বিদ্যালয়ে মেয়ে শিক্ষার্থীদের মাসিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। ছবিসূত্র: corona.gov.bd
বিদ্যালয়ে মেয়ে শিক্ষার্থীদের মাসিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। ছবিসূত্র: corona.gov.bd

মেয়েদের মাসিক ঋতুস্রাব তাদের জীবনের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, যেটি বাংলাদেশের মেয়েদের ক্ষেত্রে দশ বছর থেকে শুরু হয়। হয়তো শারীরিক গঠন এবং হরমোনের তারতম্যভেদে কারো কারো ১২/১৩ বছরেও শুরু হয়ে থাকে। ফলে বিদ্যালয়ে মেয়ে শিক্ষার্থীদের মাসিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।

মাসিক শুরুর ব্যাপারটি একজন মেয়ের জীবনে কতোটা ভয় বা আতঙ্ক সৃষ্টি করে, সেই অনুভূতি কোনোমতেই ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। পুরুষ তো এই বিষয়টি উপলব্ধি করারই যোগ্যতা রাখে না। উপরন্তু নারীরা উপলব্ধি করতে পারলেও এটিকে একটি লজ্জাজনক বিষয় হিসেবে এড়িয়ে যান। অর্থাৎ, নারীরাও এ বিষয়ে নিজ নিজ অভিজ্ঞতা অনুসারে ছোটদের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এমনকি, তিনি নিজেও জানেন না যে তার মাসিক সম্পর্কিত ধারণাটি যথেষ্ট বা পরিপক্ক কি না।

এক জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশের শতভাগ মেয়ে মাসিকের বিষয়টি নিজের মা বা বড় বোনের সাথে শেয়ার করলেও ৯৯ শতাংশ মেয়েই বাবা বা বড় ভাইকে এ বিষয়টি শেয়ার করে না। শেয়ার না করার প্রধান কারণ হচ্ছে বিষয়টিকে এখনও মেয়েরা একটি অসুস্থতা হিসেবে দেখে।

এমনকি, একে একটি লজ্জাজনক বিষয় হিসেবে দেখে আসছে মেয়েরা। অন্যদিকে, পুরুষের এ বিষয়টিতে যথাযথ ধারণা না থাকায় পুরুষও এটিকে স্বাভাবিকভাবে নিতে শিখেনি। পুরুষের মাসিক বিষয়ে অজ্ঞতা আর নারীর কাছে মাসিক বিষয়টিকে লজ্জার বিষয় হিসেবে গণ্য হওয়াতে নিভৃতে মূল ক্ষতিটা আসলে কার হচ্ছে? অবশ্য মেয়েরাই নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, কখনো কখনো এ ক্ষতি অপূরণীয় হয়ে পড়ছে।

মাসিক প্রক্রিয়াতে সর্বপ্রথম ধাক্কাটি আসছে মেয়েটির নিজের ওপর। অর্থাৎ একজন মেয়ে মাসিক শুরুর অভিজ্ঞতা না থাকাতে উৎকণ্ঠা এবং উদ্বেগের মধ্যে থাকছে। কাকে বলবে, কাকে বলবে না, কী করবে, কী করবে না, কে দেখে ফেললো, কে বুঝে ফেললো— এমন নানা প্রশ্ন কিশোরীর মধ্যে বাসা বাঁধতে থাকে।

অনেকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতে থাকে, শরীরও খুব দুর্বল হয়ে পড়ে। যে বয়সটিতে ছোট্ট শিশু বা কিশোরীর লেখাপড়া উপভোগ করার কথা, সেই বয়সে সে লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। কেনোনা, বাড়িতে তাকে মানসিক সহায়তা দেয়ার তেমন কেউ নেই, ফলে লেখাপড়া বিষয়টিতে মনোযোগ আসে না।

অপরদিকে আমাদের দেশের বিদ্যালয়গুলো মেয়ে শিক্ষার্থীদের মাসিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে এখনো অজ্ঞ এবং উদাসীন। এ দেশের ৯৫ শতাংশ বিদ্যালয়ে মেয়ে শিক্ষার্থীদের মাসিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে যথাযথ সুযোগের অভাব রয়েছে। যদিও পাঠ্যবইয়ে মাসিক বিষয়ে পাঠ রয়েছে, কিন্তু এসব পাঠদান প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থী-শিক্ষক লজ্জাবোধের দরুণ কেউই স্বাভাবিক থাকতে পারে না বলে মাসিক-সংক্রান্ত পাঠটি ভালোভাবে পড়ানোই হয় না।

যেখানে ৯৯ শতাংশ মেয়ে নিজের পিতা বা ভাইয়ের সাথে মাসিক বিষয়ে আলোচনা করতে লজ্জা পায়, সেখানে বিদ্যালয়ের পুরুষ শিক্ষকের সামনে মেয়েরা মাসিক বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে আলোচনা করবে এ আশা করার সময় এখনও আসেনি।

অনেক শিক্ষক দাবি করেছেন যে, মেয়েদের বিদ্যালয়ে অনিয়মিত উপস্থিতির একটি বড় কারণ হচ্ছে তাদের মাসিক ঋতুস্রাব। মাসে গড়ে ৩ থেকে ৭ দিন পর্যন্ত তারা অনুপস্থিত থাকে। অথবা বিদ্যালয়ে এসেও শরীর খারাপের দোহাই দিয়ে ছুটির পূর্বেই বাসায় চলে যায়। গবেষণা বলছে, মেয়েদের স্কুল কামাই দেয়ার প্রবণতা গার্লস স্কুলের তুলনায় কো-এডুকেশনে অপেক্ষাকৃত অধিক।

অন্য একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, যে সকল বিদ্যালয়ে মেয়ে শিক্ষার্থীদের মাসিক ব্যবস্থাপনা বিষয়টিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে সচেতনতা বেশি এবং বিদ্যালয়ে এ বিষয়ে নানারকম উদ্যোগ যেমন- সেনিটারি ন্যাপকিন সরবরাহ, পর্যাপ্ত টয়লেট এবং পানি সরবরাহ, মেয়েদের বিশ্রাম কক্ষ ইত্যাদি রয়েছে, সেসব বিদ্যালয়ে মেয়েদের উপস্থিতি এবং ফলাফলও অনেক ভালো। মাসিক ঋতুস্রাব ব্যবস্থাপনা যথাযথ না হলে মেয়েরা যে মারাত্নক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকছে, সেটি এখনও কর্তৃপক্ষের চেতনায় রয়েছে কি না সেটি নিয়ে অভিভাবকগণ সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।

যদিও শিক্ষায় মেয়েরা প্রতিনিয়ত ছেলেদের তুলনায় এগিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু বাংলাদেশের বেশিরভাগ বিদ্যালয়ে মেয়ে শিক্ষার্থীদের মাসিক ব্যবস্থাপনা যথাযথভাবে না থাকাতে মেয়েদের একটা বড় অংশ নিয়মিত বিদ্যালয়ে উপস্থিত হতে পারছে না। অনুপস্থিতির কারণে ভালো ফলাফল করতে না পারায় নীরবে বিদ্যালয় ছেড়ে চলে যাচ্ছে অর্থাৎ ঝরে পড়ছে। এটি পক্ষান্তরে মেয়েদেরকে বাল্যবিবাহের দিকে ধাবিত করছে। আর বাল্যবিবাহের ক্ষতিকর প্রভাব শিশু নিজেসহ পরিবার এবং সমাজকে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

মেয়ে শিক্ষার্থীদেরকে মাসিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে নিরাপদ পরিবেশ দিতে হলে আমাদের যা করতে হবে:

ক. পাঠ্যবইয়ের বিষয়বস্তুতে যেখানে মাসিক ঋতুস্রাব বিষয়টি সাজানো হয়েছে, সেটির যথার্থতা নির্ণয় সাপেক্ষে বিষয়বস্তুটিকে ঢেলে সাজাতে হবে। এক্ষেত্রে যেসব বিষয় বাদ পড়েছে, সেগুলোকে অন্তুর্ভুক্ত করতে হবে। সাথে সাথে বিষয়টিতে শিক্ষার্থীদের শিখন নিশ্চিত করার জন্য পাঠদান এবং শিখন কৌশলও পরিবর্তন প্রয়োজন হতে পারে। পাঠ্যবইয়ে একটি নির্দিষ্ট অধ্যায়ে এটিকে সীমাবদ্ধ না রেখে প্রতিনিয়ত বিষয়টিকে আলোচনায় নিয়ে আসার জন্য নির্দেশনা প্রদান করতে হবে। এক্ষেত্রে মেয়েদের মাসিক ঋতুস্রাব ব্যবস্থাপনায় ছেলেদের করণীয় সম্পর্কেও আলোচনা রাখতে হবে।

খ. মেয়েদের মাসিক ঋতুস্রাব বিষয়ে পারিবারিক এবং সামাজিক সচেতনতা তৈরি করা অনেক বেশি জরুরি। কেননা, একজন মেয়েকে তার মাসিক ঋতুস্রাব ব্যবস্থাপনায় অনেকের সংস্পর্শে আসতে হয়, অনেকের সহায়তা নিতে হয়। এক্ষেত্রে আর্থিক যোগান দিকে হয় পিতাকে। আবার প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র সংগ্রহ করার জন্য একজন পুরুষ দোকানদারের কাছেই যেতে হয়। যদি সংশ্লিষ্টদেরকে এ বিষয়ে সম্যক ধারণা দেয়া না যায় এবং এটি যে একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া এবং মেয়েরা এটি নিয়ে অনেক বেশি উদ্বেগের মধ্যে থাকে সেটি বোঝানো না যায়, তবে পুরুষরা সহযোগিতা না করে এগুলো নিয়ে উপহাস করতে থাকবে।

গ. এ ছাড়াও যে মেয়ে শিশুটির ঋতুস্রাব শুরু হবার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে বা চলছে, তার চারপাশে যে অন্যান্য নারী সদস্যরা রয়েছে তাদেরও জ্ঞানের ঘাটতি থাকতে পারে। তাই এ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলবে হবে। লিফলেট, পোস্টার, বিলবোর্ড, ক্ষুদেবার্তা প্রেরণ, কমিউনিটিভিত্তিক সেশন, ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়াতে সচেতনতামূলক বার্তা প্রদান ইত্যাদি প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে।

ঘ. বিদ্যালয় শিশুর জন্য দ্বিতীয় ঘর, অর্থাৎ নিজের পরিবারের সাথে থাকার পর শিশুরা যেখানে সবচেয়ে বেশি সময় কাটায় সেটি হচ্ছে বিদ্যালয়। বিদ্যালয়কে শিশুবান্ধব করার জন্য সংশ্লিষ্ট সকল কর্মকর্তা, কর্মচারি এবং ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যদেরকে বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এ ছাড়াও বিদ্যালয়ে মেয়ে শিশুদের জন্য নিরাপদ কমনরুম, নিরাপদ শৌচাগার এবং মাসিক ঋতুস্রাবের জন্য ব্যবহৃত উপকরণাদি ফেলার জন্য নিরাপদ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা থাকা অত্যন্ত জরুরী।

ঙ. বিদ্যালয়ে ক্লাস কিংবা পরীক্ষা চলাকালীন স্যানিটারি ন্যাপকিন সরবরাহের স্মার্ট ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে যেখান থেকে মেয়ে শিশুরা নিরাপদে এবং নির্দ্বিধায় স্যানেটারি ন্যাপকিন সংগ্রহ করতে পারবে। যেহেতু দরিদ্র পরিবারের শিশুদের জন্য ব্যয়বহুল স্যানিটারি ন্যাপকিন ক্রয় সম্ভব হবে না, তাই স্বল্পমূল্যের স্যানেটারি ন্যাপকিন সরবরাহ অত্যাবশ্যক। স্থানীয় পর্যায়ে স্যানিটারি ন্যাপকিন উৎপাদন করার উদ্যোগ নিলে সেটি উত্তম হবে।

চ. মেয়ে শিক্ষার্থীদের মাসিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে নানারকম জটিল পরিস্থিতি মেয়েদের সামনে আসতে পারে যার সদুত্তর বা সমাধান পাঠ্যবই বা বিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষকের পক্ষে দেয়া সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে একটি হটলাইনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে, যেখানে তারা টোল ফ্রি কল করে মাসিক ঋতুস্রাব বিষয়ক সমস্যাদির তাৎক্ষণিক সমাধান পেতে পারে।

ছ. এ ছাড়াও কোনো সহজ মোবাইল আ্যাপস তৈরি করা যেতে পারে যা ব্যবহার করে মেয়ে শিশুরা এ বিষয়ে জ্ঞানলাভ করে নিজেরাই নিজেদের সমস্যার সমাধান পেতে পারে।

অতএব, এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বিদ্যালয়ে মেয়ে শিক্ষার্থীদের মাসিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ক জ্ঞান এবং যথাযথ ফ্যাসিলিটি নিশ্চিত করতে পারলে নারী শিক্ষায় বাংলাদেশ আরও অনেকটা এগিয়ে যাবে। এ বিষয়ে নারীর পাশাপাশি পুরুষকেও যথাযথভাবে তৈরি হতে হবে। ভেঙ্গে দিতে হবে মাসিক ঋতুস্রাব বিষয়ক সকল কৃসংস্কার।

মনে রাখতে হবে যে মাসিক ঋতুস্রাব ব্যবস্থাপনা নারীর জন্য একটি আবশ্যকীয় জীবনদক্ষতা এবং পুরুষের জন্য একটি উপলব্ধি, যা নারীর প্রতি পুরুষের নেতিবাচক ধ্যানধারণাকে বদলে দিয়ে  নিশ্চিত করবে নারীর প্রতি দায়িত্বশীল আচরণ।

2 মন্তব্য

  1. ভাই,
    সম্পুর্ণ আর্টিকেল পড়লাম। অনেক সুন্দর, তবে সবার সচেতনতা, উপকরণের সহজলভ্যতা থাকা জরুরি সেই সাথে একাডেমিক পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্তিসহ বাস্তবায়ন (ভীতি দূরীকরণে কিশোরীদের মাসিক সম্পর্কে শেখানো) নিশ্চিত করা।

  2. Very contextual write up. In the era of 21st century when we are talking about equity of gender and empowerment of girls, these natural physical changes should not be the cause of any kind of barrier for girls. Sensitization of family and school, society (infrastructural, resource, perception) is badly needed about the changes, mental support during this particular time in a life of a girl.

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে