আমাদের বর্তমান সরকার আমাদের শিক্ষার ক্ষেত্রে বেশ কিছু যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছেন। এই পদক্ষেপগুলো আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরো সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। তাই এই সরকারের কাছে আমরা যারা শিক্ষা নিয়ে কাজ করি বা চিন্তা-ভাবনা করি তাদের চাওয়া অনেক। কারণ মানুষের চাওয়া-পাওয়ার তো আর শেষ নেই এবং এইগুলো আমাদের শিক্ষাকে একটি মানসম্মত এবং আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে গড়ে তোলার জন্যই চাওয়া। আমাদের সরকার প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে অনেক সময়োপযোগী এবং কার্যকরী সিন্ধান্ত নিয়ে অনেক সফলতার সাথে তার বাস্তবায়ন দেখিয়েছেন। নিঃসন্দেহে তা প্রশংসার দাবিদার। কিন্তু উচ্চ শিক্ষা যা হাজারটা সমস্যার আবর্তে আবর্তিত তার জন্য আমরা কি কোন পদক্ষেপ আশা করতে পারি না?

যেকোন জাতির জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার ঘটে উচ্চ শিক্ষার হাত ধরে। উচ্চ শিক্ষা নতুন নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত করে জাতিকে। আর আমাদের দেশে এই উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থাই অনেক সমস্যার জালে জড়িত। সবগুলো নিয়ে এখন কথা বলা সম্ভব না, সেই সবগুলো একসাথে সমাধানও সম্ভব নয়। আমরা সেটা আশাও করতে পারি না। তবে আজকে যে সমস্যাটির কথা আলোচনা করতে চাচ্ছি সেটি হচ্ছে ভর্তি পরীক্ষা। আমি বলতে চাচ্ছি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ এবং ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার কথা।

কিছুদিন আগে কায়কোবাদ স্যার প্রথম আলোতেই তাঁর একটি লেখায় এই ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে সুন্দর এবং যুগোপযোগী কিছু মতামত দিয়েছিলেন। আমি তাঁর মতামতের সাথে সম্পূর্ণ একমত। তিনি বলেছিলেন, বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো আন্তর্জাতিক মানের পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করার কথা। অবশ্যই তা করা জরুরী। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য SAT বা GRE মানের পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করার জন্য অনেক গবেষণা প্রয়োজন এবং সেটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই আমরা একটু অন্যভাবেও এই সমস্যার সমাধান করে আমাদের শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের কষ্ট লাঘব করতে পারি; যতদিন না SAT বা GRE মানের পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করা সম্ভব হচ্ছে ততদিনের জন্য। তার আগে একটু দেখি এই ভর্তি পরীক্ষার জন্য কী ধরনের দুর্ভোগ অভিবাবক ও শিক্ষার্থীদের পোহাতে হচ্ছে।

বেনবেইস এর ২০০৯ সালের তথ্য অনুসারে বর্তমানে বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৩১টি এবং পাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫১টি। অন্য সব জায়গাতে বলা হয়েছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বলা হয়েছে ২২টি এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বলা হয়েছে ৪৯টি। ধরলাম, এইচএসসি পাশের পর একজন শিক্ষার্থী এমন রেজাল্ট করলো যা কারণে সে সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির যোগ্যতা অর্জন করলো। এখন সে যদি ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে (পাবলিক) ভর্তি পরীক্ষা দিতে চায় তাহলে তার খরচ কেমন হতে পারে?

মোটামুটি একটি খরচ দাঁড় করানোর চেষ্টা করি। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ফরমের দাম ন্যূনতম ৫০০টাকা হয় তাহলে ফরম বাবদ খরচ দাঁড়ায় (৫০০x২০) ১০০০০টাকা। এর সাথে আনুষাঙ্গিক নানা রকম খরচ তো রয়েছেই। যেমন ফরম প্রিন্ট করা, ফরম জমা দেওয়া, ব্যাংক ড্রাফট করা ইত্যাদি। এইসব খরচ বাদ দিলেও ১০০০০টাকা খরচের ব্যাপারটি যদি চিন্তা করি, তাহলে বলা যায় একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য এটি বিশাল একটা বোঝা। নির্দিষ্ট পরিমাণ বেতনের টাকায় যাদের সংসার চালাতে হয় তারা এই বাড়তি খরচের বোঝা কীভাবে বহন করে আমার জানা নেই। এখন হয়তো কথা আসতে পারে কেন এই ২০টিতেই পরীক্ষা দিতে হবে। আমাদের দেশে প্রেক্ষাপটে বলা যায়, যত ভালো শিক্ষার্থীই হোক না কেন- সে বা তার অভিভাবক নিঃসন্দেহে কখনই বলতে পারবেন না, তার বা তাদের সন্তান এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় টিকবে।

সেক্ষেত্রে অনেকগুলো অপশন খোলা রাখতেই হয়। ফরমের খরচের কথা গেলো, এখন যদি এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের কথা ভাবি তাহলে আবার আমাদের চিন্তা করতে হবে খরচের কথা। হাতে গোনা কয়েকটি ছাড়া বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই ঢাকার বাইরে (আমি ঢাকাবাসী বলে ঢাকাকেন্দ্রিক চিন্তা করছি) এবং তাদের ভর্তি পরীক্ষাও অনুষ্ঠিত হয় ঐসব এলাকায়। ঢাকায় থাকা একজন শিক্ষার্থী যদি ঢাকার বাইরে পরীক্ষা দিতে যেতে চায় তাহলে পরীক্ষা দেওয়া জন্য থাকা, খাওয়া, আসা-যাওয়া সব যদি চিন্তা করি তাহলে একবার ভাবুন খরচটি কি আর আমাদের হাতের মধ্যে থাকছে কিনা! আর ছেলে পরীক্ষার্থীরা নিজেরা কয়েকজন মিলে পরীক্ষা দিতে সারা দেশে যাতায়াত করতে পারলেও মেয়ে পরীক্ষার্থীদের সেই সুযোগ নেই। তাই তাদের সাথে তাদের অভিভাবকদেরও ছুটতে হয়, ফলে খরচ হয়ে দাঁড়ায় ডাবল। আবার এই ভয়েই অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানদের (বিশেষ করে মেয়েদের) সব জায়গায় পরীক্ষা দেওয়াতেও পারেন না বা চান না।

আমার নিজের প্রয়োজনেই এবার কয়েকজন অভিভাবকের সাথে কথা বলতে হয়েছিলো যাদের সন্তানেরা এবার ভর্তি পরীক্ষা দিচ্ছে। তাদের অনেকেরই সন্তানটি মেয়ে এবং সেই মেয়েকে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়ার জন্য তাদের সারা দেশের নানা জায়গাতে ছোটাছুটি করতে হয়েছে। একজন অভিভাবককে বলতে শুনেছি তার মেয়েকে নিয়ে সে ময়মনসিংহ থেকে টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানীতে পরীক্ষা দেওয়ানোর জন্য তার খরচ হয়েছে মোট ৮০০০টাকা। এই টাকাটা তার লেগেছে শুধু ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য টাঙ্গাইলে আসা, হোটেলে থাকা-খাওয়ার জন্য।

এটি এখন অসম্ভব কথা নয়, কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে দুইটি ভিন্ন ভিন্ন ইউনিটে পরীক্ষা হয়েছে দুটি ভিন্ন দিনে, সেক্ষেত্রে আসা-যাওয়া ধরে কমপক্ষে তাকে তিনদিন হোটেলে থাকতে হবে, আর একটু ভালো মানের হোটেলে থাকার চেষ্টাই সবাই করে। আমি মোটামুটিভাবে চেষ্টা করছি এটা বোঝাতে যে এই পরিমাণ টাকার খরচটা স্বাভাবিক। এই টাকাটি কয়টি মধ্যবিত্তের পরিবার বহন করতে পারে? এতো গেলো খরচের একটি দিক, সেই পরীক্ষার্থীর কথা চিন্তা করুন যাকে এতগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা দিতে হচ্ছে! উচ্চ শিক্ষা বিষয়ে তার শোচনীয় অবস্থাটি আমাদের চিন্তার বাইরে। মানসিক এবং শারীরিক যে চাপ তার ওপর পরে সেটা কল্পনাতীত। এইভাবেই চলে আসছে আমাদের উচ্চ শিক্ষার ভর্তি যুদ্ধ। আমি জানি না আর কতদিন এটা চলবে। তবে বিষয়টি নিয়ে ভাবনা এখন জরুরী।

বর্তমানে আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মূলত পাঁচ ধরনের।
১. সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়)
২. বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (৫টি-দিনাজপুর, পটুয়াখালি, নোয়াখালি, সিলেট, টাঙ্গাইল)
৩. ইঞ্জিনিয়ারিং এবং প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (৫টি-বুয়েট, ডুয়েট, কুয়েট, চুয়েট, রুয়েট)
৪. কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (৩টি)
৫. টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় (১টি)

এই সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়েই ভর্তি পরীক্ষা হয় আলাদা আলাদা ভাবে। যদিও এই পাঁচ ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে আন্তঃমিল রয়েছে। একটু উদাহরণ দেওয়া যাক। যেমন- ইঞ্জিনিয়ারিং যারা পড়তে চায় তাদের এই ৫টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফর্ম নিতে হয়। এই ৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে যদি এমন একটি ব্যবস্থা গড়ে তোলা যেতে পারে যার মাধ্যমে একটি ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমেই ৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কার্যক্রম সম্পাদন করা সম্ভব হবে। যেমনটি হয়ে থাকে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার ক্ষেত্রে। সেখানে একবার মাত্র ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হয় এবং সেই পরীক্ষার ফলের ওপর নির্ভর করেই কে কোন মেডিকেলে পড়তে পারবে তা নির্ধারিত হয়। ইঞ্জিনিয়ারিং এবং প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও আমরা এই নিয়ম আনুসরণ করতে পারি।

একইভাবে সবগুলো কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়কেও যদি আমরা একটি ভর্তি পরীক্ষার আওত্তায় আনতে পারি তাহলে তা শিক্ষার্থীদের জন্য অনেক সুবিধাজনক হবে। এমনিভাবে সদিচ্ছা থাকলে আমরা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এই পদ্ধতির আওত্তায় আনতে পারি। এর ফলে কী কী সুবিধা আমরা পাবো তা যদি একবার দেখি-
• শিক্ষার্থী শারীরিক ও মানসিক চাপ অনেক কমে যাবে
• বার বার পরীক্ষা দেবার ঝামেলা থাকবে না
• অভিভাবকদের কষ্ট ও খরচ এবং দূর্ভাবনা কমবে
• ছেলে এবং মেয়েরা সমানভাবে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবে
• প্রশাসনিক কাজে দ্রুততা আসবে
• শুধু ভর্তি পরীক্ষার জন্য যে ৩-৪মাস সময় নষ্ট হয় তা হবে না
• ফলাফল প্রকাশ সহজ হবে
• দ্রুত ফলাফল প্রকাশ করা যাবে
• উচ্চ শিক্ষা বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব গড়ে উঠবে
• বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মানের উন্নয়ন ঘটবে

প্রশাসনের প্রতি বিশেষ করে এই সরকারের মাননীয় শিক্ষা মন্ত্রীর কাছে এই বিষয়টি সম্ভাব্যতা এবং অসম্ভাব্যতা নিয়ে ভাবার অনুরোধ জানাচ্ছি।

Sending
User Review
0 (0 votes)

লেখক সম্পর্কে

আকলিমা শরমিন

আকলিমা শরমিন

আকলিমা শরমিন ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ-এর ঢাকা অফিসে বিভাগীয় শিক্ষা সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করছেন।

মন্তব্য লিখুন

5 মন্তব্য