যদিও অনেকেই প্রাক-সাক্ষর সমাজের এই শিক্ষাকে অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা হিসেবে বিবেচনা করেন, তথাপি আমাদের মতে এই শিক্ষা আসলে একেবারে অনানুষ্ঠানিক ছিল না। গোত্রপতি বা দলপতির কাছে শিক্ষাগ্রহণের জন্য কতোগুলো আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে যেতে হত। এমনকি অনেক বিষয় শিশুদের অভিনয় করে দেখানো হত যা আজ Role Play নামক Learning Strategy-এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

বিবর্তনের ধারায় ঠিক কবে আজকের আমাদের মতো আধুনিক মানুষ সৃষ্টি হয়েছে তা যেমন নির্দিষ্ট করে বলা যায় না, তেমনি বলা যায় না ঠিক কবে থেকে মানুষের শিক্ষাচর্চার সূত্রপাত। শিক্ষা নৃতত্ত্ব নিয়ে যারা কাজ করেছেন তারা মত প্রকাশ করেছেন যে, সভ্যতার শুরু থেকেই মানুষের শেখার সূত্রপাত। ১৯৯৭ সালের ৪ ডিসেম্বর ব্রিসবেনে “অস্ট্রেলিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর রিসার্চ ইন এডুকেশন”- এর উদ্যোগে আয়োজিত বাৎসরিক সম্মেলনে এ বিষয়ে একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়। উক্ত প্রবন্ধের উপস্থাপক Aurther, Paul and Hughes মত প্রকাশ করেন যে, “In pre-literate societies, education was achieved orally and through observation and imitation”.

প্রাক-সাক্ষর সমাজে জ্ঞান ছিল দক্ষতামূলক। তথ্যমূলক জ্ঞানের চর্চা ছিল খুবই কম। সেসময় তথ্যমূলক জ্ঞান বলতে রূপকথা বা বীরত্বগাঁথা কিংবা শোকগাঁথা ইত্যাদির দেখা পাওয়া যায়। এসব শোকগাঁথা, বীরত্বগাঁথা ও রূপকথা ঐ সময়ের মানুষের মৌলিক বিশ্বাসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল এবং এসব গল্পগাঁথা সুরে সুরে ছড়িয়ে পড়ত সবার মাঝে। এবং তা শেখানো হত মৌখিকভাবে (Aurther, Paul and Hughes, 1997)। শিশুবয়স থেকেই এই মৌখিক শিক্ষার যাত্রা শুরু হত। শিশুরা শিখত বাবা-মা, ক্লান-এর দলপতি, বা তাদের দাদা-দাদীর কাছে। এ সম্পর্কে McGill Journal of Education-এ উল্লেখ আছে যে- “The young learned informally from their parents, extended family and grandparents.” (Michel and Augustus, 2002).

যদিও অনেকেই প্রাক-সাক্ষর সমাজের এই শিক্ষাকে অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা হিসেবে বিবেচনা করেন, তথাপি আমাদের মতে এই শিক্ষা আসলে একেবারে অনানুষ্ঠানিক ছিল না। গোত্রপতি বা দলপতির কাছে শিক্ষাগ্রহণের জন্য কতোগুলো আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে যেতে হত। এমনকি অনেক বিষয় শিশুদের অভিনয় করে দেখানো হত যা আজ Role Play নামক Learning Strategy-এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এছাড়াও প্রতিটি গোত্র বা দলের নিজস্ব কিছু বিশ্বাস, রীতি-নীতির পাশাপাশি কিছু গোপনীয় তথ্য থাকত যা সবার জানার সুযোগ ছিল না। ধর্মীয় বিশ্বাসও সবার ভেতর সমানভাবে সঞ্চারিত করা হত না। বাস্তব মূল্যায়নের ভিত্তিতে যারা উত্তীর্ণ হত তাদেরকেই জানানো হত এসব গোপন আবিষ্কার, কৌশল ও বিশ্বাস (Ancient Belief, ancient rituals)। যেহেতু প্রাক-সাক্ষর সমাজের শিক্ষা গ্রহণে কিছু আচার-অনুষ্ঠান, বিষয়বস্তুর পরিপ্রেক্ষিত নির্বাচন, গোত্রীয় শিক্ষক এবং বাস্তব মূল্যায়নের মাধ্যমে কৃতকার্য-অকৃতকার্য ইত্যাদি চিহ্নিত করার প্রচলন ছিল, সেহেতু এই শিক্ষাকে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার প্রাথমিক রুপ বলে ধরা যায়। কারণ এই শিক্ষার কাঠামো একদিকে যেমন বাস্তবতার নিরিখে নমনীয় তেমনি উপস্থাপন ও উদযাপনে আনুষ্ঠানিকতার ছোঁয়ায় ভরপুর।

প্রাগৈতিহাসিক যুগের শিক্ষা সম্পর্কিত বিভিন্ন আলোচনায় আমরা যে ধারণা পাই তা হল- ঐ সময়ে শিক্ষা বলতে জাতিগত বিশ্বাস, ধর্মীয় রীতি-নীতি ও কাহিনী জানা ও শেখাকে বোঝানো হত। Wikipedia-তে এভাবে উল্লেখ আছে- “Some forms of traditional knowledge were expressed through stories, folklore, rituals and songs without the need of writing system.”

অর্থাৎ শিক্ষণীয় বিষয়বস্তু গল্প- কবিতা-গান ইত্যাদির মাধ্যমে মৌখিকভাবে শেখানো হত । এ যুগের শিক্ষা প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত উপস্থাপন করতে গিয়ে Wikipedia-তে এভাবে বলা হয়েছে- ” Tools to aid this process include poetic devices such as rhyme and alliteration.”

সাহিত্যের নৃতত্ত্ব বিষয়ক আলোচনা থেকে জানা যায় প্রাগৈতিহাসিক যুগেই কবিতার উদ্ভব হয়েছিল; যা মানুষের মুখে মুখে সৃষ্টি, প্রচারিত ও সংরক্ষিত হত। এযুগে শিক্ষণীয় বিভিন্ন বিষয়াদি কবিতার মাধ্যমে উপস্থাপিত হত। এ সম্পর্কে Wikipedia-তে উল্লেখ আছে- “These methods are illustrating of morality. The stories thus preserved are also referred to as part of oral tradition.”

১০০০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৫০০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ

আনুমানিক ১০০০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মানব বসতি ছিল ইউরোপ ও আফ্রিকা মহাদেশে। দক্ষিণ ও পূর্ব ইউরোপ জুড়ে বাস করত নিয়ানডারথালরা এবং পূর্ব আফ্রিকায় বাস করত হোমো স্যাপিয়েন্সরা। ধীরে ধীরে হোমো স্যাপিয়েন্সরা পুরো আফ্রিকায় ছড়িয়ে পড়ে। আনুমানিক ৫৫০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রথম হোমো স্যাপিয়েন্বসরা এশিয়াতে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য যায়। এরা মাছ ধরায় ছিল পটু, অলংকার তৈরিতেও তারা ছিল দক্ষ। তারা গুহাচিত্র অংকন ও বাদ্যযন্ত্র তৈরি করতে পারত। কেউ মারা গেলে পালন করা হত নানা আচার অনুষ্ঠান। “First permanent departure from Africa by 150 people between 75,000 and 50,000 years ago. They know fishing, jewelry-making, funeral customs, cave paintings, musical instruments.” (Ref: http://www.usefulcharts.com/history/timeline-of-prehistory.html)

গ্রামের বা ক্লানের হেডম্যান বা পুরোহিতের নিকট থেকে এসব বিষয় তারা শিখত। বিশেষত গুহাচিত্র অঙ্কন, বাদ্যযন্ত্র তৈরি, মৃতব্যক্তির শেষকৃত্য ও ধর্মীয় আচার ব্যবহার; যা তারা শিখত পুরোহিতের নিকট থেকে। বয়স্কদের কাছ থেকে তারা মাছ ধরা বা শিকার করার কৌশলসমূহ শিখত। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা যা শিখেছে বা যে সকল দক্ষতা অর্জন করেছে তা মূল্যায়ন করা হত। কাজেই আমরা বলতে পারি- এ সকল শিক্ষা একেবারে অনানুষ্ঠানিক যেমন ছিল না, তেমনি পুরোপুরি আনুষ্ঠানিকও ছিল না।

৭৫০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৫৫০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে যারা আফ্রিকা থেকে এশিয়ার দিকে বসতি স্থাপন করার জন্য গিয়েছিল তারা বাসা বা আশ্রয় নির্মাণ (Shelter Construction) কৌশল, প্রাকৃতিক বিভিন্ন উপাদান থেকে রং তৈরির কৌশল জানত। সমসাময়িক নিয়ানডারথালরা জানত কীভাবে আঠা সংগ্রহ করতে হয় এবং সে আঠা কীভাবে কাজে লাগানো যায়। এছাড়াও বর্শা ও তীর ধনুক তৈরি ও তা ব্যবহার করত। এসব জ্ঞান, কৌশল ও শিখন সম্ভব হয়েছিল নমনীয় শিক্ষা কাঠামোয়, পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায়, প্রয়োজননির্ভর শিক্ষার মাধ্যমে যা আজ উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা নামে পরিচিত।

আগুন আবিষ্কার: একটি গোপনীয় শিক্ষা

প্রাচীনকালে আগুনকে দেবতার আশীর্বাদ হিসেবে দেখা হত। কোনে কোনে গোত্র আগুনকে ঈশ্বরসত্ত্বার অংশ হিসেবে পূজা করত। তারা বন থেকে আগুন সংগ্রহ করত কিংবা চকমকি পাথর ঘষে আগুন তৈরি করত। তারা একটি আগুন জ্বালাবার পিট নির্মাণ করে সেখানে আগুন জ্বালিয়ে রাখত। কোনো কারণে আগুন নিভে যাওয়াকে তারা চূড়ান্ত অমঙ্গল হিসেবে বিবেচনা করত।

মানবসভ্যতায় আগুনের নিয়মিত ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায় পালোলিথিক যুগের মাঝামাঝি সময়ে (আনুমানিক ৫৫০০০ বছর পূর্বে)। সেসময় আগুন সংক্রান্ত জ্ঞান, তথ্য ও দক্ষতাকে গোপনীয় ও দিব্যজ্ঞান ইত্যাদি হিসেবে বিবেচনা করা হত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মারা যাবার পূর্বে পুরোহিত বা গ্রামের দলনেতা পরবর্তী পুরোহিত বা নেতা নির্বাচন করে তাকে উত্তরাধিকার হিসেবে এসব জ্ঞান জানিয়ে যেতেন। যেহেতু এই শেখানোয় শিক্ষক থাকত, নির্ধারিত কিছু বিষয় থাকত, থাকত আনুষ্ঠানিকতার ছোঁয়া কাজেই এই শিক্ষাকে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার আওতায় বিবেচনা করা যায়।

৫০০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ হতে ১০০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ

এ সময়ে প্রথম পোষাপ্রাণী হিসেবে কুকুরকে পোষ মানানো সম্ভব হয়। কুকুর ধরা ও কুকুর পোষ মানানোর জন্য গোত্রের অনেককেই প্রশিক্ষণ দেয়া হয়, যা গুহাচিত্রে দেখতে পাওয়া যায়। এছাড়াও সে সময়ে মানুষ দড়ি পাকানো ও কাপড় বুনতে শেখে। কাপড় বুনন ও দড়ি তৈরি শেখার জন্য শিক্ষানবিশের প্রচলন দেখতে পাওয়া যায়। এসময়ে জার্মানিতে বাঁশি বাজানো শেখানো হয় এরকম প্রমাণও পাওয়া গেছে। আনুমানিক ১৫০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ১২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ-এর মধ্যে তৈজসপত্র তৈরির ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটে। এ সময় তৈজসপত্র তৈরির কৌশল শেখার জন্য ব্যাপকহারে শিক্ষানবিশ গ্রহণের প্রচলন দেখা যায়।

১০০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ হতে ৬০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ

উত্তর-পূর্ব আফ্রিকার একটি প্রাচীন গ্রামের বর্ণনায় পাওয়া যায়- “প্রতিরাতে গ্রামের সবাই মিলে পুরোহিতের বাড়ির সামনে খোলা জায়গায় জড়ো হত; তারা প্রজ্জ্বলিত আগুনকে ঘিরে বসত। পুরোহিত তাদের ধর্মের কথা, ঈশ্বরের কথা, বীরত্বগাঁথা শোনাতেন। এছাড়াও যাযাবর জীবনের নানা কৌশল শেখাতেন।”

প্রাগৈতিহাসিক কালের শিক্ষাব্যবস্থা ছিল নমনীয়, যাযাবর জীবনের সাথে সামজ্ঞস্যপূর্ণ। তাই-ই পড়ানো হত যা ঐ নির্দিষ্ট পরিপ্রেক্ষিতে কাজে লাগত। রাজার ছেলে আর জেলের ছেলের জন্য শিক্ষা একই রকম ছিল না অর্থাৎ শিক্ষার ক্ষেত্রে লক্ষ্যদলের চাহিদার কথা মাথায় রেখেই পুরোপুরি শিক্ষা, বিদ্যালয়, শিক্ষাক্রম, শিক্ষক ইত্যাদি নির্ধারণ ও নির্বাচন করা হত। প্রাগৈতিহাসিক কালের এই শিক্ষা উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার বৈশিষ্ঠ্যের সাথে পুরোপুরি মেলে। প্রকৃত বিশ্লেষণে দেখা যায়, অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা একদিনে আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় পরিণত হয় নি বরং উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার মধ্য দিয়েই অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা আনুষ্ঠানিক শিক্ষার রুপ লাভ করেছে।

Sending
User Review
0 (0 votes)

লেখক সম্পর্কে

রিদওয়ানুল মসরুর

রিদওয়ানুল মসরুর

রিদওয়ানুল মসরুর বাংলাদেশের সেভ দ্যা চিলড্রেন-এর কমিউনিকেশনস অ্যান্ড রিসোর্স মবিলাইজেশন বিভাগে সহকারী কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত।

লেখক সম্পর্কে

জি. এম. রাকিবুল ইসলাম

জি. এম. রাকিবুল ইসলাম

জি. এম. রাকিবুল ইসলাম বাংলাদেশের নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত।

মন্তব্য লিখুন

3 মন্তব্য