টিনের একটি বিজ্ঞাপনে গ্রামের এক প্রবীণ বিদ্যালয়ের শিক্ষক মহোদয়কে জিজ্ঞেস করছে, “মাস্টার, কোন টিন দিয়া বাড়ি বানাবো কও দেখি”! প্রকৃতপক্ষে, টিনের বেশ কয়েকটি বিজ্ঞাপনেই পণ্যের গুণগত মান একজন শিক্ষককে দিয়ে বয়ান করানো হয়েছে।

এটি কিন্তু আজকের সমাজের চিত্র না, দিন পাল্টেছে। এখন শিক্ষককে কেউ পাত্তা দেয় না। বেশিদিন আগের কথা নয়, আমার বিদ্যালয় জীবনের কথাই বলি। আমার শিক্ষকদের অনেকেরই ‘রাগী’ বা ‘কড়া’ একটি ইমেজ ছিলো। তাঁরা বিদ্যালয়ের পড়া না পারলে প্রচণ্ড মারতেন। ফলে মারের ভয়ে হলেও অনেকে পড়া শিখে আসতো। তবে অতি শাসনের উল্টোপিঠ হলো অতি আদর! অতি আদর বা ভালোবাসা দিয়েও মানুষকে শাসন করা যায়। আদর- ভালোবাসা হারানোর ভয় বড়ো সাংঘাতিক জিনিস।

কিন্তু যে-কথাটি আমরা বুঝিনি সেটি হলো, পেটানোর শাসন থেকে আদরের শাসন অনেক কঠিন কাজ। আমরা আসলেই এটি বুঝিনি বা একে গুরুত্ব দিইনি। আমাদের সরকারগুলো এই ট্রানজিশনটি শুধু প্রজ্ঞাপন দিয়ে করতে চেয়েছে; কিন্তু এটি করতে হতো ভালোমানের শিক্ষক নিয়োগের মাধ্যমে।

উন্নত বিশ্ব অনেক আগেই বুঝেছে যে, কোমলমতি শিশুদের পিটিয়ে শাসনের চেয়ে আদরের শাসন জরুরি। আমরা এটি দেরিতে হলেও উপলব্ধি করতে পেরেছি এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এ-বিষয়ে প্রজ্ঞাপন পর্যন্ত জারি করেছে। কিন্তু যে-কথাটি আমরা বুঝিনি সেটি হলো, পেটানোর শাসন থেকে আদরের শাসন অনেক কঠিন কাজ। আমরা আসলেই এটি বুঝিনি বা একে গুরুত্ব দিইনি। আমাদের সরকারগুলো এই ট্রানজিশনটি শুধু প্রজ্ঞাপন দিয়ে করতে চেয়েছে; কিন্তু এটি করতে হতো ভালোমানের শিক্ষক নিয়োগের মাধ্যমে।

আমি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেও দেখেছি যে-শিক্ষক ভালো পড়াতে পারতেন না, তিনি তার অপারগতাকে ঢাকতেন রাগ দিয়ে যেটি হলো প্রিমিটিভ ব্যবস্থা। প্রশ্ন করলে তাঁরা প্রচণ্ড রেগে যেতেন কারণ তাঁরা সর্বদা তটস্থ থাকতেন যে, তাঁরা কী জানেন বা কতো কম জানেন সেটি যদি শিক্ষার্থীদের সামনে প্রকাশ হয়ে যায়। তাই আদর দিয়ে শাসন করতে পারার মতো শিক্ষক নিয়োগ না দিয়ে যারা কেবল রাগ আর মেজাজ দিয়ে শাসন করতে জানেন, তাদেরকেই নির্দেশ দেয়া হলো আদর দিয়ে শাসন করতে। অর্থাৎ সমস্যার ভেতরে না ঢুকে সমস্যাকে প্রলেপ দেওয়ার চেষ্টা করা হলো।

আমাদের সময়কার শিক্ষকদের কথা বলি। আমার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দু’জন শিক্ষকের কথা, তাঁদের চেহারা আজও মনে আছে; কিন্তু ভিন্ন দুটো কারণে। একজন আমাকে প্রচণ্ড আদর করতেন। সত্যি বলতে কি, তিনি সবাইকেই আদর করতেন, কিন্তু তখন আমি শুধু আমাকে আদর করাটাই দেখতাম। আর অন্যজন আমাকে দেখতে পারতেন না। এই দেখতে না পারার কারণ আমি ছিলাম না। কারণটি অবশ্য পরে বুঝেছি। সেটি হচ্ছে তিনি আমার বাবাকে পছন্দ করতেন না। আমার পড়াশুনার প্রতি ভালোবাসার গোড়াপত্তন করেন ওই শিক্ষক যিনি আমাকে প্রচণ্ড আদর করতেন।

বিদ্যালয়ে আদর করতেন এমন শিক্ষক যেমন পেয়েছি, তেমনি প্রচণ্ড অপছন্দ করতেন সেইরকম শিক্ষককেও পেয়েছি। একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, তাঁদের অনেকে প্রচণ্ড ব্যক্তিত্ববান ছিলেন। যেমন, আমার বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে কোনদিন বাজার করা বা চায়ের দোকানে বসা বা অন্য কোথাও আড্ডা দিতে দেখিনি। সাধারণের সাথে খুব কম মিশতেন, দেওয়ানি আদালতের বিচারকদের মতো। ব্রিটিশদের একটি নিয়ম ছিলো যে, তারা বিচারকদের এমন সুযোগ-সুবিধা দিতেন যাতে তাদের বাজারে কিংবা অযথা রাস্তায় যেতে না হয়। আমার বাড়ির কাছেই দেওয়ানি আদালত থাকা সত্ত্বেও বিচারককে আমরা কখনো আদালতের বাহিরে দেখতাম না। আমাদের প্রধান শিক্ষক তাঁর আচরণের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের মাঝে একটি ভয়ংকর রাগী ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষের চিত্র অঙ্কন করতে পেরেছিলেন। আর আমরা তো কখনও বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির নাম শুনিনি। এই ম্যানেজিং কমিটি সৃষ্টি যখন থেকে, তখন থেকে নির্বাচন ঢুকলো, আর পচনও শুরু হলো তখন থেকেই।

আজকের বিদ্যালয় বা কলেজে এই মাখন লাল স্যারদের বড় অভাব। পৃথিবীর সর্বত্রই ভালো শিক্ষকের বড় অভাব।

সম্প্রতি বেশ কয়েকবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এমেরিটাস অধ্যাপক অরুণ কুমার বসাক স্যারের একটি ভিডিও সাক্ষাৎকার শুনছিলাম। তিনি বলছিলেন— তিনি এডওয়ার্ড কলেজে ২৬তম হয়েছিলেন। কিন্তু ওই কলেজে মাখন লাল নামে একজন বড় মানের শিক্ষক ছিলেন যাঁর আদর-ভালোবাসা আমাদের বসাক স্যার পেয়েছিলেন। সেই আদর-ভালোবাসাই তাঁকে আজকের এমেরিটাস অধ্যাপক অরুণ কুমার বসাক বানিয়েছে। এই মাখন লাল চক্রবর্তীই আজকের অধ্যাপক অরুণ কুমার বসাকের মধ্যে আলো জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন এবং নিশ্চই আরও অনেকের মাঝে এরকম আলো সেই সময় জাগিয়েছিলেন। সেই অরুণ কুমার বসাক স্যারও অনেক বছর যাবৎ অনেকের মাঝে আলো জ্বালিয়েছেন। এটিই হলো একজন ভালো শিক্ষক নিয়োগের সুফল। এ থেকে বুঝতে হবে আমাদের আজকের বিদ্যালয়-কলেজের সমস্যা কোথায়। শিক্ষক মাখন লাল ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে প্রথম শ্রেণি পাওয়া। আজকের বিদ্যালয় বা কলেজে এই মাখন লাল স্যারদের বড় অভাব। পৃথিবীর সর্বত্রই ভালো শিক্ষকের বড় অভাব।

মনে রাখা দরকার, একজন মানুষ বহু মানুষ তৈরি করতে পারেন। আবার শিক্ষকের নামে অশিক্ষক নিয়োগ দিলে তদ্রূপভাবে একজন খারাপ হাজার খারাপ বানাবে। একে বলে ক্যাসকেডিং ইফেক্ট।

বসাক স্যারের চরিত্রের একটি দিক হলো, কারো কোনো দিক পছন্দ না হলে সরাসরি কিছু বলতেন না। কিন্তু কোনো না কোনো পথ তিনি বের করতেন এবং ধরিয়ে দিতেন যে— ওটা ঠিক নয়।

যা হোক, ফিরে আসি অরুণ কুমার বসাক স্যারের কথায়। আমার সৌভাগ্য হয়েছিলো স্যারকে কাছ থেকে দেখার। আমি তখন সদ্য ইতালি থেকে কনডেন্সড ম্যাটার ফিজিক্সে ডিপ্লোমা করে দেশে ফিরেছি। এসেই দেখি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (SUST) প্রভাষক পদে বিজ্ঞপ্তি। যখন SUST-এ যোগ দিই, অধ্যাপক অরুণ কুমার বসাক স্যার ছিলেন পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান। দেখেছি একজন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক। সকাল ৭.৩০ থেকে ৮.০০-এর মধ্যেই তিনি বিভাগে এসে পড়তেন আর ন্যূনতম সন্ধ্যা বা বেশ রাতে বাসায় ফিরতেন। সকালে এসে নিজেই নিজের অফিস ঝাড়ু দিতেন। তখন SUST-এর যাত্রা মাত্র শুরু। তাঁকে রাজশাহী থেকে আনাই হয়েছিলো বিভাগটিকে গড়ার জন্য। বসাক স্যারের গুণের কথা বলে শেষ করা যাবে না। অনেক দিক থেকে তিনি অনন্য। হাঁটা, চলা, বাচনভঙ্গি, ব্যবহার সবকিছুতেই স্বকীয়তা; কারো সাথে মেলে না।

বসাক স্যারের চরিত্রের একটি দিক হলো, কারো কোনো দিক পছন্দ না হলে সরাসরি কিছু বলতেন না। কিন্তু কোনো না কোনো পথ তিনি বের করতেন এবং ধরিয়ে দিতেন যে— ওটা ঠিক নয়। যেমন, ওখানে শিক্ষকদের জন্য কমোডওয়ালা আলাদা একটি টয়লেট ছিল। প্রায়ই দেখা যেতো কমোডে যার ওপর সবাই বসে, সেখানে জুতার ছাপ। বিষয়টি নিয়ে আমরা দুয়েকজন স্যারের সঙ্গে কথা বলেছি কারণ এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং বিপদজনকও বটে। স্যার বিষয়টি নিয়ে আমাদের দুয়েকজনের সাথে মজা করতেন, কিন্তু শিক্ষক বলে কথা! কারও দিকে অঙ্গুলি প্রদর্শন করা যাবে না। কাউকে এ-বিষয়ে উপদেশও দেওয়া যাবে না, কারণ তাতে তিনি অফেন্ডেড ফিল করতে পারেন। শিক্ষক হলে আবার এই ফিলিংসটা টনটনে হয়ে যায়। তাই তিনি ঠিক করলেন শিক্ষার্থীদের ল্যাবে এ-বিষয়ে বলবেন, কারণ ল্যাবে শিক্ষকরাও থাকেন। অরুণ কুমার বসাক স্যারের বক্তব্যের বিষয় ছিলো: How to use bathroom commode! এ-বিষয়ে বোর্ডে ছবি এঁকে বিশাল এক বক্তৃতা দিলেন। এরপর থেকে টয়লেটের কমোডে আর পায়ের ছাপ দেখিনি।

অরুণ কুমার বসাক স্যারের বক্তব্যের বিষয় ছিলো: How to use bathroom commode! এ-বিষয়ে বোর্ডে ছবি এঁকে বিশাল এক বক্তৃতা দিলেন। এরপর থেকে টয়লেটের কমোডে আর পায়ের ছাপ দেখিনি।

তাঁর ক্লাস যারা করেছেন, তারা জানেন কী ইউনিক ব্যক্তিত্ব! কী ইউনিক শিক্ষক! তাঁর সাথে অন্য কোনো শিক্ষকের লেকচারের স্টাইলের তুলনা চলে না। তাঁর মতো শিক্ষক ও গাইডেন্সের কারণে ওখানকার পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের একটি সুনাম হয়েছিল। তার প্রমাণ হচ্ছে, বর্তমান প্রজন্মের দু’তিনজন সেরা পদার্থবিদের নাম নিলে আমাদের তখনকার শিক্ষার্থী মাসুদুল হকের নাম অবশ্যই আসবে। সত্যি বলতে কি ‘strongly correlated system’ নিয়ে কাজ করা বাংলাদেশী পদার্থবিদদের মধ্যে নিঃসন্দেহে সেরা।

অরুণ কুমার বসাক স্যার অবসরে গিয়েছেন অনেক দিন। ফিরে গেছেন নিজ বিশ্ববিদ্যালয় রাজশাহীতে; কিন্তু কাজ থেকে অবসর নেননি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগও তাঁকে মূল্যায়ন করতে কার্পণ্য করেনি। তাঁকে প্রফেসর এমেরিটাস বানিয়ে সম্মানে রেখে দিয়েছেন। শুনেছি এখনও তিনি পুরোনো অভ্যাস বজায় রেখে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বিভাগেই থাকেন।

আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ আছে। আমাদেরও অনেক বাঘা বাঘা স্কলার ছিলেন এবং এখনো আছেন। আজ পর্যন্ত আমরা কাউকে সম্মান দিয়ে প্রফেসর এমিরেটাস বানাতে পারিনি। ওই ভিডিওতে বসাক স্যারের মুখেই শুনেছি যে, পদার্থবিজ্ঞানে তিনিই একমাত্র এমেরিটাস অধ্যাপক। এতে প্রমাণিত হয়, আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক্ষেত্রে দলীয় সংকীর্ণতার উর্ধ্বে উঠতে পারিনি। আমি নিজে দেখেছি, যখনই এ-বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে, তখনই শিক্ষকরা দুটি ভাগে বিভক্ত হয়েছেন। শুরু হয়ে যায় নানা নোংরা তর্ক। অথচ একজন ভালো শিক্ষককে এমন সম্মান না দেওয়া মানে হলো তাঁকে বঞ্চিত করা। এদিক থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে ধন্যবাদ দিতেই হয়। এটিই প্রমাণ করে ওখানে ভালো মানুষ এবং ভালো শিক্ষক আছে।

অরুণ কুমার বসাক স্যার অবসরে গিয়েছেন অনেক দিন। ফিরে গেছেন নিজ বিশ্ববিদ্যালয় রাজশাহীতে; কিন্তু কাজ থেকে অবসর নেননি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগও তাঁকে মূল্যায়ন করতে কার্পণ্য করেনি। তাঁকে প্রফেসর এমেরিটাস বানিয়ে সম্মানে রেখে দিয়েছেন।

আমি আমার ক্লাসে বা ল্যাব ক্লাসে শিক্ষার্থীদের সবসময় বলি যে, পড়া শেষে তারা যেন ফিরে তাকায় এবং নিজেকে প্রশ্ন করে— কী শিখলাম? পদার্থবিজ্ঞানের প্রতিটি শব্দের একটি মেন্টাল পিকচার আছে। পড়তে হবে এমনভাবে, শিখতে হবে এমনভাবে যেন ফিরে তাকালে শব্দগুলোর মেন্টাল ইমেজ দিয়ে একটি মুভি হয়। ভিডিওতে দেখলাম অধ্যাপক মাখন লাল চক্রবর্তী ঠিক এমন কথাই স্যারকে বলেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে তার চেয়ে সুন্দর কথা বলেছিলেন। অধ্যাপক মাখন লাল চক্রবর্তী বলেছিলেন, “দিন শেষে আমরা যেন কোনো একটি নীরব জায়গায় যেমন নদীর ধারে কিংবা পার্কে যাই এবং দিনভর যা শিখলাম সেগুলো যেন ফিরে দেখি”!

এজন্যই পৃথিবীর সকল ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো পরিবেশটাই পার্কের মতো। যেমন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়। ওখানে আবার নদীও আছে। কী সুন্দর দৃশ্য ও প্রশান্ত পরিবেশ তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। শুনেছি, ভারতের ব্যাঙ্গালোরে অবস্থিত Indian Institute of Science-এর পরিবেশও এইরকম মনোরম। ভাবুন তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা? আজ থেকে ৩০ বছর আগেও এতো খারাপ ছিলো না। দিন যতো যাচ্ছে, এটি একটি ইটের বস্তির মতো হয়ে যাচ্ছে। যেখানে ইচ্ছে উঁচু ভবন বানাচ্ছে। যে যখন ইচ্ছে উচ্চস্বরে গান বাজিয়ে নেচে-গেয়ে বেড়াচ্ছে।

বসাক স্যারের ওই ছোট সাক্ষাৎকারের ভিডিওটি থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে, বোঝার আছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কেমন শিক্ষক নিয়োগ দেই? অনেক বিদ্যালয় আছে যেখানকার অনেক শিক্ষক এসএসসি পাশ। অধিকাংশ এইচএসসি পাশ এবং কেউ কেউ ডিগ্রি কিংবা মাস্টার্স পাশও হয়তো আছে। এই যে এসএসসি পাশ কিংবা এইচএসসি পাশধারীদের শিক্ষক বানাচ্ছি, এটি কি আজকের দিনের প্রেক্ষাপটে ঠিক? আমরা কি মাখন লাল চক্রবর্তী স্যারদেরকে বিদ্যালয়ে আনতে পারছি?

আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের আবাসিক শিক্ষক ছিলাম, তখন দেখেছি হলের তৃতীয় শ্রেণির চাকুরির জন্য অনার্স-মাস্টার্স পাশ করা প্রার্থীর ছড়াছড়ি। আজকের দিনের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শুধু এসএসসি বা এইচএসসি পাশ শিক্ষার্থীরা শিক্ষকতার কতোটুকু জানে বা কতোটুকু সংবেদনশীল? শুধু তাই নয়, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক তারাই হতে চায়, যারা অন্য সব জায়গায় ব্যর্থ হয়ে তারপর আসে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে। একই কথা প্রযোজ্য মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের ক্ষেত্রেও। এবং একই কথা বলা যায় কলেজের ক্ষেত্রেও। মোটাদাগে বিসিএসে প্রশাসন, পুলিশ, কাস্টমস ইত্যাদি ক্যাডার না পেলে আসে শিক্ষা ক্যাডারে। তাহলে এই ব্যর্থ মানুষগুলোকে শিক্ষক বানালে তারা কীভাবে সফলতার গল্প শুনাবে? সফল মানুষ বানাবে?

শিক্ষকতা মানে ৯-৫টা চাকুরি নয়, ক্লাসের বাইরেও শিক্ষকদের অনেক কাজ থাকে। আর এসব কাজ ভালোভাবে করতে হলে চিন্তামুক্ত জীবন চাই। শিক্ষকদের এমন বেতন দিতে হবে যাতে তারা সসম্মানে জীবনযাপন করতে পারে।

আমাদের উচিত শিক্ষায় জিডিপির ৪%-এর চেয়েও বেশি বাজেট বরাদ্দ দেওয়া। আমাদের উচিত ভালো বেতন দিয়ে, ভালো সম্মান দিয়ে, ভালো সুশিক্ষিত শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া। এমন বেতন দিতে হবে যাতে তারা নিজ বিদ্যালয়ে পাঠদান ছাড়া অন্য কোথাও বাড়তি উপার্জনের জন্য পড়াবে না। শিক্ষকতা মানে ৯-৫টা চাকুরি নয়, ক্লাসের বাইরেও শিক্ষকদের অনেক কাজ থাকে। আর এসব কাজ ভালোভাবে করতে হলে চিন্তামুক্ত জীবন চাই। শিক্ষকদের এমন বেতন দিতে হবে যাতে তারা সসম্মানে জীবনযাপন করতে পারে।

পাশাপাশি দরকার বিদ্যালয় থেকে সকল প্রকার রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ জরুরিভিত্তিতে বন্ধ করা। বিদ্যালয় ম্যানেজমেন্টের নামে শিক্ষকদের ওপর খবরদারি করা হলে তা শিক্ষকদের আত্মসম্মানে আঘাত পায়। এতে শিক্ষার পরিবেশ বিঘ্নিত হয়। ভালো ও শিক্ষিত শিক্ষক নিয়োগ দিলে তাঁরা আদরের শাসন যথাযথভাবে করতে পারবেন। নিশ্চিত করা যাবে শিক্ষার পরিবেশও।

Sending
User Review
0 (0 votes)

লেখক সম্পর্কে

কামরুল হাসান মামুন

কামরুল হাসান মামুন

ড. কামরুল হাসান মামুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত রয়েছে।

মন্তব্য লিখুন