শিক্ষাজীবনে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বর্তমান সময়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক নিয়ে এক ধরনের টানাপোড়ন লক্ষ্য করা যায়। শিক্ষকরা বলেন, এখনকার শিক্ষার্থীরা আগের মতো শিক্ষকদের শ্রদ্ধা করেন না। শিক্ষার্থীরাও শিক্ষকদের নৈতিকতা বা দায়িত্ববোধ নিয়ে প্রশ্ন তোলে। তাই একজন শিক্ষককে জানতে হবে একজন শিক্ষার্থী কেমন শিক্ষক আশা করেন। একইভাবে, শিক্ষার্থীকেও শিক্ষকের প্রত্যাশার কথা বুঝতে হবে। কেননা এটি একটি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এবং কার্যকর শিক্ষার জন্য এই সম্পর্ক ইতিবাচক হওয়া খুবই জরুরি।
বিশ্বজুড়ে এখন শিক্ষাক্ষেত্রে টপ-ডাউন এ্যাপ্রোচ পরিবর্তনের চেষ্টা চলছে যেন শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক আরও সহজ হয় এবং এটি একজন শিক্ষার্থীর ভালো ফলাফল অর্জনে সহায়ক হতে পারে। এই লেখায় সেই বিষয়গুলো তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক
শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক হতে হবে বন্ধুসুলভ এবং একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ অবশ্যই থাকতে হবে। একজন শিক্ষাথী যেন খুব সহজেই তার যেকোনো সমস্যা এবং কোনো বিষয়ের ওপর তার মত শিক্ষককে বলতে পারে। একইভাবে, শিক্ষার্থীকে একজন শিক্ষকেরও মতামত এবং উপদেশ শুনতে হবে, যদি সেটি তার মতের বিরুদ্ধেও যায়।
নৈতিকতা অর্জনে সহায়তা
একজন শিক্ষক পড়াশোনার পাশাপাশি মাঝে মাঝে বর্তমান সমাজের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করতে পারেন। এতে করে শিক্ষার্থীরা নৈতিক গুণাবলীর প্রতি সচেতন হবে। দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হলে সততা, বিবেকবোধ, সৎসাহস— এ-ধরনের নৈতিক গুণাবলির বিকল্প নেই। আমি মনে করি, এই জায়গাটিতে একজন শিক্ষকের চাইতে বেশি অবদান কেউ রাখতে পারবেন না।
শেখানোর কৌশল
একজন শিক্ষককে সময়ের সাথে সাথে তার শেখানোর কৌশল অবশ্যই পরিবর্তন করতে হবে এবং এ-সম্পর্কিত বিভিন্ন দক্ষতায় তিনি সবসময় নিজেকে আরো উন্নত করবেন। এতে শিক্ষার্থীরাও তার কাছ থেকে প্রতিনিয়ত নতুন কিছু শিখতে পারবে এবং নতুন কিছু শেখার বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠবে।
শিক্ষার্থীকে সহায়তা
শিক্ষার্থীরা সবসময়ই এমন একজন শিক্ষক চায় যিনি তাদের ওপর বিশ্বাস রাখেন, যিনি একজন শিক্ষার্থীকে আত্মবিশ্বাস যোগান, উৎসাহিত করেন। তিনি একটি ইতিবাচক পরিবেশে একজন শিক্ষার্থীকে বেড়ে উঠতে সহযোগিতা করেন, তাকে বুঝতে সেখান, কীভাবে নিজের যোগ্যতার সেরা চেষ্টাটুকু করতে হয়। শিক্ষার্থীরা বুঝতে পারে পরীক্ষা মানে নিজের দক্ষতাকে সামনে তুলে ধরা, কাউকে টেক্কা দেয়া নয়।
শিক্ষকের সুসংহত চিন্তা
একজন শিক্ষককে কিছু বলার পূর্বে অবশ্যই তার চিন্তাগুলো সুসংগঠিত ও পরিষ্কার হতে হবে। কারণ তিনি যাই বলছেন, সেটির প্রভাব তার শিক্ষার্থীদের ওপর পড়বে। শিক্ষার্থীরা এমন একজন শিক্ষকের প্রশংসা করেন যিনি স্বীকার করেন যে, তিনি সবকিছু জানেন না এবং যিনি শিক্ষার্থীদের মতামত বা মতবিরোধ শুনতে ইচ্ছুক হন।
একজন শিক্ষককে সময়ের সাথে সাথে তার শেখানোর কৌশল অবশ্যই পরিবর্তন করতে হবে এবং এ-সম্পর্কিত বিভিন্ন দক্ষতায় তিনি সবসময় নিজেকে আরো উন্নত করবেন। এতে শিক্ষার্থীরাও তার কাছ থেকে প্রতিনিয়ত নতুন কিছু শিখতে পারবে এবং নতুন কিছু শেখার বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠবে।
শ্রেণিকক্ষে সক্রিয় অংশগ্রহণ
একজন শিক্ষকের ক্লাসের ওপর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়াটা সবসময় কার্যকর পদ্ধতি হয়ে উঠে না। পাশাপাশি, শিক্ষকের বিরক্তিকর উপস্থাপনা শিক্ষার্থীদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। শিক্ষার্থীরা এমন একটি ক্লাসরুম চায় যেখানে তাদের সবার সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকবে এবং তারা একে অপরের সাথে তাদের কাজগুলো ভাগ করে নিতে পারবে।
ভুল স্বীকারের মানসিকতা
একজন শিক্ষকের নিজের ভুল স্বীকার করার মতো মানসিকতা থাকা উচিত। এ-ধরনের মানসিকতার শিক্ষকবৃন্দ শিক্ষার্থীদের কাছে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে থাকেন। একই সাথে, একজন শিক্ষকের নৈতিক গুণাবলীও থাকতে হবে। কারণ শিক্ষার্থীরা তাকে দেখেই এই নৈতিক গুণাবলীগুলো নিজেদের মাঝে ধারণ করবে।
গল্প বলা বা উদাহরণ দেওয়া
অনেক সময় শিক্ষকের ক্লাসে একটানা দীর্ঘক্ষণ একটি বিষয়ের ওপর কথা বলে যাওয়া, শুধু পাওয়ারপয়েন্ট দিয়ে ক্লাস লেকচার উপস্থাপন করে ক্লাস নেয়া, বা শুধু বই দেখে লাইন ধরে পড়ানো শিক্ষার্থীদের মনসংযোগে ব্যাঘাত ঘটায়। বরং, শিক্ষকদের গল্প বলতে বা এমন উদাহরণ দেওয়ার চেষ্টা করা উচিত যা শিক্ষার্থীদের কল্পনাপ্রসূত মনে সহজেই দাগ টানতে পারে।
একজন শিক্ষকের নিজের ভুল স্বীকার করার মতো মানসিকতা থাকা উচিত। এ-ধরনের মানসিকতার শিক্ষকবৃন্দ শিক্ষার্থীদের কাছে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে থাকেন।
প্রশংসা করা
একজন শিক্ষকের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের ভালো যেকোনো প্রচেষ্টাকে প্রশংসা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার্থীদের প্রশংসা করে, প্রশংসা প্রদর্শন করে বা তাদেরকে উৎসাহিত করে শিক্ষক তাদের সময়ের গুরুত্ব বুঝাতে পারেন। একই সাথে শিক্ষক তাদের শেখার ক্ষেত্রে যে ধৈর্যধারণ করে চেষ্টা করে যাচ্ছেন, এতে তারা একজন শিক্ষকের গুরুত্ব বুঝতে পারে।
শ্রেণির কাজ
শিক্ষার্থীরা এমন একজন শিক্ষক চায় যারা তাদেরকে বিভিন্ন শ্রেণি প্রকল্প বা অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে কাজটি সম্পন্ন করার জন্য চ্যালেঞ্জ জানাতে পারেন। একই সাথে, তাদের চিন্তার প্রতিফলন দেখার জন্য এবং সমস্যা সমাধান করার জন্য তাদেরকে পর্যাপ্ত সময়ও দিতে হবে। একজন শিক্ষক তাদেরকে শুধু কাজ দিয়েই তার দায়িত্ব শেষ করেন না, বরং কীভাবে তারা সমস্যাগুলোকে সমাধান করবে তার জন্য গাইডও করেন।
সবার প্রতি মনোযোগ প্রদান
শিক্ষার্থীরা এমন শিক্ষক পছন্দ করে না যিনি ক্লাসে নির্দিষ্ট কিছু শিক্ষার্থীর দিকে বেশি খেয়াল করেন। তারা এমন একজন শিক্ষক চান যিনি তাঁর ক্লাস সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারেন এবং ক্লাসে সবার প্রতি দৃষ্টি দিতে পারেন। এটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ কারণ এতে একজন শিক্ষার্থীর জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
সবশেষে, শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক আরও সুন্দর হয়ে উঠুক, প্রতিটি শিক্ষার্থীর জীবন ও মন আলোকিত হয়ে উঠুক জ্ঞানের আলোয়— এ প্রতাশ্যায় লেখাটি শেষ করছি।
লেখক পরিচিতি
ড. গৌতম সাহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।
Visitor Rating: 4 Stars