বিরোধী দলের চলমান অবরোধ কর্মসূচির মধ্যেই গত ২ জানুয়ারি বিদ্যালয় থেকে নতুন পাঠ্যপুস্তক নিয়ে বাড়ি ফিরেছে শিক্ষার্থীরা। দেশজুড়ে এ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। শিক্ষাবর্ষের প্রথম কর্মদিবসে ‘পাঠ্যপুস্তক উৎসব’ করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেওয়া হয়।
দেশে এ উৎসব শুরু হয় ২০১০ সাল থেকে। ২০১০ সাল থেকে প্রতিবছর এক উৎসবমুখর পরিবেশে শিক্ষার্থীরা স্ব স্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে নতুন বই হাতে নিয়ে বাড়ি ফিরে। এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য!
এরই ধারাবাহিকতায় এ বছর (২০১৪ সালেও) এ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। কেন্দ্রীয়ভাবে রাজধানীর গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুল চত্বরে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। উৎসবের উদ্বোধন করেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। অনুষ্ঠানে গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুল ছাড়াও বিসিএসআইআর উচচ বিদ্যালয়, ধানমণ্ডি গভ. উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়, কামরুন্নেছা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও হাফেজ আবদুর রাজ্জাক দাখিল মাদ্রসার কয়েক হাজার শিক্ষার্থী অংশ নেয়। তারা নেচেগেয়ে নতুন বই নেড়ে, আনন্দ করে, প্লাকার্ড-ফেস্টুন নেড়ে, বেলুন উড়িয়ে অনুষ্ঠানকে উৎসবের রূপ দেয়।
২০১০ সাল থেকে প্রতিবছর এক উৎসবমুখর পরিবেশে শিক্ষার্থীরা স্ব স্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে নতুন বই হাতে নিয়ে বাড়ি ফিরে। এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য!
যদিও পুরো দেশে বিরাজ করছে এক চরম অনিশ্চিত ও অস্থির পরিবেশ। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে সরকার ২০১০ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের সাড়ে ষোল কোটি শিক্ষার্থীর মধ্যে বছরের প্রথম কার্যদিবসে বিনামূল্যে পৌঁছে দিয়ে অনন্য রেকর্ড সৃষ্টি করেছে।
জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রথমবারের মতো ৫১ হাজার স্কুলে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা চালু করা হয়েছে। সেখানে ৬০ লাখ ১৬ হাজার ৫১৬ জন শিক্ষার্থীর জন্য এক কোটি ৮০ লাখ বই ছাপানো হয়েছে। এবার প্রাথমিক, ইবতেদায়ী, মাধ্যমিক, দাখিল ও কারিগরি বিদ্যালয়ের ৩ কোটি ৭৩ লাখ ৩৬ হাজার ৬৭২ জন ছাত্রছাত্রীর মধ্যে ২৬৮টি বিষয়ের মোট ২৯ কোটি ৯৬ লাখ ৭৫ হাজার ৯৩৮ কপি বই বিনামূল্যে বিতরণের জন্য ছাপা হয়েছে।
২০১০ সালে ২ কোটি ৭৬ লাখ ৬২ হাজার ৫২৯ শিক্ষাথীর মধ্যে ১৯ কোটি ৯০ লাখ ৯৬ হাজার ৫৬১টি বই, ২০১১ সালে ৩ কোটি ২২ লাখ ২১ হাজার ২৩৪টি বই, ২০১২ সালে ৩ কোটি ১২ লাখ ১৩ হাজর ৭৫৯ শিক্ষার্থীর মধ্যে ২২ কোটি ১০ লাখ ৬৮ হাজার ৩৩৩টি বই, ২০১৩ সালে ৩ কোটি ৬৮ লাখ ৮৬ হাজার ১৭২ শিক্ষার্থীর মধ্যে ২৬ কোটি ১৮ লাখ ৯ হাজার ১০৬টি বই বিতরণ করা হয়।
এতকিছুর মধ্যে যথারীতি বই ছাপানো, বাঁধাই করা ও সারা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠানো সত্যিই চ্যালেঞ্জের কাজ ছিল। এনসিটিবিসহ শিক্ষা পরিবারের সদস্যরা দিনরাত পরিশ্রম করে তা বাস্তবায়ন করেছে বলে শিক্ষামন্ত্রী উল্লেখ করেন।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের সব পাঠ্যপুস্তক এনসিটিবির ওয়েব সাইটে ই-বুক ফর্মে দেওয়া আছে। সেখানে থেকে যে কেউ তা ডাউনলোড করতে পারবে। এটি এটি ভালো পদক্ষেপ। তবে শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট অনেকের কাছে পুস্তক এখন আর সহজলভ্য বিষয় নয়। কারণ বই বাজারে কিনতে পাওয়া যায় না।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাঠ পর্যায়ের শিক্ষা কর্মকর্তাবৃন্দ শিক্ষা নিয়ে বেসরকারি পর্যায়ে যারা কাজ করছে, তাদের বিষয়ে সঠিকভাবে অবগত নন। ফলে তাদের বিনামূল্যের বই পেতে অনেক কাঠখড় পোহাতে হচ্ছে। আমি নিজেও কেন্দ্রে থেকে এবং এনসিটিবির সাথে বার বার যোগাযোগ করেও কোনো বই আনতে পারিনি। এ বিষয়টি শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে ভাবতে হবে। আর ওয়েব সাইট থেকে ডাইনলোড করা দেশের সব প্রান্তে খুব সহজ কাজ নয়।
তবে নতুন বই বিনামূল্যে বিতরণের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পজিটিভ দিক রয়েছে। যেমন: গ্রাম ও বস্তির অনেক অভিভাবকই বই কিনতে পারে না। তারা শিক্ষার্থীদের স্কুলে পাঠাতে অতটা আগ্রহী হয়ে ওঠে না। বিনামূল্যে বই পাওয়ায় ছাত্রছাত্রীদের স্কুলে যাওয়ার উৎসাহ যেমন বেড়ে যায়, তেমনি শিক্ষার্থী ড্রপ আউটের সংখ্যাও কমে।
দ্বিতীয়ত, নতুন বই হাতে পাওয়া এবং নতুন বইয়ের গন্ধ শুঁকে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা যে আনন্দ পায়, তা অর্থ দিয়ে ক্রয় করা যায় না। আমরা তো শিক্ষার্থীদের কোনো ধরনের আনন্দ দিতে পারি না! ক্লাসরুমকে আকর্ষণীয় করতে পারি না, কিন্তু নতুন বই তাদের সেই আনন্দ পুষিয়ে দেয়।
নতুন বই স্কুল এবং কমিউনিটির সাথে এক অদ্ভুত সম্পর্ক সৃষ্টি করে। যেহেতু স্কুল থেকে বই দেওয়া হয়, অভিভাবকরা বই নিতে আসেন, শিক্ষক-অভিভাবক এবং স্কুলের মধ্যে এক নতুন সম্পর্কের সৃষ্টি হয় যা শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের সব পাঠ্যপুস্তক এনসিটিবির ওয়েব সাইটে ই-বুক ফর্মে দেওয়া আছে। সেখানে থেকে যে কেউ তা ডাউনলোড করতে পারবে। এটি এটি ভালো পদক্ষেপ। তবে শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট অনেকের কাছে পুস্তক এখন আর সহজলভ্য বিষয় নয়। কারণ বই বাজারে কিনতে পাওয়া যায় না।
আমাদের দেশে পাঠ্যপুস্তক বিতরণের সাথে একটি অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে চাচ্ছি। ব্র্যাক শিক্ষা কার্যক্রম বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে কাজ করছে। সেই সুবাদে অন্য দুএকটি দেশের পাঠ্যপুস্তক সম্পর্কে কিছুটা ধারণা জন্মেছে। কয়েকদিন আগে সিয়েরা লিয়নের প্রাথমিক (প্রথম থেকে ষষ্ঠ শ্রেণি) এবং জুনিয়র সেকেন্ডারি (সপ্তম – নবম) পর্যায়ের পাঠ্যপুস্তক দেখার সুযোগ হয়েছিল।
গণিত ও বিজ্ঞানের চমৎকার বই রঙিন এবং প্রয়োজনীয় ছবি সংবলিত। সিয়েরা লিয়নে প্রাথমিক পর্যায় পর্যন্ত বই বিনামূল্যে দেওয়া হয়। তার পরবর্তী পর্যায়ের বই শিক্ষার্থীদের কিনতে হয়। এদেশে কোনো পর্যায়েই সকল শিক্ষার্থীদের নিকট বই থাকে না। বই দেওয়া হয় গ্রুপে।
এর দুটি কারণ আছে। একটি হচ্ছে বইয়ের কাগজ, কভার, ছাপা, ইলাসট্রেশন খুব উন্নতমানের বিধায় দাম খুব বেশি যা সব অভিভাবক কিনতে পারেন না। দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে, শিক্ষার্থীদেরকে বই বাসায় নিয়ে যেতে নিরুৎসাহিত করা হয়। তবে বাসায় তাদেরকে বিভিন্ন ধরনের প্রজেক্ট ওয়ার্ক দেওয়া হয়। অর্থাৎ তাদেরকে নিজেদের কাজের মাধ্যমে সৃজনশীল হতে উৎসাহিত করা হয়। বাসার প্রজেক্টগুলো ক্লাসে বই পড়ার উপর ভিত্তি করে করতে দেওয়া হয়।
এর সাথে বেশ কয়েকটি বিষয় চলে আসে। শিক্ষার্থীদের পড়ার চাপ এবং পড়াশুনার প্রতি যে একটি ভীতি, সেটি থাকছে না। শুধু পুস্তকনির্ভর হলে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতার স্থান কোথায়? আমদের দেশে যেমন নোট ও গাইড বইয়ের ছড়াছড়ি, এ অবস্থাটি এখনও সেখানে তৈরি হয়নি। প্রাইভেট টিউশনিও নেই। কারণ পুস্তকনির্ভর পড়া, গাদাগাদা পড়া, শিক্ষকের দেওয়া বই-নির্ভর হোমওয়ার্ক ইত্যাদি সেখানে নেই। শিক্ষা মনে শুধু বই, নোট, প্রাইভেট পড়া- এ ব্যাপারগুলো সেখানে এখনেও গড়ে ওঠেনি।
আরেকটি বিষয় উল্লেখ না করে পারছি না। বিরোধী জোটের টানা হরতাল অবরোধ সব ধরনের শিক্ষার্থীরাই অবর্ণনীয় দুর্ভোগের এবং টেনশনের শিকার হচ্ছে। বিশেষ করে জেএসসি, এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষা বার বার পেছাতে হয়েছিল রাজনৈতিক এসব কর্মকাণ্ডের কারণে। পেছাতে হয়েছিল সব স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষাও। শেষ পর্যন্ত অনেক স্কুল অনেক পরীক্ষ বাদ দিয়ে শুধু কয়েকটি বিষয়কে বিবেচনায় নিয়ে ফল তৈরি করেছে।
এখানে বিরোধী জোট দুটো কাজ করতে পারতো। একটি হচ্ছে এক সপ্তাহ কিংবা দশদিনের মধ্যে পরীক্ষাগুলো নেওয়ার জন্য স্কুলগুলোকে অনুরোধ করতে পারতো যে সময় তারা রাজনৈতিক কোনো কর্মসূচি দিবে না। অবশ্য সরকার সে প্রস্তাব মানতো কি না সন্দেহ। তারপরেও তারা এ কাজটি করতে পারতো।
দ্বিতীয়টি হচ্ছে তারা শিক্ষার্থীদের নিকট দুঃখ প্রকাশ করতে পারতো এই বলে যে, আমাদের দাবি আদায়ের জন্য হরতাল-অবরোধ ছাড়া বিকল্প কোনো পথ খোলা নেই। তাই তোমাদের কষ্ট দিয়েও চালু রাখতে হয়েছে পার্টির কার্যাবলী। তাও তারা করেনি। এতেই বুঝা যায়, আমাদের বর্তমান রাজনীতির ধারা শিক্ষার জন্য কতটা বন্ধুসুলভ? তারপরেও এগিয়ে যেতে হবে আমাদের।
লেখক পরিচিতি
মাছুম বিল্লাহ বাংলাদেশে ইংলিশ টিচার্স অ্যাসেসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইট্যাব)-এর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি পূর্বে ক্যাডেট কলেজ ও রাজউক কলেজের শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন। কাজ করেছেন ব্র্যাকের শিক্ষা কর্মসূচিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে। তিনি ভাব বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসেবেও কর্মরত রয়েছেন। তিনি নিয়মিত শিক্ষাবিষয়ে নানা প্রবন্ধ লিখছেন।