ভর্তি প্রক্রিয়ার একটি অংশ হলো ফোন ইন্টারভিউ। এ অংশটি হতে পারে দুই সময়ে— কোনো প্রফেসরের সাথে কাজ করা বা ফান্ডিং পাওয়া নিয়ে আলোচনা অনেকদূর আগালে প্রফেসর হয়তো শিক্ষার্থীর সাথে সরাসরি কথা বলতে চাইতে পারেন। আবার অনেক সময়ে ভর্তি প্রক্রিয়ার প্রাথমিক বাছাই শেষ হবার পরে শর্টলিস্টে থাকা প্রার্থীদের সাথে ভর্তি কমিটির প্রফেসরেরা কথা বলতে পারেন।
সেজন্য ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীর সাথে ইমেইলে যোগাযোগ করে একটি সময় নির্ধারণ করে নেয়া হয় যখন এই ইন্টারভিউটি নেয়া হয়।
কেন নেয়া হয় ফোন ইন্টারভিউ?
শিক্ষকতা জীবন শুরুর পর ভর্তি কমিটির সদস্য হিসাবে একাধিক ফোন ইন্টারভিউ নেয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার। এর ভিত্তিতে ফোন ইন্টারভিউ কেনো নেয়া হয় এবং কী কী দেখা হয়, তার ওপরে একটু ধারণা দেই।
কাগজে-কলমে একজন শিক্ষার্থী অসাধারণ হতে পারে। মানে, সিভি, জিপিএ এসবের ভিত্তিতে কাউকে খুব ভালো মনে হতে পারে। কিন্তু কথা বলে দেখে নেয়া হয়, আসলেই সেই শিক্ষার্থী এরকম ভালো কিনা। কাগজে-কলমে অসাধারণ মনে হওয়া অনেক শিক্ষার্থী হয়তো দেখা যায় ফোনে পুরোই উল্টো— কথাবার্তা মুখ ফুটে বলতে পারে না, অথবা সহজ প্রশ্নের জবাব দিতে পারে না। কিংবা টেস্ট স্কোর ভালো হলেও ইংরেজি বলতে পারে না আদৌ। এসব সমস্যা আছে কি না তা যাচাই করার জন্যই সাধারণত ফোন ইন্টারভিউ নেয় ভর্তি কমিটি।
কীভাবে নেয়া হয় ফোন ইন্টারভিউ?
ফোন ইন্টারভিউ নামটিতে ফোন থাকলেও ফোনেই হবে এমন কথা নাই। ইন্টারনেটের সুবিধা আসার পরে ফোনের পাশাপাশি ভয়েস ওভার আইপি ব্যবহার করে ইন্টারভিউ নেয়া হয়। এজন্য ব্যবহার করা হতে পারে স্কাইপ, হোয়াটসঅ্যাপ কিংবা গুগল হ্যাংআউট। আর ইন্টারভিউ অডিও এর সাথে সাথে ভিডিও চ্যাটও হতে পারে যাতে করে ভর্তি কমিটি বা প্রফেসর এবং শিক্ষার্থী একে অপরকে দেখতে পারেন কথাবার্তার সময়।
কাগজে-কলমে অসাধারণ মনে হওয়া অনেক শিক্ষার্থী হয়তো দেখা যায় ফোনে পুরোই উল্টো— কথাবার্তা মুখ ফুটে বলতে পারে না, অথবা সহজ প্রশ্নের জবাব দিতে পারে না। কিংবা টেস্ট স্কোর ভালো হলেও ইংরেজি বলতে পারে না আদৌ।
কী বিষয় যাচাই করা হয়?
ফোন ইন্টারভিউতে কী যাচাই করা হবে সেটি আসলে ইন্টারভিউকারীদের ওপরে নির্ভর করে। তবে কতোগুলা সাধারণ জিনিষ আছে যা দেখা হয়। প্রথমত, শিক্ষার্থীটি ইংরেজি কেমন বলছে, আটকে যাচ্ছে কিনা, আমতা আমতা করছে কিনা ইত্যাদি। টোফেল বা আইইএলটিএস-এর স্কোর ভালো হলেও অনেক সময়ে ইংরেজি বলতে অভ্যস্ত না থাকায় অনেকে এখানে আটকে যান। ভর্তি কমিটি এটিই দেখে— শিক্ষার্থীটি কাগজে-কলমে ইংরেজি পারে নাকি আসলে বলতেও পারে।
এরপর দেখা হয় শিক্ষার্থীটি নানা প্রশ্নের জবাব দিতে পারছে কিনা। একটি বেশ প্রচলিত প্রশ্ন হলো, কেনো উক্ত গ্রাজুয়েট স্কুলে মাস্টার্স বা পিএইচডি করতে চান, কী বিষয়ে আগ্রহ, কেনো এই বিশ্ববিদ্যালয়টি বেছে নিলেন, এরকম।
অনেক সময়ে শুরুই করা হয় এভাবে— Tell me about yourself; অর্থাৎ নিজের সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয় শিক্ষার্থীটিকে। এক মিনিটে নিজের সম্পর্কে গুছিয়ে কী বলতে পারে সেটা দেখার জন্য। পিএইচডি বা মাস্টার্স লেভেলের প্ল্যান কী? পাস করার পরে কী করতে চান এসব প্রশ্ন আসতে পারে। আবার দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা কী, সেটিও যাচাই করা হতে পারে। এক্ষেত্রে প্রশ্ন আসতে পারে পাঁচ বছর পরে কোথায় দেখতে চান নিজেকে। আর প্রায় সব ক্ষেত্রেই ইন্টারভিউয়ের শেষে প্রশ্ন করা হবে— Do you have any questions?
ইন্টারভিউতে ঝামেলা হয় কীভাবে?
ফোন ইন্টারভিউ ভজঘট বাঁধতে পারে বেশ কিছু কারণে। আসুন, দেখা যাক সেগুলো। প্রথমেই আসে ফোন লাইনের গণ্ডগোল। ফোন লাইনে কথা যদি শোনা না যায় অথবা খড়খড় শব্দের কারণে কথা বুঝতে ঝামেলা হয়, সেটি বেশ বিরক্তিকর এবং আপনার সম্পর্কে ইম্প্রেশন খারাপ করে দিবে আপনি যতোই ভালো প্রার্থী হন না কেনো।
এরপর আসছে কথাবার্তা বলা। ইংরেজিতে খাবি খাওয়া, তোতলানো— এসব আসলে আপনার ইংরেজি বলার দক্ষতা নিয়ে প্রশ্নের কারণ হবে। বিদেশী শিক্ষার্থী হিসাবে চোস্ত ইংরেজি বলবেন সেটি আসলে কেউই আশা করছে না, বাংলাদেশী এক্সেন্টে কথা বললে সেটিও সমস্যা না। কিন্তু একটি বাক্য বলতে গিয়ে যদি দশবার ইয়ে ইয়ে অথবা আই মিন, ইউ নো এরকম হোঁচট খান, তাহলে সেটি সমস্যা।
আর প্রশ্নের জবাবে অতিরিক্ত তৈলমর্দন করা কথা বলাও ভালো না। প্রফেসরেরা শিক্ষার্থীদের কথা শুনে অভ্যস্ত। তাঁরা সহজেই ধরতে পারেন কে তেলাচ্ছে, আর কে আসলেই নিষ্ঠাবান। কারো কথা শুনে যদি মনে হয় সে সব কথাতেই হুজুর হুজুর করছে, সেটি খারাপ দেখায়।
আরেকটি ব্যাপার হলো, অল্প কথায় সরাসরি জবাব না দিয়ে দীর্ঘ জবাব দেয়া। অথবা রবোটের মতো বলা, কিংবা কাগজে চোথা দেখে বা মুখস্ত বলছেন— এমন মনে হওয়া।
আমার অভিজ্ঞতায় এমন অনেক সময় গেছে যখন খুব সহজ একটি প্রশ্ন করেছি কিন্তু জবাবে শিক্ষার্থীটি প্রায় মিনিটখানিক ধরে দীর্ঘ জবাব দিয়েই চলেছে। এদিকে আমি আর আমার কলিগেরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি কখন এই জবাব শেষ হবে তা নিয়ে। অথবা প্রশ্ন করামাত্রই হড়বড় করে বিটিভির খবর পড়ার মতো করে বলছে, শুনে মনে হচ্ছে হাতে প্রশ্ন-আর-জবাবের গাইড বই নিয়ে কথা বলছে।
প্রফেসরের সাথে রিসার্চ নিয়ে ফোন ইন্টারভিউয়ের সময়ে আরো একটি গণ্ডগোল হতে পারে। প্রফেসরেরা সাধারণত নিজের রিসার্চের সাথে মিল আছে কিনা বা নিজের রিসার্চ এরিয়াগুলাতে শিক্ষার্থীর আগ্রহ কেমন সেটি জানতে চান কথা বলে। প্রায় সময়েই শিক্ষার্থীরা প্রফেসরকে পটানোর জন্য প্রফেসরের সাইট দেখে যা যা লেখা আছে তার সবগুলাতেই আগ্রহ এমন ভাব দেখান।
আমার অভিজ্ঞতায় এমন অনেক সময় গেছে যখন খুব সহজ একটি প্রশ্ন করেছি কিন্তু জবাবে শিক্ষার্থীটি প্রায় মিনিটখানিক ধরে দীর্ঘ জবাব দিয়েই চলেছে। এদিকে আমি আর আমার কলিগেরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি কখন এই জবাব শেষ হবে তা নিয়ে।
এখানে সমস্যা দুটো। এক, প্রফেসরের সাইটের তথ্য হালনাগাদ করা নাও থাকতে পারে যার ফলে সেই সব বিষয়ে প্রফেসর এখন আর কাজ নাও করতে পারেন। দুই, অন্যদিকে, সব-বিষয়েই-আগ্রহী এমন ভাব দেখালে প্রফেসরের মনে হতে পারে, এই শিক্ষার্থীর গভীরতা কম, ভর্তির মতলবে সবকিছুতেই আগ্রহের ভান করছে।
পরিশেষে দেখা যাক ভিডিও থাকলে অতিরিক্ত সমস্যা কী হতে পারে। আপনার পোষাক যদি অতিরিক্ত ক্যাজুয়াল হয় অথবা চকরাবকরা হয়, তাহলে সেটি দৃষ্টিকটু। আবার অন্ধকার ব্যাকগ্রাউন্ড, কিংবা ব্যাকগ্রাউন্ডে অগোছালো ময়লা এরকম হয় তাহলে সেটি অবচেতনভাবে হলেও ইন্টারভিউ নেয়া মানুষদের মনে প্রভাব ফেলবে।
ফোন ইন্টারভিউ আসলে বড় একটি সুযোগ, আবার বড় আশঙ্কারও ব্যাপার বটে। ফোন ইন্টারভিউয়ের মাধ্যমে আবেদনের ভিত্তিতে আপনার ওপর যে ধারণা আছে সেটি খারাপ হয়ে যেতে পারে, আবার আবেদনের অনেক সমস্যা এড়ানো যেতে পারে। কাজেই ফোন ইন্টারভিউ সফল করার জন্য দরকার কিছু প্রস্তুতি।
ফোন লাইন
শুরুতে আসি ফোন লাইন নিয়ে। এমন ফোন লাইন বেছে নিন, যাতে কথা স্পষ্ট শোনা যায়। ফোনের স্পিকার ভালো না থাকলে মাইকওয়ালা হেডসেট ব্যবহার করুন যাতে করে ভালো শুনতে পারেন এবং ফোন কানে চেপে রাখার টেনশন না থাকে।
এছাড়া এমন জায়গায় কথা বলুন যেখানে চারিদিকের শব্দ নেই বেশি। ল্যান্ড লাইন হলে সুবিধা, কলের মানের দিক থেকে। মোবাইলের ক্ষেত্রে ভালো রিসেপশন আছে এমন জায়গা বেছে নিন। হাতের সামনে খাতা-কলম রাখুন, পারলে ল্যাপটপ ও ইন্টারনেট অবশ্যই। ইন্টারভিউ যদি ভয়েস ওভার আইপি যেমন স্কাইপের মাধ্যমে হয়, সেই ক্ষেত্রে ইন্টারনেট লাইন ভালো আছে এমন জায়গা বেছে নিন।
পোশাক ও আলো
ভিডিও ইন্টারভিউ হলে আগে থেকে আলো ও ব্যাকগ্রাউন্ড কেমন দেখা যায় তা খেয়ালে রাখুন। পোশাক আনুষ্ঠানিক বা ফর্মাল থাকাই ভালো, তবে বেশি ফর্মাল আবার হাস্যকর লাগতে পারে।
হোমওয়ার্ক
ইন্টারভিউতে যেসব প্রশ্ন সচরাচর করা হয়, সেগুলার জবাব তৈরি করে রাখুন। যেমন, কেনো আপনি এই বিষয়ে পড়তে চান, কেনো এই বিশ্ববিদ্যালয় বেছে নিলেন, কোন বিষয়ে পিএইচডি করতে চান, কেনো করতে চান, পাশ করে কী করবেন, দীর্ঘমেয়াদে কী করার ইচ্ছা, ৫ বছর পর নিজেকে কোথায় দেখতে চান, এসব।
এর সাথে সাথে ইউনিভার্সিটি এবং ডিপার্টমেন্টের নানা প্রফেসরদের সম্পর্কে হোমওয়ার্ক করে রাখুন, যাতে কে কীসের ওপর কাজ করছে আন্দাজ থাকে। প্রফেসরদের ওয়েবসাইট ছাড়াও তাদের পাবলিকেশনের পেইজ দেখে বোঝার চেষ্টা করুন কীসের ওপরে তাঁরা কাজ করছেন।
প্রশ্ন করা
ইন্টারভিউতে আপনাকে অবশ্যই সবশেষে জিজ্ঞাসা করা হবে যে, আপনার কোনো প্রশ্ন আছে কিনা। এর জবাবে আপনি যদি কিছুই নাই বলেন তাহলে ধরে নেয়া হবে আপনার আগ্রহ কম। কাজেই উত্তর জানা থাকলেও কিছু প্রশ্ন তৈরি করে রাখুন। খুব বেশি নয়— ২/৩টি। এর মাধ্যমে আপনি আপনার আগ্রহটিকে প্রকাশ করবেন।
আয়নার সামনে থেকে জবাব দেয়া অনুশীলন করেন, কারণ আপনার মুখভঙ্গী দেখা না গেলেও কথার ধাঁচে/টানে আপনার মুখে হাসি না রাগ না বিরক্তি না ভয়, তার লেশ এসে পড়ে। কাজেই ফোনে কেবল কথা হলেও জোর করে হাসিমুখে বলার অভ্যাস করেন, আপনার কথায় তার ছাপ পড়বেই।
অনুশীলন
সবশেষে পরামর্শ হলো টেনশন কম করুন। নিজে আসলে যেমন, নিজের পরিবারের সাথে নির্ভয়ে যেভাবে কথা বলেন, সেভাবেই বলেন। আপনার সাবলীলতা অনেক বেশি কাজ দেবে কাউকে কথা বলে ভালো ইম্প্রেশন দেয়ার ক্ষেত্রে।
যদি নিতান্তই ভয় পেতে থাকেন, তাহলে কোনো বন্ধুকে অনুরোধ করে মক-ইন্টারভিউ দিন, মানে বন্ধুকে বলেন ফোন করে ইন্টারভিউয়ের মতো করে প্রশ্ন করতে। আর আয়নার সামনে থেকে জবাব দেয়া অনুশীলন করেন, কারণ আপনার মুখভঙ্গী দেখা না গেলেও কথার ধাঁচে/টানে আপনার মুখে হাসি না রাগ না বিরক্তি না ভয়, তার লেশ এসে পড়ে। কাজেই ফোনে কেবল কথা হলেও জোর করে হাসিমুখে বলার অভ্যাস করেন, আপনার কথায় তার ছাপ পড়বেই।
লেখক পরিচিতি
ড. রাগিব হাসান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্যা ইউনিভার্সিটি অব অ্যালাবামা অ্যাট বার্মিংহাম-এ অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। তিনি বাংলাদেশের শিক্ষার নানা প্রসঙ্গ নিয়ে নিয়মিত লেখালেখি করছেন।