মাদ্রাসা মানসিকতা ও ধর্মের সীমানা

আমাদের এক খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক বলে বেড়াচ্ছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণাটাই এসেছে মাদ্রাসা থেকে। আসলেও কি তাই? যদি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আদর্শ বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে ধরে নেওয়া হয়, তাহলে তাঁর কথা হয়তো সত্য। কারণ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীদের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যে উদ্দেশ্য নিয়ে চালিত, সেটি হলো ডিগ্রি প্রদান। দুনিয়াতে ডিগ্রি প্রদানের ধারণাটা এসেছে মাদ্রাসা থেকে, এটি সত্য।

আমেরিকার আফগানিস্তান থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেবার পর যেমন সেখানে একটা ক্ষমতার শূন্যতা বিরাজ করছে, রোমের পতনের পর খৃষ্টাব্দ ৫০০-এর পর থেকে পূর্ব রোমের অধিকৃত এলাকাগুলোতে তেমনই শুন্যতা বিরাজ করছিলো।

এরকম ক্ষমতার শূন্যতায় নিকটবর্তী শক্তি সেই এলাকার দখল নিয়ে নেয়, কিন্তু মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দূর করা ও চাহিদা পুরণ করার মতো সামর্থ তাদের থাকে না। ঠিক আফগানিস্তানের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দূর করা ও চাহিদা পুরণের সামর্থ যেমন পাকিস্তানের নেই।

মানুষ যখন কোনো আশার আলো ছাড়া ভুগতে থাকে, তখনই আদর্শবাদ তাদের আরও গ্রাস করে নেয়। তারা আঁকড়ে ধরে কোনো তাত্ত্বিক ধারণা যার ফলে মুক্তি মিলবে বলে তারা মনে করে।

ঠিক এখনই যদি আমেরিকা সারা দুনিয়া থেকে তাদের গুটিয়ে নেয়, সারা দুনিয়ায় একটি ক্ষমতার শূন্যতা সৃষ্টি হবে। সেটির ফলে স্থানীয় দখলকারীরা তাদের হস্ত প্রসারিত করবে নিকটবর্তী এলাকাগুলোতে।

কিন্তু সেখানকার মানুষের সমস্যা সমাধান করার মতো অতিরিক্ত সম্পদ বা ক্যাপাসিটি তাদের নেই। এর ফলে ভুক্তভোগী মানুষের ইহলৌকিকতায় ক্রমেই বিশ্বাস হারানোর ফলে সারা দুনিয়াতেই আদর্শবাদের প্রসার ঘটবে।

ঠিক এটিই ঘটেছিল রোমের পতনের পর। নবী মুহম্মদের জীবনকালে ইসলামের প্রসার মোটামুটি সৌদি আরবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো (মদীনা, মক্কা থেকে ইয়েমেন পর্যন্ত)। তাঁর মৃত্যুর পর চার খলিফা তথা রাশেদুন আমলে ইসলাম প্রসার লাভ করে অস্বাভাবিক দ্রুত। আফ্রিকার মিসর থেকে সিরিয়া, আর্মেনিয়া, ইরান থেকে আফগানিস্তান পর্যন্ত ইসলাম ছড়িয়ে পড়ে মাত্র ২৯ বছরে।

এর পর উমাইয়াহ আমলের (৬৬১-৭৫০) ৯০ বছরে লিবিয়া, স্পেন, তুরস্ক, মধ্য এশিয়া হয়ে ভারত পর্যন্ত ইসলাম বিস্তার লাভ করে। মাত্র ১২০ বছরে তখনকার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ দুনিয়াব্যপী ইসলাম বিস্তার কেন করতে পারল ইতিহাসবিদদের কাছে সেটি একটা বিস্ময়।

তবে এই বিষয়ে যদি সারা দুনিয়াকে সামরিকীকরণ ও নিপিড়িত মানুষের মনোবিজ্ঞান বিবেচনায় নেওয়া যায়, তাহলে এটি কেন হলো তার উত্তর পাওয়া যায়। তবে সেই আলোচনা পরে কখনও বিশদভাবে করা যাবে, বর্তমান লেখাটির উদ্দেশ্য সেটা নয়।

এখন মাত্র ১২০ বছরে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ দুনিয়াব্যপী ইসলাম বিস্তারের ফলে প্রধান সমস্যা হলো, বিচিত্র সব দেশে বিচিত্র সব সংস্কৃতিতে প্রকৃত ইসলাম কী সেটির সঠিক প্রশিক্ষণ দেওয়া। দেখা গেলো, যার যেমন খুশি সে তেমনভাবে ইসলামকে ব্যাখ্যা করছে।

সেই কারণে রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষণা করা হলো, ইসলাম সম্পর্কে যে শেখাবে, অর্থাৎ যিনি প্রশিক্ষক বা হুযুর, তিনি যে ইসলামের সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত তার সনদ থাকতে হবে। নির্দিষ্ট মাদ্রাসা থেকে সনদ না নিলে কেউ প্রশিক্ষক হতে পারবেন না।

রোমের পতনের পর পূর্ব রোম রাজ্যগুলো যেমন মুসলিমশাসিত হয়ে গেল, প্রকৃত রোম তথা ইউরোপীয় অঞ্চলে তখন একইভাবে খ্রীষ্টধর্ম বিস্তারলাভ করে; কারণ ৪০০ সালেই রোম সম্রাট কনস্টানটিনের আমলে খ্রীস্টধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করে।

ইউরোপে যখন উচ্চশিক্ষার প্রসার ঘটতে শুরু করে, তখন রোমের প্রভাবে সেখানকার রাজতন্ত্রগুলো ছিলো পোপ বা খ্রীষ্টধর্মীয় যাজকদের নিয়ন্ত্রণে। উচ্চশিক্ষার প্রসারে চার্চ এবং রাজা উভয়েই হুমকি অনুভব করে এবং মুসলিম মাদ্রাসার অনুকরণে উচ্চশিক্ষার শিক্ষকদের ডিগ্রি প্রদানের আইন চালু করে।

এই ডিগ্রি প্রদান কাকে করা হবে তার নিয়ন্ত্রণ থাকে রাজা এবং পোপের ওপর। এ বিষয়ে বিশদ আছে এই লেখার ‘রাজনৈতিক মূর্খতা’ অংশে।

ইউনির্ভাসিটি অব বোলোনিয়া শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের একটি স্বাধীন সংঘ বা একাডেমিক গিল্ড তৈরি করার মাধ্যমে ১২ শতকে শিক্ষায় চার্চ ও রাষ্ট্রের রাজনীতি নিয়ে বিভক্ত শিক্ষিত সমাজ এর থেকে বের হবার পথ তৈরি করে। একই সময় ফ্রান্সের ইউনিভার্সিটি অব প্যারিস ও লন্ডনের ইউনির্ভার্সিটি অব অক্সফোর্ড একই রকম একাডেমিক গিল্ড তৈরি করে জ্ঞানের স্বাধীনতার পথ উন্মুক্ত করে রাষ্ট্রের ও চার্চের আওতামুক্ত হতে।

সুতরাং, বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণাটা মাদ্রাসা থেকে আসেনি, মাদ্রাসা থেকে এসেছে সার্টিফিকেটের ধারণাটা। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আমরা যখন থেকে জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র থেকে পেশাগত প্রশিক্ষণকেন্দ্র বানিয়ে সার্টিফিকেট প্রদানের কেন্দ্র বানিয়ে ফেলেছি, ধর্ম আবার সেখানে ফিরে এসেছে রাশেদুন এবং উমাইয়া খিলাফত আমলের সর্বশক্তি নিয়ে যেখানে ধর্ম আর সরকারপ্রধান নিয়ন্ত্রণ করে বিশ্ববিদ্যালয়কে।

মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণের ফলে ছোটবেলা থেকে ইসলামের গর্ব ও ইগো নিয়েই বড় হয়েছি। জ্ঞান-বিজ্ঞানের অধ্যয়নে ৯০০ থেকে ১২০০ শতকের ইসলামের স্কলারদের জ্ঞানেবিজ্ঞানে চিন্তা ও কাজ অনুপ্রাণিত করেছে।

কিন্তু মনে সবসময় প্রশ্ন ছিলো, ১২০০ সালের পর তো ইসলাম শেষ হয়ে যায়নি। তার পরিধি এবং প্রসার বহুগুণে বেড়েছে। ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং খনিজ তেল আবিষ্কার ও তার মূল্যবৃদ্ধির পর ইসলামী দেশগুলো সর্বোচ্চ ধনী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে।

কিন্তু ইসলামী সমাজগুলোর জ্ঞানেবিজ্ঞানে সেই উৎকর্ষতা কোথায় হারিয়ে গেল? পরিস্থিতি এখন এমন, যেখানেই ইসলাম সেখানেই নির্বুদ্ধিতা, আবদ্ধ চিন্তা, শর্টকার্ট চিন্তা এবং জ্ঞানের প্রতি চরম অবহেলা।   

জ্ঞানবিজ্ঞানে যতোই অগ্রসর হয়েছি, আরেকটা বিষয় আমাকে বিস্মিত করেছে যে, ৮০০-১২০০ সালের মুসলিম জ্ঞানী ও বিজ্ঞানীরা যে বিষয়েই কাজ করেন না কেন, জীবন ও বিশ্বপ্রকৃতি সম্পর্কে তাঁরা যে পরিষ্কার চিন্তাধারা ধারণ করতেন সেটি গেলো কোথায়?

যে দেশেই হোক, যখন থেকে মুসলিমরা সমাজ অর্থনীতি ও রাজনৈতিক ক্ষমতা অধিগ্রহণ করেছে, যখন থেকে তারা সবকিছুতে ইসলামী আদর্শ প্রয়োগ করেছে, তখন থেকে পরিষ্কার চিন্তাধারা, সুস্থ দিগদর্শন ও আবিষ্কার উদ্ভাবন, সমস্যা সমাধান যেন হারিয়ে গেছে।

যদি তাই হবে, তাহলে ৮০০-১২০০ সালের মুসলিম জ্ঞানী-বিজ্ঞানীরা এত ভালো করলেন কীভাবে? এই প্রশ্নের জবাব আছে নবী মুহম্মদের সময় যে ইসলাম মদীনা মক্কা ছেড়ে বেশিদুর যেতে পারেনি, সেটা মাত্র ১২০ বছরে প্রায় অর্ধেক দুনিয়াব্যপী বিস্তার করতে পারল কেন সেই ধাঁধার জবাবে। এবং সেই ধাঁধার জবাব আছে ২০২১ সালে মাত্র কয়েক সপ্তাহে তালেবানেরা কীভাবে দখল করে নিলো আফগানিস্তান, সেই ধাঁধার উত্তরে।

১৯৭৯-এর প্রাক সোভিয়েত আফগানিস্তানকে যদি তালেবানরা দখল করতে চাইতো, তাহলে হয়তো কখনই তারা সেটা পারতো না। পারলেও সেটি হতো বহুবছরব্যাপী গৃহযুদ্ধের ফল। কিন্তু বিদেশি দ্বারা দখল হয়ে বিদেশি শক্তির হাতে প্রশিক্ষিত ও বিদেশী অস্ত্রে সজ্জিত হবার পর বিদেশী শক্তি চলে গেলে যখন তারা পক্ষত্যাগ করে, তখন তাদের শক্তিকে ব্যবহার করে আদর্শবাদীদের বিজয় অতি সহজ হয়ে যায়।

২০২১ সালে আফগানিস্তানে যে বিষয়টা ঘটে তালেবানদের বিজয় এনে দিয়েছে ঠিক সেভাবেই বিজিত হয়েছিল ইসলাম মুহম্মদের মৃত্যুর পর যখন রোম গুটিয়ে নিয়েছিল নিজেকে তার বিশাল সাম্রাজ্য থেকে। একুশ শতকে আমেরিকানরা আফগানিস্তানে এবং সাতশ শতকে রোমানরা বা ৮০০ শতকে পারস্য যে ইনটেলেকচুয়াল অর্ডার প্রতিষ্ঠা করেছিলো, সেই অর্ডার ব্যবহার করেই সহজ জয় পেয়েছে মুসলিমরা।

কিন্তু তারা যখন সমাজের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে, সেই সমাজ থেকে ক্রমেই হারিয়ে গেছে ইনটেলেকচুয়াল অর্ডার। তারা তখন সেখানে প্রতিষ্ঠা করেছে ধর্মীয় অর্ডার যার ফলে বন্ধ হয়ে গেছে সকল বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রগতি।

যুদ্ধ ও রাজনীতির মতো ঠিক একই ঘটনা ঘটেছে বুদ্ধিবৃত্তি এবং উচ্চশিক্ষা চর্চার ক্ষেত্রে। ব্রিটিশরা যতোদিন ভারতবর্ষ শাসন করেছে, তারা স্থাপন করেছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। সেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চরম আর্থিক দৈন্যতা এবং শিক্ষার স্বল্প প্রসারের মাঝেও দেখিয়েছে চরম উৎকর্ষতা। কারণ ব্রিটিশরা প্রতিষ্ঠা করেছিল সেই ইনটেলেকচুয়াল অর্ডার।

তারা চলে যাবার পর যখন মুসলিমরা হর্তকর্তা হয়ে যায় সেই ইনটেলেকচুয়াল অর্ডার ভেঙে পড়ে। সেটি প্রতিস্থাপিত হয় ধর্মীয় অর্ডার দ্বারা। বন্ধ হয়ে যায় জ্ঞানবিজ্ঞানের অগ্রগতির সকল পথ। উচ্চশিক্ষা ও জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রয়োজন ইনটেলেকচুয়াল অর্ডার। দার্শনিক চিন্তা একটি পর্যায়ের পর মুসলিমদের জন্য নিষিদ্ধ। যতো বড় ডিগ্রিই থাক জ্ঞানের সেই স্তরে তারা নিরক্ষর।

এই নিরক্ষরতার ফলে তৈরি হয় ডিসঅর্ডার। যখন তারা সকলে মিলে দার্শনিক চিন্তা করতে চায় বা ভবিষ্যৎকে দেখতে চায়, তখন তৈরি হয় ক্যায়স। সেই ক্যায়স নিয়ন্ত্রণে তারা আরোপ করে ধর্মের অর্ডার। সেটি শেষ করে দেয় উচ্চশিক্ষা আর জ্ঞান অর্জনের সকল সম্ভাবনা।            

মুসলিম দর্শন একটি প্যারাসিটিক দর্শন, যেটি জ্ঞান ও বুদ্ধিতে এগিয়ে যাওয়া জাতীকে দখল করে তার ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকে। নিজের বৃদ্ধির জন্য তার কোন শেকড় নেই। জ্ঞানের বিকাশের জন্য সেটি একটি অবচেতনের সীমানা টেনে দেয়। উচ্চশিক্ষা ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সফল করতে হলে সেগুলো ধর্মনিয়ন্ত্রিত হলে ব্যর্থ হবে।

লেখক সম্পর্কে

সিরাজুল হোসেন

সিরাজুল হোসেন

সিরাজুল হোসেন বিশেষ জ্ঞান, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন এবং সেগুলোর সামাজিক প্রয়োগে বিশেষজ্ঞ। পাশাপাশি, তিনি ইনোভেশন অ্যাডভাইজার, ডিনেট ও এমডি সাইবারনেটিক সিস্টেমস লিমিটেডে কর্মরত।

মন্তব্য লিখুন