শিক্ষাকে সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পর্যালোচনা বা অনুসন্ধান করার প্রয়োজন আছে। কারণ আমাদের জানাশোনার সবকিছুর প্রয়োগটা ওই সমাজেই। যা শিখছি, সমাজ থেকেই আবার শিক্ষার ওই নির্যাসটুকু ফিরিয়ে দিচ্ছি ওই একই জায়গায়। শিক্ষার সংজ্ঞা বলে, এটি এক ধরনের প্রক্রিয়া/ঘটনা/কর্মকাণ্ড যা আচরণের পরিবর্তন ঘটায়। এ আচরণ হতে হবে অবশ্যই সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত। আমেরিকান সমাজবিজ্ঞানী ম্যাকাইভারের মতে, সমাজ হলো সম্পর্কের একটি ব্যবস্থা যার মধ্যে আমরা বসবাস করি। আর সমাজ সম্পর্কে পরীক্ষিত বা বৈজ্ঞানিক জ্ঞান আমরা অর্জন করি সমাজবিজ্ঞানের মাধ্যমে। আমাদের সমাজে বর্তমানে শিক্ষাক্ষেত্রের যে চিন্তাটি ক্রনিক মাথাব্যথার মতন দাঁড়িয়ে গেছে, সেটি হলো; বিজ্ঞান পড়ার প্রতি আগ্রহ শিক্ষার্থীদের কমে যাচ্ছে। এটি যদিও পুরো বিশ্বের মাথাব্যথা; তাঁরপরও আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটের কথা চিন্তা করে বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করার দরকার আছে। শিক্ষাক্ষেত্রে এমন বহু ঘটনা আছে যার সমাধানের ক্ষেত্রে সমাজের বিভিন্ন দিকগুলো মাথায় রেখে গবেষণা করা দরকার। মূল কথা হলো, সমাজের যে কোনো ঘটনা সম্পর্কে সিদ্ধান্তে পৌঁছাবো গবেষণালব্ধ তথ্যের মাধ্যমে। শ্রেণিতে পাঠদানের ক্ষেত্রে শিক্ষকের একনিষ্ঠতা কেন ব্যাহত হচ্ছে? শিক্ষকদের প্রাইভেট টিউশনি কেন করতে হয়? শিক্ষকবৃন্দ শ্রেণির বাইরে কেন বেশি সময় দিচ্ছেন? অধ্যাপক শামসুল হক মন্তব্য করেছেন,
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, উচ্চ কোন স্তরেই নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জিত হচ্ছে না।
এগুলোর পেছনে সমাজগত কারণ আছে এবং সেটিই গবেষণার মাধ্যমে খতিয়ে দেখা দরকার। সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে শিক্ষা সমাজব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা বা বিষয় নয়। একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ধারা উক্ত দেশের সমাজব্যবস্থাকে ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে। তাই একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে পর্যালোচনা করলে উক্ত দেশের সমাজের মূল কাঠামো সম্পর্কে আন্দাজ করতে পারা যায়। সমাজকাঠামোর বিভিন্ন উপাদান আছে- রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ইত্যাদি। উক্ত উপাদানগুলোর ভূমিকাকে কেন্দ্রীভূত করেই মূলত একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থা তার আপন বৈশিষ্ট গড়ে তোলে। এখনকার শিক্ষাদর্শনের মূল কথা হলো শেখার কৌশল ও পদ্ধতি সম্পর্কে জানানো; শিখিয়ে দেয়া নয়। এটি বিভিন্ন সামাজিক গবেষণারই ফল। এখনকার শিক্ষা যে আরও ৫০ বছর আগের শিক্ষার মতো নয়, এটি স্পষ্ট হলো কী করে? এই যে ডিজিটাল যুগের ভাবনা; পরিবর্তিত পাঠ্যপুস্তক, শিক্ষাক্রম এসব ভাবনা এল কোত্থেকে? এখনকার সমাজ যে পরিবর্তিত, ছেলেমেয়েদের চাহিদা-ভাবনা যে তাদের পূর্বের জেনারেশন থেকে পৃথক সেটি আমাদের জানার সীমার ভেতরে এল কীভাবে? এ সমাজ থেকেই এসব পরিবর্তনের আভাস আমরা পাই। অনেক সময় আমরা বলি মূল্যবোধের অবক্ষয় হচ্ছে; কিন্তু সেটি কার দৃষ্টিতে? আরেকজনের দৃষ্টিতে নাও হতে পারে। সমাজ আমাদের জন্য যুগের সুচনা করে। অনেক সময় আমরা কথায় কথায় বলি, “ছেলেমেয়েরা রসাতলে যাচ্ছে”। আসলে তাই কি? সমাজবিজ্ঞান কিন্তু এমনটি বলবে না। কেবল ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দেবে- কেন এরকম হচ্ছে। যেকোনো বিজ্ঞানের কাজই হলো একটি বস্তুনিষ্ঠ নিরপেক্ষ সিদ্ধান্তে পৌঁছান। সমাজবিজ্ঞান সমাজের বিভিন্ন ঘটনার কার্যকারণ সম্পর্ক নির্ণয় করে। সমাজবিজ্ঞানের প্রেক্ষাপটে তাই শিক্ষাকে পর্যালোচনা করতে গেলে একটি মূল্যবোধ নিরপেক্ষ অবস্থান নিতে হবে। যেমন, কোচিং সেন্টার সম্পর্কে অনেকেই ইতিবাচক ধারণা পোষণ করেন না। কিন্তু এর অপকারিতা শিক্ষার্থীদের দিক থেকে চিন্তা করলে যেমন পাওয়া যাবে, ঠিক তেমনি শিক্ষকদের দিক থেকে চিন্তা করলে এটি তাদের বেঁচে থাকার জন্য বিরাট একটা প্রয়োজন। কাজেই ঠিক/বেঠিক বা ভালো/মন্দ এসব অনেক ক্ষেত্রেই আপেক্ষিক ব্যপার। সুতরাং মূল্যবোধ নিরপেক্ষ মন্তব্যের এখতিয়ার রাখে সমাজবিজ্ঞান। তবে শেষ পর্যন্ত একটা ভালোমন্দের ফলাফলতো চাই। গবেষণার ভিত্তিতে একটা ফলাফলে পৌঁছবার দায়িত্ব নিতে পারেন নীতি-নির্ধারকেরাসহ আরও অনেকে। কাজেই আমাদের সমাজের প্রেক্ষাপটে শিক্ষা সঙ্কটের কারণগুলো গবেষণা করবেন সমাজ বিজ্ঞানীরা আর গবেষণার ভিত্তিতে একটি সিদ্ধান্তে পৌছানো নীতিবিজ্ঞানের কাজ। তবে একথা স্পষ্ট যে, শিক্ষাক্ষেত্রে একটা আদর্শ শিক্ষণ-শিখন পরিবেশ গড়ে তুলতে গেলে, বিদ্যালয়ে ছেলেমেয়েদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করতে গেলে, শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধ করতে, মৌলিক শিক্ষাকে সর্বজনীন করে তুলতে, লেখাপড়ার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের সুযোগ খরচ আর আনুষঙ্গিক খরচ নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে সামাজিক কারণগুলো বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে খতিয়ে দেখে সমাধান খোঁজা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। কাজেই বাংলাদেশের শিক্ষাসঙ্কট নিরসনের জন্য বিরাজমান অন্যান্য কারণের সাথে সামাজিক কারণগুলোও চিহ্নিত করা প্রয়োজন। এই কারণগুলোর মধ্যে পরিবার প্রধানের আয়, পরিবার প্রধানের পেশা, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, পর্দাপ্রথা, কুসংস্কার ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ‘বাংলাদেশের শিক্ষা সংকট: সামাজিক কারণের স্বরূপ বিশ্লেষণ’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবদুল মালেক লিখেছেন,
বাংলাদেশের শিক্ষা সংকটের গভীরতা ব্যাপক। এই সংকট শিক্ষায় পরিমাণগত ও গুণগত উভয় দিককে কেন্দ্র করে বিদ্যমান। বর্তমানে বাংলাদেশের সাক্ষরতার হারের পরিমাণ যেমন হতাশাজনক, তেনি শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর শিক্ষার গুণগত মান অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আশানুরূপ নয়। বস্তুত শিক্ষাকে কেন্দ্র করে একটা জাতির যে আশা আকাঙ্ক্ষা বিদ্যমান থাকে বাংলাদেশের তা কোনভাবেই পূরণ হচ্ছে না। ফলে তৃতীয় বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ হিসেবে আমাদের সামগ্রিক উন্নয়নধারা ব্যাহত হচ্ছে।
২০০২ সালে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ প্রাযুক্তিক আধুনিকায়নের ক্ষেত্রে এখনও অনেক পিছিয়ে রয়েছে। The World Bank, United Nations Development Programme (UNDP) , United Nations Educational, Scientific and Cultural Organization (UNESCO) ইত্যাদি সংস্থা বাংলাদেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে দক্ষ জনবল ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প ব্যবস্থা নেই- এ ব্যাপারে সহমত পোষণ করেছে। বাংলাদেশের মানুষকে দক্ষ, পেশাদার মনোভাব ও জব-ওরিয়েন্টেড করতে তাদেরকে প্রয়োজনীয় কারিগরি ও প্রযুক্তি শিক্ষা দিতে হবে। তবে ৪২ বছরে এখনও পর্যন্ত রাজনৈতিক স্থিরতায় আসতে না পারাটা আমাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পথে একটা বড় রকমের বাঁধা। যার স্পষ্ট ছাপ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় পড়েছে, এখনো পড়ছে। উক্ত রিপোর্ট অনুযায়ী শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নয়নের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের পর পঁচিশ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এবং মানব উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটা বড় রকমের পরিবর্তন আসতে পারত, কিন্তু এটা বাস্তবে হয়ে উঠতে পারেনি। দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড এবং মালয়শিয়া ১৯৭১ সালের পর পঁচিশ বছর সময়কালের মধ্যে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনের মাধ্যমে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে এবং মধ্য আয়ের দেশগুলোর মধ্যে তাদের অবস্থান উপরের দিকে। বস্তুত জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে এই অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করা সম্ভব হয়েছে উপযুক্ত শিক্ষন-শিখন পরিবেশ নিশ্চিতকরণ এবং বিভিন্ন টেকনিক্যাল ও প্রফেশনাল ফিল্ডে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার মাধ্যমে। ইউনেস্কোর এক সমীক্ষায় মতামত ব্যক্ত করা হয়েছে,
কোন উন্নয়নশীল দেশের মাধ্যমিক স্তরে পড়ার উপযোগী বয়সের ছেলেমেয়েদের অন্তত ৫০ শতাংশ শিক্ষার মাধ্যমিক স্তর উত্তীর্ণ হওয়া প্রয়োজন কেবলমাত্র সেদেশের প্রচলিত উন্নয়ন প্রকল্পগুলো সচল রাখার উপযোগী দক্ষ জনশক্তি উৎপাদনের গরজেই।
দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন শিক্ষা। শিক্ষা সমাজের নিম্ন আয়ের মানুষদের পরিবারে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ আনয়নের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট অবদান রাখে। এজন্য সরকারকে জনসংখ্যা, সামাজিক প্রয়োজন, বিশ্বায়নসহ অন্যান্য দিক মাথায় রেখে বিভিন্ন ধরনের এডুকেশনাল প্রোগ্রাম অফার করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যুরো অফ এডুকেশনাল ইনফরমেশন অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিক্স (BANBEIS)-এর ২০০৭-এ দেয়া বিবৃতি অনুযায়ী স্বাধীনতার পরে আমাদের শিক্ষাবিষয়ক নীতিতে অনেক পরিবর্তন আনার চেষ্টা করা হলেও আশানুরূপ উন্নয়নের লক্ষ্যে পৌঁছানো এখন পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। তার একটা বড় কারণ হল, বেশিরভাগ শিক্ষানীতি এবং উন্নয়নের পদক্ষেপ সাধারণ শিক্ষার ধারায় নেয়া হয়েছে। ১৯৯৬ সালে Bennell পর্যবেক্ষণ করেন যে, সকল দেশ বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর উন্নয়নে ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য জাতীয় উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষার সকল সেক্টরে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি প্রয়োজন। কাজেই চলমান সামাজিক অবস্থার গবেষণার ভিত্তিতে এর থেকে বেরিয়ে আসার দিকগুলো নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে। বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি পর্যায় থেকে শিক্ষাসঙ্কট কমিয়ে আনার জন্য নিরক্ষরতা দূরীকরণ, সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা প্রকল্পসহ বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (Bangladesh Institute of Development Studies)- এর সাবেক মহাপরিচালক মাহবুব হোসেন উল্লেখ করেছেন,
সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন বহুদিন থেকেই সরকারের একটি বহুল বিঘোষিত নীতি। এই লক্ষ্য অর্জনে সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে সম্পদ বরাদ্দে সরকার সাধ্যমত চেষ্টা করছেন।
বাংলাদেশের মতো একটি জনাকীর্ণ দেশে কাজের খোঁজে মানুষের শহরে অভিবাসন নিয়মিত ঘটনা। তারা তাদের পরিবার-সন্তানাদি নিয়ে সীমাহীন দারিদ্রে দিনাতিপাত করে। এসব ছেলেমেয়েদের একটি বড় অংশের বাসস্থান রাস্তায়। তদের অনেকেই বিদ্যালয়ে যাবার সুযোগ, খরচ এবং আনুষঙ্গিক খরচের জোগান দিতে পারে না। বাংলাদেশে ৫-১৭ বছরের শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ৩২ লাখ (ILO, report/ BBS, 2006)। এর মধ্যে ৪ লাখ ২১ হাজার কাজ করে গৃহপরিচারিকা হিসেবে।
বাংলাদেশের শিশুদের অমানবিক এমনকি বিপজ্জনক কাজে হামেশাই লাগানো হয়। এসব শিশুদের প্রায়শই সামাজিকভাবে হেয় করা হয়। কারখানার কাজে, ঘরের কাজে, বিড়ি ফ্যাক্টরিতে, বাল্যবিবাহ, পতিতাবৃত্তি, ভিক্ষাবৃত্তি, গাড়ির হেলপার প্রভৃতি নিম্নমানের কাজে নামমাত্র মজুরিতে কাজে লাগানো হয়। অধ্যাপক কামরুন্নেসা বেগম ও সালমা আখতার মন্তব্য করেছেন, “দরিদ্র পিতা-মাতারা তাঁদের ছেলে-মেয়েদের বিদ্যালয়ে লেখাপড়া শেখানোর বদলে অল্প বয়সেই মাঠ ও গৃহের কাজে সাহায্যকারী হিসেবে নিয়োগ করে থাকে।” যে সকল ছেলেমেয়ে আদৌ বিদ্যালয়ে ভর্তি হয় না তাদের বেশিরভাগ ঘটনার মূলে রয়েছে পিতা-মাতার দারিদ্র। ১৯৮২ সালেই শামীমা ইসলাম উল্লেখ করেছিলেন, দরিদ্র পরিবারগুলি ‘সুযোগলাভের খরচজনিত’ কারণে অবৈতনিক বিদ্যালয়েও তাদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর জন্য পাঠাতে সমর্থ হয় না। কাজেই অনেক ছেলেমেয়ে দারিদ্র, শিশুশ্রম, সুযোগ খরচের অভাব ইত্যাদি নানা কারণে শিক্ষালাভ থেকে বঞ্চিত থাকে। শিক্ষাবঞ্চিত এই সকল ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া থেকে বঞ্চিত থাকার নানা সামাজিক কারণগুলো তাই খতিয়ে দেখা দরকার।
সমাজকে বাদ দিয়ে তো কিছু নয়, কাজেই শিক্ষার চুলচেরা বিশ্লেষণ করে উন্নয়নশীলতার একটা পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়া চাই। এই পর্যায়টা নিশ্চিতভাবেই সফলতার মুখ দেখে যখন আমরা সুস্পষ্টভাবেই সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিকে আরও পরিশীলিত করি। শিক্ষার উন্নয়নের ক্ষেত্রে এটি প্রয়োজন। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের সমাজ ব্যবস্থায় এটি বিশেষভাবে প্রয়োজন। সমাজ ব্যবস্থায় প্রকৃত স্থিরতা না থাকলে উন্নয়নের চাবিকাঠি অর্জন করা মুশকিল। শিক্ষাক্ষেত্রে নেয়া সঠিক সিদ্ধান্ত তাই টেকসই উন্নয়নের গ্যারান্টি দিতে পারে। সঠিক সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে প্রয়োজন সমাজ ব্যবস্থাকে পর্যবেক্ষণ করা, চিন্তাকে পরিশীলিত করা একই সাথে নিজের সমাজকে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। আমাদের দেশে বর্তমানে শিক্ষাক্ষেত্রে রাজনৈতিক অস্থিরতার যে চরম সময় পার করছে, এর থেকে বের হয়ে আসতে গেলে বোঝা প্রয়োজন, রাজনীতি করার প্রতি তাদের আগ্রহটা কীসের? স্বল্পসময়ে অর্থ আর ক্ষমতার প্রলোভনটাই কি তাদের বেশি টানে নাকি আরও অন্যান্য কারণ আছে। ব্যাপারটি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। এমনভাবে সামাজিক ঘটনাগুলোকে গবেষণা করে না এগুলে যে যুগের সাথে তাল মেলানো দায় হয়ে পড়ে। একুশ শতক তো ভিন্ন- এই অর্থে যে এখানে একটা বড় রকমের সামাজিক পরিবর্তন হল, আগের যে ছেলেমেয়েগুলো বাইরে দুরন্তপনা করে সময় কাটাতো, এখন তাদের সে সময়গুলো কাটে টেকনোলজির সাহচর্যে। কী করে এর ভেতর থেকেই একটা ‘মানুষ’ এর জন্ম দেয়া যায় সেইটেই ভাবা দরকার। কিন্তু সমাজের ঘটমান এসকল বিষয় সরকার, শিক্ষা গবেষক, পরিকল্পনাকারী এদের নজরে পড়তে হবে। সামাজিক গবেষণাকে তাই খেলো করে দেখলে হবে না। একটা মানুষকে রগড়ে ‘মানুষ’ বের করে নিয়ে আসা অতটা সহজ তো নয়! সমাজকে উন্মোচন করতে না পারলে সামাজিক সমস্যাগুলো চোখের সম্মুখে ধরা দেবে না কখনোই। শিক্ষার মানোন্নয়নে তাই চাই সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি।
লেখক পরিচিতি
ফারহানা মান্নান লেখক, শিল্পী, শিক্ষা-গবেষক। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাগবেষণায় স্নাতকোত্তর পর্যায়ে অধ্যয়নরত।