মধ্যরাতে ‘ও’ এবং ‘এ’ লেভেল পরীক্ষা

শান্ত ও নীরব পরিবেশ যে কোনো ধরনের পরীক্ষার্থীদের জন্য প্রথম ও প্রধান শর্ত। দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, আমরা আমাদের পরীক্ষার্থীদের জন্য সে পরিবেশ নিশ্চিত তো করতে পারিইনি; বরং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বারবার পেছাতে হয়েছিল এবারকার এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা, এ লেভেল ও ও লেভেল পরীক্ষাও। রাজনৈতিক সহিংসতার  কারণে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে দেশের  পুরো শিক্ষাকার্যক্রম।  অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে শিক্ষার্থীরা। পরিপূর্ণ শিক্ষালাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা যাদের সংখ্যা প্রায় সোয়া চার কোটি।

দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে প্রায় তিন কোটি ৬৮ লাখ ৮৬ হাজার ১৭২ জন শিক্ষার্থী আছে। দেশের ৩৫টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় বিশ লাখ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত বিভিন্ন কলেজে প্রায় ১৪ লাখ, বেসরকারি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় প্রায় তিন লাখসহ সারা দেশে প্রায় সোয়া চার কোটি শিক্ষার্থী আছে। ভবিষ্যতে যাদের দ্বারা পরিচালিত হবে দেশ ও জাতি, তাদের শিক্ষাগ্রহণকাল এবং পরীক্ষাগ্রহণের দিনগুলো বিভিন্নভাবে বাঁধাগ্রস্ত হচেছ।

হরতালে প্রত্যক্ষ ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে পাবলিক পরীক্ষায় অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা। দেশের সবচেয়ে বড় দুই পাবলিক পরীক্ষা হরতালের বিপত্তির কারণে বারবার পেছাতে হয়েছে। ১০ লাখ শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণে শুরু হওয়া চলমান এইচএসসি পরীক্ষা এরই মধ্যে ছয়দিন হরতালের কবলে পড়েছে। হরতালের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো নিয়মিত পরীক্ষা ও ক্লাস নিতে পারছে না। ক্লাস বন্ধের পাশাপাশি একের পর এক পরীক্ষা পেছাতে বাধ্য হয়েছে কর্তৃপক্ষ। লেখাপড়ার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান সাপ্তাহিক ছুটি বাতিল করে শুক্র ও শনিবারে ক্লাস ও পরীক্ষা গ্রহণ করছে।

ও এবং এ লেভেল পরীক্ষা হরতালের কারণে ৮ মে সকাল ১১টার পরীক্ষা সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় আর দুপুর ২টার পরীক্ষা ম্যধরাতে রাত তিনটা পর্যন্ত নিতে হয়েছে। ‘ও’ এবং ‘এ’ লেভেল পরীক্ষায় বিঘ্ন সৃষ্ট হলে বিকল্প ব্যবস্থায় পরীক্ষায়  অংশ নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সম্ভবত এ কারণেই ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার বিষয়টি কিছুটা আমলে নিয়েছিলেন আমাদের রাজনৈতিক নেতারা। ‘ও’ এবং ‘এ’ লেভেল পরীক্ষা সারা বিশ্বে ব্রিটিশ কাউন্সিলের অধীনে একইদিনে একই প্রশ্নপত্রে  অনুষ্ঠিত হয়। যদি কোনো দেশে কোনো কারণে নির্দিষ্ট দিনে পরীক্ষা না হয়, তাহলে পরের বছর ছাড়া আর ওই পরীক্ষা নেওয়ার সুযোগ থাকে না। ব্রিটিশ কাউন্সিল কোনো নির্দিষ্ট দেশের জন্য নতুন করে প্রশ্নপত্র তৈরি করে পরীক্ষা নেয় না। নেওয়ার বিধানও নেই।

৮ মে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় অনুষ্ঠিত হয় ‘এ’ লেভেল রসায়ন পরীক্ষা যা সকাল দশটায় হওয়ার কথা। একই সময়ে ‘ও’ লেভেলের রসায়ন হওয়ার কথা ছিল সকাল এগারটায়। এছাড়া রাত ১২টা থেকে তিনটা পর্যন্ত  ‘ও’ লেভেল গণিত ও বাংলা পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল দুপুর পৌনে ১২ টা থেকে। ৯ তারিখ হরতালের কারণে ‘ও’ এবং ‘এ’ লেভেলের পদার্থবিজ্ঞান পরীক্ষা হয়েছে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায়।

আমাদের দেশের সরকার ও বিরোধীদলীয় নেতারা সবাই দেশের ভাবমূর্তির কথা বলেন। অথচ একমাত্র বাংলাদেশেই রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ভোররাতে  পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এতে কি দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় না? তাদের সবারই জানা যে, আন্তর্জাতিক মানের এই পরীক্ষা পেছানো যায় না। তারপরেও তারা ‘ও’ লেভেল এবং ‘এ’ লেভেল পরীক্ষার দিনগুলোতে হরতাল ডাকছে। হরতাল ডাকছে বিরোধী জোট আর সরকারি জোট তাদের বিরুদ্ধে কিছু কথা বলেই খালাস। কারণ বিরোধীদলে থাকাকালীন তারাও তো একই কাজ করেছে! কাজেই জোর দিয়ে তো কিছু বলতে পারছে না। কিন্তু অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে কোমলমতি পরীক্ষার্থী আর সাধারণ জনগণ।

আমি একজন অভিভাবক হিসেবে ওই ভোররাতের পরীক্ষার কাছে ছিলাম। কিছু কিছু ব্যাপার আমার কাছে বিস্ময়কর মনে হয়েছে। আমাদের দেশে নাকি ২৫টি টিভি চ্যানেল আছে, অথচ কোনো চ্যানেলকে দেখলাম না এই বিশেষ সময়ে রাজনৈতিক গোলযোগের কারণে পরীক্ষা নেওয়ার ওপর কোনো প্রতিবেদন বা তথ্যচিত্র দেখাতে। অথচ সামান্য কোনো রাজনৈতিক কারণেও চ্যানেলগুলো ফলাও করে প্রচার করে সেসব ঘটনা বা বিশ্লেষণ। আর প্রায় পনের হাজার আন্তর্জাতিক প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা এবং গভীর রাতে পরীক্ষা- এ নিয়ে কারুর যেন কোনো চিন্তাভাবনা নেই। গভীর রাতের ১৫ হাজার পরীক্ষাথীর সাথে আরও ৩০থেকে ৪০ হাজার অভিভাবক ছিলেন। অথচ নিরপত্তার জন্য কোনো পুলিশের গাড়িও সেখানে যায়নি। ব্যপারটি দেখে মনে হয়েছে শিক্ষাব্যবস্থা কতটা অবহেলিত! মুখে আমরা যত কথাই বলি না কেন, আমাদের শিক্ষা আসলেই অবহেলিত।

এতকিছুর পরেও একটি বিষয় আমার খুব ভালো লেগেছে । হাজার হাজার পরীক্ষার্থী হরতালের কারণে এবং ঢাকার ট্রাফিক বা নিরাপত্তার কারণে পরীক্ষার কয়েক ঘণ্টা পূর্বে এসে অপেক্ষা করছে বসুন্ধরা কনভেশন সেন্টারের বাইরে। কিন্তু কারোর হাতে কোনো বই নেই, পরীক্ষায় কী আসবে বা আসবে না সে নিয়ে কোনো অভিভাবক বা ছাত্রছাত্রীদের কথা নেই। এটি একটি চমৎকার দৃশ্য, অন্তত আমাদের দেশে। এসএসসি বা এইচএসসি পরীক্ষায় কী হয়? কয়েকশ পরীক্ষার্থী যেখানে পরীক্ষা দিবে, সেখানে কয়েক হাজার বই, নোই বই, নোট খাতা থাকবেই। অভিভাবকদের কাছেও বই বা খাতা বা নোট থাকবে। ছাত্রছাত্রীরা সব বাদ দিয়ে একটু পরপর বই বা নোটে চোখ বুলাচ্ছে কিংবা মুখস্থ করছে এবং বলাবলি করছে কী আসতে পারে পরীক্ষায়, কী আসবে না, গতবার কী এসেছিলো ইত্যাদি। কিন্তু ‘ও’ এবং ‘এ’ লেভেল পরীক্ষায় এ ধরনের কোনো কথা নেই কারণ এখানে কমন পড়ার কিছু নেই। কাজেই আলোচনার কিছু নেই, গাইডের কোনো ব্যাপার নেই। এই বিষয়টি সত্যিই আমার ভালো লেগেছে। এটিই মূলত পরীক্ষা।

আমার প্রতিক্রিয়া শুনে অনেক লোক বলেছেন, বাংলাদেশে ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা একটি বিলাসিতা। আসলেই কি তাই? আমার মতো ছাপোষা অভিভাবক কি বিলাসিতার জন্য ইংরেজি মাধ্যমে আমার মেয়েকে পাঠিয়েছি? না, তা নয়। আমি পাঠিয়েছি বাংলা মাধ্যমের স্কুলগুলোয় ভর্তি হওয়া মানে মহাযুদ্ধ, কমিটির লোকজনকে খুশি করার জন্য মোটা অংকের বকশিস আমি কোত্থেকে দিব। আর ছাত্রছাত্রীর অনুপাতে ঢাকায় তো ভালো স্কুল-কলেজে সিট নেই। তাই বাধ্য হয়েই অনেক অভিভাবক তাদের ছেলেমেয়েদের ইংরেজি মাধ্যমে পাঠায়। ওখানে অন্তত ভর্তি পরীক্ষার মতো পাগলামি নেই। এ বিষয়গুলো সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে ভাবতে হবে গভীরভাবে।

লেখক পরিচিতি

মাছুম বিল্লাহ

মাছুম বিল্লাহ বাংলাদেশে ইংলিশ টিচার্স অ্যাসেসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইট্যাব)-এর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি পূর্বে ক্যাডেট কলেজ ও রাজউক কলেজের শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন। কাজ করেছেন ব্র্যাকের শিক্ষা কর্মসূচিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে। তিনি ভাব বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসেবেও কর্মরত রয়েছেন। তিনি নিয়মিত শিক্ষাবিষয়ে নানা প্রবন্ধ লিখছেন।

জনপ্রিয় নিবন্ধ

প্রাথমিক স্তরে ভাষা শেখা : বিষয় – বাংলা

ভাষার দক্ষতা চারটি— শোনা, বলা, পড়া, লেখা। আর ভাষা...

আগে ইংরেজি গ্রামার শিখবো, নাকি ভাষা শিখবো?

কোন ভাষার গ্রামার হলো ঐ ভাষার গঠন প্রকৃতি যার...

শিক্ষাব্যবস্থার হালচাল

অর্থনীতিবিদদের মতে, শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ সবচেয়ে লাভজনক এবং নিরাপদ রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ। অর্থনীতিবিদ এডাম স্মিথ, ডেভিড রিকার্ডো এবং মার্শালের মতে, শিক্ষা এমন একটি খাত যার কাজ হলো দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলে পুঁজির সঞ্চালন ঘটানো। শিক্ষার অর্থনীতি নিয়ে মৌলিক গবেষণায় অর্থনীতিবদ আর্থার শুল্জ ও রবার্ট সলো দেখিয়েছেন যে, প্রাথমিক শিক্ষায় বিনিয়োগ করলে সম্পদের সুফল ফেরত আসে ৩৫ শতাংশ, মাধ্যমিক শিক্ষায় ২০ শতাংশ, এবং উচ্চ শিক্ষায় ১১ শতাংশ।

আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা : পিএইচডির পর কী?

আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়, আমি নিজেও এ-নিয়ে...

ক্যাডেট কলেজে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে কিছু কথা

ক্যাডেটসমূহ বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।...

আরও কিছু লেখা

অধিক

    সাধারণ জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে কিভাবে ইংরেজি পড়াবেন?

    আমরা যখন ভাষা শিখি কিংবা শিক্ষার্থীদের ক্লাসে শেখাই, পারিপার্শ্বিক...

    বোধ

    কেন এই নাম দিলাম ব্যাখ্যা করতে পারবো না। মূল্যবোধ...

    বিদ্যালয় হোক আনন্দের এক রঙিন ফুল

    হাবীব ইমন লিখেছেন বিদ্যালয় ও আনন্দময় শিক্ষা নিয়ে শিক্ষা-সংশ্লিষ্টতায় অনেকদিন...

    ছাত্রজীবন সুখের জীবন, যদি না থাকে এক্সামিনেশন

    শিক্ষার্থীরা সাধারণত যে পরীক্ষাগুলোর কথা শুনলে ভয় পায় তা হলো, দুইটি সাময়িক পরীক্ষা এবং একটি বার্ষিক অথবা সমাপনী পরীক্ষা। এই ভয় শুধু যে স্কুল-কলেজে ছিল তাই না, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এসেও দেখতে পাই ইনকোর্সের ভয়ে আমরা ভীত থাকতাম। একটি শিক্ষা কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে চলছে কিনা, এর উদ্দেশ্য কতটা সফল হলো, তা জানার যখন আরও অনেক ধরন (বাড়ির কাজ, শ্রেণির কাজ, মৌখিক প্রশ্ন-উত্তর, ব্যবহারিক কাজ) আছে; তবে এই পরীক্ষা নামক জুজুর ভয় কেন আমাদের পোহাতে হবে?

    পথহারানো পথ

    শ্রদ্ধা করার মতো শিক্ষক পাওয়া যায়, ভালোবেসে পদতলে লুটিয়ে...

    উচ্চশিক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয় ও সান্ধ্য কোর্স প্রসঙ্গে: পর্ব ১

    আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থাকে মূলত তিনভাগে ভাগ করা যায়: প্রাথমিক,...

    কোচিং সেন্টার নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন সুস্পষ্ট ও কার্যকর নীতিমালা

    আমাদের দেশে ঠিক কবে, কখন, কীভাবে কোচিং সেন্টারগুলোর জন্ম...

    যোগ্য শিক্ষার্থীরা ব্রিটেনে পড়ালেখার সুযোগ পাবে আবারও

    আমাদের দেশ থেকে যেসব ছাত্রছাত্রী ব্রিটেনে পড়াশুনা করতে যায় তারা মধ্যবিত্ত, উচ্চ-মধ্যবিত্ত ও বিত্তবান পরিবারের সন্তান। ব্রিটেনে যাওয়ার তাদের সাধারণত দুটি উদ্দেশ্য থাকে। একটি হচ্ছে স্থায়ীভাবে ব্রিটেন থেকে যাওয়া বা ইউরোপের অন্য কোনো দেশে বা আমেরিকায় পাড়ি জমানোর চেষ্টা করা ।

    প্রাসঙ্গিক নিবন্ধসমূহ

    নতুন লেখার খবর পান ইমেইলে
    বাংলাদেশের শিক্ষা প্রসঙ্গে নতুন লেখা প্রকাশিত হলে সেই খবর পৌঁছে যাবে আপনার ইমেইলে।