উদীয়মান একদল মানবশিশু বা তরুণদের জীবন, জগত এবং বিশ্বের বিবিধ রহস্যের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য নিয়োজিত যে একদল কর্মীবহিনী তারাই শিক্ষক নামে পরিচিত। এ পেশার সাথে যারা জড়িত স্বভাবতই তারা অন্যান্য পেশাজীবিদের চেয়ে একটু আলাদা। এ পেশায় যারা পূর্বে নিয়োজিত ছিলেন তারা সাধারণত ভোগ-বিলাস ও লোভলালসার উর্ধ্বে ছিলেন। পৃথিবী পাল্টেছে, শিক্ষকতা পেশা পাল্টেছে। পরিবর্তন এসেছে এ পেশায় নিয়োজিতদের। বিনা পারিশ্রমিকে শিক্ষাদান এখন আর শিক্ষকদের মধ্যে তেমন একটা চোখে পড়ে না। এখন তারা সময়ানুবর্তী অর্থাৎ নির্দিষ্ট সময়ের বেশি সময় শিক্ষাদান করেন না। তারা ঘড়ি ধরে ৫৯ মিনিট পড়ান। এক মিনিটের মধ্যে অন্য আরেকটি ব্যাচকে ঢোকার সুযোগ দেন। শিক্ষকদের শহরে ভালোমানের বাড়ি আছে। অনেক শিক্ষক গর্ব করেই বলেন, বাসা নয় স্বর্গ বানিয়েছি। তার বা তাদের এই স্বর্গ বানানোর অর্থ ঘুষের টাকার থেকে আসে নি, এসেছে প্রাইভেট পড়ানো টাকা থেকে। এগুলো সবই পরিবর্তন। তবে এগুলো সবই পজিটিভ পরিবর্তন নয়। আমি যে পরিবর্তনের কথা বলতে যাচ্ছি সেটি হচ্ছে শিক্ষাদান পদ্ধতির পরিবর্তন। এই পরিবর্তন আমাদের শিক্ষাদান পদ্ধতিতে তেমন একটা পরিলক্ষিত হয় না।
এখন শিক্ষাদান পদ্ধতি হচ্ছে অংশগ্রহণমূলক। অর্থাৎ শিক্ষাদান পদ্ধতিতে সবাই শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করবে। পূর্বে ধারণা ছিল শিক্ষক শুধু শিক্ষাদান করবেন এবং ছাত্রছাত্রীরা তা শুধু শুনবে। কিন্তু এই একমুখী শিক্ষাদান আর শ্রবণ করা ছাত্রছাত্রীদের মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে না। এতে তারা খুব কমই উপকৃত হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, যে শ্রেণীতে শুধু শিক্ষক নিজে কথা বলছেন এবং লেকচার দিচ্ছেন এবং শিক্ষার্থীরা শুধু শ্রবণ করছে সে ক্লাসে শিক্ষার্থীরা ৩০ ভাগ উপকৃত হয়। আর যে ক্লাসে শিক্ষার্থীরা তাদের অভ্যন্তরীন ও বাহ্যিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ব্যবহার করছে তারা ঐ ধরনের ক্লাস থেকে শতকরা ৭০-৮০ ভাগ উপকৃত হয়। এখন আধুনিক শিক্ষক হচ্ছেন তিনি যিনি তার শিক্ষার্থীদের শিক্ষাগ্রহণে সক্রিয় অংশগ্রহণ করাতে পারেন। কিভাবে অংশগ্রহণ করাবেন তার কতকগুলো পদ্ধতি আছে। যেমন- দলগত কাজ, জুটিতে কাজ ইত্যাদি।
আমি অনেক শিক্ষককে ভিন্ন ভিন্নভাবে প্রশ্ন করেছি আপনি শিক্ষকতা পেশায় কতটা সন্তুষ্ট বা এ পেশা কতটা উপভোগ করছেন? ব্যতিক্রম ছাড়া সবাই বলেছেন, বোরিং পেশা। ঘণ্টা পড়ার সাথে সাথে একজন শিক্ষক মানসিক কিংবা শারীরিকভাবে প্রস্তুত থাকুক বা না থাকুক, ডিস্টার্বড থাকুক, ক্লাসে তাকে ঢুকতেই হচেছ। আর ক্লাসে ঢুকে তাকে চুপচাপ বসে থাকলে চলবে না। ক্লাসের সাইজ (সংখ্যনুপাতে) ছোট হলে এক ধরনের ম্যানেজ করা যায় কিন্তু ক্লাস সাইজ বড় হলে শিক্ষক এক ধরনের মনস্তত্ত্বিক চাপে ভোগেন। কারণ ৫০-৬০ কিংবা তারও বেশি শিক্ষার্থী একটি ক্লাসে থাকে আর প্রায় সবাই এক এক ধরনের চরিত্রের অধিকারী। তারা তাদের স্বভাবসুলভ আচরণ করবে ক্লাসে যদি তাদেরকে ভীষণভাবে ব্যস্ত না রাখা যায়। তা না হলে কেউ চেচামেচি, কেউ চিৎকার, কেউ খোঁচাখুচি করবে। আর শিক্ষক যদি চুপচাপ থাকেন তাহলে তো কথাই নেই। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা ক্লাসে কখনই বিনা কাজে চুপচাপ বসে থাকবে না। তাদের বয়স, প্রয়োজন, চাহিদা, সিলেবাস ও পরীক্ষা মোতাবেক কোনো কাজে ব্যস্ত না রাখলে তারা মজা পাবে না, তাই এসব দিকে খেয়াল রেখে একজন শিক্ষককে প্রস্তুতি নিয়ে ক্লাসে ঢুকতে হয়। কিন্তু তিনি যদি মানসিক, ব্যাক্তিগত, পারিবারিক কিংবা শারীরিক কারণে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকেন তা হলে প্রস্তুতিও নিতে পারেন না এবং ক্লাসে তার প্রতিফলন ঘটবে। শিক্ষাথীদের স্বভাবসুলভ ও বয়সী আচরণ তাকে আরও মানসিকভাবে পর্যুদস্ত করবে। বাস্তবে একজন শিক্ষককে প্রতিদিন এ ধরনের একটি কিংবা দুইটি ক্লাস যদি করতে হয় তা হলে তিনি হয়তো কোনোরকম ম্যানেজ করতে পারেন। কিন্তু একজন শিক্ষককে এই ধরনের চার, পাঁচ কিংবা ছয়টি ক্লাস নিতে হয়। ফলে তার মন মানসিকতা স্বভাবতই বিষানো থাকে আর তাই অনেকেই বলেন যে, এটি একটি বোরিং বা বিরক্তিকর পেশা। তাই যাদের সুযোগ আছে তারা অন্যত্র চাকুরি খুঁজতে থাকেন।
তাছাড়া একজন শিক্ষকের কাজ তো শুধু ক্লাসেই নয়, টিউটোরিয়েল পরীক্ষা নেওয়া, খাতা পরীক্ষণ করা, প্রশ্নপত্র তৈরি করা, পরীক্ষার ডিউটি করা ইত্যাদিসহ অনেক ধরনের কাজ একজন শিক্ষককে করতে হয়। আর এসব কারণে একজন শিক্ষক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও অনেক সময় ভালোভাবে ক্লাসের প্রস্তুতি নিতে পারেন না। নতুন কিছু জানার ও শেখার আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও তিনি হয়ত অনেক সময় তা পেরে ওঠেন না। আর প্রতিষ্ঠানটি যদি হয় বেসরকারি এবং অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া, তা হলে তো কথাই নেই। চাকুরি শেষে তার কোনো আর্থিক নিরাপত্তা নেই, এই চিন্তা তাকে জ্বালাতন তো করবেই। তিনি জাতিকে শিক্ষিত করার মহান ব্রতে নিয়োজিত অথচ তার নিজের সন্তানকে সঠিকভাবে পরিচালিত করার অর্থ যখন তার থাকে না, তখন কি তিনি এই মহান কাজে পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করতে পারেন? পারার কথা নয় কারন তিনি তো একজন মানুষ, তার রয়েছে সব ধরনেরই চাহিদা যা একজন সাধারণ মানুষের থাকে। আর তাই তিনি অনেক সময় ইচ্ছের বিরুদ্ধে প্রাইভেট কোচিং বা এই ধরনের উপার্জনের দিকে ঝুকে পড়েন।
তা হলে এর সমাধান কী? সমস্যা তো জটিল এবং ব্যাপক। সমস্যা ব্যক্তিগত, প্রতিষ্ঠানিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত। আপনি ব্যক্তিগত, প্রাতিষ্ঠানিক এবং বেশি ঝুঁকি নিলে হয়ত সামাজিক পর্যায় পর্যন্ত সমস্যার কিছু সমাধান দিতে পারেন কিন্তু রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তো আপনার তেমন কিছু করার নেই। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ও বছরের পর বছর একই ধরনের কাজ, ক্লাস, বিদ্যালয় নিতান্তই একঘেয়েমি। যত একঘেয়েমিই হোক, কাউকে না কাউকে তো এই মহান ব্রত ও দায়িত্ব পালন করতেই হবে আমাদের এই দরিদ্র দেশে। একদল নিঃস্বার্থ মানুষদের তো এগিয়ে আসতে হবে জাতির ভাগ্য পরিবর্তন করতে। তাই হাজার সমস্যা আছে এই পেশায়, তারপরেও অনেক শিক্ষক এখানে চাকুরি করেন, নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেন এই মহান পেশায়। বিনিময়ে জীবনব্যাপি দারিদ্রের সাথে সংগ্রাম করেন, আপোষ করেন না কোন মিথ্যের সাথে, অসত্যের সাথে। সমাজ তাকে এভাবেই চেনে, জানে, মনে করে তার মৃত্যুর পরেও। এই তার চরম পাওয়া, জীবন তার স্বার্থক।
কেউ কেউ আবার শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে দিয়ে ব্যাংকিং পেশায় চলে আসেন। শুধু অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য? না, শুধু তাই নয়। ব্যাংকিং পেশা চাপ তারা সহ্য করতে রাজি কিন্তু শিক্ষকতার শারীরিক, মানসিক ও মনস্তাত্ত্বিক চাপ সহ্য করতে পারছেন না। দ্বিতীয়ত, শিক্ষকতা পেশায় ওপরে ওঠার তেমন কোনো ধাপ নেই, খুব সীমিত ধাপ। এটিও বোরিং হওয়ার আরেকটি কারণ।
একজন শিক্ষককে প্রতিদিন ৪ থেকে ৫টি ক্লাস নিতে হয়। পুরো সময়ই যদি তিনি কথা বলেন তাহলে ক্লান্ত হয়ে যাবেন। তাই শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন কাজে লাগাবেন, আর তাই আপনাকে টিচার টকিং টাইম কমাতে হবে। বাড়াতে হবে স্টুডেন্ট টকিং টাইম। শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করাতে পারলে তারা ক্লাসে মজা পাবে, আপনার চাপ কমবে। শারীরিক ও মানসিকভাবে আপনি সুস্থ থাকবেন। নতুনভাবে চিন্তা করুন কিভাবে ক্লাসকে আপনার ও শিক্ষার্থীদের জন্য আনন্দময় করা যায়। স্কুল আপনার আনন্দের জায়গা, খেলার জায়গা, উপার্জনের জায়গা এবং বিনোদনের জায়গা। এই কথা মনে করুন সব সময়।
বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করুন আপনার বিদ্যালয়ে। যেমন, গণিত মেলা, গণিত অলিম্পিয়াড, বিজ্ঞান মেলা ও অলিম্পিয়াড, ইংরেজি সপ্তাহ বা মেলা, কুইজ কম্পিটিশন ইত্যাদি বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন করুন, আপনার প্রশাসনিক, পেশাগত ও সাংগঠনিক দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে, আনন্দ পাবেন কাজে। দেশে-বিদেশের বিভিন্ন শিক্ষক সমিতি, পেশাগত সমিতিগুলোর সদস্য হোন। সেখানকার পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করুন, দুনিয়াব্যাপী না হলেও দেশব্যাপি শিক্ষকদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করুন। একে অপরের সুখদুঃখ, আনন্দ-বেদনার কথা, পেশাগত উন্নয়নের কথা ভবিষ্যত পরিকল্পনার কথা ভাগাভাগি করুন, দেখবেন অনেক আনন্দ পাবেন। আলাদা এক জগত সৃষ্টি হবে, সেখান থেকে আরও বেশি আনন্দ পাওয়ার চেষ্টা করুন।
লেখক পরিচিতি
মাছুম বিল্লাহ বাংলাদেশে ইংলিশ টিচার্স অ্যাসেসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইট্যাব)-এর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি পূর্বে ক্যাডেট কলেজ ও রাজউক কলেজের শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন। কাজ করেছেন ব্র্যাকের শিক্ষা কর্মসূচিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে। তিনি ভাব বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসেবেও কর্মরত রয়েছেন। তিনি নিয়মিত শিক্ষাবিষয়ে নানা প্রবন্ধ লিখছেন।
শিক্ষা বিষয়ক আলোচনা ভাল লেগেছে ।