শিক্ষক প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষার গাণিতিক উন্নয়ন

আজকাল বাংলাদেশে প্রশিক্ষণের ধুম পড়েছে। প্রশিক্ষণ প্রদানকারী নানা উন্নয়ন সংস্থা আর প্রতিষ্ঠানের ভিড়ে আমি নিয়ত খুঁজে ফিরি ‘রাস্তার পাশে মূত্র বিসর্জন না করা’ সংক্রান্ত কোনো প্রশিক্ষণ কোথাও দেওয়া হয় কি-না। রাস্তার পাশে মূত্র বিসর্জন আজকের ঢাকার অন্যতম নাগরিক মূল্যবোধের স্খলন, জনদুর্ভোগের কথা না হয় বাদই দিলাম! শিক্ষার সাথে মূল্যবোধের নিগূঢ় সম্পর্কের কথা আমরা জানি, যদিও এব্যাপারে আমরা স্বেচ্ছায় সচেতন হতে চাই না। কারণ সচেতন হওয়ার যন্ত্রণা অনেক।

শিক্ষার সংখ্যাগত লক্ষ্যমাত্রা মোটামুটি অর্জিত হওয়ায় পর শিক্ষার গুণগত মান এখন আমাদের অন্যতম লক্ষ্য। উন্নতমানের প্রোডাক্ট পেতে হলে প্রয়োজন উন্নতমানের কাঁচামাল আর উন্নতমানের উৎপাদন ব্যবস্থা। আমরা বাংলাদেশিরা যে অত্যন্ত উন্নতমানের কাঁচামাল সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। বিশ্বাস না হলে আসুন ধোলাইখালে কিংবা জিঞ্জিরায় কিংবা নীলক্ষেতে; কী চান আপনি- ফেরারি কিংবা জাগুয়ারের লেটেস্ট মডেলের কনভার্টিবল, সীব্যাগোসের জুতা নাকি সাতশ বছর আগে মারা গেছেন এমন কারো ন্যাশনাল আইডি কার্ড? শর্তসাপেক্ষে সব সম্ভব। অর্থাৎ কাঁচামাল ভালো তাই এখন চলছে সিস্টেম ভালো করার প্রয়াস। তাই শিক্ষকরা ভাসছেন ট্রেনিং জোয়ারে, কাউকে না পেলে খোদ সাহিত্যের শিক্ষককে ধরে এনে হয়ত বিজ্ঞান বিষয়ক ট্রেনিং দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। আসলে তার ফলাফলটা কী? শিক্ষকদের আমরা ট্রেনিং দিব, কিন্তু সম্মান দিব না। রাস্তায় তাদের ধরে পুলিশ দিয়ে পেটাবো অথচ কানে কানে বলব তোমরা জাতির কারিগর। কী আশ্চর্য সৃজনশীল পরিহাস! সারা পৃথিবীকে আমরা নাড়া দিতে পারি, বিশ্ব আমাদের সমীহ করে চলে, সৃষ্টি হয় ‘পলিসি ফর হরতাল’, বাচ্চারা পরীক্ষা দেয় রাত বারোটায়। আর আমরা ভাবি আমাদের বাচ্চারা বড় হয়ে আমাদের মুখ উজ্জ্বল করবে- কী অদ্ভুত বোকার অভিনয় করে চলেছি আমরা!

ষাটের দশকেও বোর্ড পরীক্ষায় কেউ সেকেন্ড ক্লাস পেলে নাকি পাঁচ গ্রাম থেকে তাকে দেখতে আসত আর আজ এ+ পাওয়া ব্যাপার না। একথা ভেবে বেশ ভালোই লাগে যে, আমাদের উন্নতি হচ্ছে। তবে দুঃখজনক ব্যাপার এই যে, এই উন্নতি যতটা গাণিতিক ততটা বাস্তব নয়। একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে- সারাদিনে ১২ ঘণ্টায় ১২ বার বৃষ্টি হল এক ঘণ্টা পরপর, প্রতিবার ২ মিনিট করে, গাণিতিক ভাবে বৃষ্টি হয়েছে ২৪ মিনিট। ধরা যাক, মিনিট বিশেক বৃষ্টি হলেই কোনো এক জমিতে সেচ দেওয়া লাগবে না। তো এই ২৪ মিনিট বৃষ্টিতে আমরা কী সিদ্ধান্তে আসব- জমিতে সেচ দিতে হবে নাকি হবে না? আমাদের প্রশিক্ষণসমূহের প্রকৃতি অনেকটাই এরকম। এবং এসব প্রশিক্ষণের সম্ভাব্য ফলাফল গাণিতিকভাবে বিশ্লেষণ করে পণ্ডিতজনেরা আমাদের বলেন আমরা উন্নতির স্বর্ণশিখরে প্রায় আরোহন করে ফেলেছি এবং আমরা বোকা নই তা প্রমাণ করার জন্য ‘ঠিক’ ‘ঠিক’ বলে উঠি। তবে উন্নতি আমাদের হচ্ছে। আমরা যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা করছি, সময়ের সাথে থাকার চেষ্টা করছি। বিশ্বাস না হলে খোঁজ নিয়ে দেখুন, অধিকাংশ বড় বড় শিক্ষা বিষয়ক উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান বর্তমানে শিক্ষা উপকরণসমূহ ডিজিটাইজের কাজ করছে। আর এই ডিজিটাইজড শিক্ষা-উপকরণসমূহের ব্যবহার শিক্ষককে শেখানোর জন্য প্রশিক্ষণ প্রকল্পের। আর এ দেশে প্রকল্প মানেই তো টাকা এবং বিদেশিদের কাছে ভিক্ষাবৃত্তি।

তবে এর কিছু ভালো দিক আছে। বাংলার শিক্ষককে যেমন বিজ্ঞান বিষয়ক প্রশিক্ষণ দিলে তাকে মাঝেমধ্যে প্রয়োজনে বিজ্ঞান ক্লাসে পাঠানো যাবে বলে মনে করেন বোদ্ধারা; তেমনি ডিজিটালাইজড উপকরণ দেখাতে গিয়ে হয়ত বাচ্চারা নতুন কিছু প্রযুক্তির সাথে পরিচিত হবে। কিন্তু জাতীয় পর্যায়ে অর্থব্যয় কতটা হবে তা কি আমরা ভেবে দেখেছি? ভেবে দেখেছি কি নতুন প্রযুক্তিপণ্য আমদানি করতে গিয়ে খরচ হবে কী পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা? আমি মোটেও বলছি না আমরা পরিবর্তনের সাথে তাল মেলাবো না বরং আমি বলতে চাইছি আমরা চাইলেই সাশ্রয়ী উপায়ে শিক্ষার আকাঙ্ক্ষিত গুণগত মান অর্জন করতে পারি। আমি আমার স্নাতকোত্তর গবেষণায় পাওয়া ফলাফল থেকে দেখেছি, ট্রেনিং নেওয়া অসংখ্য শিক্ষক যথাযথ উপায়ে ক্লাস নিতে পারছেন না, পারছেন না প্রয়োজনীয় উপকরণ তৈরি করে নিয়ে ক্লাসে যেতে। ট্রেনিং থেকে তারা যা শেখেন তার কতটা তারা বাস্তবায়ন করতে পারছেন, তা মূল্যায়নের জন্যও নেই যথাযথ ব্যবস্থা।

এর অন্যতম কারণ আমাদের শিক্ষকদের বেশিরভাগেরই মধ্যেই পেশাদারী মনোভাব অনুপস্থিত। যারা শিক্ষকতা করার জন্য নয় বরং চাকরি করার জন্য শিক্ষক, পেশার প্রতি তারা কতোটা নিবেদিতপ্রাণ। তাছাড়া অন্যদের তুলনায় অধিক পরিশ্রম করে, নানা রকম উপকরণ বানিয়ে, নিজের দক্ষতা বৃদ্ধি করে যদি একজন শিক্ষক ক্লাস নেন তাকে আমরা তার এই আগ্রহ ও পরিশ্রমের জন্য কী পুরষ্কার দিই? তাছাড়া যারা এই শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন কর্মসূচির পরিকল্পনায় যুক্ত থাকেন, তারা প্রায়ই ভুলে যান আমাদের একজন শিক্ষককে সপ্তাহে ২৬-৩০ টি ক্লাস নিতে হয়, শ্রেণীতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা গড়পরতা ৬৫ জন, অনেক শিক্ষার্থীই না খেয়ে বিদ্যালয়ে আসে, অনেক শিক্ষককে সংসার চালাতে শিক্ষকতার পাশাপাশি অন্য পেশায় যুক্ত থাকতে হয়। এছাড়াও ‘পরিবর্তনের ভয়’ একটি বড় ইস্যু; অনেক শিক্ষকই ইতস্তত বোধ করেন নতুন উপায়ে ক্লাস নিতে। যারা প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন তারা প্রশিক্ষণ দেবার জন্য কতটা দক্ষ তা পরিমাপের কোনো উপায় আমাদের নেই। বেসরকারি পর্যায়ে বিশেষত এনজিওসমূহে একই প্রশিক্ষক ‘মাইক্রোক্রেডিট’ বিষয়ক প্রশিক্ষণ যেমন দেন, তেমনি দেন ‘শ্রেণীকক্ষ ব্যবস্থাপনা’ বিষয়ক। আবার একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক কিংবা সমমানের পেশাজীবির পক্ষে প্রত্যন্ত গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কোনো শ্রেণীর বাস্তব পরিবেশ, সমস্যা ও চ্যালেঞ্জসমূহ অনুধাবন করা অনেক সময়ই সম্ভব হয়ে ওঠে না। ফলে যা শেখা হয় সবই হয় ভাসাভাসা, খুঁটিনাটি রয়ে যায় অগোচরে। অথচ আকাঙ্ক্ষিত গুণগত মান অর্জনের জন্য প্রয়োজন খুঁটিনাটি জানা। স্বপ্ন দেখি আগামীদিনের প্রশিক্ষণসমূহ আরো ফলপ্রসূ, আকাঙ্ক্ষিত দক্ষতা অর্জনে অধিক সহায়ক হবে।

জনপ্রিয় নিবন্ধ

প্রাথমিক স্তরে ভাষা শেখা : বিষয় – বাংলা

ভাষার দক্ষতা চারটি— শোনা, বলা, পড়া, লেখা। আর ভাষা...

আগে ইংরেজি গ্রামার শিখবো, নাকি ভাষা শিখবো?

কোন ভাষার গ্রামার হলো ঐ ভাষার গঠন প্রকৃতি যার...

শিক্ষাব্যবস্থার হালচাল

অর্থনীতিবিদদের মতে, শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ সবচেয়ে লাভজনক এবং নিরাপদ রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ। অর্থনীতিবিদ এডাম স্মিথ, ডেভিড রিকার্ডো এবং মার্শালের মতে, শিক্ষা এমন একটি খাত যার কাজ হলো দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলে পুঁজির সঞ্চালন ঘটানো। শিক্ষার অর্থনীতি নিয়ে মৌলিক গবেষণায় অর্থনীতিবদ আর্থার শুল্জ ও রবার্ট সলো দেখিয়েছেন যে, প্রাথমিক শিক্ষায় বিনিয়োগ করলে সম্পদের সুফল ফেরত আসে ৩৫ শতাংশ, মাধ্যমিক শিক্ষায় ২০ শতাংশ, এবং উচ্চ শিক্ষায় ১১ শতাংশ।

আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা : পিএইচডির পর কী?

আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়, আমি নিজেও এ-নিয়ে...

ক্যাডেট কলেজে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে কিছু কথা

ক্যাডেটসমূহ বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।...

আরও কিছু লেখা

অধিক

    আমার ভিক্টোরিয়া কলেজ ও বর্তমান শিক্ষার হালচাল

    মুনতাসির বিন মোস্তফা লিখেছেন কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজ নিয়ে আমি কুমিল্লার...

    আমরা কি পরীক্ষানির্ভর শিক্ষার দিকে ঝুঁকছি?

    পরীক্ষানির্ভর এই শিক্ষাব্যবস্থায় নভেম্বর মাসের শুরুতে অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের...

    পলান সরকার : একজন আলোর ফেরিওয়ালা

    বইপ্রেমী পলান সরকার যেভাবে ‘আলোর ফেরিওয়ালা’ হয়ে ওঠেছেন সেই...

    শিক্ষার্থীর স্বাধীনতা

    মানুষের পরিপূর্ণ বিকাশের ক্ষেত্রে স্বশাসন বা স্বনিয়ন্ত্রণ একটি গুরুত্বপূর্ণ...

    উচ্চ শিক্ষা এবং কিছু কথা

    আমাদের বর্তমান সরকার আমাদের শিক্ষার ক্ষেত্রে বেশ কিছু যুগান্তকারী...

    মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি কি শুনছেন?

    মুক্তবাজার অর্থনীতির ডামাডোলে শরিক হয়ে দেশে পঁচাত্তর-পরবর্তী সরকারগুলো শিক্ষার বাজারীকরণের মহোর‌্যাসবে মেতে উঠেছে। কিন্তু বিশ্বের পুঁজিবাদী মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, জাপান, ইতালি ও কানাডার মতো দেশের কোনোটাই প্রাথমিক শিক্ষাকে বাজারের পণ্যে পরিণত করেনি। এসব দেশের প্রতিটিতেই একক মানসম্পন্ন আধুনিক প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালনা করছে রাষ্ট্র।

    শিক্ষকতা পেশা: বোরিং না আনন্দময়?

    উদীয়মান একদল মানবশিশু বা তরুণদের জীবন, জগত এবং বিশ্বের...

    প্রাসঙ্গিক নিবন্ধসমূহ

    নতুন লেখার খবর পান ইমেইলে
    বাংলাদেশের শিক্ষা প্রসঙ্গে নতুন লেখা প্রকাশিত হলে সেই খবর পৌঁছে যাবে আপনার ইমেইলে।