বাড়ি পরীক্ষা ও মূল্যায়ন ব্যবস্থা

জিপিএ-৫ এবং আমাদের শিক্ষার্থীদের মানসিক অবস্থা

জিপিএ-৫ পেয়ে শিক্ষার্থীদের উল্লাস; ছবি: ঢাকা ট্রিবিউন
জিপিএ-৫ পেয়ে শিক্ষার্থীদের উল্লাস; ছবি: ঢাকা ট্রিবিউন

ফজিলাতুন নেসা লিখেছেন জিপিএ-৫ এবং আমাদের শিক্ষার্থীদের মানসিক অবস্থা প্রসঙ্গে

২০২০ সালে যেসব শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পাওনি, তাদের অনেক অনেক অভিনন্দন জানিয়ে কিছু বিষয় অবতারণা করতে চাই। জিপিএ-৫ না পাওয়া কোনো অপরাধ হতে পারে না, কারণ জিপিএ-৫ যোগ্যতা নির্ধারণের কোনো মাপকাঠি হতে পারে না।

শৈশব হলো শিশুর নিজের দক্ষতা ও যোগ্যতা দেখিয়ে নিজেকে প্রমাণ করার সময়। শৈশব শিশু নিজেকে যতো বেশি মেলে ধরতে পারবে, পরবর্তীকালে অর্থাৎ বড় হয়ে তার চলার পথ ততো বেশি সুগম হবে। সকল শিশুকিশোরের রয়েছে শিক্ষার সমানাধিকার।

এসব কথা অবশ্য আমাদের দেশে এখন ফাঁকা বুলি। শৈশব থেকেই আমাদের দেশের শিশুরা হচ্ছে নগ্ন বৈষম্যের স্বীকার। ফলাফলভিত্তিক এই শিক্ষাব্যবস্থায় ভালো ফলাফল করতে না পারলেই ভালো বনাম খারাপের মধ্যে টেনে দেওয়া হচ্ছে বৈষম্যের এক লম্বা রেখা। আর তারই সূত্র ধরে প্রতি বছর আমাদের দেশে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে।

যখন অসংখ্য ছেলে-মেয়ে প্রতিবছর পিএসসি, জেএসসি, এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ ফলাফল নিয়ে পাশ করছে, তখন তাদের পাশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অভিভাবক, রাষ্ট্রসহ সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষ দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। ধরেই নেয়া হচ্ছে, এরা সকলের গর্ব। আর যে-সব শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ নিয়ে পাশ করতে পারছে না, তারা পিছিয়ে পড়ছে ইঁদুর দৌড়ে। সেসব শিশু-কিশোরদের ভালো ফলাফল করতে না পারা মানেই তাদেরকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্র-সমাজ এবং অভিভাবকসহ সবাই এক ধরনের বোঝা ভাবছে। তাদের ব্যাপারে সামাজিক, প্রতিষ্ঠানিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েই নেওয়া হচ্ছে যে, এসব ছেলেমেয়েরা বাবা-মা কিংবা সমাজের গর্ব নয়। যেহেতু এরা মেধাহীন তাই এরা সায়েন্স পাবার যোগ্য নয়, ভালো কলেজে চান্স পাবার যোগ্য নয়, ইত্যাদি ইত্যাদি।

পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের প্রতি এই যে সামাজিক এবং প্রতিষ্ঠানিক সব আচরণ, এর ফলে তারা কোন ধরনের সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, আমরা কি কেউ কখনো ভেবে দেখেছি? আমরা কি তাদের চেষ্টা বা ভালো কাজ করার প্রচেষ্টাগুলোকে মূল্যায়ন করছি? কীসের ভিত্তিতে আমরা মেধার পরিমাপ করছি?

মনে রাখতে হবে, জিপিএ-৫ শুধু প্রতিযোগিতায় টিকতে সাহায্য করে; কিন্তু ভালো মানুষ হওয়ার জন্য খুব একটা সাহায্য করে না। শুধু জিপিএ-৫ বা পরীক্ষার ভালো ফলাফলের পেছনে ছোটা মানেই হলো অসুস্থ প্রতিযোগিতা। এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা কীভাবে শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক ও সুস্থ বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে অন্তরায় হচ্ছে, তার ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করছি। এই ভয়ানক বৈষম্যে শিক্ষার্থীরা ব্যক্তিগত, শারীরিক, মানসিক, শিক্ষার ক্ষেত্রে এবং সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

ব্যক্তিগত, শারীরিক ও মানসিক যে ক্ষতিগুলো হচ্ছে সেটি হলো, ছেলে-মেয়েদের আত্মবিশ্বাস কমে যাচ্ছে। কমে যাচ্ছে কাজ করার এবং নিজেকে যোগ্য করে তোলার আত্মতৃপ্তি। ভর করছে বিষণ্নতা এবং হতাশা। আশংকাজনকভাবে উদ্বিগ্নতা বাড়ছে। পাশাপাশি যখন এসব ছেলে-মেয়েরা ভাবছে তারা ততোটা ভালো নয়, তাদের দ্বারা কিছু হবে না, সেই বোধ থেকে তারা নিজেদের সব কিছু থেকে সরিয়ে নিচ্ছে। বাড়ছে অপরাধপ্রবণতা এবং ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ। এসব পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের প্রতি শিক্ষকদের নেতিবাচক আচরণও মারাত্মক প্রভাব ফেলে। পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের প্রতি শিক্ষকের নেতিবাচক আচরণ এমন হীনমন্যতার দিকে ঠেলে দেয় ও পরশ্রীকাতর  করে তোলে যার ফলে দক্ষ মানব সম্পদ হয়ে গড়ে ওঠার প্রক্রিয়াটা অংকুরেই বিনষ্ট হয়।

সকলেরই মনে রাখা প্রয়োজন, জিপিএ-৫ শুধু শিক্ষার্থীদের সার্টিফিকেট পাবার প্রতিযোগিতায় টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করে কিন্তু আত্মবিশ্বাসী এবং নৈতিক মানুষ হতে সাহায্য করে না।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে এবং সমাজের অন্যান্য মাধ্যম থেকে পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের প্রতি নেতিবাচক মনোভাবের ফলাফল হলো, এসব ছেলে-মেয়েরা কোনোদিক থেকেই নিজেদের সামাজিকভাবে যোগ্য প্রতিযোগী মনে করছে না। মনে মনে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। সমাজের অন্যদের বা সামাজিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি কোনো শ্রদ্ধা বা মমত্ববোধ তৈরি হচ্ছে না। তাই আমাদের এখন অসুস্থ মানসিকতার মানুষের চেয়ে মানসিকভাবে সক্ষম মানবিক মানুষ বড্ড বেশি প্রয়োজন।

সাসটেইনেবল ডেভলপমেন্ট গোল-এ বলা হচ্ছে, no health without mental health and no sustainable development without mental health। কাজেই আজকের পড়াশোনার বিষয়টি শিশু-কিশোরদের জন্য কঠিন প্রতিযোগিতার হওয়ার কারণে এই ব্যবস্থা হয়ে উঠছে শিশু-কিশোরদের মানসিক ও মনোসামাজিক বিকাশের অন্তরায়। অথচ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অভিভাবকসহ সকলেই হন্যে হয়ে ছুটছেন জিপিএ-৫ এর পেছনে। প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা বা জেএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়া ছাড়া যেন শিক্ষার্থীদের আর কোনো কাজ নেই। পড়াশোনা মানেই তাদের কাঁধে চাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে ভয়ানক এক বোঝা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বলছে, জিপিএ-৫ না পেলে সায়েন্স পাবে না, ভালো কলেজে পড়তে পারবে না। বাবা-মা বলছেন, তোমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। যেন এসব ছেলে-মেয়ে অচ্ছ্যুত এবং ব্রাত্যজন।

পড়াশোনার পাশাপাশি শিশু-কিশোরদের দায়িত্ববান হিসেবে গড়ে তোলা প্রয়োজন। ওদের চাপ-সহনীয় করে গড়ে তোলা দরকার। ওদের মধ্যে আশাবাদের বীজ বুনে দেয়া দরকার। দরকার ইতিবাচক শক্তি ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ জাগরণের। সমাজ, পারিপার্শ্বিকতা এবং জীবনের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনতে শেখানোটা জরুরি।

শ্রেণীকক্ষের একদল ভালো শিক্ষার্থীদের নিয়ে যখন শিক্ষকরা ভীষণ ব্যস্ত। ঠিক তখনই আরেক দল শিশু- কিশোররা ভাবতে শিখছে, তাদের দিয়ে ভালো কিছু হবে না। কেন এই বৈষম্য তৈরি করা হচ্ছে জানা নেই।

জিপিএ-৫ পেয়ে ‘ভি’ চিহ্ন দিয়ে পোজ দিয়ে ছবি তোলার নেতিবাচক সংষ্কৃতিতে যাবতীয় শিক্ষা প্রকাশিত হয় না। শিক্ষা প্রকাশিত হয় বিনয়ে, ধীরতায়, অনাড়ম্বরতায়। এটি আমরা শিশুদের শেখাতে পারছি না।

ছাত্র-ছাত্রীদের কাজ হচ্ছে পড়ালেখা করা, এটি তাদের কর্তব্য। কেউ তার কর্তব্য পালন করলে কি এরকম ঘটা করে ধন্যবাদ জানাতে হয়! মায়ের দায়িত্ব যদি ধন্যবাদহীন হয়, শিক্ষকের দায়িত্ব যদি ধন্যবাদহীন হয়, তাহলে শিক্ষার্থীরা পড়ে খুব ভালো ফলাফল করলেই সেটি কেন দুনিয়াবাসীকে ঢালাও করে জানান দিতে হবে? অবশ্যই আমরা ভালো কাজের মূল্যায়ন করবো বা স্বীকৃতি দেবো; কিন্তু তার মধ্যে কেন এত উগ্রতা বা বৈষম্য থাকতে হবে? নিজেদের মধ্যে কি এটি উদযাপন করা যায় না? কেন পত্রিকার পাতা ভরে ফেলতে হবে ভি চিহ্নের স্বল্পসংখ্যক শিক্ষার্থী দিয়ে? কেন ফেইসবুক সয়লাব করতে হবে, ফুলের মালা গলায় পরিয়ে, সন্তানকে দিয়ে কেক কাটিয়ে? কেন প্রধানমন্ত্রী বা শিক্ষামন্ত্রীকে গিয়ে ফুলের মালা দিতে হবে?

বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে কি শুধু যারা প্রথম শ্রেণি পেয়েছেন শুধু তাদেরই সংবর্ধিত করা হয়? নাকি যারা স্নাতক সম্পন্ন করেন তাদেরও সবার সমান সুযোগ থাকে অংশগ্রহণের? যদি এসএসসি বা এইচএসসি শিক্ষার যোগ্যতা অর্জনের পাশের এক-একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হয়, তাহলে যারা খুব ভালো করেছে এবং যারা ভালো করতে পারছে না, তাদের সবাইকেই সমান উৎসাহ ও গুরুত্ব দেয়া উচিৎ। পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর যে মচ্ছব শুরু হয়, সেটি একটি অসুস্থ সংষ্কৃতি। এর ফলে যেটি দাঁড়াচ্ছে, বড় সংখ্যক কচিকাঁচা ছেলে-মেয়েরা নিজেদের অপরাধী ভাবছে। ভাঙ্গা হৃদয় নিয়ে তারা যন্ত্রণাময় জীবন-যাপন করছে।

যেদিন শিক্ষার্থীদের ফলাফল প্রকাশিত হয়, তাদের অভিভাবকরা সেদিন লজ্জায় ফোন বন্ধ রাখেন। ছেলে-মেয়েরা হাপুস নয়নে কাঁদতে বসে গেছে। কেউ বাবা-মায়ের দিকে তাকাতে পারছে না। আত্মীয়-স্বজনদের হাসি আর অনুকম্পার জবাব দিতে পারছে না। মাত্রাতিরিক্ত তারিফ করা অথবা বলা যেতে পারে অযথাযথ তারিফ করা কোনোটাই সঙ্গতও নয়। এর ফল হচ্ছে ভয়াবহ। জিপিএ-৫ বা গোল্ডেনধারীরা ভাবছে, জীবনটা এমনই। তারা আর হারবে না। যখন বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা বা উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণের ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত জায়গায় সুযোগ পাচ্ছে না, তখন অনেক গোল্ডেনধারী শিক্ষার্থী খাদের কিনারে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। কারণ তারা কোনো পরাজয় মেনে নিতে শেখেনি বা শিখছে না। বাবা- মা তখন হাজার চেষ্টা করেও আর তুলে আনতে পারছেন না।

ভাবুন তো, আপনার দুটো সন্তানের মধ্যে একজন গোল্ডেন পেলো তাকে নিয়ে আনন্দ করবেন এবং আরেকজন ৪.২০ পেলো, তাকে কি লুকিয়ে রাখবেন? এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা এখুনি বন্ধ হওয়া উচিৎ।

কোন মন্তব্য নেই

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Exit mobile version