উচ্চশিক্ষার সাথে আমাদের কাঙ্ক্ষিত জ্ঞানভিত্তিক সমাজের সম্পর্ক কোথায়? সহজ কথায় বুঝি- জ্ঞানভিত্তিক সমাজে পৌঁছাতে আমাদের প্রয়োজন সর্বজনীনকৃত এবং সর্ব-অংশগ্রহনে সাধারণীকৃত উচ্চশিক্ষা যা আসলে ঐ লক্ষ্যে পৌঁছানোর সিঁড়ি। আবার এই উচ্চশিক্ষাই পারে সামাজিক সমতা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে। অনেক প্রশাসন বিশেষজ্ঞই মনে করেন- সর্বস্তরে সামাজিক সমতা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে প্রয়োজন সকলের স্বেচ্ছাগ্রহ ও স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। আর তা একমাত্র শিক্ষা দ্বারাই সম্ভব এবং (শিক্ষার সামাজিক প্রভাব নিয়ে কাজ করেন এমন অনেকেই মনে করেন) তা যথার্থভাবে পারে একমাত্র উচ্চশিক্ষা।

সামজিক পরিবর্তন সংক্রান্ত ইস্যুতে অত্যন্ত সুপরিচিত স্লোভেন দার্শনিক স্লাভোজ জিজ্যাক আমাদের বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের গতিপ্রকৃতি নির্দেশ করতে গিয়ে বলেছেন, “…বৈশ্বিক পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা নিয়ত রহস্য-উন্মোচনকারী শূন্যতার দিকে এগিয়ে চলেছে”। তিনি এর পেছনে চারটি কারণকে দায়ী হিসেবে উল্লেখ করেন। সেগুলো হলো- পরিবেশগত বিপর্যয়, বায়োজেনেটিক বিপ্লবের পরিণাম, পুঁজিবাদী কাঠামোর অভ্যন্তরীণ ভারসাম্যহীনতা, সামাজিক শ্রেণীবৈষম্য বৃদ্ধি। শুধু স্লাভোজ জিজ্যাক একাই নন, আরও অনেক সমাজবিজ্ঞানী ও দার্শনিক একই মত প্রকাশ করেছেন বলেই সমসাময়িক লেখালেখিতে খুঁজে পাওয়া যায়। প্রশ্ন হলো- এর সাথে উচ্চশিক্ষার কী সম্পর্ক বা উচ্চশিক্ষা ও সামাজিক পরিবর্তনের সম্পর্ক নিরূপণে একথা আসছে কেন? সে প্রশ্নের উত্তর আমরা খুঁজব এ আলোচনায়।

উচ্চশিক্ষার সাথে আমাদের কাঙ্ক্ষিত জ্ঞানভিত্তিক সমাজের সম্পর্ক কোথায়? সহজ কথায় বুঝি- জ্ঞানভিত্তিক সমাজে পৌঁছাতে আমাদের প্রয়োজন সর্বজনীনকৃত এবং সর্ব-অংশগ্রহনে সাধারণীকৃত উচ্চশিক্ষা যা আসলে ঐ লক্ষ্যে পৌঁছানোর সিঁড়ি। আবার এই উচ্চশিক্ষাই পারে সামাজিক সমতা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে। অনেক প্রশাসন বিশেষজ্ঞই মনে করেন- সর্বস্তরে সামাজিক সমতা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে প্রয়োজন সকলের স্বেচ্ছাগ্রহ ও স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। আর তা একমাত্র শিক্ষা দ্বারাই সম্ভব এবং (শিক্ষার সামাজিক প্রভাব নিয়ে কাজ করেন এমন অনেকেই মনে করেন) তা যথার্থভাবে পারে একমাত্র উচ্চশিক্ষা।

আবার উচ্চশিক্ষাই আলোচনা করে নানাবিধ সামাজিক সম্প্রদায় এবং তাদের মধ্যেকার আন্তঃসম্পর্ক ও আন্তঃনির্ভরশীলতার নানাদিক নিয়ে। কাজেই কোন ধরনের সামাজিক পরিবর্তন আমাদের কাম্য হওয়া উচিত তা যেমন বলতে পারবে উচ্চশিক্ষা তেমনি বলতে পারবে ঠিক কোন কোন আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সূচকের পরিবর্তনের ফলে সেই আকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন সূচিত হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, সমাজ নিয়ত পরিবর্তনশীল এবং সমাজের ক্রমপরিবর্তনের সাথে সাথে এ সংক্রান্ত সকল সূচকীয় হিসেব-নিকেশ পরিবর্তনযোগ্য। কাজেই একটি সমাজ যদি তার নিজস্ব নিগেনট্রপিকে শক্তিশালী করতে চায় এবং সিস্টেম হিসেবে দক্ষ ভারসাম্যের অধিকারী হতে হয় তবে সেই সমাজের অবশ্যই বিস্তর চলমান গবেষণাভিত্তিক উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। আবার একটা সমাজে নানারকম পেশাজীবি যেমন আছেন তেমনি আছে নানা রকম প্রতিষ্ঠান, আছে তাদের নানাবিধ কাজ ও দায়িত্ব-কর্তব্য। সামাজিক পরিবর্তনের দিক নিয়ন্ত্রণে এসব স্বতন্ত্র্ পেশাজীবি ও প্রতিষ্ঠানসমূহের ভূমিকা অনেক। তাদের অবদান ছোট ছোট বালুকণা আর বিন্দু বিন্দু জল হয়েই মহাদেশ-মহাসাগরের ন্যায় সামাজিক পরিবর্তন সাধন করে।  উচ্চশিক্ষা শুধু এই প্রতিষ্ঠান ও কর্মীদের কেমন হওয়া উচিত- তা নিয়েই মাথা ঘামায় না বরং এরকম অনেক প্রতিষ্ঠানসহ সবরকমের কর্মী তৈরি করে। এই সকল কর্মীদের সামগ্রিক আকাঙ্ক্ষা ও সম্মিলিত প্রচেষ্টা সাধন করে সামাজিক পরিবর্তন। আর এভাবে উচ্চশিক্ষা ভুমিকা রেখে চলে চলমান সামাজিক গতিপথের শাখা-প্রশাখায়।

তো উচ্চশিক্ষার সেই কল্যাণকামী রূপটি দিন দিন উধাও হয়ে যাচ্ছে। উচ্চশিক্ষার প্রকৃতি হয়ে যাচ্ছে- ফেল কড়ি মাখো তেল। তো কড়ি ফেলে তেল মেখে সবাই ঝুঁকবে কড়ি উপার্জনের দিকে- এটাই তো স্বাভাবিক। তাহলে সমাজের মঙ্গল ভাবনা ভাববে কে? ভাববে সেই, যাকে সমাজ কড়ি দেবে তাঁর ভাবনার জন্য। এটা সত্যিকার অর্থে অসম্ভব। আর তাই সমাজের মঙ্গলভাবনা ছেড়ে আমরা সবাই যে যার মতো কড়ি সংগ্রহে ব্যস্ত। এমনকি আমাদের শিক্ষক মহোদয়গনও। আচ্ছা, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হওয়ার আগে তাঁরা তো জানতেন এখানে বেতন কত, এই পেশার কাজ কী? তাহলে সেই বেতনে আজ তাদের সংসার চলে না কেন? তাদের যদি বেশি টাকার প্রয়োজনই থাকে তাহলে তো তারা অন্য পেশায় যেতে পারতেন, তারা তো দেশের প্রথম সারির মেধাবী। আসলে এর পেছনে যে কারণটি রয়েছে তা হলো- আমাদের সামগ্রিক সামাজিক ব্যাধি ‘পূঁজিবাদী মনোভাব’। আমাদের সামনে কেউ যখন খানিকটা হুঁশ ফিরে পেয়ে বলে ওঠেন- আহা, দেশটা যাচ্ছে যে রসাতলে। তখন আমরা অতিচালাক হয়ে সমস্বরে বলে উঠি- আরে রাখ তোর দেশ, আগে আমাকে রসটা খেতে দে। ওরে বোকা, ঘরের পাশে বস্তি রেখে তুই যত থাকিস মস্ত ঘরে, চোর-ভিখারী-ডাকাত-সাধু সবার নজর রবে তোর পরে।

আবার সেই পুঁজিবাদী মনোভাবের কারণেই আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রশাসন হয়ে গেছে আধুনিক মাফিয়া। জানেন তো- আধুনিক মাফিয়ারা কিন্তু ডাকাতি-রাহাজানি করে না, তৈরি করে নিয়ম (যেমন- এই রাস্তা দিয়ে যেতে হলে আপনাকে ৫০০ টাকা চাঁদা দিতে হবে)। আমার কথা আপনার বুঝতে কষ্ট হবে না যখন আপনি কষ্ট করে আপনার কষ্টার্জিত সার্টিফিকেটখানা তুলতে যাবেন মন্দিরসম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার বিল্ডিংয়ে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থায়নটা দেখুন। কোথায় কোন খাতে কতটা অর্থায়ন করা হয়েছে তা নিয়ে ভাবতে গিয়ে আপনি কোনো যুক্তি হয়ত পাবেন না। আসলে একটু পুঁজিবাদী মনোভাব নিয়ে ভাবুন। এমন করেই বাজেট তৈরি করা হয় যাতে তারা নিজেরা উপকৃত হতে পারেন। আরে, পরের ছেলে পরমানন্দ করবে গবেষণা তাতে আমার কি আনন্দ! সে জন্যই আমাদের উচ্চশিক্ষা দিন দিন গবেষণাশুন্য হয়ে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে যেন গবেষণা শব্দটা না মুছে যায় সেজন্য বিশ্বব্যাংক জন্ম দিয়েছে HEQEP প্রজেক্ট। তৃতীয়বিশ্বের শিক্ষা-সমাজ রক্ষায় স্বয়ং ত্রাণকর্তার ভূমিকায় নেমে পড়েছে তারা। আহা, কেউ যদি জানত এই ত্রাণকর্তারূপী রাক্ষসী তার আস্তিনে কী লুকিয়ে রেখেছে! বেক (১৯৯২) তাই আমাদের এই সমাজকে বলেছেন ‘Risk Society’। আবার রিস্ক সোসাইটির উচ্চশিক্ষাক্ষেত্রের স্বরূপ আঁকতে গিয়ে মার্টিন ট্রো (২০০৬) দিকনির্দেশ করেছেন “Expansion & Differentiation”-এর দিকে। তিনি সুস্পষ্টভাবে দেখিয়েছেন যে, এই সমাজ যতই বিস্তৃতি লাভ করছে, মৌলিক অধিকারসহ নানা ক্ষেত্রে বৈষম্য ততোই বাড়ছে। এই বৈষম্য উচ্চশিক্ষা খাতের কোথায় কীভাবে বাড়ছে তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ক্লার্ক (১৯৮৩) এবং টেইশ্লে (২০০৭) ব্যাখ্যা করেছেন ‘আনুভূমিক বৈষম্য’ ও ‘উলম্ব বৈষম্য’। দুঃখ হয়, হয় অভিমান- কেন আইইআরে ৫/৬ বছর পড়েও এসবের নাম শুনলাম না।

তবে এতো বৈষম্যের মধ্যে টিকে আছি আমরা, কারণ আমরা বাংলাদেশী। আমাদের ইতিহাস যুদ্ধ ও সংগ্রামের ইতিহাস, শত হায়েনার সাথে খালি হাতে যুদ্ধ করে টিকে থাকার ইতিহাস। আমরা হার মানি নি, মানবো না। একদিন না একদিন, যেদিন আমারা আইইআর সবাই সৈনিক হয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নামবো পরিবর্তনকে জয় করে আনতে, হয়ত সেদিন কিংবা তার আরও পরে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উচ্চশিক্ষার গুনগতমানবিচারে ছুঁয়ে যাবে এভারেস্ট।

তথ্যসূত্র
Beck, U. (1992) The Risk Society, London: Sage Publications.
Brennan, J. and Singh, M. (2011) Playing the Quality Game: Whose Quality and Whose Higher Education?
Rhoten, d and Calhoun, C (eds), Knowledge Matters:The Public Mission of the Research University, New York: Columbia University Press.
Brennan, J., Enders J., Musselin, C., Teichler, U. and Valimaa, J. (2008) Higher Education Looking Forward: An Agenda for Future Research, Strasbourg: The European Science Foundation.
Calhoun,C. (2006) The University and the Public Good, Thesis 11 (84), Sage.
Clark, B.R. (1983) The Higher Education System: Academic Organisation in Cross-National Perspective, Berkeley and Los Angeles, University of California Press.
Trow, M. (2006) Reflections on the Transition from Elite to Mass to Universal Access: Forms and Phases of Higher Education in Modern Societies Since World War II, in Forest J and Altbach, P (eds) International Handbook on Higher Education, New York: Springer.
Teichler, U. (2007) Higher Education Systems: Conceptual Frameworks, Comparative Perspectives, Empirical Findings, Rotterdam and Taipei: Sense Publishers.
Zizek, S. (2010) Living in the End Times, London and New York: Verso.

Sending
User Review
0 (0 votes)

লেখক সম্পর্কে

রিদওয়ানুল মসরুর

রিদওয়ানুল মসরুর

রিদওয়ানুল মসরুর বাংলাদেশের সেভ দ্যা চিলড্রেন-এর কমিউনিকেশনস অ্যান্ড রিসোর্স মবিলাইজেশন বিভাগে সহকারী কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত।

মন্তব্য লিখুন