান্য পায় পরীক্ষার প্রশ্নপত্র/খাতা সংগ্রহ, বিতরণ এবং পরীক্ষা শেষে সেগুলি গোপনীয়তার সাথে সংরক্ষণ এসব বিষয়ে। হয়তো আসন ব্যবস্থা, হল পরিদর্শন এসব বিষয়েও নানারকম আলোচনা হয়ে থাকে। এসবের সাথে সাথে খুব বেশি জরুরি পরীক্ষা শুরুর পূর্ব থেকে পরীক্ষা শেষ হওয়া পর্যন্ত শিশুদের/শিক্ষার্থীদের মনোসামাজিক সুরক্ষার বিষয়টিতে প্রাধান্য দেয়া।
আমাদের দেশের পরীক্ষা পদ্ধতির মূল্য লক্ষ্য হচ্ছে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, শিক্ষা প্রশাসন এবং অভিভাবকদেরকে ফিডব্যাক (ফলাবর্তন) প্রদান। অর্থাৎ শিক্ষার্থী পরীক্ষায় খারাপ ফলাফল করলে যে এটা সংশ্লিষ্ট অংশীজনের জন্যও ভালো বিষয় নয় এবং সংশ্লিষ্টদেরকে আরও বেশি সচেষ্ট এবং সচেতন হতে হবে সে বিষয়ে কারও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলে সেই দায়ভার শিক্ষার্থীকেই নিতে হয়। কখনো কখনো মানসিক চাপে শিক্ষার্থীরা বিপদগামী হয়ে পড়ে, এমনকি আত্নহননের পথও বেছে নেয়।
আমরা কখনো কি শুনেছি যে একটি বিদ্যালয়ে একজন শিক্ষার্থী পাশ না করাতে কোনো শিক্ষক আত্নহননের পথ বেছে নিয়েছেন? আমরা চাই না যে, শিক্ষাসংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তিই শিক্ষার্থীর ফলাফলে বিপথগামী হোক কিংবা প্রাণ হারাক, তবে পরীক্ষা ব্যবস্থাকে অতটা হালকা ভাবে নেয়াও সমীচিন হবে না। পরীক্ষার ফলাফল ভালো করার যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা শিক্ষার্থীসহ সকলের আরামকে হারাম করে দিচ্ছে সেটা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
বাংলাদেশের শিক্ষায় সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে লেবেলিং। শিশুকে লেবেলিং, ফলাফলকে লেবেলিং, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে লেবেলিং, শিক্ষা মাধ্যমকে লেবেলিং— যার কারণে শিশুর মানসসত্ত্বাকে অঙ্কুরেই বিনাশ করা হচ্ছে। সবকিছুকে লেবেলিং-এর অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে মূল্যায়ন, তুলনা এবং অনুকরণ। একটি প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত শিক্ষার্থীকে তৈরি করা এবং পরীক্ষা হচ্ছে সে লক্ষ্যে পৌছে দেয়ার একটি উৎকৃষ্ট মাধ্যম। বর্তমানে শেখাটা গৌণ হয়ে পড়েছে, মূখ্য হচ্ছে ফলাফল অর্জন সেটিও গুণগত নয়, কেবলই পরিমাণগত।
পরীক্ষা ব্যবস্থাকে কার্যকর এবং সুখকর করতে হলে কতোগুলো বিষয়ে শিক্ষা কর্তৃপক্ষকে দৃষ্টি দিতে হবে।
প্রথমত, পরীক্ষা বিষয়ে শিক্ষার্থী যেন কোনোরকম মানসিক চাপে না থাকে সে জন্য ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে।
দ্বিতীয়ত, শিক্ষার্থীর সংস্পর্শে যে সকল ব্যক্তিবর্গ থাকেন তাদেরকে সচেতন করতে হবে, যাতে তারা শিক্ষার্থীকে প্রেসার না দিয়ে মনোসামাজিক সহযোগিতা দিতে পারেন।
তৃতীয়ত, পরীক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট সকল কর্মকর্তা-কর্মচারিকে শিক্ষার্থীর মনোসামাজিক সহায়তার ওপর বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। যে সকল শিক্ষকের এ ধরনের প্রশিক্ষণ বা দক্ষতা থাকবে না তাদেরকে পরীক্ষা গ্রহণ থেকে শুরু করে পরীক্ষার খাতাকাটাসহ সকল ধরনের কাজের বাইরে রাখতে হবে। সর্বোপরি, পরীক্ষা ব্যবস্থাকে কার্যকর করার জন্য যে বিদ্যমান ঘাটতি রয়েছে সেগুলি চিহ্নিত করে সমাধানের যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।
আমরা পরীক্ষা ব্যবস্থাকে আনন্দময় করতে পারিনি। সেটা আমাদের ব্যর্থতা। সেই ব্যর্থতা দূর না করে কতক শ্রেণির জন্য পরীক্ষা বাতিল করে আমরা আরেকটি ব্যর্থতার প্রমাণ দিয়েছি।
বর্তমানে মূল্যায়ন নামক যে ব্যবস্থা শ্রেণি শিক্ষকের হাতে ন্যস্ত হয়েছে, সে বিষয়ে বাংলাদেশের এনজিওসমূহের অভিজ্ঞতা ব্যাপক। সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সরকার চাইলে পরীক্ষা ব্যবস্থাকে কিংবা মূল্যায়ন ব্যবস্থাকে শিক্ষার্থীর শিখনের জন্য কার্যকর করতে পারে। আশা করছি খুব শিগগির শিক্ষার্থী এবং পরীক্ষার্থীদের জন্য সকল পরীক্ষা বা মূল্যায়ন ব্যবস্থা সুসংগঠিত ভাবে পরিচালিত হবে।
লেখক পরিচিতি
মো: সাইদুল হক বাংলাদেশে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় শিক্ষাবিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।
Visitor Rating: 5 Stars
মূল্যায়ন হলো শিশুদের প্রতিভা যাচাইয়ের একটি মাধ্যম। যার মাধ্যমে শিশু্দের শেখার আগ্রহ বৃদ্বি পায়, চিন্তাও চেতনায় উদ্দোমী হতে সাহায্য করে। মূল্যায়ন ব্যবস্থাকে আনন্দময়ী করতে হলে মূল্যায়ন ব্যবস্থায় বাস্তবমুখি ও পরিবেশগত ব্যবহারিক মূল্যায়ন সংযোজন করা প্রয়োজন।
Visitor Rating: 5 Stars