আলোচ্য বিষয়সমূহ
শিক্ষার্থীরা কেন ক্লাস করতে চায় না এই প্রশ্নটি নতুন নয়। সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিভাগের মাস্টার্সের ফাইনাল পরীক্ষায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থীর উপস্থিতির ভিত্তিতে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের অযোগ্য বিবেচিত হওয়া নিয়ে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি হয়।
শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ই নয়, দেশজুড়ে উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের ক্লাস না করার প্রবণতা ক্রমশ বাড়তে শুরু করেছে। সর্বমহলেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে কেন শিক্ষার্থীরা ক্লাস করতে চায় না সেটি নিয়ে।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের ক্লাসে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাতে কোনো কোনো বিভাগে উপস্থিতির ওপর নম্বর বরাদ্দ থাকে। আবার কোথাও কোথাও থাকে বাধ্যতামূলক উপস্থিতির বিধান। বিভিন্ন সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে অনেককেই বলতে শোনা যায়, “উপস্থিতি বাধ্যতামূলক না হলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের শতকরা ১০ শতাংশও ক্লাসে আসতো কিনা সন্দেহ”।
প্রশ্ন হচ্ছে, এতো সুযোগ-সুবিধা, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার পরেও ঠিক কেন এইসব শিক্ষার্থীরা ক্লাস করতে চায় না?
শিক্ষার্থীরা কেন ক্লাস করতে চায় না
বর্তমান সময়ে শিক্ষার্থীদের নিয়মিত ক্লাসে না আসা নিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নানারকম আলোচনা হয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাটি অতি-সাম্প্রতিক সময়ের বলে উদাহরণ হিসেবে উঠে এসেছে মাত্র।
ক্লাসে উপস্থিতির বিষয়টি নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন করতেও দেখা গেছে। শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থিতি কম থাকা নিয়ে ১০ শিক্ষার্থীর ভর্তি অনিশ্চিত হওয়া নিয়ে জাতীয় দৈনিকে সংবাদ প্রকাশিত হয় (দৈনিক ইত্তেফাক, ২০২৩)। আবার, জাতীয় দৈনিক যায়যায়দিনে প্রকাশিত সংবাদে দেখা যায়, “উপস্থিতি কম থাকায় পরীক্ষায় বসতে পারেননি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ শিক্ষার্থী”।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থিতির বিষয় নিয়ে ক্লাসে অনুপস্থিতির জরিমানা ১৬ গুণ, তবুও ফাঁকা ক্লাস। করোনাকালে অনলাইন ক্লাসের ক্ষেত্রেও অনেক বিভাগেই দেখা গেছে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার থাকার পরেও একটা বড় অংশের শিক্ষার্থীরা ক্লাসে অংশগ্রহণ করে না। এমনকি কোনো কোনো বিভাগে অনলাইন ক্লাস বন্ধ করে দিতে হয়েছিলো কেবল অনুপস্থিতির কারণে!
দেশের প্রায় সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষার্থীদের ক্লাসে উপস্থিতির হার আশঙ্কাজনকভাবে কমছে। অনেক জায়গা দেখা গেছে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে কিংবা ব্যক্তিগত প্রভাব খাটিয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের ঘটনাও। তাই শিক্ষার্থীদের ক্লাসে না আসার ঘটনাটি নতুন কোন ঘটনা নয় বরং এটি বর্তমান সময়ে সারাদেশেরই একটি অতিপরিচিত চিত্র!
“শিক্ষকের কাজ হলো শিক্ষার্থীদের আনন্দ পাইয়ে দেওয়া”
শিক্ষার্থীরা কেন ক্লাসে আসে না বা ক্লাস করতে চায় না এ প্রসঙ্গে দেশের সিংহভাগ মানুষই কাঠগড়ায় দাঁড় করতে চান শিক্ষককে। শিক্ষকের কাজ কী? এ প্রসঙ্গে দেশের পদার্থবিজ্ঞানের একমাত্র ইমিরেটাস অধ্যাপক ড. অরুণ কুমার বসাক এক ভিডিও সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন:
আমাদের শিক্ষকদের দায়িত্ব হলো ছাত্রদের যে কোনো বিষয়ে আনন্দ পাইয়ে দেওয়া, একজন যেটা জানতো না সেটা যখন সে জানতে পারলো ওইটা দেখে আমার চরম আনন্দ হয়।
প্রথিতযশা এই শিক্ষকের কথাটিকে বিশ্লেষণ করলে আসে, শিক্ষণের প্রক্রিয়াটি হতে হবে আনন্দময়। শিক্ষক শিক্ষার্থীদের যখন পড়াবেন তখন তিনি যেকোনো বিষয়ে শিক্ষার্থীদের আনন্দ পাইয়ে দেবেন।
অনেকেই মনে করেন, এই আনন্দময় শিক্ষাটা হবে এমন যে, শিক্ষক ক্লাসে কথা বলবেন আর শিক্ষার্থীরা হেসে কুটিকুটি হয়ে যাবে। ক্লাসে হাসির রোল পড়ে যাবে। দলে দলে অন্য বিভাগের শিক্ষার্থীরাও ওই শিক্ষকের কথা শুনতে আসবে।
এ-প্রসঙ্গে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক গৌতম রায় একবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছিলেন,
…যতো ‘ভালো’ ‘আনন্দদায়ক’ ‘রসালো’ শিক্ষকই হোন না কেন, আশেপাশের ডিপার্টমেন্ট থেকে দলে দলে শিক্ষার্থীরা ‘কোয়ান্টাম মেকানিক্স’, কিংবা ‘সেল বায়োলজি’ বা ‘ডি মোভারস থিওরাম’ শুনতে গেছেন, এমনটা শোনা যায়নি কখনো।
তাই শিক্ষক যা পড়বেন সব বিষয়েই ক্লাসে হাসির ঢেউ খেলে যাবে, এমন ভাবনা ভাবাটা অযৌক্তিক। আনন্দময় শিখন বলতে অরুণ কুমার বসাক স্যারের পরের কথাটি ধরা যেতে পারে,
একজন যেটা জানতো না সেটা যখন সে জানতে পারলো ওইটা দেখে আমার চরম আনন্দ হয়।
আনন্দময় শিখন হলো শিক্ষার্থী যা জানে, আর যা জানে না তার মধ্যে সমন্বয় ঘটিয়ে দেওয়া। এই শিখন হলো শিক্ষার্থী মানসিক অবস্থা বিবেচনা করে সে অনুযায়ী পুরোনা জ্ঞানের সাথে নতুন জ্ঞানের সংযোগস্থাপন। শিক্ষার্থীদের শিক্ষকের প্রতি নির্ভরশীলতা দূর করে স্ব-শিখনের জন্য প্রস্তুত করে তোলাও আনন্দময় শিখন।
তাহলে শিক্ষকের কাজ হবে আনন্দদায়ক শিখনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ওই আনন্দ পাইয়ে দেওয়া। আনন্দময় শিখন যেকোনো শিক্ষার্থীকে ক্লাসের প্রতি আগ্রহী করে তুলবে। আনন্দময় শিখনের অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের ক্লাস বিমুখ করে তোলে, কমতে থাকে শিক্ষার্থীর উপস্থিতির হার।
অনিয়মিত ক্লাসের সময়সূচিও বড় কারণ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিভাগের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, “কোর্স শিক্ষকেরা নিয়মিত ক্লাস নেন না। তারা সকালের ক্লাস বিকেলে নেন। এখন মাস্টার্সের একজন শিক্ষার্থী হয়ে একটা ক্লাসের জন্য সারাদিন বসে থাকা সম্ভব হয় না” (পদ্মা টাইমস ২৪.কম)।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে প্রায়ই শিক্ষকদের সময়মতো ক্লাস না নেওয়া নিয়ে শিক্ষার্থীদের হতাশা প্রকাশ করতে দেখা যায় । শিক্ষার্থীরা যে নিয়মিত ক্লাস করতে চায় না তার কারণ হিসেবে অনেকেই ক্লাসের অনিয়মিত সময়সূচিকেই দায়ী মনে করেন।
বাস্তবেও অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বিভাগেই দেখা যায়, ক্লাস রুটিন এবং ক্লাস অনুষ্ঠিত হওয়ার সময়ের মধ্যে ব্যাপক ফারাক, যার জন্য শিক্ষার্থীরা ক্লাস করতে চায় না বা তাদের প্রেষণা হারিয়ে ফেলে। শিক্ষার্থীদের মূল্যবান সময় অপচয় হয়। শিক্ষার্থীদের মনে আসে বিরক্তি, হতাশা ও দুশ্চিন্তা!
নিয়মিত সঠিক সময়ে ক্লাস না হওয়ার পেছনে শিক্ষকের চেয়ে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের দায়বদ্ধতা বেশি। যেকোনো বিভাগে শিক্ষকরা ক্লাস ঠিকমতো নিচ্ছেন কিনা সেটি নিয়ে যথাযথ মনিটরিংয়ের অভাব এমন অসঙ্গতি সৃষ্টি করে।
একজন শিক্ষকের নিজেরও পেশাগত দায়বদ্ধতা রয়েছে তিনি নিয়মিত ক্লাস নিচ্ছেন কিনা সেটি নিয়ে। তাই শিক্ষার্থীদের নিয়মিত ক্লাসে ফিরিয়ে আনতে শিক্ষকদেরও নির্ধারিত সময়ে ক্লাস নেওয়ার প্রবণতা সৃষ্টি করতে হবে।
অনেক শিক্ষার্থীকেই টিউশন, ফ্রিল্যান্সিং, পার্ট-টাইম চাকরি ইত্যাদির মাধ্যমে নিজের খরচ চালাতে হয়। সেক্ষেত্রে ক্লাসের সময়সূচির অনিয়ম শিক্ষার্থীদের মধ্যে নানাবিধ সমস্যার সৃষ্টি করে। তাই শিক্ষার্থীদের নিয়মিত ক্লাসে ফেরাতে হলে অবশ্যই নির্ধারিত সময়ে ক্লাস পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়া নিশ্চিত করতে হবে।
অনিয়ন্ত্রিত লাইফস্টাইলের প্রভাবও কিন্তু কম নয়
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীসহ বর্তমান সময়ের প্রায় অধিকাংশ মানুষেরই লাইফস্টাইলে অত্যন্ত অনিয়ম দেখা যায়। আমাদের ঘুমানোর সময় আমরা ফোন, ল্যাপটপ বা অন্যান্য ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করে, কিংবা তাস খেলা বা আড্ডায় কাটিয়ে ফেলি। আর ভোর হলে আমরা ঘুমোতে যাই। দেশের প্রায় সবকয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলের চিত্র একই!
রাত বারোটা কিংবা একটা তো কেবল আড্ডা শুরু হয়; ঘুমোতে ঘুমোতে তিনটে বা চারটে। যার ফলাফল সকালে উঠতে দেরি এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সকালের প্রথম ক্লাস মিস! এ কারণেও অনেক শিক্ষার্থী ক্লাস করতে চায় না। আমাদের অনিয়মিত লাইফস্টাইল আমাদের জৈবনিক ঘড়িকে পরিবর্তন করে দিয়েছে; যার জন্য শিক্ষার্থীদের শেষ রাতে ঘুমানো এবং বেলা করে ঘুম থেকে ওঠার প্রবণতা সৃষ্টি করেছে।
এই অনিয়মিত লাইফস্টাইল শিক্ষার্থীর কেবল একাডেমিক পড়াশোনার জন্যই ক্ষতিকর নয়, বরং জীবনের জন্য ব্যাপক হুমকিস্বরূপ!
চাকরি প্রস্তুতির সাথে একাডেমিক পড়াশোনার পার্থক্যও বড় কারণ!
বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে চাকরি হয়ে দাঁড়িয়েছে সোনার হরিণ। অধিক সংখ্যক জনসংখ্যা এবং চাকরির স্বল্পতা শিক্ষার্থীদের একাডেমিক পড়াশোনার তুলনায় চাকরির প্রস্তুতিকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। যার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর লাইব্রেরির রিডিংরুমে শিক্ষার্থীরা একাডেমিক বইয়ের পরিবর্তে বিসিএস কিংবা ব্যাংকের চাকরি পরীক্ষার প্রস্তুতিতে মত্ত থাকছে। শিক্ষার্থীরা যে ক্লাস করতে চায় না, তার একটি বড় কারণ এটি।
অনেক শিক্ষার্থী একাডেমিক ক্লাসের পরিবর্তে চাকরির প্রস্তুতি কোচিংয়ে সময় কাটাচ্ছে। মনস্তাত্ত্বিকভাবেও শিক্ষার্থীর কাছে একাডেমিক ফলাফলের তুলনায় চাকরির প্রস্তুতি কোচিং যখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, তখন শিক্ষার্থীরা নিয়মিত ক্লাসে আসবে না সেটাই তো স্বাভাবিক। সংশ্লিষ্টরা এই সমস্যার ক্ষেত্রে চাকরির পরীক্ষার সাথে একাডেমিক পড়াশোনার পার্থক্যকে দায়ী করেন।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষাক্রম এবং চাকরির প্রস্তুতির মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। শিক্ষার্থীদের মনস্তাত্ত্বিক দিকের পরিবর্তন ঘটাতে হবে, পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার সাথে চাকরির পরীক্ষার মেলবন্ধন ঘটাতে হবে। ফলে শিক্ষার্থীরা ক্লাসের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠবে।
শিক্ষার্থীদের অর্থনৈতিক সংকট
করোনাত্তোর পৃথিবীতে অর্থনৈতিক সংকট প্রকট হয়েছে। যার প্রভাব থেকে বাদ যায়নি বাংলাদেশও। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, অর্থনৈতিক মন্দাসহ বিভিন্ন কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অর্থনৈতিক সংকট আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় প্রকট হয়েছে।
ফলে, শিক্ষার্থীদের নিজেদের অর্থনৈতিক সংকট দূর করার জন্য পার্ট-টাইম চাকরি, ফ্রিল্যান্সিং, টিউশন কিংবা অন্যান্য বিভিন্নভাবে অর্থ উপার্জনে মনোযোগী হতে হচ্ছে। ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্লাস করার প্রবণতা কমছে। আবার ইচ্ছে থাকলেও অনেকটা বাধ্য হয়েও অনেক শিক্ষার্থীকে পড়াশোনার পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে হচ্ছে, যা তাদের নিয়মিত ক্লাস থেকে দূরে রাখছে।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের অনেক শিক্ষার্থী রাত জেগে ফ্রিল্যান্সিং করার জন্য সকালের ক্লাসে অংশ নিতে পারে না। ফলে বলা যেতে পারে শিক্ষার্থীদের নিয়মিত ক্লাসে আসা না আসার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর অর্থনৈতিক অবস্থাও একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক।
সেক্ষেত্রে গরীব ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে বৃত্তির ব্যবস্থা করা যায়, তা নিঃসন্দেহে একটা বড় অংশের শিক্ষার্থীদের জন্য উপকারী হতে পারে। পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি উন্নয়নসংস্থাগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে।
শিক্ষকের প্রতি আস্থাহীনতা
সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষক নিয়োগ দূর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপসহ বিভিন্ন কারণে সমালোচিত হচ্ছে। পত্র-পত্রিকায় অহরহ শিরোনাম হচ্ছে শিক্ষক নিয়োগের অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে। ফলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে শিক্ষক সম্পর্কে বিরূপ মনোভাব সৃষ্টি হচ্ছে। সৃষ্টি হচ্ছে আস্থাহীনতা।
শিক্ষণ-শিখন কার্যক্রমের মধ্যে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রতি পারস্পরিক বিশ্বাস অপরিহার্য। কিন্তু শিক্ষকের প্রতি বিরূপ মনোভাবের কারণ অনেক শিক্ষার্থীরাই ক্লাসের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে। ফলে অনেক শিক্ষার্থীই ক্লাসে অনিয়মিত হচ্ছে। তাই শিক্ষকের প্রতি আস্থাহীনতাও শিক্ষার্থীদের নিয়মিত ক্লাসে আসতে না চাওয়ার আরেকটি কারণ।
শিক্ষকদের বিষয় জ্ঞান ও শিক্ষণ দক্ষতার অভাব
শিক্ষকের দক্ষতাকে মূলত মোটাদাগে দুভাগে ভাগ করা হয়। একটি হলো বিষয়জ্ঞান (Subject Knowledge) এবং অপরটি হলো শিক্ষাবিজ্ঞান-সংক্রান্ত জ্ঞান (Pedagogical Knowledge)। সহজ কথায় বললে শিক্ষক যে বিষয়ে পড়াবেন সে বিষয় সম্পর্কে তার পর্যাপ্ত জানাশোনা থাকতে হবে। আর কীভাবে শিক্ষার্থীদের পড়াতে হয় সেটিও জানতে হবে।
আমাদের দেশের শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে অনেকটা ধারণা করে নেওয়া হয় যে, ভালো শিক্ষার্থী মানে অবশ্যই ভালো শিক্ষক। কিন্তু ভালো জানাশোনা এবং শিক্ষকতার দক্ষতা যে এক নয়, সেটি আমরা অনেকেই বুঝতে চাই না। তাই অনেকক্ষেত্রই আমাদের শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া ব্যক্তির যথাযথ বিষয়জ্ঞান ও শিক্ষণের দক্ষতা অনুযায়ী শিক্ষক নিয়োগ করতে পারে না।
আবার দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, স্বেচ্ছাচারিতা এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে অনেক সময়ই অযোগ্য শিক্ষক শিক্ষাঙ্গনে প্রবেশ করে। ফলে শিক্ষকের পড়ানোর দক্ষতা ও পেশাদারিত্বের অভাব শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি করে। ক্লাসের প্রতি সৃষ্টি করে অনীহা।
অনেকক্ষেত্রে দেখা যায়, শিক্ষকের পাঠদান প্রক্রিয়া শিক্ষার্থীকে আকৃষ্ট করতে পারে না। তাই অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষকের বিষয়জ্ঞান ও শিক্ষণ দক্ষতার অভাব শিক্ষার্থীদের ক্লাসে আসতে অনীহা তৈরি করে। শিক্ষার্থীরা ক্লাসে আসতে চায় না। শিক্ষার্থীদের নিয়মিত ক্লাসে না আসার পেছনের অন্যতম প্রধান কারণ এটি।
শিক্ষার্থীদের উদাসীনতা
শিক্ষার্থীদের নিয়মিত ক্লাসে না আসার পেছনের অন্যতম কারণ শিক্ষার্থীদের উদাসীনতা। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থীদের দেখা যায় যাদের আসলে নির্দিষ্ট কোন লক্ষ্য উদ্দেশ্য নেই। যার ফলে অনেকেই বাছ-বিচার ছাড়াই আড্ডায় সময় নষ্ট করে।
শিক্ষার্থীদের উদাসীনতার ক্ষেত্রে বা নির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য উদ্দেশ্য না থাকার ক্ষেত্রে গাইডেন্সের অভাব পরিলক্ষিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অহরহ এমন শিক্ষার্থীদেরও পাওয়া যায় যারা একাডেমিক পড়াশোনা, চাকরির পড়াশোনা, খেলাধুলা, ফ্রিল্যান্সিং কিংবা উল্লেখযোগ্য কোনো কর্মকাণ্ডে স্বক্রিয় অংশগ্রহণ নেই। লক্ষ্য উদ্দেশ্যহীন এমন অধিকাংশ শিক্ষার্থীরাই ক্লাসে আসার ক্ষেত্রে অনীহা বোধ করে।
সেক্ষেত্রে ক্যারিয়ার বিষয়ক কাউন্সিলিং এবং গাইডেন্সের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য নির্ধারণ এবং পড়াশোনার প্রতি উৎসাহ সৃষ্টি করতে শিক্ষকদেরও নৈতিক দায়বদ্ধতা রয়েছে। তবে বিভাগের সিনিয়রদেরও একটা বড় ভূমিকা থাকে শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে কাউন্সিলিং ও গাইড করতে।
বিশ্বের অনেক দেশেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পরেই একজন মেন্টর নির্ধারণ করে দেওয়া হয় যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের তাদের গন্তব্য থেকে বিচ্যুত না হয়ে পড়ে। কিন্তু আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী অকালে ঝরে যাবার পেছনে দায়ী থাকেন অসাধু সিনিয়ররা। রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে কিংবা অপকর্মে জড়িয়ে অনেক শিক্ষার্থীই একাডেমিক পড়াশোনায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।
ফলে শিক্ষার্থীরা ক্লাসে আসার প্রয়োজন অনুভব করে না বা ক্লাস করতে চায় না। কেবল অসৎসঙ্গের পাল্লায় পড়ে কত মেধাবী শিক্ষার্থীরা বিপথে যাচ্ছে এর সঠিক কোন পরিসংখ্যান নেই, কিন্তু এই সংখ্যাটা নেহাতই ছোট নয়!
শিক্ষার্থীদের সচেতনতা ও আত্মমর্যাদাবোধ
স্কুল, কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বড় একটা পার্থক্য হলো, এখানে কোন শিক্ষার্থীকেই বাবা-মা হাত ধরে স্কুলে নিয়ে আসেন না। হাত ধরার বিষয়টি অনেকটা রূপক অর্থে হলেও মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা প্রকৃত অর্থে স্বাধীন হতে থাকে। এ পর্যায়ে এসে তার কাজগুলো, তার সিদ্ধান্তগুলো বাবা-মা বা অন্য কেউ নিয়ে দেয় না বরং নিজেকেই নিতে হয়।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে কিংবা মেসে থাকায় বাড়ি থেকে দূরে থাকে। ফলে শিক্ষার্থীর কোন কাজ-কর্মের প্রতিই অন্যদের বিশেষ কোনো হস্তক্ষেপ থাকে না। শিক্ষার্থীদের এখানে ক্লাসে আসতে হয় আত্মসচেতন হিসেবে। এখানে আর আদেশ কিংবা নির্দেশ দিয়ে শিক্ষার্থীদের ক্লাসে আনার সুযোগ নেই।
ফলে শিক্ষার্থী যদি নিজের ক্লাসের বিষয়ে নিজে থেকে সচেতন না হয় তাহলে বাইরে থেকে কোনোভাবেই তাকে ক্লাসে আনা সম্ভব নয়। একদিকে শিক্ষার্থীরা নির্ধারিত সময়ে ক্লাস করতে চায় না, অন্যদিকে তাদের মধ্যে নির্ধারিত সময়ের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করার প্রবণতাও তৈরি হচ্ছে।
বিশেষ করে ক্লাস টেস্টের মতো কোর্স চলাকালীন গাঠনিক মূল্যায়নের অংশগুলোতে শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ নির্ধারিত সময়ের পরিবর্তে দীর্ঘসূত্রতাকেই বেশি পছন্দ করে। এগুলো শিক্ষার্থীদের আত্মমর্যাদার অভাবে ঘটে থাকে। তাই শিক্ষার্থীদের আত্মমর্যাদা এবং আত্মসচেতনতার অভাব শিক্ষার্থীদের ক্লাসে না আসার পেছনের অন্যতম একটি কারণ।
শিক্ষকের জবাবদিহিতা
শিক্ষকের স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম কিংবা অপেশাদার আচরণের পেছনে বড় কারণ হলো জবাবদিহিতার অভাব। অনেক শিক্ষকের সম্বন্ধে সময়সূচি অনুযায়ী ক্লাস পরীক্ষা না নেওয়ার যে অভিযোগ ওঠে, সেটিও ঘটে মূলত জবাবদিহিতার অভাবেই।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর পরিবর্তে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর। আবার অনেকসময় পত্রপত্রিকায় দেখা যায় শিক্ষা ছুটি না নিয়েও দীর্ঘদিন শিক্ষাঙ্গনে আসেন না বিভিন্ন শিক্ষক।
শিক্ষাছুটির অপব্যবহার কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি ছাড়াই শিক্ষাছুটিতে বিদেশে সময় কাটানোর অভিযোগ আছে অসংখ্য শিক্ষকের সাথে। একজন শিক্ষকের দায়িত্ব হলো তার জন্য নির্ধারিত ক্লাস পরীক্ষা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ করা এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যে উত্তরপত্র মূল্যায়ন করা।
যখন নির্ধারিত সময়সূচির ব্যত্যয় ঘটে তখন শিক্ষার্থীদের মধ্যে সৃষ্টি হয় হতাশা, নষ্ট হয় শিক্ষার্থীদের মূল্যবান সময়। শিক্ষার্থীরা ক্লাসে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। সঠিক জবাবদিহিতার মাধ্যমে শিক্ষকের নিজের ওপর আরোপিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন নিশ্চিত করা গেলে তা শিক্ষার্থীদের একাডেমিক কার্যক্রমে আগ্রহী হয়ে উঠতে সহায়তা করবে। শিক্ষার্থীরা যে ক্লাস করতে চায় না, তার পেছনে এগুলোকেও কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
শিক্ষকের ক্লাস মূল্যায়নের সুযোগ থাকা যেতে পারে
দেশের স্বনামধন্য কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে শিক্ষকদের মূল্যায়নের পদ্ধতি চালু হয়েছে। এটি শিক্ষকের আত্মউন্নয়নের একটি হাতিয়ার হিসেবেও কাজ করে। শিক্ষক তাঁর মধ্যে গুণগত পরিবর্তন সৃষ্টির সুযোগ পান।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও হাতেগোনা দু’একজন শিক্ষক কোনো কোর্স পড়ানোর শেষে শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে মূল্যায়নের সুযোগ সৃষ্টি করছেন। উন্নত বিশ্বের অনেক জায়গাতেই শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের ফলাফল খারাপ এলে কৈফিয়ত এমনকি চাকরিও চলে যাবার মতো ঘটনা ঘটে। সেক্ষেত্রে শিক্ষক ক্রমশ নিজের গুণগত পরিবর্তন সৃষ্টিতে কাজ করেন যে ধরনের পদক্ষেপ বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে দেখা যায় না বললেই চলে।
শিক্ষার্থীরা কেন ক্লাসে আসে না বা ক্লাস করতে চায় না এসব প্রশ্নের সঠিক জবাব হয়তো তখনই মিলতো যদি শিক্ষকদের পড়ানোর মূল্যায়নের সুযোগ সৃষ্টি হতো। তবে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা কিংবা ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত দন্দ্বের কারণে শিক্ষকের বিরুদ্ধে সঠিক মন্তব্যের সুযোগ নাও সৃষ্টি হতে পারে। তবে সঠিকভাবে মূল্যায়নের সুযোগ সৃষ্টি হলে শিক্ষার্থীদের ক্লাসের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হতে পারে।
দায়টা শুধু শিক্ষক কিংবা শিক্ষার্থীর নয়
শিক্ষার্থীরা কেন ক্লাস করতে চায় না? এ প্রশ্নের জবাবে ঢালাওভাবে শিক্ষক কিংবা শিক্ষার্থীর দিকে আঙুল তোলার সুযোগ নেই। শিক্ষার্থীরা কেন ক্লাসের আসে না এ বিষয়ে শিক্ষকেরও যেমন ভূমিকা আছে, তেমনি উচ্চশিক্ষা পর্যায়ের শিক্ষার্থীদেরও ভূমিকা আছে। আবার নিয়মিত ক্লাস মনিটরিং, সমস্যা চিহ্নিতকরণ, সমস্যার সমাধান করাসহ শিক্ষার্থীদের ক্লাসের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনেরও দায় এড়ানোর সুযোগ নেই।
আবার এর সাথে দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অবস্থাও জড়িত। তাই শিক্ষার্থীরা কেন ক্লাসে আসে না, সেটার জন্য মূলত দায়ী কে? এভাবে কাউকে দায়ী করার সুযোগ নেই। বরং অনেকগুলো প্রেক্ষাপটের সম্মিলন শিক্ষার্থীদের ক্লাসের প্রতি অনাগ্রহী করে তুলেছে।
প্রয়োজন ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস
শিক্ষার্থীরা ক্লাস করতে চায় না এটা ঠিক, কিন্তু এর সমাধান কী? শিক্ষার্থীদের ক্লাসের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে প্রয়োজন ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস। যেখানে শিক্ষক, শিক্ষা প্রশাসন এবং শিক্ষার্থী সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে হবে। শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরানোর জন্য শিক্ষকদের আধুনিক ও যুগোপযোগী প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে আনন্দময় পাঠদান করতে হবে।
কর্মজীবন এবং একাডেমিক পড়াশোনার মধ্যে সঙ্গতি সৃষ্টি করতে হবে। সর্বক্ষেত্রে জবাবদিহিতার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। শিক্ষার্থীর কাউন্সিলিং এবং গাইডেন্সের মাধ্যমে ক্লাসে আসতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে এবং শিক্ষার্থীদের প্রকৃত মেধার মূল্যায়ন করতে হবে। সামষ্টিক লিখিত মূল্যায়নের পরিবর্তে গঠনমূলক কাজের মাধ্যমে মূল্যায়নের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। সর্বোপরি ক্লাসের বিষয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির সৃষ্টি করতে হবে।
লেখক পরিচিতি
শামস আল গালিব রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী। তিনি নিয়মিত শিক্ষার নানা প্রসঙ্গ নিয়ে লেখালেখি করেন।