জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর সুপারিশের আলোকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক শিক্ষা আইন ২০১৩-এর খসড়া প্রণয়ন করা হয়। খসড়াটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেয়া হয়েছে সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে ফিডব্যাক নেয়ার জন্য। এটি একটি ভালো উদ্যোগ।

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর সুপারিশের আলোকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক শিক্ষা আইন ২০১৩-এর খসড়া প্রণয়ন করা হয়। খসড়াটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেয়া হয়েছে সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে ফিডব্যাক নেয়ার জন্য। এটি একটি ভালো উদ্যোগ। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় এখানে উল্লেখ করার মতো।

শিশুদেরকে শিক্ষায় আগ্রহী করে তোলার নিমিত্তে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা চালু করা হবে। প্র্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার  বয়স ৪-৬ বছর, সকল শিশুকে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা প্রদান করা হবে। সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়/এবতেদায়ী মাদ্রাসায় প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা চালু করা হবে। কিন্তু প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হবেন কারা তার উল্লেখ নেই, উল্লেখ থাকলে ভাল হতো। প্রাথমিক স্তরে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি ও সকল ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জন্য স্ব-স্ব মাতৃভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা করা হবে। একই সাথে প্রতিবন্ধী, অটিস্টিক, কর্মজীবি ও সুবিধাবঞ্চিত ও শিশুদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহল করা হবে। সেই উপযুক্ত ব্যবস্থাগুলো কী তা উল্লেখ করা হলে ব্যাপারটি আরও পরিস্কার হতো। আর তা না হলে ব্যাপারটি থেকে যাবে ভাসা ভাসা এবং ধরাছোঁয়ার বাইরে।

অটিস্টিক, শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থাপনায় পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যসূচি প্রণয়ন করা হবে। সেই বিশেষ ব্যবস্থার দু-একটি উল্লেখ করলে ভালো হতো। কারণ এ ব্যাপারে আসলেই কিছু হবে কিনা সন্দেহের উদ্রেক করে। জনগোষ্ঠির একটি বড় অংশ অটিস্টিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী। তাদের শিক্ষার আসলে কোনো ব্যবস্থা নেই। বেসরকারি পর্যায়ে কিছু আছে, তবে তা নিতান্তই অপ্রতুল।

মাধ্যমিক স্তরের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে নির্ধারিত কর্তৃপক্ষের নিকট বাধ্যতামূলকভাবে নিবন্ধন করতে হবে এবং পাঠদানের জন্য উপযুক্ত কর্তপক্ষের অনুমতি লাগবে। তবে সেটি যেন জটিল এবং উৎকোচ গ্রহণের পথ সুগম করে না দেয় সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। শিক্ষা থাকবে উন্মুক্ত, রেশনিং-এর আওতায় যেন আনা না হয়।

’ও’ এবং ’এ’ লেভেল শিক্ষাদান কার্যক্রম সরকারি অনুমোদন-সাপেক্ষে পরিচালনা করা হবে। সাধারণ ধারার  সমপর্যায়ের বাংলা ও বাংলাদেশ স্টাডিজ বিষয়সমূহ পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এটি একটি ভালো উদ্যোগ। তবে মাউসি-তে যে ঘুষ ও মাথা-সমান দুর্নীতি হয়, ইংরেজি মাধ্যমে সরকারি নিয়ন্ত্রণ চালু হলে সেরকম যাতে না হয় সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে। ইংরেজি মাধ্যমের বেতন ও অন্যান্য ফি সরকার বা উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের অনুমোদন-সাপেক্ষে নির্ধারণ করা হবে। নিয়ন্ত্রণের নামে সেখানেও যাতে দুনীতি না ঢোকে যা বোর্ড এবং মাউসি-তে হচ্ছে। তবে উদ্দেশ্য ভালো।

মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কমপক্ষে একজন পূর্ণকালীন অথবা খণ্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে যিনি প্রতিবন্ধীসহ অনগ্রসর শিশুদের শিক্ষায় বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হবেন। এটি একটি চমৎকার উদ্যোগ। নতুন শিক্ষকদের নিয়োগের এক বছরের মধ্যে বুনিয়াদি প্রশিক্ষণসহ চলমান বিষয়ভিত্তিক  প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হবে। পরিবর্তিত নতুন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি প্রবর্তনের পূর্বেই শিক্ষকদের সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান প্রদানের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ, তবে বাস্তবায়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রধান শিক্ষা পরিদর্শক নামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একটি পদ সৃষ্টি করা হবে যা খুব একটা স্পষ্ট নয়।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নির্বাচিত সভাপতিকে ন্যূনতম স্নাতক পাশ হতে হবে। নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ, তবে নিশ্চিত করতে হবে তার সার্টিফিকেট কে দেখবে। রাজনৈতিক ব্যক্তি যাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কার্যাবলীকে প্রভাবিত করতে না পারে সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে। এটি যেন কথার কথা না হয়, বাস্তবেই যেন ঘটে।

উচ্চশিক্ষা গ্রহণ হবে মাতৃভাষার ম্যধ্যমে- ভালো কথা কিন্তু ইংরেজিতে পিছিয়ে থাকা যাবে না। জ্ঞানের ভাণ্ডার উন্মুক্ত করতে ইংরেজি বই পড়তে হবে আর সেজন্য দরকার এই ভাষা সুন্দরভাবে রপ্ত করা। আধুনিক যুগের চাকুরির ক্ষেত্রে (দেশে এবং বিদেশে) ইংরেজি ভাষা ব্যবহারের দক্ষতা উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিদের অবশ্যই থাকতে হবে। শুধু গ্রাজুয়েট তৈরি করে লাভ নেই, তাতে বেকারত্ব ও শিক্ষিতদের মধ্যে হতাশা বাড়বে। স্নাতক পর্যায়ের সকল কোর্সে ন্যূনতম ১০০ নম্বরের অথবা তিন ক্রেডিট ইংরেজি বিষয় অধ্যয়ন বাধ্যতামূলক করা দরকার। সেখানে শিক্ষার্থীরা  কী পড়বে- কমিউনিকেটিভ ইংরেজি, না গ্রামার নাকি ইংরেজি সাহিত্য বিষয়টি স্পষ্ট করতে হবে।

ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের মেধা ও যোগ্যতা অনুযায়ী দেশের প্রকৌশল বিশ্বাবিদ্যালয়সমূহে উচ্চতর শিক্ষার জন্য  ক্রেডিট সমন্বয় এবং ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করা হবে। নিঃসন্দেহে ভালো পদক্ষেপ। কারণ শিক্ষা উন্মুক্ত থাকতে হবে মেধাবীদের জন্য।

মাদরাসা শিক্ষায় সাধারণ ধারার মতো চার বছরমেয়াদি ফাজিল অনার্স এবং এক বছরমেয়াদি কামিল কোর্স  ক্রমান্বয়ে চালু করা হবে। ভালো পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে। ফাজিল ও কামিল পর্যায়ে শিক্ষাক্রম অনুমোদন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমুহের তদারকি ও পরিবীক্ষণ এবং পরীক্ষা পরিচলনার জন্য দেশে একটি অনুমোদনকারী (এফিলিয়েটিং) ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হবে বলে শিক্ষা আইনে বলা হয়েছে। কিন্তু মাদরাসা লেভেলে আরেকটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজন আছে কি? বর্তমানের ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় দ্বারাই চালানো যায় কিনা তা চিন্তা করে দেখা দরকার। আমাদের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার মান উন্নয়নকল্পে কোনো ধরনের কার্যকর পদক্ষেপ সত্যিকার অর্থে আজও নিতে পারেনি।

দেশে এবং বিদেশে নার্সিং পেশার ক্রমবর্ধমান চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে মানসম্মত নার্সিং শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে পর্যায়ক্রমে কলেজে বিএসসি এবং এমএসসি নার্সিং খোলার উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। সকল সরকারি -বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সঙ্গে নার্সিং ও প্যারামেডিকেল শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলন করা হবে। খুব ভালো সিদ্ধান্ত। মেডিকেল তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় অথবা ইনস্টিটিউট করা হবে- বিদ্যমান মেডিকেল কলেজের মান যাচাই ও নতুন বেসরকারি মেডিকেল কলেজ অনুমোদনের সময় প্রকল্পের যথাযথ অনুমোদনের জন্য।

উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে শিক্ষার্থী বেতন ও অন্যান্য ফি-সমূহ যৌক্তিক হারে নির্ধারণ করার জন্য সরকার একটি রেগুলেটরি কমিশন গঠন করবে। আমাদের প্রশ্ন ইউজিসি কি এ কাজ করতে পারে না?

সরকারি ও বেসরকারিভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগের দুই বছরের মধ্যে বুনিয়াদি প্রশিক্ষণসহ চলমান বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হবে। নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ। সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর  পর্যায়ে  শিক্ষাপ্রদানকারী  সরকারি-বেসরকারি  উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহের  মান-নির্ণয় এবং সেই ভিত্তিতে প্রতি বছর এগুলোর র্যাং কিং নির্ধারণ করা ও উন্নয়নের পরামর্শ দান করার জন্য যথাযথ ক্ষমতা ও দক্ষতাসম্পন্ন একটি অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করা হবে। চমৎকার সিদ্ধান্ত, তবে বাস্তবায়ন করতে হবে।

মাধ্যমিক স্তরের শুরুতে নবম শ্রেণির পাঠ্যক্রমে জেন্ডার স্টাডিজ এবং প্রজনন স্বাস্থ্য অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এটিও ভালো সিদ্ধান্ত। বাংলাদেশের একমাত্র ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিকেএসপিকে একটি পূর্ণাঙ্গ ক্রীড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে রুপান্তরিত করে তার অধীনে জেলা পর্যায়ে ক্রীড়াশিক্ষা স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে ক্রীড়াশিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা কর হবে।

উত্তরপত্র কার্যকরভাবে মূল্যায়ন করার জন্য প্রধান পরীক্ষকসহ উত্তরপত্র পরীক্ষক এবং প্রশ্ন পরিমার্জনকারীদের  উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। বর্তমানে অনেক পরীক্ষকই আসলে জানেন না পরীক্ষার খাতা কীভাবে মূল্যায়ন করতে হয়ে। সিনিয়র শিক্ষকরা তাঁদের অভিজ্ঞতার আলোকে খাতা দেখেন কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক কোনো প্রশিক্ষণ নেই এ বিষয়ে। তাঁদের প্রশিক্ষণ দরকার। বোর্ড কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মদক্ষতা ও গতিশীলতা বৃদ্ধির  লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে এবং প্রশাসনিক স্বার্থে যথোপযুক্ত কর্তৃপক্ষের অনুমোদনসাপেক্ষে আন্তঃবোর্ড বদলীর ব্যবস্থা করা হবে। এটি করা হলে তাদের যোগ্যতা যেমন বাড়বে, পলিটিক্স করার প্রবণতা কমবে এবং বোর্ডের দুর্নীতিও কিছুটা হয়তো কমবে।

দুর্গম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে পদায়ন ও অবস্থানের জন্য সংশ্লিস্ট শিক্ষককে বিশেষ ভাতা প্রদান করা হবে। নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ। বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ ও সরকারি-বেসরকারি শিক্ষকদের বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ প্রদান করার উদ্দেশ্যে প্রত্যেক প্রশাসনিক বিভাগে জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি (নায়েম)-এর আওতায় একটি করে আঞ্চলিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা হবে। এ সিদ্ধান্তকে অবশ্যই স্বাগত জানাই।

Sending
User Review
0 (0 votes)

লেখক সম্পর্কে

মাছুম বিল্লাহ

মাছুম বিল্লাহ

মাছুম বিল্লাহ ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত রয়েছেন। তিনি সাবেক ক্যাডেট কলেজ, রাজউক কলেজ ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। বর্তমানে তিনি ইংলিশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইট্যাব)-এর প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

মন্তব্য লিখুন